তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব ২ + ৩

0
5114

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব ২ + ৩
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২

ফোনের ওপাশ থেকে এমন তাচ্ছিল্যের আওয়াজ শুনে ইভান হাসল। বেশ শব্দ করেই হাসল। নিজের হাসি থামিয়ে বলল
–কামান আরমান! ডোন্ট লেট মি ডাউন। আমি তো ভেবেছিলাম তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আর কেউ না বুঝুক তুই তো অন্তত বুঝিস আমাকে। এতো দিনের শত্রুতা আমাদের। আমার সম্পর্কে তোর সব ধারণা থাকা উচিৎ ছিল। বলেছিলাম না যত কিছুই কর ঈশা আমার হবে। আমি আমার কথা রেখেছি।

ইভানের কথা শুনে আরমান রেগে গেলো। একটু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
–বিয়ে তো করেছিস আবার সেই মুহূর্তে বাড়ি থেকেও বের হয়ে গেলি। বউয়ের সাথে বাসর টা তো হল না। কি ভাগ্য তোর। এখন কি করবি? আমি তোর আর ঈশার মাঝে এতোটা দূরত্ব তৈরি করবো তুই এই জীবনে ঈশাকে পাওয়ার আশা ভুলে যাবি ইভান।

ইভান আবার হাসল। কিন্তু এবারের হাসি রহস্যময়। খুব শান্ত ভাবে বলল
–ঈশা আমার। ওকে নতুন করে পাওয়ার কিছুই নেই। আর বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ায় তুই এতো কষ্ট পেয়েছিস জানলে আমি এরকম কিছু হতেই দিতাম না। তোর কষ্ট আবার আমার সহ্য হয়না। এক মাত্র শত্রু বলে কথা। আমি তোর কষ্টটা একটু কমিয়ে দেই কি বলিস! আগামি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঈশা নিজেই আমাকে ডাকবে তার কাছে। অপেক্ষা কর। সময় হলেই সব জানতে পারবি।

বলেই ইভান ফোনটা কেটে দিলো। ফোনের স্ক্রিনে ঈশার জ্বলজ্বল করা ছবিটায় নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে হেসে বলল
–আই এম ওয়েটিং ফর ইউর কল জান পাখি।
বলেই ড্রাইভ করতে শুরু করলো। এইদিকে আরমান ফোনটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিলো। চিৎকার করে বলল
–এটা হতে পারেনা। ইভানের কাছে আমি হেরে যাবনা। কিছুতেই না। আমি ঈশাকে হাসিল করেই ছাড়বো।

–কিন্তু তুমি তো ঈশাকে ভালোবাসনা ভাইয়া।
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রিনি বলল। বোনের উত্তরে দাতে দাত চেপে আরমান বলল
–ইভানের জান ওই ঈশাতেই আটকে আছে। তাই তো আমি ঈশাকেই চাই। ইভানের কাছ থেকে যা কিছু কেড়ে নেই না কেন এতে তার কিছু ক্ষতি হবে মাত্র। কিন্তু ঈশাকে ছাড়া প্রানহীন হয়ে পড়বে। যা দেখতে আমার ভালো লাগবে। আমি সেটার লোভ সামলাতে পারছি না। ঈশা আমার জেদ। ইভানের সাথে এই যুদ্ধে জেতার এক মাত্র পুরষ্কার সে। আর এই পুরষ্কার আমিই হাসিল করবো।

বলেই হাসতে লাগলো। রিনি অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভাই জেদের বসে কোন ভুল করতে চলেছে কিনা সেটা বুঝতেই ব্যস্ত সে।

————-

অন্ধকার ঘরে সোফার উপরে হেলানি দিয়ে সামনের টেবিলে পা তুলে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে ইভান। বাইরে ডাইনিং থেকে হালকা আলো ঘরের ভিতরে আসছে। নিকোটিনের সেই উটকো গন্ধ সারা ঘরময় ছেয়ে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ইভানের ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি। হাসির কারন হল সামনে টিভির নিউজ। যেখানে ব্রেকিং নিউজের জায়গায় বড় বড় করে লেখা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আফজাল মাহমুদের এক মাত্র ছেলে ইভান মাহমুদ এর সাথে তার বড় ভাই আশরাফ মাহমুদের মেয়ে ঈশা মাহমুদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। নিউজটা ইভানই টিভিতে এভাবে প্রচার করার ব্যাবস্থা করেছে যাতে তার শত্রুরা এটা ভালো করে দেখতে পায়। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সেটা ফেলে দিয়ে গলা তুলে বলল
–আলি চাচা এক কাপ কফি।

ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো
–জি বাবা। এখনি আনছি।

কথা শেষ হতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ইভান বাইরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। যেন সে জানে কে এসেছে। নিজের পা নামিয়ে গা এলিয়ে বসে পড়ে। জেন সেই কাঙ্খিত ব্যক্তিটার অপেক্ষায়।

আলি চাচা দরজা খুলে দিতেই হাসি মুখে বললেন
–আরে ইলহাম বাবা ভিতরে আসেন।

ইলহাম একটু হেসে সাথে আরেকজনকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ইভানের ঘরের দিকে যেতেই আলি চাচা আবার বলল
–বাবা আপনারা কফি খাবেন তো?

ইলহাম হেসে বলল
–অবশ্যই চাচা। আপনার হাতের কফি না বলি কি করে।

আলি চাচা শব্দ করে হেসে রান্না ঘরে চলে গেলো।
দুজনকে ঘরে ঢুকতে দেখে ইভান দরজার দিকে তাকাল। ইলহাম আর আরাফ সোফায় গিয়ে বসলো। টিভির উচ্চ শব্দ কানে আসতেই তারাও সেদিকে ফিরে তাকাল। সাম্নের ব্রেকিং নিউজটা খুব মনজগ দিয়ে দেখল। ব্রেকিং নিউজ দেখে আরাফ বলল
–বাহ! তাহলে অবশেষে তোর মনের আশা পুরন হল।

ইভান একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
–এমনি এমনি তো হয়নি অনেক নাটক করেই করতে হয়েছে।

নিজের দৃষ্টি ইলহামের দিকে ফিরে বিরক্ত নিয়ে বলল
–তোর বোনের নাটক সামলাতে আমাকেই শেষ পর্যন্ত নাটকের আশ্রয় নিতে হল।

ইলহাম ইভানের দিক থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে সামনে টেবিলে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জালিয়ে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল
–তোরা দুইটাই ড্রামাবাজ। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি তোদের ড্রামার শেষ নেই।

ইভান হেসে বলল
–কি করবো বল তোর ড্রামাকুইন বোনের প্রেমে যখন থেকে পড়েছি তখন থেকে আমাকেও এসব শিখতে হয়েছে। না হলে যে তাকে সামলানো আমার পক্ষে অসম্ভব।

ইলহাম ইভানের দিকে তাকিয়ে চিন্তত হয়ে বলল
–বাড়ি থেকে তো বের হয়ে আসলি এখন কি করবি ভেবেছিস? আবার নিজের বাড়িতে উঠবি কিভাবে?

–তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আচ্ছা বাড়ির পরিবেশ কেমন এখন?
ইভান একটু আবেগি হয়ে গেল। সামনে টিভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ইলহাম কে।

–এখন মোটামুটি শান্ত। ছোট মা ছোট বাবা ৪ তলায় চলে গেছে। আর আমাদের বাড়িতে বাবা মাকে দেখলাম চুপচাপ।

ইলহামের কথার মাঝেই তাকে থামিয়ে দিয়ে ইভান বলল
–আর ঈশা?

ইলহাম ইভানের দিকে একবার তাকাল। তার চোখ সামনে টিভির দিকে থাকলেও মন যে অন্য খানে সেটা বোঝা যাচ্ছে বেশ। ইভান কে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–নিচে একবার দেখলাম। তোকে ছোট বাবা বের করে দিয়েছে সেটা শুনেই আবার উপরে চলে গেছে। ইরা কিছুক্ষন পর পর যাচ্ছিলো দেখতে। কিন্তু রাগ দেখানোর জন্য সেও আর যাচ্ছে না।

