তোমায়_পাবো_বলে,পর্ব_২১
নিশাত_জাহান_নিশি
পাখির কিচির মিচির শব্দ বহু পূর্ব থেকেই আমার কর্নকুহরে উচ্চ আওয়াজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে৷ আন্দাজ করতে পারছি প্রভাত ঘনিয়ে এসেছে। তন্মধ্যেই সমস্ত মুখমন্ডলে কারো উষ্ণ হাতের বিচরন অনুভব করতেই আমি তাৎক্ষণিক ঘুম ভেঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম! ভয়াল দৃষ্টিতে অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হাত দুখানা মুখে চেঁপে ধরে আমি চিৎকার করে বললাম,,
“আপনিনিনিনি? আআপনি এএএই রুমে কি করছেন?”
সঙ্গে সঙ্গেই বিকি ছেলেটা মুখমন্ডলে অস্থিরতা নিয়ে আমার থেকে প্রায় এক ফুট দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুখমন্ডলে হাত চেঁপে এখন ও আমি অত্যধিক ভয়ে অবিরত গুঙ্গিয়ে উঠছি। প্রতিটা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছেলেটাকে অবলোকন করছি। আমার চেয়ে দ্বিগুন ভয়ে ছেলেটা কুঁকিয়ে উঠছে। বিষয়টা খুবই অদ্ভুত ঠেকছে আমার। তাৎক্ষণিক ছেলেটা বাঁ হাত দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখমন্ডল মুছে কম্পিত গলায় আমায় বললেন,,
“সস্যরি। পপপরশকে এএএই বিষয়ে কিছু বলো না!”
ফটাফট মুখমন্ডল থেকে হাত দু খানা সরিয়ে আমি তেজর্শী গলায় ছেলেটাকে শুধিয়ে বললাম,,
“পরশ কোথায়? বলুন আমার পরশ কোথায়?”
ইতোমধ্যেই যেনো মনে হলো রুমের দরজা ঠেলে কেউ দ্রুত বেগে রুমে প্রবেশ করলো। দরজার দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দৃষ্টির সীমানায় পরশের অস্তিত্ব দেখা গেলো। কলিজায় পানি এলো আমার। বুকে হাত রেখে আমি স্বস্তির শ্বাস নির্গত করতে প্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মনে চেঁপে বসা সাংঘাতিক ভয়টা ও যেনো মুহূর্তের মধ্যে উবে গেলো। হাতে পাউরুটির প্যাকেট এবং মিনারেল ওয়াটার নিয়ে পরশ আমার দিকে তাজ্জব দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। ভয়ার্ত অবস্থায় আমাকে দেখা মাএই পরশ আশপাশ না তাকিয়ে পেরেশান গ্রস্থ হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,,
“কি হয়েছে টয়া? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? ভয় পেয়েছ?”
শুকনো মুখের আদলে আমি হাজারো আতঙ্ক নিয়ে বিকির দিকে আঙ্গুল তাক করে ইশারায় পরশকে বললাম,,
“ওদিকে তাকান!”
পরশ আমার ইশারা বুঝে অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বিকি যেনো মুহূর্তের মধ্যেই শুকনো ঢোক গিলে জোরপূর্বক হাসি টেনে নিলেন ঠোঁট জোড়ায়। অতঃপর ধীর পায়ে হেঁটে পরশের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,,
“তোদের দেখতে এসেছিলাম পরশ! কি করছিস তোরা। এসে দেখি তুই নেই!”
ঝাঁঝালো গলায় আমি এক নিশ্বাসে বিকির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,
“মিথ্যে বলছেন আপনি। আপনি মোটে ও আমাদের দেখতে আসেন নি। আপনি এসেছিলেন সুযোগ বুঝে আমার সাথে নোংরামো করতে!”
পরশ বোধ হয় মুহূর্তের মধ্যেই চটে গেলেন। মুখমন্ডলে রক্ত জবার লাল বর্ণটা সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে। অত্যধিক রাগে ফুসফুস করে পরশ আচমকা বিকির শার্টের কলার চেঁপে ধরে বললেন,,
“কি বলছে টয়া এসব? তুই আমার উডবি ওয়াইফের সাথে?”
