তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-১৩,১৪

0
4703

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-১৩,১৪
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৩

সকাল সকাল শাওয়ার নিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই ঈশার মুখ হা হয়ে গেলো। ইভান তার বিছানায় হেলানি দিয়ে বসে ফোনে কথা বলছে। আওয়াজ পেয়ে ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। ঈশা তাকে ভালো করে দেখে নিলো। বুঝে গেলো সে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি? ইভানের পাশে এসে দাড়াতেই সে ফোন টা রেখে উঠে দাঁড়াল। ঈশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো। তারপর তার মুখের দিকে কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে। ঈশার বেশ অসস্তি হতে লাগলো। ঈশা ইভানের দিকে না তাকিয়েই বলল
–তুমি এতো তাড়াতাড়ি?

ইভান উত্তর দিলো না। সে ঈশাকে দেখতেই ব্যস্ত। মাত্র গোসল করায় চুলগুলো বেয়ে পানি পড়ছে। কোমরের নিচের অংশটা ভিজে গেছে সেই পানিতে। কপালে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। ফ্রেশ লাগছে। ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভান এক হাতে তার কোমরের ভেজা অংশে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়। আচমকাই এমন কাজে ঈশা ভয় পেয়ে যায়। ইভানের দিকে তাকায়। কেমন নেশা ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ঈশাকে আরও একটু কাছে টেনে আনে। এতটা কাছে ঈশার মনে হল সে যেন ইভানের হার্ট বিট শুনতে পাচ্ছে। ইভানের তপ্ত শ্বাস ঈশার মুখে আছড়ে পড়ছে। ঈশার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো। হার্ট বিটও বেড়ে গেছে। ইভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস ঈশার ঠাণ্ডা মুখে পড়তেই সারা মুখে উষ্ণতা ছড়িয়ে গেলো। ইভান ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল
–তোর এই রূপটা আমার কল্পনাতেই ছিল। বাস্তবেও দেখতে পাব সেটা ভাবিনি। তবে জানিস তুই আজ একদম আমার কল্পনার ঈশার মতো। আমি চোখ ফেরাতে পারছি না। তোর এই ভেজা চুলের ঘ্রাণ আমার নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। তোর মুখে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানির কনা গুলো কেমন মুক্তর মতো জলছে। তোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে জান।

বলেই ঈশার ঠোট দুটো নিজের ঠোটের মাঝে আবদ্ধ করে নিলো। এই প্রথম ইভান ঈশাকে এভাবে স্পর্শ করছে। ইভানও নিজের মধ্যে নেই। সে আজ ঈশার নেশায় হারিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আটকে রাখার সাধ্য তার নেই। আচমকাই এমনটা হওয়াতে ঈশার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ঈশা একদম জমে যায়। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে ইভানের খেয়াল নেই। ঈশার দম আটকে যেতেই সে ছটফট করতে থাকে। ইভান ঈশাকে ছেড়ে দেয়। দুজনি অনেক জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। ইভান তার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঈশার ঠোঁটে স্লাইড করতে থাকে। ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইভান একটু হাসে। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে একটু সরে দাড়ায়। ঈশা চোখ খুলে ফেলে কিন্তু ইভানের দিকে তাকায় না। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে খুব শান্ত ভাবে বলে
–আজ আমার ইম্পরট্যান্ট একটা কাজ আছে। মা বলল ভালো কাজে যাওয়ার আগে নাকি মিষ্টি মুখ করতে হয়। তাই তো মিষ্টি মুখ করতে চলে এলাম।

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান একটু হেসে চলে যাওয়ার জন্য ফোনটা হাতে নিয়ে সাভাবিক ভাবেই বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি চলে গেলাম। তুই ইলহামের সাথে ভার্সিটি যাস। আর আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকব। আসতে দেরি হবে।