ইভান কিছু বলল না। সামনেই তাকিয়ে থাকলো নিস্পলক। ইলহাম সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইভানের দিকে তাকাল। তার মনের কষ্টটা বুঝতে চেষ্টা করছে। ইলহাম জানে সে এই মুহূর্তে অনেক কষ্ট পেলেও কাউকে বুঝতে দিবে না। ইলহাম ইভান কে খুব ভালো করে জানে। তারা এক সাথে ছোট বেলা থেকে বড় হয়েছে। একি সাথে পড়ালেখাও করেছে। খুব ভালো বন্ধু আবার কাজিন। দুজন দুজন কে খুব ভালো মতো জানে। ইভান তার বোন কে কতটা ভালবাসে সেটা তার উপলব্ধি করতে কষ্ট হয়না। কারন ছোট বেলা থেকে ইভান ঈশাকে কোন কষ্ট পেতে দেয়নি। ঈশার খেয়াল রেখেছে। কিন্তু আজ সে যা করেছে বাধ্য হয়ে। এতে ঈশা কষ্ট পেয়েছে ঠিকই কিন্তু তার থেকেও বেশি অপরাধবধ জমে গেছে ইভানের মাঝে। ইলহাম ইভানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলল
–ইভান!

ইভান গভীর ভাবনায় ডুবে থাকায় চমকে উঠলো। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে ইলহামের দিকে তাকাল। ইলহাম আবার বলল
–কিভাবে ঠিক করবি সব কিছু?

ইভান মাথা নিচু করে একটু হাসল। তারপর নিজের দৃষ্টি ইলহামের দিকে স্থির করে বলল
–আমি ঈশাকে কোন দিন আমার অভাব বুঝতে দেইনি। আর সেটা বুঝতে না পারলে আমার প্রতি তার মনে কোন অনুভুতি আছে কিনা সেটা কিভাবে বুঝবে।

ইভানের এমন রহস্যময় কথা কেউ বুঝতে পারল না। আরাফ ভ্রু কুচকে বলল
–তুই কি করতে চাইছিস?

ইভান আরাফের ঘাড়ে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলল
–দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায় বন্ধু।
বলেই নিজের এক চোখ টিপ দিলো। ইভানের কথা শুনে তিনজনই হাসল। কারন ইভান ঠিক কি বোঝাতে চাইছে সবাই সেটা বুঝতে পারছে।

তাদের কথোপকথনের মাঝেই আলি চাচা কফি নিয়ে এলো। কফির কাপ গুলো টেবিলে রেখে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকলো। ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান বুঝতে পেরে বলল
–কিছু বলবে চাচা?

আলি চাচা হাসি মুখে নিয়ে বলল
–বাবা ঈশা মামনিকে বিয়ে করছেন?

ইভান হাসল। তিনি ইভানের হাসি দেখে আবার বললেন
–আমি খুব খুশি হইছি। মামনি এই বাড়িতে আসবে না বাবা?

ইভান কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
–আসবে চাচা। সময় হলেই আসবে।

–মামনি এই বাড়িতে আসলে কত খুশি হবে। সব নিজের পছন্দের জিনিস যখন দেখবে তখন তার খুশির শেষ থাকবে না। সারা বাড়ির দেয়ালে ঝুলান মামনির ছবি গুলা যখন দেখবে তখন অবাক হয়ে যাবে। আমি ওই দিনটার অপেক্ষায় আছি বাবা। আমি ওইদিনটা দেখতে চাই।

বলে তিনি ঘাড়ের গামছা দিয়ে নিজের চোখ মুছে ফেললেন। আরাফ ইলহাম দুজনি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের এই বাড়িটা তার নিজের মতো করে বানানো। কিন্তু সব কিছু ঈশার পছন্দের। এই বাড়িতে ইভান কিছু বিশেষ ব্যক্তি ছাড়া কাউকে এলাউ করেনা। কারন হচ্ছে সারা বাড়িতে ঈশার বড় বড় ফ্রেমে টাঙ্গানো ছবি। তার যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন সে এই বাড়িতে এসে একা সময় কাটায়। ঈশার পছন্দের সব জিনিসের মাঝে ইশাকে খুজে নেয়ার চেষ্টা করে। আলি চাচা এই বাড়ির এক মাত্র কেয়ার টেকার। লোকটা খুব বিশ্বাসী আর ইভান কে বেশ ভালবাসে। নিজের ছেলের মতো। তার চোখের পানিই আজ বলে দিচ্ছে ঈশার প্রতি ইভানের ভালোবাসা কত তীব্র সেটা তারও দৃষ্টিতে এড়ায় নি। আর বুঝবেই না বা কেন। এতদিন পর্যন্ত ইভান নিজের কষ্টগুল সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে। কোন দিন তার প্রান প্রিয় বন্ধু ইলাহাম আর আরাফের সামনেই নিজের দুর্বলতা দেখায় নি। কিন্তু নিজের কষ্ট গুলো এই বাড়িতে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের চোখ থেকে ঝরিয়েছে গোপনে। এই মানুষটা ইভানের সেই সব গোপন কষ্টের সাক্ষী। তাই তো তিনি আজ ইভানের সুখের সময় আনন্দের অশ্রু বিসর্জন করছেন।

