তোমায়_পাবো_বলে,পর্ব_২৪
নিশাত_জাহান_নিশি
“যা শুনার কাল সকালে শুনব। এখন প্লিজ আমায় বিরক্ত কর না।”
কি আশ্চর্য! লোকটা এত বেপরোয়া স্বভাবের কেন? মানে আমি কি বলতে চাইছি তা তো একটু শুনতে হবে। বুঝতে হবে কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পিয়ালী আপুর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন। না এই লোক তো এখন নিজের দেহের খোরাকে ব্যস্ত বিপরীত পাশের মানুষটার কথা ভাববার সময় আছে নাকি লোকটার? তা ও আমি অতি তৎপর হয়ে লোকটাকে এক ঝটকায় ঘাড় থেকে সরিয়ে বিরক্ত মিশ্রিত গলায় বললাম,,
“আমি একটা কথা বলতে চাইছি। শুনতে পারছেন না আপনি?”
লোকটা পূর্বের তুলনায় অধিক উত্তেজিত হয়ে আমার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে বললেন,,
“না। শুনতে পারছি না। বুঝতে পারছ না তুমি? তোমার বর এখন অধিক রোমাঞ্চে প্রলোভিত হয়ে আছে? সো চুপচাপ থেকে এখন আমায় সঙ্গ দাও! বিরক্ত করলেই রাতের ঘুম হারাতে হবে। অনিদ্রায় সারা রাত কাটাতে হবে!”
একদম হেড মাস্টার টাইপ কথা। চূড়ান্ত বদ, অসভ্য, বেহায়া এই লোকটার কথা মতই আমাকে লোকটার সঙ্গ দিতে হলো। অসম্ভব নাছোড়বান্দা এই লোক। নিজে যা বলবে ঠিক তাই করবে। আমার ভালো লাগা, খারাপ লাগার কোনো প্রাধান্যই নেই! তবে লোকটার অতি অত্যাচার পূর্ণ ভালোবাসায় আমি ও এখন সিক্ত প্রায়। এক অদ্ভুত সুন্দর এই অনুভূতি। না পারি দূরে ঠেলে দিতে পারি, না পারি স্ব-ইচ্ছায় বরণ করে নিতে। জান বের হয়ে যায় লোকটার এই পাগলামী পূর্ণ ভালোবাসায়। মরণ বুঝি অতি সন্নিকটে এই অনুভূতিটাই তখন বেশি প্রশ্রয় পায়!
,
,
ফজরের মিষ্টি আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসতেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল আমার। তবে আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গে নি আমার। ঘুম ভেঙ্গেছে দরজায় কড়া নড়ার শব্দে। বিক্ষিপ্ত ভাবে পরশের গাঁয়ের উপর হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি। সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন শরীরে। লোকটার যন্ত্রনায় বস্ত্র পরিধান করা সম্ভব হয় নি আমার! অর্ধ খোলা নেত্রযুগলে আমি দরজার দিকে নজর দিতেই দরজায় পুনরায় কড়া পড়ল। শ্বাশুড়ী মা দরজায় কড়া নাঁড়ছেন আর উচ্চ আওয়াজে বলছেন,,
“টয়া শুনছ? তাড়াতাড়ি উঠো।”
কপালের ভাঁজে উদ্বিগ্নতা ভর করতেই আমার আঁখিদ্বয় থেকে তন্দ্রা পরীরা ডানা ঝাপটে উড়াল দিল। ধরফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠতেই পরশের ভারী হাতটা আমার বুকের উপর ঠাঁয় পেল। বিরক্তি নিয়ে লোকটার হাতটা দ্রুত গতিতে সরিয়ে আমি ফ্লোর থেকে শাড়িটা উঠিয়ে গাঁয়ে পেঁচিয়ে নিতেই পরশ উবুড় হয়ে শোয়া অবস্থাতেই ঘুম জড়ানো গলায় বললেন,,
“এই? কোথায় যাচ্ছ?”