বলেই চলে গেলো। ঈশা চোখ তুলে তাকাল। সে বোকার মতো দাড়িয়ে ভাবছে। এখনও ঘোরের মাঝেই আছে। ফোনের টুংটাং শব্দে ঘোর কাটল। একটা শুকনো ঢোক গিলে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে ইভানের নামটা দেখে অদ্ভুত ভাবে লজ্জা সারা মুখে ছড়িয়ে গেলো। মেসেজটা ওপেন করলো দেখার জন্য।

‘এভাবে না দাড়িয়ে থেকে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে নে। নাহলে ভার্সিটি যেতে দেরি করে ফেলবি। এতো লজ্জা কই থেকে আসে জান? অবশ্য তুই চাইলে আমি তোর লজ্জা ভাঙ্গাতে পারি। কি বলিস?’

ইভানের এস এম এস পড়েও কেমন একটা লজ্জা ভাব হচ্ছে। ঈশা বুঝতে পারছে না এমন হওয়ার কারন। এর আগেও সে অনেক বার তার কাছে এসেছে কিন্তু এমন অনুভুতি কখনও হয়নি। বা ইভান কে দেখেও এতো লজ্জা হয়নি। তাহলে এখন কেন? ইভানের ভালবাসার প্রথম স্পর্শ! ভাবতেই এক রাশ লজ্জা ঈশাকে ঘিরে ধরল। সে ঠোট কামড়ে একটু হাসল।
—————

বাড়ির সবাই বাইরে বসে অপেক্ষা করছে। কেউ সোফায় বসে আছে আবার কেউ টেবিলে। মাঝে মাঝে তো দুই একজন উকি ঝুকি মারছে। তাদের এমন উকি ঝুকি মারা দেখে ঈশা বিরক্ত হচ্ছে। রাগি চোখে তাকালে সবাই আবার নিজেদের জায়গায় বসে পড়ছে। এভাবেই অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু ঈশা এখনও রান্না ঘর থেকে বের হয়নি। সে আজ বিরিয়ানি রান্না করবে। দীর্ঘ দুই ঘণ্টার অভিজানের পর ঈশা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসল। কাউকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেয়নি। কাজের মহিলার হেল্প নিয়ে সে রান্না শেষ করেছে। তার অবস্থা একেবারেই দেখার মতো। পুরো গা ঘেমে একাকার অবস্থা। খোপা বাধা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ঘাড়ে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। গলা বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। শরীরের সাথে কাপড় টা লেপটে আছে। ঈশা বের হয়ে সেখানে আর না দাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
–তোমরা একটু বস আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।

বলেই ঘরের ভিতরে ঢুকে লাইট অন করতেই চিৎকার করতে যাবে তার আগেই মুখে শক্ত পোক্ত হাত এসে চেপে ধরে।
–কি করছিস? এভাবে চিৎকার করলে সবাই কি ভাববে বলতো? বাইরে সবাই বসে আছে।

ইভানের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ঈশা। ইভান মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলে সে বুকে হাত দিয়ে সস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিজেকে সাভাবিক করে নিয়ে বলল
–এভাবে কেউ ভয় দেখায়?

ইভান ভ্রু কুচকে ফেলে। অবাকের সুরে বলে
–আমি তোকে ভয় দেখালাম কখন?

–এই যে এভাবে চুপ করে রুমে অন্ধকারে এসে বসে আছো। আমার জায়গায় যে কেউ আসলেই ভয় পেত।

–আমি চুপ করে আসিনি। সবাই জানে আমি এই ঘরে। অফিস থেকে সোজা এসেছি তাই ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম।

–সবাই জানে মানে? আমি কেন জানিনা?

ইভান একটু অভিমান করেই বলল
–তুই জানতে চাস না তাই জানিস না। আমার ঠিকমত খোজ নিলেই জানতে পারতিস আমি কখন এসেছি।

ঈশা ইভানের অভিমান বুঝতে পারল। একটু রাগ করে বলল
–একদম ঠিক। আমি তো স্বার্থপর। কারও কথা ভাবিনা। এতক্ষন রান্না ঘরে গরমে রান্না করলাম সেটা তো কারও চোখেই পড়লো না।

ইভান অবাক হয়ে তাকাল। শান্ত সরে বলল
–তুই আমার জন্য রান্না করেছিস?