আলি চাচা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আরাফ ইভানের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল
–হায় রে প্রেমিক পুরুষ! তোর এই ভালবাসার সাক্ষী সারা দুনিয়া।

আরাফের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। আড্ডা দিতে দিতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। সামনে দেয়ালে বড় ঘড়ির দিকে তাকাল ইভান। রাত হয়ে গেছে। ১১ টা বাজে। ইলহাম কে বলল
–বাসায় কখন যাবি?

ইলহাম ইভানের দিকে তাকাল। সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলল
–তুই কবে যাবি?

ইভান একটু হেসে বলল
–তুই যা। আমি সময় হলেই যাব।

ইভানের কথা গুরুত্ত না দিয়েই ইলহাম ঘর থেকে বের হতে হতে হতাশার সুরে বলল
–কবে যে তোর সময় হবে? আর কি যে ভাবছিস তুই?

বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আরাফও ইভানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইলহামের সাথে চলে গেল। ইভান বসে বসে ভাবছে। ভাবছে না ঠিক; অপেক্ষা করছে। ইশার ফোনের অপেক্ষা। কখন তার প্রেয়সী অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তাকে ফোন করবে আর ডাকবে। তার ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ঈশার হাস্যজ্জল ছবিটা দেখেই ইভানের মনে খুশির জোয়ার উঠলো। কষ্টের মাঝেও এক অপরিসীম ভাল লাগা কাজ করছে। তার জিবনে এই মেয়েটাই সব। এই মেয়েটার কথা ভেবেই সে সব কস্ত হাসি মুখে মেনে নিতে পারে। ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে গেল। ইভানের কোন ভাবান্তর হল না। সে নিরবে এক রহস্যময় হাসি নিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আবারো ফোন বেজে উঠলো। নিজের ঠোটের হাসি প্রশস্ত করে এবার ফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোনটা রিসিভ করে বলল
–হ্যালো।
অপাশ থেকে ঈশার বিচলিত কণ্ঠ শোনা গেল।
–তুমি যেখানেই থাক তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আস। মা…মা অসুস্থ হয়ে গেছে। বারবার তোমার কথা বলছে।
ঠোঁটে হাসি চেপে অয়াবকের সুর টেনে ঈশাকে বলল
–কি হয়েছে বড় মার। আর তুই তো চাস না আমি অই বাড়িতে যাই।
–বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ। তোমার জেদের কারনে দেরি যেন না হয়ে যায়।
ঈশা কাদতে কাদতে বলল। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে শান্ত ভাবে বলল
–আসছি পাখি।

ঈশা সাথে সাথেই ফোনটা কেটে দিল। ইভান ফোনটা হাতে নিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে একটু হাসল। তারপর গাড়ির চাবিটা নিতে নিতে বলল
–দেরি তো হবেই না। তুই ডেকেছিস আর আমি দেরি করবো। কিভাবে সম্ভব জান?
বলেই বের হয়ে চলে গেল।

চলবে……।

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩

সারা ঘরময় নিরবতায় ছেয়ে আছে। সবাই চিন্তিত চেহারা নিয়ে সামনে নিজেদের দৃষ্টি স্থির রেখেছে। সামনের বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ঈশার মা। ঈশা এক পাশে বসে আফসানা বেগমের ঠাণ্ডা হাত নিজের দুই হাতে ঘসেই যাচ্ছে। তিনি একটু পর পর কেঁপে উঠছেন। এই নীরবতার মাঝে ইরার গলার আওয়াজ পেয়ে সবাই দরজার দিকে তাকায়।
–ভাইয়া তুমি এসেছ।

ইভান দরজায় দাড়িয়ে ঈশার মার দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে। সবাই ইভানের দিকে তাকালেও সে একবারও চোখ তুলে কারও দিকে তাকাল না। ধির পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিচে হাঁটু গেড়ে বসে ঈশার মায়ের মাথায় হাত দিয়ে খুব সাবধানে ডাকল
–বড় মা।

তিনি গলার আওয়াজ শুনে পিট পিট করে চোখ খুলে তাকালেন। কয়েকবার পলক ফেলে ইভানের দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করে ক্লান্ত গলায় বললেন
–তুই এসেছিস বাবা। কোথায় চলে গিয়েছিলি?