শাড়ির কুঁচি সামলে আমি অগোছালো গলায় বললাম,,
“মা ডাকছেন!”
পরশ নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি তড়িঘড়ি করে দৌঁড়ে রুমের দরজাটা খুলে দিতেই শ্বাশুড়ী মা দৃষ্টি নুঁইয়ে তটস্থ গলায় বললেন,,
“বাড়িতে নামাজ, কালাম করো নি? এতক্ষন অবধি কিসের ঘুম?”
মাথা নুঁইয়ে আমি নিম্ন আওয়াজে বললাম,,
“কাল থেকে আর ভুল হবে না মা।”
“কাল কেন? আজ থেকেই নামাজ ধর। নামাজের পর প্রতিটা রুম ঝাঁড়ু দিয়ে এরপর রান্নাঘরে আসবে। মনে থাকবে?”
“জ্বি মা। মনে থাকবে।”
“আর একটা কথা। মাথায় সবসময় ঘোমটা টেনে রাখবে। বাড়িতে কত মেহমান, অতিথি আসে। তাছাড়া তোমার শ্বশুড় বাবা ও বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই থাকে৷ তাই এই জিনিসটা একটু মাথায় রাখবে।”
“ঠিক আছে মা। মাথায় থাকবে।”
“আসছি আমি। ঠিক ৬ টায় রান্নাঘরে যাবে। সবার জন্য নাশতা তৈরী করবে।”
“যদি বলতেন ব্রেকফাস্টে কি কি করতে হবে?”
“চা, পরোটা, ওমলেট।”
“ঠিক আছে মা। আমি চেষ্টা করব।”
মা প্রস্থান নিলেন। রুমের দরজাটা আটকে আমি বিছানার এক পাশে দু হাতে ভর দিয়ে বসে পড়লাম। শরীরে প্রচন্ড ব্যাথার অনুভূতি হচ্ছে। মাথাটা খুব ঘুড়ছে এবং মস্তিষ্ক জুড়ে চিনচিনে ব্যাথার উৎপত্তি ও হচ্ছে। আর একটু ঘুমুলে হয়তো শরীরটা ভালো লাগত। রাতে হাতে গুনে ৩ ঘন্টা ঘুমিয়েছি কিনা সন্দেহ আছে। লোকটার জ্বালায় ইদানিং আমার ঘুম পূর্ণ হয় না। আর ঘুম পূর্ণ না হলেই আমার শরীর এমনিতে ও ঝিমঝিম করে। হাঁটা চলা, খাওয়া-দাওয়া এবং কাজে মন বসাতে পারি না। প্রচন্ড অলসতা কাজ করে। ইচ্ছে করছে আর একটু ঘুমিয়ে নিতে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম ৫ঃ১০ মিনিট বাজছে ঘড়িতে। শ্বাশুড়ী মায়ের নির্দেশ মতো ঠিক ৬ টায় রান্নাঘরে থাকতে হবে। গোসল, নামাজ, রুম ঝাঁড়ু দেওয়া সব মিলিয়ে ৫০ মিনিট সময় তো ব্যয় হবেই। তার মানে, ঘুমানো হলো না আর। এক্ষনি কাজে লেগে পড়তে হবে আমার।
ঢুলুঢুলু শরীরে আমি বসা থেকে উঠতেই পরশ পিছন থেকে পুনরায় আমায় ঘুম জড়ানো গলায় ডেকে বললেন,,
“কি হলো? আবার কোথায় যাচ্ছ?”
