তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-১৯ শেষ পর্ব
লেখক- এ রহমান
হসপিটালের করিডোরে বসে সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সবার চোখ সামনের কেবিনের দরজায়। ভেতর থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসতেই ইভান হাতের মুঠি শক্ত করে ফেলল। ঈশার চিৎকার যেন তাকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। সে নিজেকে শান্ত করতে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ঈশার কোন কষ্টই ইভান সহ্য করতে পারেনা। ঘাড়ে কারও স্পর্শ অনুভব করতেই পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভানের মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি শান্ত সরে বললেন
–ভাবিস না বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইভান কোন কথা বলল না। সে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। সামনে দৃষ্টি স্থির করে ভাবছে। এই ঈশাকে আজ পর্যন্ত সে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। নিজের জিবনের বিনিময়ে তাকে বাচিয়েছে। সেদিন যখন আরমান তাকে কিডন্যাপ করেছিল তখন সে জানত এমন কিছু করবে। তাই সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। ঈশার লকেটে জি পি এস ট্রেকার লাগানো ছিল যার কারনে সে জানতে পেরেছিল ঈশা কোথায়। কিন্তু ইভানের ধারনা ছিলনা আরমানের প্ল্যান অন্য কিছু। সে যে তাকে হারাতে ঈশাকেই মেরে ফেলতে চায় সেটা সে কোন ভাবেই বুঝতে পারেনি। ইভান এটা ভাবেইনি যে আরমান এসব ভাবতেও পারে। তার এতোটুকু বিশ্বাস ছিল যে আর যাই করুক এতো জঘন্য চিন্তা আরমানের মাথায় আসবে না। ভাবতেই ইভানের বুক কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল। নার্সের কথা কানে আসতেই চোখ খুলে সামনে তাকাল।
–আপনার মেয়ে হয়েছে।
ফুটফুটে ছোট একটা বাচ্চা কোলে করে দাড়িয়ে আছে তিনি। সবাই উঠে এসে ঘিরে ধরে দাঁড়াল। সবার মাঝে প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে কে আগে কোলে নিবে। ইভানের এসব কানেই আসছে না। সে তার মেয়েকে দেখতেই ব্যস্ত। দুনিয়াতে আসতেই যেন সে সবার মাঝে তার প্রতি অসিম মায়া তৈরি করে ফেলেছে। অদ্ভুত শক্তি তার। এই মায়াবী মেয়েটা পৃথিবীর তৃতীয় নারি যার প্রতি ইভানের অসীম ভালবাসা কাজ করছে। তার জিবনের প্রথম নারি তার মা যে তাকে জন্ম দিয়েছে। আর দ্বিতীয় নারি ঈশা। জাকে সে নিজের জিবনের থেকেও ভালোবাসে। আর তৃতীয় নারি এই মেয়ে যে তার অংশ। ভেবেই একটু হাসল।
–আপনারা এখন ভিতরে যেতে পারেন।
নার্সের কথা শুনে ইভান হাত বাড়িয়ে দিলো। নার্স একটু হেসে তার মেয়েকে কোলে দিলেন। সে কোলে নিয়ে দেখছে। তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। মেয়েকে কোলে নিয়েই ভিতরে ঢুকলেন। ঈশা চোখ বন্ধ করে আছে। কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ খুলে ফেলল। সামনে ইভান কে দেখে ঠোটের কনে হাসি ফুটে উঠলো। ইভান মেয়েকে ঈশার পাশে শুয়ে দিয়ে তার পাশে বসলো। মাথায় হাত দিয়ে বলল
–তুই ঠিক আছিস?
ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান আলতো করে ঠোট ছুয়ে দিলো কপালে। তার হাত কাঁপছে। চোখের কনে জল চিকচিক করছে। ইভান মেয়েটার দিকে তাকাল। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে শান্ত সরে বলল
–কাদছ তুমি?
ইভান এতক্ষন নিজেকে সামলে রাখলেও ঈশার এই কথাটা শুনে নিজেকে আটকাতে পারল না। ঈশার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল। ঈশা বুঝতে পারল ইভান কাঁদছে। সে আলতো করে ইভানের মাথায় কাপা কাপা হাত রেখে বলল
–এভাবে কাদছ কেন? তুমি তো অনেক স্ট্রং!
