তোমায়_পাবো_বলে,পর্ব_৩৬
নিশাত_জাহান_নিশি
“শ্বশুড় আব্বব্বাব্বা… আপনার মেয়েকে বলুন, তাড়াতাড়ি আমার জন্য কফি করে আনতে!”৷
অগ্নিশর্মা আমি। মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে লোকটি এই হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে বসবে কে জানত? সুযোগ পেলেই শুধু চলবে! কিভাবে আমার বাবাকে হেনস্তা করা যাবে সেই ফন্দিতে থাকবে। এই কোন শয়তানী ভূত চেঁপেছে লোকটির মাথায় আল্লাহ্ মালুম! আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলন্ত আঁখি যুগল নিয়ে আমি পেছন থেকে লোকটিকে ডেকে বললাম,,
“এই? এদিকে তাকান। এদিকে তাকান বলছি!”
লোকটি কিয়ৎক্ষণ পর পর বাবার ভেজানো রুমের দরজায় দূরদর্শী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। আমার ডাকাডাকিতে লোকটির কোনো ভাবান্তর নেই! বোধ হয় বেশ বিরক্তিবোধ করছেন। তাই তো কেমন যেন বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বললেন,,
“উফফ যাও তো এখন। শ্বশুড় আব্বাকে জ্বালানোর সময় ডিস্টার্ব করতে এসো না!”
লোহিত গলায় আমি লোকটিকে শুধিয়ে বললাম,,
“কি বললেন আপনি? আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি?”
“হ্যাঁ, করছই তো! আমার লক্ষ্য থেকে আমায় লক্ষ্যচুত্য করছ!”
প্রত্যত্তুরে আমি হাঁক ডাক ছেড়ে বললাম,,
“উউউফফফ… আপনার শ্বশুড় আব্বা এখন রুমে নেই! তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় প্যান্ডেলের কাজে ব্যস্ত!”
পরশ তড়িঘড়ি করে পিছু ঘুড়ে তাকালেন। ভেজা টাওয়ালটা আমার গলায় ঝুলিয়ে তিক্ত গলায় বললেন,,
“ধ্যাত! আগে বলবে না? খামোখা হাঁক ডাক ছেড়ে শরীরের এনার্জি নষ্ট করলাম।”
প্রতিত্তুর করার পূর্বেই লোকটি হাত দু খানা ঝেড়ে কদাচিৎ হেসে বললেন,,
“যাই এবার! একটু প্যান্ডেলের দিকটায় যাই। শ্বশুড় আব্বাকে একটু ঘাঁটিয়ে আসি!”
ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে লোকটি আমায় উপেক্ষা করে বাড়ির আঙ্গিনায় গতিপথ নির্ধারন করলেন। দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি পেছন থেকে লোকটিকে শুধিয়ে বললাম,,
“কফিটা কি করব? আমার মাথায় ঢালব?”
পরশ থামলেন। কিছু একটা ভেবে ট্যারা দৃষ্টিতে পিছু ফিরে আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর মন্থর গতিতে হেঁটে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,,
“এক কাজ কর! আর ও এক কাপ কফি করে আনো! ঠিক প্যান্ডেলের দিকটায় চলে আসবে। শ্বশুড় আব্বা ও হয়তো এখন ও কিছু খান নি!”