“শাওয়ার নিতে হবে। নামাজ পড়তে হবে।”
“আযান তো দিল মাত্র। আর একটু ঘুমিয়ে নাও।”
“না। নামাযের সময় চলে যাবে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
পরশ প্রত্যত্তুরে কিছু বললেন না। বেচারা নিজেই ঘুমে কাত। তা ও আমার যত্ন রাখার খাতিরে বার বার ঘুম থেকে জেগে উঠছেন। খবরা খবর নিচ্ছেন আমার। দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আমি শরীরের আড় মোড়া ভেঙ্গে শাওয়ারে চলে গেলাম। কিছু সময় পর শাওয়ার সেরে আমি নামায আদায় করে চুল থেকে টাওয়াল টা সরিয়ে যেই না ভেজা চুলে পরশের পাশে বসলাম অমনি পরশ হেচকা টানে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আঁখি যুগল বুজে লোকটা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বললেন,,
“নামায পড়া তো শেষ এবার। আর একটু ঘুমিয়ে নাও।”
আমি লোকটার বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে আনমনে বললাম,,
“সময় নেই। রুম ঝাঁড়ু দিতে হবে। রান্নাঘরে যেতে হবে।”
“তাড়া নেই কারোর। এই বাড়িতে সবাই ৭ টা ৮ টার পূর্বে সচরাচর ঘুম থেকে জাগে না। সো এক, দু ঘন্টা তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমুতেই পারো।”
“মা রেগে যাবেন না তো?”
“উঁহু। মা রাগ করবেন না। তুমি ঘুমাও!”
মৃদ্যু হেসে আমি লোকটাকে শক্ত হাতে ঝাপটে ধরে ঘুমের অতলে তলিয়ে পড়লাম। লোকটা কিছুক্ষন বাদে বাদে আমার মুখমন্ডলে নাক দ্বারা শুড়শুড়ি দিচ্ছেন, চুমু খেয়ে দিচ্ছেন, শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিচ্ছেন, বুকে মুখ গুজে দিচ্ছেন। ঘুমের মাঝে ও বেশ টের পাচ্ছি আমি। বড্ড অসভ্য এই লোক। সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
,
,
সকাল ৯ টা বেজে ১০ মিনিট বাজছে ঘড়িতে। এদিকে আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। পরশের শাওয়ারের ফাঁকে কোনো মতে ফ্রেশ হয়ে আমি প্রচন্ড ভয়, ভীতি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতেই দেখলাম শ্বাশুড়ী মা রান্নাঘরে পরোটা সেঁকছেন আর বিড়বিড় করে কিসব যেন বলছেন। ভয়ে অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল আমার। নিশ্চয় আমাকেই মা মনে মনে বকছেন! অনবরত শুকনো ঢোক গিলে আমি শ্বাশুড়ী মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,,
“সসস্যরি মা। আআআমি আসলে…
সম্পূর্ণ উক্তি শেষ করার বেগ পেলাম না পর্যন্ত। এর অতি পূর্বেই শ্বাশুড়ী মা আমার দিকে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“বিয়ের প্রথম সপ্তাহেই তোমার এই অবস্থা? বাকি দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ এই গুলোতে কি করবে তুমি?”
মাথা নুঁইয়ে আমি অপরাধী গলায় বললাম,,
“স্যরি মা। কাল থেকে আর এমন হবে না।”
“তুমি যদি ভেবে থাক রোজ আমি তোমাকে ঠিক এভাবেই ছাড় দিব, তাহলে তুমি ভুল ভাবছ টয়া! কিছুতেই তোমাকে ছাড় দেওয়া যাবে না। বউমা হিসেবে তোমাকে মেনে নিয়েছি এই অনেক। এর’চে অধিক কিছু আর কি এক্সপেক্ট করো তুমি আমার থেকে? শুধু মাএ ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নয়তো তোমার বাবার মতো আমি ও তোমায় বর্জন করে দিতাম! একমাত্র ছেলে আমার। নির্ঘাত ছেলের অন্যায় আবদার ফেলতে পারছিলাম না তাই!”