ঈশা মাথা নামিয়ে বলল
–দুপুরে খাওনি তাই ভাবলাম রান্না করি। আমি রান্না ঘরে গেছি শুনে সবাই এভাবে বাড়িতে ভিড় করে বসে আছে। কি একটা অবস্থা!

–আমি দুপুরে খাইনি তুই জানলি কিভাবে?

ঈশা ইভানের তাকাল। একটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে ইভান কে হালকা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। আলমারির কাছে গিয়ে সেখানে কাপড় বের করতে করতে বলল
–আমি শাওয়ার নিতে জাচ্ছি। এসে একসাথে খাব।

কাপড় বের করে পিছনে ফিরতেই ইভানের সাথে ধাক্কা খায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই সে পিছিয়ে আলমারির সাথে লেগে গুটি সুটি হয়ে দাড়ায়। ইভান এগিয়ে তার কাছে এসে দাড়ায়। তার মাথার কাছে আলমারির সাথে এক হাত রেখে নেশাল দৃষ্টিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে। ঈশার সকালের সেই ঘটনা মনে পড়তেই সে শুকনো ঢোক গিলে ফেলে। ইভান নিজের দৃষ্টি স্থির করে নেশাল কণ্ঠে বলে
–সবটা না জানা পর্যন্ত তো আমি তোকে কোথাও যেতে দিব না।

ঈশার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। ইভান আর একটু ঝুকে যেতেই ঈশা কাপা কাপা গলায় বলে
–আ…আমার ঠাণ্ডা লাগছে।

ইভান দুষ্টুমির সুরে বলল
–গরম করে দিব?

ঈশা আবারো শুকনো ঢোক গিলে কাদ কাদ গলায় বলল
–কেন এমন করছ? আমাকে ছেড়ে দাও।

–আমি ধরিনি তো!

ধরেনি ঠিকই কিন্তু এতটা কাছে দাড়িয়ে আছে যে ঈশার এখন মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। দম আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা। ইভান দেখল ঈশার সমস্ত কাপড় ঘেমে ভিজে আছে। ফ্যানের বাতাসের কারনে শরিরে ঠাণ্ডা অনুভুতি হচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষন থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। তাই ঈশার অবস্থা বুঝতে পেরে একটু হেসে সরে দাড়িয়ে বলল
–বেশী সময় নিবিনা। খুব তাড়াতাড়ি বের হবি।

ঈশা মাথা নাড়িয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো যেন বাঘের খাচা থেকে ছাড়া পেয়েছে। ইভান হাসল। কিন্তু তার মাথায় ঢুকছে না ঈশা কিভাবে জানল সে দুপুরে খায়নি। বিছানায় বসে গভির চিন্তায় ডুবে গেলো সে।
———–

ঈশা বমি করছে আর ওয়াশ রুমের সামনে দাড়িয়ে সবাই অবাক চোখে দেখছে সেই দৃশ্য। যেন জিবনেও কাউকে এভাবে বমি করতে দেখেনি। অনেকটা সময় বমি করার ফলে বেশ দুর্বল লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে উঠে দাড়িয়ে মনে হল মাথাটা ঘুরে উঠেছে। মাথায় হাত দিতে নিলেই ইভান তাকে ধরে ফেলে। হাত পা ছেড়ে দিয়ে ইভানের বুকে ঢলে পড়লেও পুরোপুরি জ্ঞান হারায় নি ঈশা। ইভান আলতো করে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকার পর ঈশা ক্লান্ত ভাবে চোখ খুলে তাকায়। ঈশার চোখ খুলতে দেখে ইভান বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে
–ঠিক আছিস তুই?