পরশ প্রস্থান নিলেন। সত্যিই তো বাবা এখন ও কিছু খান নি! ব্যস্ততায় সকালের কফিটা ও মা করে দিতে পারেন নি। পরশ না বললে হয়তো বিষয়টা আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে যেত। তড়িঘড়ি করে আমি রান্নাঘরের দিকে মোড় নিলাম। রান্নাঘরে মা এবং চাচীমনিদের ব্যস্ততা ঠেলে দু কাপ কফি করে প্যান্ডেলের দিকটায় চলে এলাম। বাবা এবং পরশ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। বুকে দুহাত গুজে গুরু গম্ভীর রূপে বাবা দন্ডায়মান। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে বাবা ক্ষনে ক্ষনে পরশের দিকে দৃষ্টি বুলাচ্ছেন। পরশের উপস্থিতি কিছুতেই যেন বাবার পছন্দ হচ্ছে না। তাই মাঝে মাঝে হাত নাড়িয়ে প্যান্ডেলের লোকদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন কিভাবে কি করতে হবে! পরশকে টোটালি ইগনোর করার চেষ্টা করছেন। পরশ ও কম যান না। অবিকল বাবার মতো বুকে দুহাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন! বাবার দেখাদেখি পরশ ও হাত নাড়িয়ে প্যান্ডেলের লোকদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন! বিষয়টা বাবার বিব্রতকর ঠেকতেই বাবা তীক্ষ্ণ গলায় পরশকে শুধিয়ে বললেন,,
“কি হয়েছেটা কি? আমাকে এভাবে অনুকরন করছ কেন?”
পরশ বেগহীন গলায় ক্রুর হেসে বললেন,,
“বারে! জামাই শ্বশুড়কে অনুকরন করবে না তো, কাকে করবে?”
দাঁতে দাঁত চেঁপে বাবা অধৈর্য্য গলায় বললেন,,
“তোমাকে না বলেছিলাম? সকাল ১০ টার আগে ঘুম থেকে না উঠতে? আমার মাথা না খেতে?”
“এত গুলো দিন কি কম জ্বালিয়েছিলেন আমায়? মাথা শুদ্ধু খেয়ে নিয়েছিলেন! অসভ্য, বেয়াদব, ধূর্ত, ধপবাজ বলে! পালাক্রমে এবার আপনার ও পালা এসেছে! মাথা তো আপনার ও খেতে হবে তাই না?”
“উফফফ বিরক্তিকর! তোমার মতো জামাই যেন আমার চির শত্রুর ও না হয়!”
পরশ ফিক করে হেসে রঙ্গরসিক গলায় বললেন,
“ইদানিং আপনার অভিশাপ ও আমার দো’আ মনে হচ্ছে! কেন এমন মনে হচ্ছে আপনি জানেন শ্বশুড় আব্বা?”
“না জানি না!”
রাগে গজগজ করে বাবা স্থান পরিত্যাগ করে পেছনের দিকে মোড় নিতেই আমি বাবার সম্মুখস্থ হয়ে দাঁড়ালাম। শুকনো হেসে বাবাকে শুধিয়ে বললাম,,
“কোথায় যাচ্ছ বাবা?’
“জাহান্নামের চৌরাস্তায়! তোর জামাইয়ের প্রতি আমি সত্যিই খুব বিরক্ত!”
পরশ দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে আমার হাত থেকে কফির মগ গুলো তুলে নিলেন। অতঃপর ধোঁয়া উঠা এক কাপ কফি বাবার দিকে এগিয়ে বললেন,,
“কফিটা খেয়ে মাথাটা ঠান্ডা করুন শ্বশুড় আব্বা। সকাল সকাল এত হাইপার হলে চলবে?”
“তোমার মতো ধড়িবাজ জামাই থাকলে আমার মাথা এমনিতে ও ঠান্ডা হবে না! তড়তড় করে মাথা গরম হতেই থাকবে তো হতেই থাকবে!”
“পর পর আর ও দুইদিন আপনাকে এই জ্বালা সহ্য করতে হবে শ্বশুড় আব্বা! তাই অভ্যেস করে নিন!”
জোরপূর্বক পরশ কফির মগটা বাবার হাতে গুজে দিলেন। বাধ্য হয়ে বাবা কফির মগটা হাতে তুলে নিলেন। কফির মগে এক চুমুক দিয়ে পরশ মিষ্টি হেসে বাবার লোহিত দৃষ্টিতে নমনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“কফি এমনিতেই অনেক গরম আছে শ্বশুড় আব্বা। আপনার অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে না আবার কফিতে আগুন ধরে যায়!”