ইভান খুব সাবধানে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–কি হয়েছে তোমার? কি নিয়ে এত ভাবছ?

ঈশার মা চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি ফেলে বললেন
–তুই আর কোথাও যাস না বাবা। আমি সুস্থ হয়ে যাব।

ঈশা উঠে এক পাশে সরে দাঁড়াল। ইভান উপরে উঠে আফসানা বেগমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসলো। আফসানা বেগম সবার দিকে একবার তাকাল। তারপর নিজের কণ্ঠ একটু গম্ভির করে বলল
–যে যাই বলুক তুই আর কোথাও যাবি না।

আফসানা বেগমের এই অসুস্থ অবস্থায় বলা কথার প্রেক্ষিতে কেউ কথা না বললেও ইভানের বাবা বলল
–ভাবি আপনি ওর সব অপরাধ এত সহজে কিভাবে ভুলে যাচ্ছেন?

আফসানা বেগম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন
–ভুলে যাস না আমাদের পরিবারের একটা মান সম্মান আছে। আমাদের পরিবারের ব্যপার আমরা নিজেরাই মিটে নিব। এসবের জন্য মানুষকে কথা বলতে দেয়া মানে বোকামির পরিচয় দেয়া। ইভানকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিস সেটা যদি একবার বাইরে সবাই জানতে পারে পারবি সেসবের উত্তর দিতে। আর এই সিদ্ধান্তের জন্য শুধু ইভান না ঈশাকেও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

–কিন্তু ভাবি……।

ঈশার বাবা এতক্ষন সব চুপ করে শুনছিলেন। ইভানের বাবাকে তিনিও থেমে দিয়ে বললেন
–এই বিষয়ে আর কোন কথা আমি শুনতে চাইনা। কোন কথাই হবে না। ইভান বাসা থেকে কোথাও যাবে না।

কেউ তার কথার প্রেক্ষিতে আর কথা বলার সাহস করল না। সবাই তার সিদ্ধান্ত মেনে নিল। কারন তার স্ত্রীর কথা গুল একদম সত্যি সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই তিনিও ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলেন। যা হবার হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করাই ভাল। হয়ত তাদের ভাগ্য এমনি ছিল। কিন্তু এতো কিছুর মাঝে ইভান কোন কথাই বলছে না। সে একদম শান্ত। নিজের দৃষ্টি হাতের উপরে স্থির রেখেছে। তার ঠিক সামনেই দাড়িয়ে আছে ঈশা। চোখ ফিরিয়ে একবার ইভানের দিকে তাকাল। এই সিদ্ধান্ত ঈশার মনেও কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। ইভানের বাড়ি থেকে বের হয়ে জাওয়ার কথা শুনে তার মনটা খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এখন একটু হলেও মনের কষ্টটা কমে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল ইভান আসার পর থেকে একবারও ঈশার দিকে তাকায়নি। আগে এরকম কখনও হয়নি। ঈশা ইভানের সামনে থাকলে সে ঈশাকে দেখতেই ব্যস্ত হয়ে থাকত। একদিনে এত পরিবর্তন ভেবেই ঈশার মন খারাপ হয়ে গেল। ঈশা নিজের চোখ ফিরিয়ে নিল। ইভান আড় চোখে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশার মন খারাপ দেখে তারও মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সাভাবিক করে নিল। কারন এই মুহূর্তে এই ছোট ছোট অনুভুতি গুলকে গুরুত্ত দিলে ঈশার মনে তার জন্য যে অনুভুতি আছে সেগুল কন দিন ঈশা প্রকাশ করবে না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিল। এক রাশ মন খারাপ নিয়ে বলল
–বড় মা তুমি রেস্ট নাও।

–তুই আমার কাছে একটু বসবি বাবা?
ইভান কে উদ্দেশ্য করে আফসানা বেগম বললেন। ইভান তার কথা শুনে ম্লান হেসে বলল
–আমি এখানেই আছি।