ঈশা মাথা নাড়ায়। ইভান তাকে দেখে বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কি হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করার আগেই ইভানের মা এগিয়ে এসে কৌতূহলী ভাবে প্রশ্ন করে
–কি হয়েছে তোর? বমি করছিস আবার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। সব ঠিক আছে তো ঈশা। তোর খাওয়ার রুচি আছে তো? কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?

ঈশা তার চাচির প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়। ইভান ভ্রু কুচকে ঈশার দিকে তাকায়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর তার মায়ের প্রশ্নের অর্থ বুঝতে পেরে ঠোট চেপে নিজের হাসি আটকাতে চেষ্টা করে। তিনি ঈশার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবারো জিজ্ঞেস করেন
–ডাক্তারের কাছে যাবি? একবার দেখিয়ে আনলে সবটা বোঝা যেত ঠিক কি হয়েছে?

ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভানের দিকে চোখ পড়লো। সে হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো তার মা কি বলতে চাচ্ছে। ঈশা বুঝতে পেরে চোখ বড় বড় করে ফেলল। বিরক্ত হয়ে বলল
–আমার কিছুই হয়নি। এসিডিটি হয়েছে তাই বমি হচ্ছিল।

–তাহলে মাথা কেন ঘুরছে?

ইভান এবার আবারো হেসে ঈশার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো তার মায়ের উত্তর দিতে। ঈশা ইভানের উপরে রেগে গেলো। একটু রাগ করেই ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–সন্ধ্যা থেকে এতো বার বমি করলে মাথা ঘুরাটা স্বাভাবিক। এভাবে ভাবার কিছু নাই।

বলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার কথা শুনে সবাই কতটা আশস্ত হতে পারল সেটা এই মুহূর্তে বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। ইভান বুঝতে পারল ঈশার খারাপ লাগছে। তার রেস্ট দরকার। তাই খুব শান্ত ভাবে বলল
–তেমন কিছু না মা। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। অনেক রাত হয়েছে তোমরা শুয়ে পড়।

ঈশার মা ইভানের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন
–রাত টা তুই আজকে এখানেই থেকে যা বাবা। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।

তার কথা শুনে ঈশা চোখ খুলে ফেলল। ইভানের দিকে বড় বড় চোখে তাকাল। ইভান্ ঈশার দিকে তাকিয়ে ঠোট চেপে হেসে বলল
–আমি আছি বড় মা। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

ঈশার মা একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন
–তুই ঈশার কাছে থাকলে আমি তবুও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।

ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত গলায় বলল
–আমি বেচে থাকতে তোমাকে এসব ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না বড় মা। আমি মরে গেলে না হয় তোমরা ভাবিও।

কথা শেষ করেই ইভান চোখ ফিরিয়ে নিলো। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কথাটা ঈশাকে খুব বেশী কষ্ট দিলো। তার চোখ ছল ছল করে উঠলো।

চলবে………

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৫

অনেকটা সময় ধরে ঈশা ইভান কে ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু তার ঘুম থেকে উঠার কোন নাম নেই। ঈশা হতাশার সুরে বলল
–প্লিজ ওঠো না। অনেক বেলা হয়েছে। অফিসে যাবে না।

ইভান আবারো উলটা দিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো। ঈশা আবার ডাকল। এবার ইভান খানিকটা বিরক্ত হয়েই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–প্লিজ ঈশা। আমাকে ঘুমাতে দে। আমি আজ অফিসে যাবনা।

–কেন যাবে না?