কফির মগ হাতে নিয়ে বাবা এবার সত্যি সত্যিই স্থান পরিত্যাগ করলেন। আমার বারনকে অগ্রাহ্য করে পরশ ও বাবাকে অনুসরন করতে আরম্ভ করলেন! বাবা যেখানে যাচ্ছেন পরশ ও ঠিক সেখানেই যাচ্ছেন। বাবা যা করছেন পরশ ও ঠিক বাবাকে সেই ভাবেই অনুকরন করছেন! বাবার প্রতিটা কাজে পরশ বেগড়া দিচ্ছেন! ওয়াশরুম বাদে সব স্থানেই পরশ বাবার ছায়া সঙ্গী হিসেবে ঘুড়ঘুড় করছেন! বাড়ির সবাই জামাই শ্বশুড়ের এহেন কান্ড দেখে কখন ও হাসছেন তো কখন ও হাসি থামিয়ে দুজনের সাথেই মজা নিচ্ছেন। ফারিহা আপু এবং জিজু ও সকালের দিকে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন। জিজুর প্রশংসায় বাবা পঞ্চমুখ! পরশকে এক প্রকার দেখিয়ে দেখিয়ে বাবা জিজুর সাথে মিষ্টি হেসে কথা বলছেন এবং যত্ন আত্তির দিকে খুব খেয়াল রাখছেন। বিষয়টায় পরশ অনেক জেলাস! তাই তিনি জিজুর থেকে যত সম্ভব পারছেন দূরে থাকার চেষ্টা করছেন! তবে বাবার পিছু লাগা থেকে যেন কিছুতেই বিরাম নিচ্ছেন না!
কাজিনরা মিলে আমরা এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিলাম শপিংয়ে যাব। আজই মিলি আপুর গাঁয়ে হলুদ। কেনা কেটা এখন ও অনেক কিছু বাকি আছে৷ সেগুলো আজ বিকেলের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে। পরশ এবং হিমেশ ভাইকে নিয়ে আমরা দুপুর ১২ টার দিকে রওনা হলাম শপিং মলের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠতে যাব অমনি পেছন থেকে বাবা আমায় ডেকে বললেন,,
“টয়া শুন?”
পরশ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে ছিলেন। তাই বাইরের কিছু খেয়াল করেন নি। মিষ্টি হেসে আমি বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতেই বাবা আমার ডান হাতটায় মুঠো ভর্তি টাকা গুজে দিয়ে বললেন,,
“এখানে কিছু টাকা আছে৷ তোর শ্বশুড় বাড়ির সবার জন্য শপিং করে নিস। ব্যস্ততার কারনে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না আমার। তাই এই দায়িত্বটা তোর হাতে দিলাম।”
“কিন্তু বাবা। তুমি যদি নিজেই সবার জন্য শপিং করে আনতে তাহলেই হয়তো বিষয়টা ভালো দেখাত!”
“ব্যস্ত আছি বললাম তো! ব্যস্ততা শেষ হলে অন্য একদিন আমি নিজ হাতেই তোর শ্বশুড় বাড়ির সবার জন্য শপিং করে আনব। আজ তুই একটু ম্যানেজ করে নে!”
“তাহলে তুমি টাকাটা পরশের হাতে দিতে!”
“তোর জামাইকে আমার পছন্দ না! জামাই হিসেবে কথা বলতে ও আমার রুচিতে বাঁধে!”
দাম্ভিকতা নিয়ে বাবা প্রস্থান নিলেন। মনটা মুহূর্তের মধ্যেই যেন বিষন্ন হয়ে উঠল। পরশের নামে কারো করা কটুক্তি আমার পছন্দ নয়! নেহাত বাবা বলেই কোনো তর্কে জড়াতে চাইলাম না। পিছু ঘুড়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। প্রথম গাড়িতে আমি, রুম্পা আপু, ফারিহা আপু এবং পিয়ালী আপু। দ্বিতীয় গাড়িতে নীলা, স্নিগ্ধা, পায়েল এবং হিমেশ ভাই। গাড়ি দুটো ছুটে চলল শপিং মলের উদ্দেশ্যে। পরশের পাশাপাশি সিটে আমি বসেছি। অনেকক্ষন যাবত দেখছি পরশ খুব চুপচাপ আছেন। কেমন যেন মনমরা হয়ে ড্রাইভ করছেন। পাশ থেকে আমি লোকটির বাঁ হাতটায় আলতো হাত স্পর্শ করে শুধালাম,,
“কি হয়েছে আপনার?”