বিকি নিজেকে বাঁচানোর জন্য দিব্যি মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বললেন,,
“বিশ্বাস কর পরশ। তুই যা ভাবছিস তা না। আমি আসলে তোদের দেখতে এসেছিলাম। কিছু প্রয়োজন কিনা জানতে এসেছিলাম।”
অশ্রুসজল গলায় আমি পরশকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,
“ছেলেটা মিথ্যে বলছে পরশ। আমার মুখ মন্ডলে ছেলেটা বাজে স্পর্শ করেছিলেন। ভাগ্যিস আমি তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙ্গে লাফিয়ে উঠেছিলাম। নয়তো আজ ছেলেটা আমার…
ঢুকড়ে কেঁদে উঠলাম আমি। হুট করে পরশ ছেলেটার নাক বরাবর শক্ত এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন। ছেলেটার নাক বেয়ে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়তেই পরশ পুনরায় সেই ব্যাথা যুক্ত জায়গাটায় আর ও এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন। ছেলেটা কোনো আর্তনাদ ব্যতীতই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন। নাক চেঁপে ধরে ছেলেটা চুপটি করে শুয়ে আছে ফ্লোরে। পাল্টা প্রতিবাদ, আক্রমনাত্নক ভাব বা কোনো রূপ আক্রোশতা ছেলেটার মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রচন্ড অবাক হয়ে আমি বসা থেকে উঠে পরশের ডান হাতটা চেঁপে ধরে ভয়ার্ত গলায় পরশকে শুধিয়ে বললাম,,
“ছেলেটা কোনো আর্তনাদ করলেন না কেনো? এভাবে শুয়ে আছেন কেনো ছেলেটা?”
হাত দু খানা ঝেড়ে পরশ দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,
“শালা ড্রাগ এডিকটেড! বিবেক বুদ্ধি, চেতনা, অনুভূতি কিছু আছে নাকি তার মধ্যে?”
পরশ তাড়াহুড়ো করে ফ্লোরে পড়ে থাকা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে আমার হাত ধরে দৌঁড়ে রুম থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন আর বলছেন,,
“এই বাড়িতে থাকাটা আপাতত সেইফ না। আমাদের এক্ষনি, এই মুহূর্তে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে!”
“সিলেট আপনার কোনো রিলেটিভস আছে?”
“হুম। আব্বুর দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই আছেন ওখানে। মামা নিশ্চয়ই আমাদের ফিরিয়ে দিবেন না!”
“আপনার মামা যদি খবরটা লিক করে দেন?”
“দিবেন না। মামা আমার বন্ধুর মতই। আমাদের যথেষ্ট আগলে রাখবেন!”
“কিন্তু আমার তো এখনই কিছু খেতে হবে পরশ। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে আমার!”
“ধ্যাত খাবারটা ও নষ্ট হয়ে গেলো!”
বাড়ির মেইন গেইটের পার্শ্বে পার্ক করে রাখা বাইকটার সামনে এসে পরশ এবার দৌঁড় ঝাপ থামালেন। হাঁফিয়ে উঠা কন্ঠে পিছু ফিরে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,
“সামনেই একটা হোটেল আছে। ওখানে আমরা ব্রেকফাস্ট করেই তবে রওনা হব। বাইকে উঠে পড় জলদি!”
পরশ বাইকে চেঁপে বসতেই আমি ও তাড়াহুড়ো বাইকে উঠে বসলাম। হেলম্যাটটা পরশ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,
“হেলম্যাটটা আগে পড়!”
হেলম্যাটটা পড়ে আমি পরশের কাঁধে হাত রাখতেই পরশ হাই স্পীডে বাইকটা ছেড়ে দিলেন। ভয়ে, ক্ষুধায় থরথরিয়ে হাত-পা কাঁপছে আমার। ঐ নেশাখোর বিকি যদি আমাদের কোনো ভাবে ফলো করেন তখন কি হবে? পরশ পারবেন তো একা সবদিক সামলাতে। না জানি ঐ দিকে আবার দুই পরিবারের লোকজন কতোটা তল্লাশিতে আছেন আমাদের! যদি কোনো ভাবে আমরা ধরা পড়ে যাই? তখন কি হবে? শেষ পর্যন্ত আমাদের মিলন হবে তো? বিয়েটা হবে তো আমাদের? এসব ভাবতে ভাবতেই আমি পরশের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে ক্লান্তিতে আঁখিদ্বয় বুজে নিতেই পরশ আমায় ডেকে বললেন,,
“জড়িয়ে ধরো আমায়। এইভাবে কাঁধে হাত রেখে পিঠে মাথা ঠেঁকানোটা রিস্কি।”
ম্লান হেসে আমি পরশকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে পিঠে মাথা গুজে পুনরায় আঁখিদ্বয় বুজে নিলাম। ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটে নি আমার। তাই অল্পতেই আঁখিদ্বয় ক্লান্ত হয়ে উঠছে। কিছু মুহূর্তের মধ্যেই মনে হলো যেনো চলমান বাইকটা হঠাৎ থেমে গেছে। আর তক্ষনি পরশ অতি আদুরে গলায় আমার নাম ধরে ডেকে বললেন,,
“টয়া উঠো। ব্রেকফাস্ট করবে না?”