ঈশার কথা কানে আসতেই ইভান বিরক্ত হয়ে উঠে বসল।তারপর খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–ওহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার আজ সারার সাথে ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। সারা ওয়েট করছে সেই কখন থেকে। থ্যাঙ্ক ইউ জান ঘুম থেকে তোলার জন্য।

ঈশা দরজার দিকে পা বাড়াতে জেয়েও থেমে গেলো। ইভান বিছানার উপরেই বসে আছে। সে ভালো করেই জানে এই কথা শোনার পর ঈশা তাকে আর অফিসে কেন এই ঘরের বাইরেই যেতে দিবে না। তাই চুপচাপ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে সে। ঈশা পিছনে ঘুরে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–থাক আজ অফিসে যেতে হবে না। তুমি ঘুমাও।

ইভান নিজের হাসি আটকে রেখে বলল
–কিন্তু সারা……।

কথা শেষ করার আগেই ঈশা ইভানের কাছে এসে বসলো। কঠিন ভাবে বলল
–তোমার ঘুম হয়নি তুমি এখন ঘুমাবে।

–এখন তো ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কিভাবে আর ঘুম আসবে?

ঈশা একটু তাকিয়ে থেকে বলল
–তুমি শুয়ে পড় আমি মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি। ঠিক ঘুম আসবে।

ইভান মাথা নাড়িয়ে শুয়ে পড়লো। ঈশা মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। ইভান একটু হেসে বলল
–এতো ভয় পাস তাহলে দূরে থাকিস কেন? জানিস তো ছেলেদের বিশ্বাস করতে হয়না কখন কি করে ফেলে।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। কিছু বলল না। ইভান একটু হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। বেশ কিছুক্ষন পর ঈশা যখন বুঝতে পারল ইভান ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সে ধির পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান তখনই চোখ খুলে ফেলল। উঠে বসলো। গভির ভাবে ভাবতে লাগলো। আরমান দেশে এসে পড়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যে এই খবর সবাই জেনে যাবে। আর ইভানের মা জেনে গেলে তার বোনের ছেলেকে এই বাড়িতে অতি জত্নে আনবে। আর এই বাড়িতে আসা মানেই ইভানের জন্য বিপদ। তার আগেই জেভাবে হোক ঈশাকে তার কাছে আনতে হবে। কিন্তু কিভাবে? এই মুহূর্তে জোর করে আনলে বিষয়টা ঠিক হওয়ার চাইতে বিগড়ে যাবে। তাই এমন কিছু করতে হবে যাতে ঈশা নিজে থেকেই আসে। এমন কিছু একটা প্ল্যান করতে হবে। ইভান ভাবতে শুরু করলো।

আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ইভান আর ইলহাম যখন বিদেশে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলো তখন তাদের বিজনেসের ম্যানেজার হিসেবে আরমানের বাবাও ছিলেন। বেশ ভালই চলছিল তাদের বিজনেস। কিন্তু যখন ইভান আর ইলহাম এসে অফিসের কাজ সামলাতে শুরু করলো ঠিক তখনই বিপত্তি শুরু হল। অ্যাকাউন্টেন্ট অনেক টাকার হিসেবে গোলমাল করে ফেলে। আরমানের বাবার উপরে বিশ্বাস রেখেই ঈশার বাবা আর ইভানের বাবা তেমন কিছুই গুরুত্ত দিতেন না। কারন তিনি খুব সৎ লোক ছিলেন। জার উপরে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু অফিসের ম্যানেজার হওয়ায় সমস্ত হিসেবের দায় ভার তার উপরে পড়ে যায়। ইভান সবটা জেনে যাওয়ায় সত্যিটা জাচাই না করেই তার বাবাকে সব জানায়। আর তিনি আরমানের বাবাকে চাকরি থেকে বের করে দেন। এতে তাদের অনেক বদনাম হয়। কিন্তু পরে অবশ্য ইভান নিজেই সত্যিটা জানতে পেরে তাকে আবার সসম্মানে অফিসে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এই ভুলের জন্য অনেকবার সবাই তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। অনেক ক্ষতি পূরণও দিয়েছে। অবশ্য আরমানের বাবা মা সবাইকে ক্ষমা করে দিলেও তারা দুই ভাই বোন ক্ষমা করতে পারেনি। আরমান এই ভুল বুঝাবুঝির জন্য সারাজীবন ইভান কেই দায়ি করে এসেছে। সে ইভান কে হারাতে নানা ভাবে চেষ্টা করেছে। ইভান কিছুই বলেনি। সে তার ভুলের প্রাপ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আরমান এবার ইভানের উপরে প্রতিশোধ নিতে ঈশাকে টার্গেট করে। যা ইভান কোন ভাবেই মেনে নিবে না। কারন ঈশা তার জীবন। ঈশার কিছু হলে সে বাচবে না। তাই তো ইভান এতো চিন্তিত।