পরশ আমার দিকে তাকালেন। শুকনো হেসে বললেন,,
“কিছু না!”
“কিছু না”- কথাটির মধ্যেই কিন্তু অনেক না বলা কথা লুকিয়ে আছে! কি লুকিয়ে আছে বলুন?”
“আমার বউটা ও না? একটু বেশিই বুঝে! এত বেশি বুঝলে মন খারাপের অনুভূতি টা অনুভব করব কিভাবে? বউয়ের জোরাজুরিতে তো সবসময় আমায় হাসি-খুশি থাকতে হবে!”
“মন খারাপ হবে কেন আপনার হুম? আমি থাকতে কখন ও আপনার মন খারাপ হতে দিব না!”
পরশ মিষ্টি হেসে বললেন,,
“জানি তো! তাই তো মন খারাপকে বেশিক্ষন আশকারা দিতে পারি না!”
মৃদ্যু হেসে আমি পরশের বাঁ হাতটায় দীর্ঘ এক চুমো এঁকে দিলাম। অমনি রুম্পা আপু পেছন থেকে গলা ঝাঁকিয়ে বললেন,,
“উহুম উহুম! কি হচ্ছে কি বোনদের সামনে হুম? রাতে রোমান্স করার সময় পাস নি তোরা?”
সঙ্গে সঙ্গেই পরশের হাত খানা ছেড়ে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলাম। পরশ ক্রুর হেসে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“এত দিকে নজর দিতে নেই শালী সাহেবা! আমার বউ এমনিতে ও নিজ থেকে আমায় আদর করতে চায় না। আজ যা ও করতে চাইল তখনি আপনি বেগড়া দিলেন?”
উপস্থিত সবাই ফিক করে হেসে দিল। লোকটির মুখে আসলেই লাগাম নেই৷ মুখ দিয়ে যা আসে ঠিক তাই বলে বসে। লোকটির এই হটকারীতার জন্য সবসময় আমাকেই অপ্রস্তুতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়!
,
,
সন্ধ্যা ৭ টা চলমান ঘড়িতে। পরশকে বাড়ির কোথাও খুঁজে না পেয়ে আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। মানুষটা গেল কোথায়? প্রায় অনেকক্ষন যাবত লোকটির অস্তিত্ব লুপ্ত প্রায়। বাড়ির সব সদস্যরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত বলে লোকটির খবর ও নিতে পারছে না কেউ। আর আমি তো এইদিকে মেহেন্দি পড়তে পড়তেই সন্ধ্যা গড়িয়ে দিলাম। ব্যস্ততার কারনে লোকটির খুঁজ ই নেওয়া হলো না। শ্বাশুড়ী মা, শ্বশুড় আব্বু ও বসার ঘরে মেহমান-অতিথিদের সাথে কথা বার্তায় মশগুল। তাদের ও হয়তো পরশের দিকে খেয়াল নেই। মেহেন্দি রাঙ্গা হাতে শাড়ির কুঁচি সামলে আমি ছাদের দিকে গতিপথ নির্ধারন করলাম। লোকটি বোধ হয় ছাদেই আছেন। এত এত অপরিচিত মেহমান-অতিথিদের সাথে থাকার কথা নয়। তাছাড়া বাবাকে ও দেখলাম চাচাদের সাথে বিভিন্ন কাছে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। পরশের অস্তিত্ব বাবার আশেপাশে দেখা গেল না!