সবাই ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল তাকে রেস্ট নিতে দিতে। ইরা চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল। সবাই ঘর থেকে বের হয়ে জেতেই ইরা ঘরের দরজা লক করে দিল। আফসানা বেগম একবার ভাল করে দেখে নিয়ে উঠে বসলেন। তারপর গভির ভাবে তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ইরা এসে ইভানের কাছে বসল। ঈশার মা ইভানের দিকে তাকিয়ে বললেন
–জাক বাবা অবশেসে সব ঠিক হল।

ইভানও হাসল। ইরা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–বড় মা তুমি তো ভালই অভিনয় করতে পার। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। না জানি যদি ধরা পড়ে যাই। কেউ যদি কোন ভাবে জানতে পারে এটা পুরোটাই আমাদের প্ল্যান তাহলে খুব খারাপ হবে। এবার ভাইয়ার সাথে সাথে আমাদের সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।

ইভান একটু হেসে বলল
–ভাবিস না ইভানের প্ল্যান আজ পর্যন্ত কোন ভাবেই ফেইল হয়নি। আর এটাও হবে না।

তাদের কথার মাঝেই দরজায় নক করার আওয়াজে ইরা চমকে উঠে। কেউ শুনে ফেলল না তো আবার! কেউ শুনলেই তাদের তিনজনের জন্য বিপদ। ঈশার মা তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়ে। ইভান ফিস ফিস করে ইরাকে দাতে দাত চেপে বলে
–তুই এভাবে ভয় পেলে কেউ বুঝুক আর না বুঝুক ঈশা ঠিকই বুঝে যাবে। নিজেকে সাভাবিক কর।

ইভানের কথা শুনে ইরা জোর জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সাভাবিক করে দরজা খুলে দিল। ঈশা বেশ অবাক হল। ভ্রু কুচকে ইরার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
–দরজা বন্ধ করে কি করছিলি?

ইরা দাত কেলিয়ে বলল
–বাইরে থেকে শব্দ আসছিল তো বড়মার অসুবিধা হচ্ছিল তাই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

বলেই পাশ ফিরে ঈশাকে ঢুকতে সাইড দিল। ঈশা ঘরে ঢুকে এক পাশে দাড়িয়ে গেল। ইভান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল
–বড় মা তুমি এখন ঘুমাও। আমি বাসায় যাব।

–সারাদিন কিছু খেয়েছিস বাবা?

আফসানা বেগম চোখ ছোট ছোট করে ইভান কে প্রশ্ন করে। ইভান উঠতে উঠতে বলে
–ক্ষুদা নেই বড় মা।

ইভান সারাদিন না খেয়ে আছে শুনেই ঈশা কষ্ট পেল। তার মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল।
ইভান আবার ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই কি এখনি যাবি? নাকি পরে?

–পরে যাব ভাইয়া তুমি যাও।
ইভান ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঈশার মা চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ইরা ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–আপু আমি আছি। তুমি যাও।

ঈশা একটু হেসে ইরার মাথায় হাত দিয়ে বের হয়ে গেল। ইভান এখন ইলহামের ঘরে তার সাথে কথা বলছে। এই দিকে ঈশা ডাইনিং এ পাইচারি করছে। ইভান ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ঈশা নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে টেবিলে বসে পড়লো। ইভান ঈশাকে খেতে দেখে একবার তার দিকে তাকাল। তারপর নিজের চোখ নামিয়ে নিয়ে চলে জেতে গিয়েও দাড়িয়ে গেল। দরজা খুলেও আবার বন্ধ করে দিয়ে ঈশার সামনে এসে দাঁড়াল। ঈশা খাবার মুখে তুলতে যাবে তখনি তার হাত ধরে ফেলল। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–এখন কি খাবার খাওয়ার জন্য তোমার পারমিশন লাগবে?

ইভান অগ্নি দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলে ইভান আরো শক্ত করে ধরে বলল
–বলেছি না আমি না চাইলে তুই নিজেকে ছাড়াতে পারবি না।

বলেই প্লেটটার দিকে তাকিয়ে বলল
–এগুলা কেন খাচ্ছিস?