ভাবনার মাঝেই ইভানের ফোন বেজে উঠে। সে একটু চমকে উঠে। একটা শ্বাস ছেড়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। ইলহামের নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করে ফেলে
–হ্যালো।

ইলহাম বেশ চিন্তিত হয়েই বলল
–কোথায় তুই?

–বাসায়।

–তুই ঠিক আছিস তো?

–হুম। কেন বলছিস?

–অফিসে আসিস নি তাই জিজ্ঞেস করলাম।

–এমনিতেই। আজ ভাবলাম বাসায় থাকি। তুই সব সামলাতে পারবি তো? নাকি আমাকে যেতে হবে? হলে বলিস আমি বাসাতেই আছি চলে আসব।

ইলহাম আশ্বস্ত করে বলল
–না না আসতে হবে না। তুই রেস্ট নে।

ইলহাম চুপ হয়ে গেলো। ইভান বুঝতে পারল সে কিছু একটা ভাবছে। তাই একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–ইলহাম! সব ঠিক আছে তো?

ইলহাম ছোট্ট করে ‘হুম’ বলল। ইভান আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই বলল
–ইভান, আরমান দেশে ফিরেছে।

ইভান বুঝতে পারল ইলহামের চিন্তার কারন। সে ছোট্ট করে বলল
–জানি।

–আজ রাতে ওদের বাসায় সবার দাওয়াত। সবাই যাবে। এমন কি তুই ঈশাও।

ইভান একটু ভ্রু কুচকাল। এতো তাড়াতাড়ি সে আরমানের মুখমুখি হতে চায়না। অন্তত ঈশাকে তার কাছে আনার আগে তো নয়ই। কিন্তু এখন কি করবে? আরমান ঈশাকে অবশ্যই ফোন করবে। আর ইভান কোন কাজের বাহানা দিলেও ঈশাকে আটকাতে পারবে না। সে যাবেই। ইভানের চুপ করে থাকায় ইলহাম আবারো বলল
–কি ভাবছিস?

–সবটা আরমানের প্ল্যান। ঈশাকে ওই বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই ছোট নাটক। কিন্তু তার আগেই কিছু একটা করতে হবে।

–কি করবি ভেবেছিস?

–এখনও ভাবিনি। ভেবে নিব। তুই ভাবিস না। ওই দিকটা সামলে নিস।

–আচ্ছা।

বলেই ইলহাম ফোনটা রেখে দিয়ে ভাবতে লাগলো। এইদিকে ইভানও ভাবতে লাগলো কিভাবে ঈশাকে আটকাবে?
———-

বই হাতে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে পড়ছে ঈশা। ঘরে তার ফোন বেজেই যাচ্ছে। পড়ায় বিঘ্ন ঘটায় বেশ বিরক্ত হয়েই সে ঘরে গেলো ফোন তুলতে। আরমানের নাম্বার দেখে ঈশা একটু হাসল। অনেকদিন পর আরমানের ফোন। ফোনটা তুলতেই আরমান ওপাশ থেকে বিচলিত হয়ে বলল
–কেমন আছো ঈশা?

ঈশা একটু হেসে বলল
–ভালো আছি আরমান ভাইয়া। তুমি কেমন আছো?

–এতক্ষন ভালো ছিলাম না। তোমার সাথে কথা বলে এখন ভালো আছি।

কথাটা শুনে ঈশা শব্দ করে হাসল। হাসি মুখেই বলল
–তুমি আগের মতই থেকে গেলে।

–পরিবর্তন হলে বুঝি তুমি খুশি হতে?