ইভান বেশ কিছুক্ষন পর মাথা তুলে তাকাল। তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি আজ দুনিয়ার সব থেকে সুখি।
ঈশা হাসল। ইভান তার মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল
–বাবা হওয়ার খুশিটাই একে বারে অন্য রকম। সব থেকে বেশী।
ইভানের কথা শেষ হতে সবাই এক এক করে ঘরে ঢুকল। সিমানা সামনে এসে বলল
–নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে এলে আর আমরা যে বাইরে দাড়িয়ে আছি সে খেয়াল তো নেই দেখছি।
তার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। ঈশাও হাসছে। ইভান ঈশাকে দেখছে। সিমানা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। সবাই তার পাশে দাড়িয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। অনেক কথা বলছে। কিন্তু ইভানের সমস্ত কথা যেন আজ হারিয়ে গেছে। সে বাক্রুদ্ধ। কথায় আছে না অনেক কষ্টে আর অনেক খুশিতে মানুষ যেন কথা হারিয়ে ফেলে। ঈশার মা এগিয়ে এসে ইভানের ঈশার কপালে একটা চুমু দিলেন। তারপর ইভানের কপালে চুমু দিয়ে বললেন
–তোরা সারাজিবন এভাবেই সুখে থাক। দোয়া করি। সারাজিবন দুজন দুজনকে আগলে রাখিস।
ইভান একটু হেসে ঈশার মায়ের হাত ধরে বলল
–তুমি ভেবনা বড় মা। আমি তোমার মেয়ে আর আমার মেয়ে দুজনকেই আগলে রাখবো। তাদের কোন ক্ষতি দিবনা।
ঈশার মা চোখ বন্ধ করে ফেলল। দুই ফোটা পানি চোখ বেয়ে পড়লো। ইভান হেসে আরও শক্ত করে হাত চেপে ধরে বলল
–কাদিওনা বড় মা। সব ঠিক আছে।
ঈশার মা নিজেকে আটকাতে পারলেন না। কেদে ফেলল হু হু করে। তার কান্না শুনে ঈশার বাবাও এগিয়ে আসলেন। ইভানের মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–এবার আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব। আমার কোন আফসোস থাকল না। ঈশার দায়িত্ত তোর থেকে ভালো কেউ নিতে পারবে না। তোরা সুখি হ।
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। তার চোখের কোনেও পানি চিকচিক করছে। আজকের দিনটা তাদের দুজনের জন্য এক অসীম সুখের দিন।
————
ইভান বারান্দায় দাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। ঈশা ধির পায়ে তার কাছে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ইভান একটু হেসে তাকে সামনে এনে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো। ঈশার হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা যখন ইভান তাকে বাঁচানোর জন্য এভাবে জড়িয়ে রেখেছিলো। অনেক কিছুই হতে পারত সেদিন। কিন্তু ভাগ্য ভালো হওয়ায় গুলিটা ইভানের কাধে লেগেছিল। আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যাওয়ায় বড় কোন দুর্ঘটনা থেকে বেচে গেছে। ঘটনার আগের দিন রাতেই ইভান ঈশাকে আরমানের কথা বলেছিল। ইভানের সাথে শত্রুতার কথাও জানিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু ঈশা সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। দুজন মানুষের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির তীব্রতা যে এতই বেশী হতে পারে সেটা ঈশার ধারনা ছিল না। আরমান এখন জেলে। ইভান তাকে মাফ করে কেস উইথড্র করে নিতে চাইলেও ঈশা সেটার সায় দেয়নি। সেদিন যদি ইভানের কিছু হয়ে যেত তাহলে ঈশা বাচতে পারতনা। সেই ঘটনার জন্য ঈশা আজও নিজেকে মাফ করতে পারেনা। ইভানের কথা গুলো বিশ্বাস করলে এতো কিছু হতনা। তাদের কোন বিপদ আসতই না।
–কি ভাবছিস?
ইভানের আওয়াজে ঈশা ভাবনা থেকে বের হয়। ধির কণ্ঠে বলে
–কিছু না।
ইভান একটু হেসে বলল
–তোর সব অনুভুতির সাথে আমি পরিচিত। আমাকে এসব বলে লাভ নেই।
ঈশা একটু হাসে। ইভানের বুক থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলে
–সব যখন জানই তাহলে জিজ্ঞেস করো কেন?
ইভান বিরক্ত হয়ে বলল
–তুই এতো বছরে আগের মতই থেকে গেলি। কোন পরিবর্তন হল না তোর। সব কিছুর আগে তোর জেদ।
ঈশা একটু রাগ করে বলল
–জানই তো আমি এরকম। এরকম দেখেই তো আমাকে ভালবেসেছ। আগে তো বলতে সব সহ্য করে নিবে। এখন কি হল? সহ্য হচ্ছে না?
ইভান ঈশার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে আনল। দাতে দাত চেপে বলল
–এটা ভাবিস না। সহ্য তোকে আমি সারাজিবন করবো। কারন তুই আমার। শুধুই আমার। তুই আমার কাছ থেকে কোনদিনও বাচতে পারবি না।
ঈশা নিজেকে ইভানের সাথে লেপটে নিয়ে বলল
–আমি চাইওনা। আমি সারাজিবন তোমার থাকতে চাই। শুধুই তোমার।
–বাবা ,বাবা!
আধো আধো কণ্ঠে ডাক শুনে ইভান ঈশাকে ছেড়ে দেয়। ঘরের দিকে চলে যায় দ্রুত পায়ে। ঘরে গিয়ে ইনায়াকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে
–আমার প্রিন্সেস চকলেট খাবে?
ইনায়া মাথা নাড়ায়। ইভান পকেট থেকে চকলেট বের করে প্যাকেট খুলে ইনায়ার হাতে দিয়ে দেয়। ইনায়া চকলেট খাচ্ছে। ইভান তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা পাশে এসে দাড়াতেই ইভান তাকে এক হাতে জড়িয়ে নেয়। ইভান দুজনকে জড়িয়ে রাখে নিজের সাথে। এই দুইটা মেয়ে তার জিবনের সব। তাদেরকে ছাড়া সে বাচার কথা চিন্তাই করতে পারেনা।
সমাপ্ত
(প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝে গল্পটা অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলো। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আর সব সময় আমি একটা কথা বলি যে আপনারা গল্পকে বাস্তবতার সাথে কখনও মেলাবেন না। গল্প কাল্পনিক। গল্পকে গল্পের মতই পড়বেন এটাই আমার অনুরোধ। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ ধৈর্য নিয়ে গল্পটা পড়ার জন্য।)