ঈশা এবার রেগে বলল
–এগুলা নিশ্চয় কোন অখাদ্য না। রান্না করা খাবার।

–আমার চোখ আছে। সেটা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু রেড মিট কেন? বাড়িতে অন্য খাবার নাই।

একটু ধমকে বলল ইভান। ঈশা কিঞ্চিত ভয় পেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–আছে কিন্তু এই মুহূর্তে আমার এটাই খেতে মন চাচ্ছে। আমি এখন এটাই খাব।

ইভান রাগ করে প্লেট টা সামনে থেকে সরিয়ে দিল। কিন্তু ঈশাও নাছোড়বান্দা। সে আবার সেটাকে টেনে সামনে নিয়ে আসল। ইভান ততক্ষনে ঈশার হাত ছেড়ে দিয়েছে। সে আবার সেই প্লেট থেকে রেড মিটের একটা টুকরো তুলে মুখে দিতে যাবে তখনি ইভান তার হাত ধরে ফেলে। নিজের মুখটা হাতের কাছে এনে ঈশার হাত থেকে খাবারটা খেয়ে নেয়। তারপর চিবুতে চিবুতে বলে
–তোর রেড মিটে এলারজি সেটা কি মাথায় আছে?

ঈশা প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার কাছে ঔষধ আছে। খাবার খেয়ে ঔষধ খাব।

ইভান এবার রাগ করে প্লেট টা তুলে নিয়ে সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–তুই এভাবে কথা শুনবি না। ভাল কথা তোর হজম হয়না।

বলেই প্লেটের খাবার টা খেতে শুরু করল। ইভান খাচ্ছে আর ঈশা তাকে দেখছে। সব খাবার শেষ করে ঈশার হাতে প্লেটটা ধরে দিয়ে বলল
–নে এবার খা। যত ইচ্ছা খা।

বলেই হাত ধুতে বেসিনের সামনে দাড়িয়ে ইভানের মনে হল সে সব খাবার খেয়ে ফেলল কিন্তু ঈশা কিছুই বলল না। এতটা শান্ত কিভাবে? ঈশা তো শান্ত থাকার মেয়ে না। নিশ্চয় কোন রহস্য আছে। ইভান ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। ঈশা নিজের প্লেট আগেই সাজিয়ে রেখেছিল। সেখান থেকে খাবার তুলে খাচ্ছে। ইভান ভাল করে খেয়াল করল সেখানে কোন রেড মিট নেই। তার মানে ঈশা রেড মিট তার জন্য না ইভানের জন্য এনেছিল। তাকে খাওয়ানোর জন্য পুরো নাটক। কি ড্রামাবাজ মেয়ে রে বাবা! ইভান হাত ধুয়ে পানি খাওয়ার জন্য এসে আবার আগের জায়গাতেই বসে পড়লো। গ্লাসে পানি ঢেলে একটু খেয়ে বলল
–এসব নাটক করে কি বোঝাতে চাস?

ঈশা মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছিল। ইভানের মুখে এমন কথা শুনে খাবার গলায় আটকে গেল। ইভান নিজের গ্লাসটা এগিয়ে দিল। ঈশা পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস নিল। ইভান ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বিচলিত হয়ে বলল
–তুই ঠিক আছিস পাখি?

ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান আবার নিজের জায়গায় এসে বসলো। খুব শান্ত ভাবে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–জান? তুই কি সত্যিই আমাকে বুঝতে পারিস না? তোর কি মনে হয় আমি অন্যায় করেছি?

ঈশা নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বলল
–আমার মনে হওয়া না হওয়াতে এখন আর কিছুই যায় আসেনা। আগের মত আর কিছুই নাই।

–তুই চাইলেই সব আগের মত হয়ে যাবে।
বলেই ইভান উঠে গেল। ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–আমি চাইনা।

ইভান দরজা খুলে পিছনে ঘুরে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–ওই ফুলটুসি! এত জেদ কিন্তু ভাল না। যখন আমার সময় আসবে তখন কিন্তু আমি সব কিছুর হিসাব নিব। মনে রাখিস।

ইভানের কথা শুনে ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ‘ফুলটুসি’ শব্দটা ঈশার মেজাজ নিমিশেই গরম করে ফেলে। আর ইভান সেটা খুব ভাল করেই জানে। তাই তো ঈশাকে ছোট বেলা থেকেই এই নামটা বলেই রাগায়। ঈশাকে রাগতে দেখে ইভানের খুব হাসি পেল। সে একটু হেসে বের হতে যাবে তখনই ঈশার ফোন বেজে উঠলো। ঈশা ফোন কারও আসার কথা বলছিল। ইভান কারও আসার কথা শুনে থেমে গেলো। নামটা কানে আসতেই রাগে তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো।

চলবে……।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here