ঈশা আবারো হাসল। তারপর স্বাভাবিক ভাবে বলল
–তারপর বল তোমার কি খবর?

–সেটা বলার জন্যই তো ফোন দিলাম। আমি দেশে এসেছি। আর আজ রাতে কিন্তু তোমরা সবাই বাসায় আসছ।

কথাটা শুনেই ঈশা অবাক হয়ে বলল
–কি বল? কখন এসেছ? আমাকে বলনি কেন?

–সারপ্রাইজ দেব বলে। আগে বললে কি তোমাকে এত খুশি দেখতে পেতাম। যাক গে! ইভান কোথায়? ওকে ফোনে পাচ্ছি না। তুমি একটু বলবে আমাকে ফোন দিতে।

–আমি আসলে জানিনা কোথায়। ঠিক আছে আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি।

–ওকে বাই। রাতে দেখা হচ্ছে।

–হুম।

ফোনটা রেখেই ঈশা একটু হেসে ইভান কে ফোন দিলো। কয়েকবার ফোন বেজেই গেলো কিন্তু রিসিভ করলো না। ঈশা অবাক হল। ইভান তো এমন কখনও করেনা। ব্যস্ত থাকলেও ঈশার ফোন ধরতে সে কখনও দেরি করেনা। কিছুক্ষন পর আবার ফোন করলো। এবার ইভান রিসিভ করলো। ঈশা একটু গম্ভির হয়েই বলল
–কোথায় তুমি?

ইভান কঠিন ভাবে বলল
–কেন? কোন দরকার আছে?

ইভানের এভাবে কথা বলাটা ঈশা ঠিক হজম করতে পারল না। রেগে গেলো। কিন্তু সে এই মুহূর্তে ইভান কে দেখাতে চাইছে না তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–দরকার ছাড়া কি ফোন করা যায় না?

–আমি ব্যস্ত ঈশা। কি বলবি তাড়াতাড়ি বল। বলার কিছু না থাকলে রেখে দিচ্ছি।

ইভানের এরকম রুড ব্যাবহার ঈশার মন খারাপ করে দিলো। আরমানের কথাটা বলার জন্যই তাকে খুশি মনে ফোন দিয়েছিল কিন্তু সে যে এমন ব্যাবহার করবে বুঝতে পারেনি। মন খারাপ করেই বলল
–আরমান ভাইয়া ফোন দিয়েছিল। দেশে এসেছে। আজ রাতে ওই বাসায় আমাদের যেতে বলেছে। আর তোমাকে ফোন দিতে বলেছে।

ঈশার কথা শেষ হতেই ইভান সময় নষ্ট না করেই বলল
–আমার সময় নেই। আমি খুব ব্যস্ত। তুই সবার সাথে চলে যা। আর আমি পরে আরমানের সাথে কথা বলে নিবো। এখন রাখছি।

ফোনটা কেটে দেয়ার আগে ঈশার কানে স্পষ্ট কোন মেয়ের কণ্ঠ কানে আসল। সে ইভান কে বলছে
–দিজ ইজ ফর ইউ।

কথাটা কানে আসতেই ইভান ফোনটা কেটে দিলো। টুট টুট শব্দ করলেও ঈশা সেটা কানে ধরেই ভাবছে। ইভানের এমন ব্যবহারের কারন আবার কোন মেয়ের আওয়াজ। কোথায় থাকতে পারে ইভান। আর কি এমন ব্যস্ততা যে ঈশার সাথে এমন ব্যাবহার করল। ঈশার মাথায় রাগ চেপে গেলো। সে দ্রুত ইলহামের নাম্বারে ফোন করলো। ইলহাম ফোন রিসিভ করতেই ঈশা কঠিন গলায় বলল
–ভাইয়া ইভান কোথায়?