চোখের কানায় কানায় জল পরিপূর্ণ হতেই শ্বাশুড়ী মা রাগে গজগজ করে পরোটা এবং ওমলেট সমেত রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নিলেন। মাথা নুঁইয়ে আমি চোখের জল ছাড়তে ব্যস্ত। কতটা বিচিত্র মেয়েদের জীবন। বিয়ের পর সম্পূর্ণ বদল ঘটে মেয়েদের নিত্যদিনকার চলাচলে, কাজ কর্মে, অভ্যেসে। সামান্য ভুলের কারনে ও তাদের প্রতি পদে হেনস্তা হতে হয়, কটুক্তি শুনতে হয়, হৃদয়ে আঘাত ধরানোর মতো কুৎসার মুখোমুখি তে হয়, সুযোগ সুবিধা, ভালো মন্দ বিচার বিবেচনা না করেই তাদের একপাক্ষিক ভাবে বিবেচনা করা হয়। আর বিয়েটা যদি হয় পরিবারের অমতে। তাহলে তো কথাই নেই। সে জায়গায় তো আমি পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম উনার ছেলেকে। দোষটা উভয় পক্ষের থাকলে ও দোষটা সম্পূর্ণ এখন আমার কাঁধেই এসে বর্তাবে। এটাই আমাদের সমাজ। যেখানে মেয়ে হয়ে মেয়ে জাতির দোষটাই বড় করে দেখা হয়!
ঢুকড়ে কেঁদে উঠতেই পেছন থেকে শ্বাশুড়ী মা ঝাঁঝালো গলায় আমায় শুধিয়ে বললেন,,
“চা টা কি আমি করে আনব?”
তড়িঘড়ি করে আমি চোখের কোনে আবদ্ধ জলরাশি মুছে অতি স্বাভাবিক গলায় মা কে বললাম,,
“আমি করে আনছি মা। আপনি যান।”
চায়ের পাতিল গ্যাসে বসিয়ে আমি অতি মনযোগের সহিত চা টা বানিয়ে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ডাইনিং টেবিলে প্রায় সবাই ই আছে। তবে আমার শ্বশুড় আব্বু এবং পিয়ালী আপুকে দেখা যাচ্ছে না। পরশ ভেজা চুলে খুব মনযোগ দিয়ে পেপার পড়তে ব্যস্ত। গ্রীণ কালার টি শার্টে লোকটাকে বেশ মানিয়েছে। দৃষ্টি ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে। পাশেই পায়েল হাসি মুখে ফোনে স্ক্রলিং করছে। শ্বাশুড়ী মা সবার প্লেটে নাশতা সার্ভ করছেন। আমি চায়ের ফ্লাক্সটা টেবিলের উপর রেখে জিগ্যাসু স্বরে মা কে বললাম,,
“বাবা কোথায় মা?”
মা অতি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,,
“অফিসে। এই প্রথম মানুষটাকে ব্রেকফাস্ট না করেই অফিসে যেতে হলো!”
সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নুঁইয়ে নিলাম আমি। আমার একটু আরামের জন্যই বাবাকে আজ খালি মুখে অফিসে যেতে হলো। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। পাশ থেকে পরশ খবরের কাগজটা টেবিলের উপর রেখে প্রশ্নবিদ্ধ গলায় মা কে বললেন,,
“বাবা ব্রেকফাস্ট করে যায় নি অফিসে?”
“বাড়ির বউ যদি দিনের ৯ টা ১০ টা পর্যন্ত আরাম করে ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে বাড়ির বাকি সদস্যদের তো না খেয়েই কাজে কর্মে যেতে হবে তাই না?”
পরশ অতি সাবলীল গলায় প্রত্যত্তুরে বললেন,
“তুমি যদি টয়াকে মিন করে থাক। তাহলে বলব আমিই টয়াকে বলেছিলাম, একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে! আসলে, ওর শরীরটা খারাপ ছিল মা। দুদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল অনেকটা। তাছাড়া তুমি কোথায় ছিলে মা? অন্তত বাবাকে এক কাপ কফি বা চা করে দিতে! তাহলে খালি মুখে বাবাকে বের হতে হতো না!”