আঁখি জোড়া খুলে আমি হম্বিতম্বি হয়ে পরশকে ছেড়ে বাইক থেকে নেমে পড়লাম। পরশ ও চট জলদি বাইক থেকে নেমে বাইকটা এক সাইডে পার্ক করে ঐ সময়ের আনা পানির বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,
“চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে নাও। ঘুমের রেশ কেটে যাবে।”
পানির বোতলটা হাতে নিয়ে আমি মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে পানির বোতলটা পরশের দিকে এগিয়ে দিলাম। বোতলটা হাতে নিয়ে পরশ প্যান্টের পকেট থেকে টিস্যুর প্যাকেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,
“মুখটা মুছে নাও!”
মুখ মুছতে মুছতে পরশ আমায় নিয়ে বড় একটা হোটেলে প্রবেশ করলেন। ডিম, পরোটা অর্ডার করে পরশ আমায় নিয়ে হোটেলের ঠিক মধ্যখানের টেবিলটায় বসলেন। আমার পাশ ঘেঁষে বসে পরশ খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামনের চুল গুলো টেনে বললেন,,
“আই থিংক হিমেশকে একবার কল করা প্রয়োজন।”
“আমার ও তাই মনে হচ্ছে।”
“ওয়েট। ফোনটা সুইচ অন করে নেই।”
প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে পরশ ফোনটা সুইচ অন করে হিমেশের নাম্বারে ডায়াল করতেই তাৎক্ষণিক হিমেশ কলটা রিসিভ করে নিলেন। পরশ ফোনটা লাউডে দিতেই শুনতে পেলাম হিমেশ অতি উত্তেজিত গলায় বলছেন,,
“এই কই তুই? বিয়েটা হয়ে গেছে তো?”
“না ইয়ার। আমরা এখন ও কুমিল্লার আশেপাশেই আছি। এখন ও সিলেট যাওয়া হয় নি। আগে বল ঐ খানের কি পরিস্থিতি?”
“দুই পরিবারই ক্ষেপে আছেন। তোদের দুজনকে সামনে পেলেই একদম কেটে রেখে দিবে। তাই বলছি, যত দ্রুত সম্ভব বিয়েটা করে নে। পুলিশ তোদের খুঁজে বের করার পূর্বেই!”
“মানে কি? পুলিশ এলো কোত্থেকে?”
“টয়ার বাবা থানায় ডায়রি করেছেন তোর বিরুদ্ধে।”
“হোয়াট রাবিশ! ভাগ্য গুনে একটা হিটলার শ্বশুড় পেয়েছি। সব ক্ষেএেই এই লোকের বাড়াবাড়ি। উনার মেয়ে এখন ১৮+. স্ব-ইচ্ছায় টয়া আমার সাথে পালিয়েছে। তো এখানে পুলিশ কি করবে?”
“তোদের খুঁজে বের করবে ব্যাস এটুকুই। বড় কোনো অনর্থ হওয়ার পূর্বেই বিয়েটা করে নে। তাড়াতাড়ি সিলেটে পালা ভাই।”
“দুই পরিবারের কেউই যেনো সিলেটের খবরটা জানতে না পারে। প্লিজ একটু খেয়াল রাখিস।”
“এই নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। এখন মোস্ট ইম্পর্টেন্ট বিয়েটা করা ওকে?”
“ওকে। রাখছি তাহলে। বিয়ে শাদির পর কল করছি!”
“ওকে। আর শুন? সিমটা আর অন করিস না। নাম্বার ট্রেকিং এ রাখলে আবার মহা ঝামেলা!”
“ওকে বায়!”
পরশ কলটা কেটে ব্যতিব্যস্ত গলায় আমায় বললেন,,
“দু, এক ঘন্টার মধ্যেই আমাদের কুমিল্লা ছাড়তে হবে। তোমার হিটলার বাপ পুলিশ লাগিয়েছেন আমাদের পেছনে!”