দ্রুত কদমে সিঁড়ি টপকে আমি ছাদের বাউন্ডারিতে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম পরশ রাগান্বিত মুখমন্ডলে একের পর এক সিগারেটে ফুঁক দিচ্ছেন। রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে সমস্ত মুখমন্ডল। নাকের ডগা রক্ত জবার মতো রঙ্গিন। উদ্বিগ্ন রূপে আমি দ্রুত কদমে হেঁটে মানুষটির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“এই? কি হয়েছে আপনার? ছাদে নিরিবিলি কি করছেন? আর এভাবে রেগে আছেন কেন? কি হয়েছে কি?”
মুহূর্তের মধ্যেই পরশ হাত থেকে অর্ধ জ্বলন্ত সিগারেটটা নিচে ফেকলেন। চোয়াল শক্ত করে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“কিসের এত দাম্ভিকতা তোমার বাবার হ্যাঁ? কিসের এত ক্ষোভ আমার উপর উনার? কোন ক্ষতিটা করেছিলাম আমি উনার? উনার মেয়েকে পালিয়ে বিয়ে করাটা কি খুব বড় অন্যায় ছিল আমার? যার কারনে তিনি সবার সাথে আমার পরিচয় দিতে কুন্ঠা বোধ করেন? রীতিমতো সবার সামনে আমাকে ছোট করার চেষ্টা করেন!”
নীরব, নিভৃত, মানব মূর্তি আমি। উদ্বিগ্নতায় ঘেরা দুটো আঁখি যুগলে পরশের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“কি হয়েছে বলবেন তো? কোথায় আমার বাবা আপনাকে ছোট করেছেন? কার সাথে পরিচয় করান নি?”
“আমার চোখের সামনে তোমার বাবা বড় জিজুকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অথচ আমি ও যে উনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি উনি সেইদিকে নজর ই দিলেন না। একবার ও পরিচয় করিয়ে দিলেন না আমি উনার ছোট মেয়ের জামাই!”
রাগে, ক্ষোভে, অতি যন্ত্রণায় পরশের রক্তিম আঁখি যুগলে ভাসমান জল স্পষ্টত! লোকটি কান্না করছেন! খুব মনে লেগেছে আঘাতটা! শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে আমি লোকটিকে শান্তনা দিতে যাব অমনি লোকটি আর ও এক খানা সিগারেট ধরিয়ে মুখে গুজে নিলেন! অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ক্ষীন গলায় আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“যাও তুমি এখান থেকে। আমাকে একটু একা থাকতে দাও৷ সিগারেটের বিদঘুটে গন্ধে আমার বাচ্চার সমস্যা হতে পারে!
“বাচ্চার কথা ছাড়ুন! আগে আমার কথা চিন্তা করুন। শুনুন আমি কি বলতে চাইছি!”
পরশ প্রত্যত্তুরে কিছু বলার পূর্বেই ছাদের দরজা থেকে বাবার বাজখাই গলার স্বর কর্নকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো! বিস্মিত দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকাতেই বাবা পরশকে ডেকে বললেন,,
“আমার বাড়িতে ধূমপান নিষিদ্ধ পরশ! হাত থেকে এইসব ছাই পাশ ছুড়ে ফেল!”
রূঢ় দৃষ্টিতে পরশ পিছু ঘুড়ে তাকালেন। কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই বাবার দিকে তেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন,,
“আপনার বাড়িতে আর কি কি নিষিদ্ধ একটু বলবেন? মুখ খুলে শুধু একবার বলুন আপনার বাড়িতে আমি ও নিষিদ্ধ! কথা দিচ্ছি আমি এক্ষনি, এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব!”