মা হেয় গলায় বললেন,,
“আমি না? রোজ তোকে দেখি আর অবাক হই! কি যাদু করেছে রে ঐ মেয়েটা তোকে? সবসময় দেখি ঐ মেয়েটার পক্ষ নিয়ে কথা বলিস! এক কালে তো আমি ও এই বাড়ির বউ ছিলাম। আমার ও শ্বাশুড়ী মা ছিলেন। বিয়ের পর দিন থেকেই শ্বাশুড়ী মায়ের কড়া নির্দেশে আমাকে চলতে হয়েছে। হাজার শরীর খারাপ, অসুস্থতা এবং ক্লান্তি নিয়ে ও আমি কাজ করেছি, পরিবারের প্রতিটা সদস্যের যত্ন নিয়েছি, খেয়াল রেখেছি। দুদিন পর পর বাড়ি ভর্তি মেহমানদের ঢল পড়ত। সব একা হাতে সামলেছি৷ তোর বাবা ও কখন ও আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা এবং সুযোগ, সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখেন নি। মা যা বলেছিলেন তাই! কখন ও মায়ের মুখের উপর দু কথা বলার সাহস দেখান নি। আর তুই এই দুই দিনের সংসারে বউয়ের পক্ষ ধরে কথা বলা শিখে গেছিস? বউয়ের হয়ে আমাকে বলছিস কাজ করতে? আমার ছেলের বউ আরাম করে শুয়ে থাকবে আর আমি কাজ করব? এই তোর নীতি? এই দিন দেখার জন্যই তোদের মেনে নিয়েছিলাম আমি?”
পরশ নির্বোধ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“এসব তুমি কি বলছ মা? কোথা থেকে কোথা চলে গেলে তুমি? আমি এত কিছু ভেবে চিন্তে কিন্তু কথা গুলো বলি নি। আমি জাস্ট বলতে চেয়েছিলাম তুমি যেহেতু জেগেই ছিলে, আর ফ্রি ও ছিলে বাবাকে সামান্য কফিটা করে দিতে পারতে। তাহলেই বাবাকে আর খালি মুখে বের হতে হতো না। তাছাড়া টয়া আজকের দিনটাই একটু ছাড় পেয়েছে নিতান্তই অসুস্থতার জন্য৷ কাল থেকে নিশ্চয়ই সে ঠিক সময়ে উঠে সবার ব্রেকফাস্ট তৈরী করবে। পরিবারের সবার ভালো-মন্দের খেয়াল রাখবে। টয়ার প্রতি সেই আস্থা আছে আমার। তুমি অযথা টয়া এবং আমাকে ভুল বুঝছ মা!”
“বলে দে তোর বউকে। কাল থেকে যেনো সকাল ঠিক সাড়ে ছয়টার মধ্যে রান্নাঘরে উপস্থিত থাকে। সবার নাশতার দিকটা খেয়াল রাখে। সাথে দুপুরের রান্না বান্নার দিকটাতে ও নজর রাখে। কাজের বুয়া এক সপ্তাহের জন্য ছুটিতে গেছে। অন্তত এই কয়েকটা দিন কাজের প্রতি একটু যত্নশীল হতে।”
“খেয়াল রাখবে মা। তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিও তাহলেই চলবে!”
“কেন বাপের বাড়ি থেকে শিখে পড়ে আসে নি কিছু? শুধু কি প্রেম ভালোবাসাই শিখে এসেছে? আর শিখেছে কিভাবে ছেলেদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে হয়?”
পরশ এবার রাগ সংযত করতে না পেরে খাবার চেয়ার ছেড়ে উঠে তেজী গলায় মা কে কিছু বলতেই আমি গলা জড়ানো স্বরে পরশকে থামিয়ে বললাম,,
“কেনো কথা বাড়াচ্ছেন আপনি? বসুন না। নাশতাটা করুন প্লিজ!”