মাথা নুঁইয়ে আমি রাগী গলায় বললাম,,
“শুনেছি। এক কথা বার বার বলতে হবে না।”
“বাবাকে নিয়ে কিছু বললেই গাঁয়ে খুব জ্বালা ধরে না? কই যখন তোমার বাবা তোমার পুরো পরিবারের সামনে আমার গাঁয়ে হাত তুললেন, বকলেন তখন তো তোমার বিন্দু পরিমান ও গাঁয়ে লাগে নি। সামান্য প্রতিবাদটুকু ও করো নি!”
“সেই তো। আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না। তাই তো কোনো প্রতিবাদ করি নি। পেয়ে গেছেন উত্তর?”
পরশ দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,
“হুম পেয়ে গেছি। জানি তো আমি সব ভালোবাসা শুধু পরিবারকে নিয়ে। বাবাকে নিয়ে, মা কে করে নিয়ে। আমার বেলায় সব গোল্লা! কানা কঁড়ি ও মিলে না!
“এই শুনুন? আমি আপনার সাথে এখানে ঝগড়া করতে আসি নি। ক্ষিদে পেয়েছে আমার। খেতে হবে এক্ষনি!”
পরশ রাগে গজগজ করে হোটেল বয়দের ডেকে বললেন তাড়াতাড়ি খাবার দিতে। আর একটু বিলম্ব হলেই সোজা হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবেন। আমার উপর জমা সমস্ত রাগ যেনো লোকটা হোটেল বয়দের উপর ঝাড়ছেন! পাশ ফিরে আমার দিকে তাকাচ্ছেন না পর্যন্ত। মুখ ফুলিয়ে আমি চুপটি করে বসে আছি লোকটার পাশে থেকে একটু খানি দূরে। সব দোষ যেনো আমার। লোকটার কোনো দোষই নেই। বোধ হয় বের হওয়ার সময় আমি বাবাকে বলে এসেছিলাম পুলিশ হায়ার করতে আমাদের পিছনে! কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল বয় খাবার নিয়ে এলেন। দুজনই মনমরা হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল থেকে বেরিয়ে সোজা বাইকে উঠে বসলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর পরশ পেট্রোল পাম্প থেকে বাইকে পেট্রোল ফুল করে নিলেন। পাশাপাশি ফুটপাত থেকে একটা মাস্ক কিনে মুখটা ঢেকে নিলেন। ভুলক্রমে ও যেনো রাস্তা ঘাটে পরিবার, আত্নীয়-স্বজন বা পুলিশরা ছটিয়ে ছিটিয়ে থাকলে আমাদের চিনতে না পারেন তাই।
,
,
দীর্ঘ ২২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পর আমরা সিলেট পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছি। এই মুহূর্তে আমরা সিলেটের মৌলভীবাজারে অবস্থান করছি। পরশের মামা আমাদের রিসিভ করতে আসছেন বড় বাজারের দিকে। আমার তুলনায় পরশ খুব বেশি ক্লান্ত। সারাটা পথ বাইক চেঁপে আসার দরুন মানুষটার শরীর একদম নেতিয়ে পড়েছে। মুখটা শুকিয়ে একদম একটু হয়ে আছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সতেজ ঠোঁট জোড়া জীর্ন শীর্ণ হয়ে আছে। এক জায়গায় দাঁড়াতে পারছেন না পর্যন্ত। মনে হচ্ছে যেনো হেলে দুলে পড়ছেন। এক্ষনি, এই মুহূর্তে লোকটার বিশ্রামের প্রয়োজন। বাইকের পাশে আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটা সামনের টং দোকানটায় গেছেন পানি আনতে। এক বোতল পানি এনে লোকটা ক্লান্ত মুখমন্ডলে ভালো ভাবে ছিটিয়ে নিলেন পানিটা। অতঃপর অর্ধ পানির বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,
“চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে নাও! ভালো লাগবে।”
বোতলটা হাতে নিয়ে আমি চোখে, মুখে পানি ছিটাতেই দেখলাম লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে আস্ত একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন! প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট হাতে নিয়ে মুখে গুজতেই আমি খপ করে সিগারেটটা লোকটার মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে তেজী গলায় বললাম,,
“এসব ছাই পাশ খেতে হবে না আপনার। আর কখন ও যেনো এসব খেতে না দেখি!”
পরশ বিরক্তি ভরা গলায় বললেন,,
“উফফ ক্লান্ত লাগছে আমার। সিগারেটটা দাও তো!”