বাবা নিরুত্তর। শুধু বুকে দুহাত গুজে সরল দৃষ্টিতে পরশের দিকে চেয়ে আছেন। রাগী গলায় পরশ পুনরায় বললেন,,
“খুব কুন্ঠা বোধ হয় আপনার তাই না? আমাকে ছোট জামাই হিসেবে পরিচয় দিতে? আমাকে আপনার বড় জামাইয়ের মতো কাছে টেনে নিতে? স্নেহ করতে? এতটাই খারাপ আমি? ছোট জামাই হওয়ার এতটাই অযোগ্য আমি? বুঝতে পারেন না? আমি ও আপনাকে ভালোবাসি? শ্বশুড় হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করি এবং শ্রদ্ধাবোধ ও করি? পার্থক্য শুধু এতেই। আমি শো অফ করি না। আপনার বড় জামাইয়ের মতো শো অফ করতে পারি না আমি। সম্পর্কটাকে একটু অন্য রকমভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করি। আর এটাই আমার দোষ তাই না?”
পরশের অনুরক্তিতে বাবার বিন্দু পরিমান ভাবান্তর হলো না। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। কেবল ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললেন,,
“আর কিছু? আর কোনো অভিযোগ আছে?”
ভাসমান জলরাশি গুলো দু হাত দিয়ে মুছে পরশ খর্ব গলায় বললেন,,
“আপাতত আর কিছু মনে পড়ছে না! মনে পড়লে বলব!”
বাবা হঠাৎ ফিক করে হেসে দিলেন। আমাদের দুজনকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বাবা পরশের হাত থেকে সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে হুট করে পরশকে ঝাপটে ধরে বললেন,,
“তোমার চোখে আমার প্রতি ঠিক এই ভালোবাসাটাই দেখতে চেয়েছিলাম পরশ! যাক, দেখা হয়ে গেল! নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি। শুধু আমিই আমার ছোট জামাইকে ভালোবাসি না! ছোট জামাইটা ও তার শ্বশুড়কে ঠিক অতোটাই ভালোবাসে! তুমি কি ভেবেছ? হেরে যাওয়ার কষ্টে আমি খুব আপসেট হয়ে আছি? না একদমই না! এই হেরে যাওয়ার মাঝেই আমি প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছি। একজন ভালো জামাই এবং একজন ভালো বন্ধু খুঁজে পেয়েছি। যার ভালোবাসার কাছে আমার মেয়ে আজীবন সুখে, শান্তিতে নিরাপদে থাকতে পারবে! যার সাথে আমার সম্পর্ক সবসময় দুষ্টু-মিষ্টি পর্যায়ের থাকবে৷ একদম একগুঁয়ে সম্পর্ক হবে না আমাদের। সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা সম্পর্ক বজায় থাকবে!”
মৃদ্যু হাসলেন পরশ। বাবাকে ছেড়ে কিয়ৎক্ষন বাবার দিকে সন্তোষজনক দৃষ্টি স্থির করলেন। অতঃপর ফিক করে হেসে বললেন,,
“আসেন আব্বা! আজ আমরা জামাই, শ্বশুড় মিলে একই রঙ্গের পাঞ্জাবি পড়ব!”
বাবা অট্ট হাসি হাসলেন। মুহূর্তের মধ্যেই পরশ বাবার হাত দুখানা চেঁপে ধরে পাশ ফিরে আমার দিকে দুষ্টু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি তৃপ্তির হাসি হেসে উঠতেই পরশ বাবাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। তাদের পিছু পিছু আমি ও হাঁটা ধরলাম!
,
,
রাত ৯ টা বাজতেই বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান জমজমাট। পরশের জোরাজুরিতে বাবাকে ও হলুদ পাঞ্জাবি পড়তে হলো! দুই জামাই, শ্বশুড়ের হাস্যকর কান্ডে বাড়ির সব সদস্যদের পাশাপাশি মেহমান-অতিথিরা ও হাসতে বাধ্য হচ্ছিল। হাসি, খুশি, আনন্দ, অনুষ্ঠানে কেটে গেল হলুদের রাত! কাজিনরা যে যেভাবে পেরেছে নেচেছে। তবে আমি এইবার নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারি নি। প্রেগনেন্ট তার উপর পরশের কড়া নির্দেশ!
চলবে…?