ইলহাম ঈশার এমন রুড কণ্ঠ শুনে খুব অবাক হল। বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি সেটা বুঝতে না পারলেও ইভান তাকে যা বলতে বলেছে সেটাই তাকে বলতে হবে। পরে ইভান নিজে থেকেই তাকে সব খুলে বলবে। তাই সে ইভানের কথা মতই বলল
–ওর ফ্ল্যাটে। সারার সাথে মিটিং করছে।

কথাটা কানে আসতেই ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে কোন কথা না বলে ফোনটা কেটে দিলো। একটু ভেবে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। ইলহাম ইভান কে ফোন করে সব জানালো। ইভান সব শুনে একটু হেসে ফোনটা রেখে দিলো। ইভান জানত যে ঈশা এই কথা শোনার পর আর দেরি করবে না। কারন মুখে না বললেও সে যে ইভানের সাথে কাউকে সহ্য করতে পারেনা সেটা ভালো করেই ইভান বুঝতে পারে। তাই তো বুঝে শুনে এই প্ল্যান করেছে জাতে ঈশা নিজে থেকেই চলে আসে তার কাছে।

ইভানের ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠে। আরমানের ফোন দেখে ইভান সেটা রিসিভ করে ফেলে। আরমান হাসি মুখে বলে
–কখন এসেছি আমি তোর সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছি। আর তুই কিনা ব্যস্ত। আমাকে এভাবে কষ্ট দিতে পারছিস বল! আর দেরি করিস না চলে আয়। ওহ হ্যা ঈশার সাথে কথা হল ও আসছে রাতে। অবশ্য তুই না আসলেই ভালো। ওর সাথে আমি একটু নিজের মতো সময় কাটাতে পারব।

আরমানের কথা শুনে ইভান রেগে হাতে থাকা কফির মগটা ছুড়ে ফেলে দিলো। দাতে দাত চেপে বলল
–আমার ঈশাকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলব। আমি সব সহ্য করতে পারি আরমান! কিন্তু ঈশাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে তাকে আস্ত রাখিনা মনে রাখিস।

ইভানের কথা শুনে আরমান শব্দ করে হাসল। সাভাবিল হয়ে বলল
–কুল। এখনি এতো রেগে জাচ্ছিস কেন? আমি তো এসে পড়েছি। সবে মাত্র খেলা শুরু। আরও অনেক কিছুই দেখতে পাবি আর শুনতেও পাবি। দেখিস আবার তোর পাখিকে তোর কাছ থেকে আমি ছিনিয়ে না নেই।

ইভান ফোনটা ছুড়ে ফেলল। রাগে তার মাথার রগ ফুলে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে দুই পাশে চেপে ধরে রাগ কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করছে। এবারে ইভানের জেদ চেপে বসলো। জোর করে হলেও সে ঈশাকে নিজের করেই ছাড়বে। ঈশাকে কোনদিন সে অন্য কারও হতে দিবে না।

ইভান একটা সময় আরমান কে খুব ভালবাসত। ইলহাম আর আরমান তার কাছে শুধু ভাই না ঈশার পরেই দুজন প্রিয় মানুষ ছিল। কিন্তু এই ভুল বুঝাবুঝির পর আরমান তার সাথে গেম খেলতে শুরু করে। সেটা ইভান বুঝেও না বোঝার ভান করেই থাকত। আরমানের মনে ইভানের জন্য যে ক্ষোভ আছে সেটা জাতে শেষ হয়ে যায় তাই ইভান আরমান কে আবার নতুন করেই তাদের পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে দিতেই বাসায় এনে রাখত। ইভান নিজেই ঈশার সাথে আরমানের ভালো সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে আরমান এটার সুযোগ নিবে। ঈশাকে তার কাছ থেকে আলাদা করার চেষ্টা করবে। ইভান দাতে দাত চেপে বলল
–তোর এই আশা কোনদিন পুরন হবে না। আমার ঈশা শুধুই আমার। আমি ঈশাকে কারও হতে দিবনা।
চলেব…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here