মা পরোটা মুখে দিয়ে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে পরশকে বললেন,,
“হ্যাঁ হ্যাঁ নাশতাটা করে নে। জবটা তো ছেড়েই দিয়েছিস। ঐ এক মেয়ের জন্য। কি এমন যাদু করেছিল আল্লাহ্ মাবুদ জানেন। এখন আর কি? বাবা তো আছেনই তাই না? আবার তোর জন্য চাকরী ও খুঁজছে। শুন? তোর বাবা বলে গেছেন, নাশতা করে ১১ টার পূর্বেই তোর বাবার অফিসে প্রেজেন্ট থাকতে। উনার অফিসে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের একটা পদ খালি আছে। ওটাতেই তোকে নিয়োগ দিবেন।”
পরশ রাগ দেখিয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যেতেই মা পেছন থেকে পরশকে ডেকে বললেন,,
“রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। খাবারটা খেয়ে যা। এমন এক সময় আমরা ও উঠতে বসতে শ্বাশুড়ী মায়ের অনেক কথা শুনেছি। তোর বাবা ও শুনেছেন। তাই এসব বিষয় গুলো ধরতে নেই!”
পাশ থেকে পায়েল বিরক্ত মিশ্রিত স্বরে মা কে বললেন,,
“মা এবার তুমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছ! আগের কার দিন কি এখন ও আছে? সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা ধারা ও বদলেছে। ভাইয়া, ভাবী আগে যা করেছিল প্লিজ ভুলে যাও এসব। আর বিয়ের পরের কয়েকটা দিন টুকটাক ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। নতুন পরিবেশ, নতুন বাড়ি, নতুন মানুষজন ভাবীর একটু মানিয়ে নিতে সময় তো লাগবেই তাই না? ধরেই তো আর ভাবী সবজান্তা এবং কাজ কর্মে পারদর্শী হতে পারবে না তাই না? একটু তো সময় দিতে হবে, ছাড় দিতে হবে।”
“হয়েছে হয়েছে। ভাই, ভাবীর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে হবে না। পিয়ালীকে ডেকে দে। ইদানিং মেয়েটার ও ঘুম ভারী হয়ে আসছে। বিয়ে ও ঘনিয়ে এসেছে মেয়েটার অভ্যেস গুলো ও খারাপ হচ্ছে!”
পায়েল খাবার টেবিল ছেড়ে উঠতেই আমি পায়েলকে থামিয়ে বললাম,,
“তুমি বসো পায়েল। আমি যাচ্ছি। আপুকে ডেকে দিচ্ছি!”
পায়েল মিষ্টি হেসে বলল,,
“ঠিক আছে ভাবী!”
পরশ এখন ও রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। জোরপূর্বক হেসে আমি লোকটাকে চোখের ইশারায় বললাম,,
“বসে পড়ুন। মায়ের কথায় আমি মন খারাপ করি নি।”
পরশ মুখটা ভাড় করে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। রাগে অতি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন লোকটা। আমার বিরুদ্ধে বলা কোনো কথাই যেন লোকটার সহ্য হয় না! একদম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। ধন্য আমি এই লোকটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে। অন্তত নিজের ভালো দিকটা এই লোককে বলে কয়ে বেড়াতে হয় না আমার। লোকটা নিজেই আমার ভালো দিকটা বের করে সেই দিকটাই সবার কাছে জাহির করেন!
ম্লান হেসে আমি সিঁড়ি টপকে পিয়ালী আপুর রুমের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রায় অনেক বার কড়া নাড়লাম আপুর রুমের দরজায়। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ আসছে না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ যত বিকট হচ্ছে নিস্তব্ধতা ততোই গাঢ় হচ্ছে। হুট করেই গত কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল আমার৷ বোধ হয় এই ভয়টাই গতকাল রাতে আমি পেয়েছিলাম। বুকটা ধড়ফড় করে কেঁপে উঠতেই আমি আপুর রুমের দরজা থেকে সরে এসে উপর তলা থেকে ড্রইং রুমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বললাম,,
“পরশ শুনছেন? পিয়ালী আপু দরজা খুলছেন না!”
চলবে….?