“ক্লান্ত লাগলে বাইকে উঠে বসুন। আমার জানা মতে, সিগারেট খেলে অন্তত ক্লান্তি দূর হয় না।”
“হয়। তুমি বুঝবে না। সিগারেটটা দাও!”
“দিবো না বলছি তো? শুনতে পারছেন না আপনি?”
“ওকে ফাইন। দিতে হবে না।”
এক রোঁখা ভাব নিয়ে পরশ প্যান্টের পকেট থেকে আর ও একটা সিগারেট বের করে মুখে গুজতেই পেছন থেকে কেউ পুরুষালী গলায় বললেন,,
“পরশ?”
তাড়াহুড়ো করে পরশ মুখ থেকে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ভদ্র ছেলের মতো পিছু ঘুড়ে বললেন,,
“আরেহ্ মামু!”
মাঝবয়সী ভদ্র লোকটা তৎক্ষনাৎ পরশকে ঝাপটে ধরে মৃদ্যু হেসে বললেন,,
“কেমন আছিস পরশ?”
“ভালো আছি মামু। তুমি কেমন আছে?”
“তোকে দেখার পর খুব বেশি ভালো আছি!”
দুজনই কৌশল বিনিময় করে একে অপরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তাৎক্ষণিক আমি মাথা নুঁইয়ে নিলাম। পরশ লজ্জা মাখা স্বরে মাথা নুঁইয়ে মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“মামু টয়া। যার কথা তোমাকে বলেছিলাম!”
মাথা উঁচিয়ে আমি মামাকে সালাম দিয়ে লজ্জাসূচক হাসি টানতেই মামা মৃদ্যু হেসে আমায় শুধিয়ে বললেন,,
“এই তবে টয়া? যার জন্য আমার একমাএ ভাগ্নে বাড়ি ছেড়েছে?”
প্রসঙ্গ পাল্টে আমি মাথা নুঁইয়ে বললাম,,
“কেমন আছেন মামা?”
“ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”
মাথা দুলিয়ে ভালো আছি জানাতেই মামা ব্যতিব্যস্ত গলায় পরশ এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“আচ্ছা এখন আমরা বাড়ি যাই। বিয়ের পর ও একসাথে বসে অনেক কথা বলা যাবে!”
পরশ অনেকটা অবাক হয়ে মামার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,
“সিরিয়াসলি মামু? তোমরা সব রেডি করে রেখেছ?”
মামু উচ্চ আওয়াজে হেসে পরশের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,
“সব রেডি। কাজী হতে শুরু করে রেজিস্ট্রি অফিসার। এবার শুধু মিয়া, বিবির কবুল বলার অপেক্ষা!”
পরশ মৃদ্যু হেসে আমার দিকে তাকালেন। বিনিময়ে আমি ও মৃদ্যু হেসে পরশের দিকে তাকাতেই দুজনের দৃষ্টি একই রেখায় মিলে গেলো। লজ্জায় দুজনই দৃষ্টি নুঁইয়ে নিলাম!
,
,
রাত প্রায় ১০ টা বাজছে ঘড়িতে। বিছানার এক কোণায় লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আমি নব বধূর ভেসে বসে আছি। বুক ভর্তি ধুকপুকানি সমেত প্রচন্ড জড়তায় ভুগছি আপাতত। এই তো কিছুক্ষণ পূর্বে তিন কবুল এবং রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিয়েটা সম্পন্ন হলো আমাদের। আজ এবং এই মুহূর্ত থেকে আমি পরশের অর্ধাঙ্গিনী। বিয়ের মতো এক পবিএ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি আমরা। সত্যিই তো এবার উপর ওয়ালা ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো শক্তি আমাদের আলাদা করতে পারবেন না৷ এমনকি আমার বাবা ও হাজার চেষ্টা করলে পারবেন না আমাদের আলাদা করতে। জীবন, মরনের জন্য পরশের সাথে আমার ভাগ্য জুড়ে গেছে!
গোলাপ ফুলে সজ্জিত বিছানাটায় সেই কখন থেকে আমি একলা একা বসে আছি। এখন ও অবধি পরশের সাথে কোনো দেখা নেই। এই লোক কখন কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে ঠিক ঠাওড় করতে পারি না আমি। এ বাড়িতে এসেছে ধরেই তিনি আমার দৃষ্টির বাইরে। শুধু বিয়ে পড়ানোর মুহূর্তটাতেই একটু পাশে পেয়েছিলাম লোকটাকে। এখন আবার কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো ঠিক বুঝতে পারছি না। লোকটা আমায় অপেক্ষা করাতে করাতে একদম মেরেই ফেলবে। সমস্ত রুম জুড়ে ক্যান্ডেল জ্বলছে। খোলা জানালা দিয়ে বয়ে আসা রাতের হিমেল বাতাসে ক্যান্ডেলের সলতে গুলো নিভু নিভু করছে। মনে হচ্ছে যেনো এক্ষনি, এই মুহূর্তে তারা নিভে যাবে। আলো বিলাতে ভুলে যাবে। আর তখনি বুঝি ভয়ে আমার দমটা বন্ধ হয়ে আসবে। লোকটা যে কেনো আসছে না কি জানি!
মন মরা হয়ে আমি শেষ পর্যন্ত অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। এমনিতেই খুব ক্লান্ত লাগছে তার উপর এই লোকটা আবার অযথা আমায় অপেক্ষা করাচ্ছেন। কারো জন্য এতো অপেক্ষা করতে পারব না আমি। ঠেঁকা পড়ে নি আমার! এই বাড়িতে আসার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্য ও বিছানায় গাঁ এলাতে পারি নি আমি। ক্ষনে ক্ষনে পরশের মামু, মামানী, মামাতো ভাই, মামাতো বোনরা কথা বলতে ছুটে আসছেন আমার কাছে। উনারা সবাই খুব মিশুক এবং বাচাল প্রকৃতির। সারাক্ষন বকবক করে আমার মাথা খেয়ে নিয়েছিলেন। প্রশ্নে প্রশ্নে প্রায় জর্জরিত করে তুলেছিলেন।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে আঁখি জোড়া বুজে নিলাম মুহূর্তের মধ্যেই। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ধরা দিলো চোখে। এভাবে কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ মুখমন্ডলে কারো তপ্ত শ্বাস অনুভব করতেই আমি তৎক্ষণাৎ আঁখিদ্বয় খুলে নিলাম। পরশ বেসামাল দৃষ্টিতে খানিক ঝুঁকে আমার মুখের আদলে চেয়ে আছেন। উনার নাক, মুখ থেকে নিঃসৃত তপ্ত প্রতিটা শ্বাস আমার মুখমন্ডলে উপছে পড়ছে। পরম আবেশে আমি আঁখিদ্বয় বুজে নিতেই পরশ আচমকা আমায় শক্ত হাতে ঝাপটে ধরে আদুরে স্বরে বললেন,,
“লাভ ইউ বউ!”
ঝট করে আমি লোকটাকে আমার থেকে প্রায় এক ফুট দূরত্বে ছিটকে ফেলে অভিমানী স্বরে বললাম,,
“কয়টা বাজছে ঘড়িতে?”
পরশ বোকা স্বরে বললেন,,
“১২ টা। কেনো?”
“তাহলে মোট কত ঘন্টা আমায় অপেক্ষা করিয়েছিলেন?”
“আমি ইচ্ছে করে ওয়েট করাই নি বউ। হিমেশের সাথে কথা বলছিলাম। দুই পরিবারের খবরাখবর নিচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছে না খুব বেশি দিন আমরা এই বাড়িতে টিকতে পারব বলে। বাবা ঠিক এই বাড়িতে এসে হানা দিবেন! আর শ্বশুড় মশাই তো আছেনই। এক্সট্রা প্যারা৷ ঠিক এই লোক পুলিশ নিয়ে এই বাড়িতে হাজির হবেন। তাছাড়া এখন সবার সন্দেহ হিমেশের দিকে। জানি না হিমেশ কতক্ষন মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবে।”
ভয়ে সিঁধিয়ে উঠে আমি শোয়া থেকে উঠে পরশের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,
“এবার কি হবে পরশ? আমার তো ভীষন ভয় করছে!”
মুহূর্তের মধ্যেই পরশ বিষন্ন ভাবভঙ্গি পাল্টে ঠোঁটের আলিজে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে হেচকা টানে আমাকে লোকটার বুকের সাথে মিশিয়ে বললেন,,
“কিচ্ছু হবে না। এখন আমরা বিবাহিত। দুই পরিবারের লোকজন হাজার চেষ্টা করে ও আমাদের আলাদা করতে পারবেন না। যদি আলাদা করতেই হয় তবে আমাদের লাশ দুটোকে আলাদা করতে হবে!”
চলবে…?