তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব ৮
লেখক-এ রহমান
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। রাত ৯ টা বাজে এই সময় এই বৃষ্টির সাথে ধোঁয়া উঠা এক কাপ কফি বেশ লাগবে। বারান্দায় দাড়িয়ে কফির কথা ভাবতেই ঈশার বাইরের দরজার দিকে চোখ পড়লো। একটা গাড়ি বাইরে দাড়িয়ে হর্ন দিচ্ছে। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই ঈশা ভালো করে নিচে তাকাল। গাড়িটা দেখেই বুঝে গেলো ইভান এসেছে অফিস থেকে। তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। আজ সারাদিন তার সাথে ইভানের দেখা হয়নি। এমন কি সকালে তাকে ভার্সিটিও নিয়ে যায়নি। ঈশা তার বন্ধুদের সাথে গিয়েছে আজ। ইভান নাকি কি একটা কাজে খুব ব্যস্ত। তাই ঈশা ঘুম থেকে উঠার আগেই অফিসে চলে গিয়েছে। তাই সে ধরেই নিলো যে ইভান তার কাছে আসবে। তাকে এক নজর দেখতে। তাই বারান্দা থেকে ঘরে গিয়ে বিছানায় বসলো। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেলো কিন্তু ইভানের কোন খবর নেই। বারবার ঘড়ি দেখছে ঈশা। আজ অপেক্ষার প্রহরটা বড্ড বেশি জ্বালাময় মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে তার কাছে দুনিয়াতে সব থেকে কি বেশি কঠিন তাহলে সময় নষ্ট না করে এক কথায় বলবে ‘অপেক্ষা’। তার কাছে এটাই এখন প্যারাময় মনে হচ্ছে। তাহলে ইভান কিভাবে সহ্য করে। এতো বছর তার জন্য অপেক্ষা করেছে। এখন বিয়ের পরেও অপেক্ষা করছে ঈশার চোখে তার জন্য ভালবাসা দেখার। কিন্তু ঈশা কি তাকে ভালোবাসে? আজ এই যে সে ইভানের জন্য অপেক্ষা করছে। এটা কি ভালবাসা নাকি মায়া। আজও ঈশার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে সে আসলেই ইভান কে ভালোবাসে কিনা। সে নিজেই এখনও বুঝতে পারছে না তাহলে ইভান কে কিভাবে বোঝাবে? ভাবতে ভাবতেই আনমনে নিজের সাথেই বলল
–আমি কিভাবে বুঝবো ইভান কে ভালবাসি কিনা? ইভান কিভাবে বুঝেছিল আমাকে ভালোবাসে? ইভানের মতে এটা যদি তার প্রতি আমার মায়া হয়ে থাকে তাহলে ভালবাসা কোনটা? কি আজব একটা বিষয়। ছোট্ট একটা শব্দ কিন্তু তার গভীরতা মাপার ক্ষমতা সবার হয়না। কেন এমন হচ্ছে?
ভাবনা থেকে বের হয়ে সামনে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল রাত ১০ টা বাজে। এখনও ইভানের কোন খবর নেই। আর কিছু না ভেবেই ঈশা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বাইরের দরজা খুলতেই তার মা জিজ্ঞেস করল
–কোথায় জাচ্ছিস এতো রাতে?
–৪ তলায় জাচ্ছি।
ঈশা তার মায়ের দিকে না তাকিয়েই কথাটা বলে বের হয়ে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবছে কি এক পরিক্ষার মাঝে পড়ে গেলো। কিভাবে বুঝবে সে ইভান কে ভালোবাসে কিনা। ভাবতে ভাবতেই ৪ তলায় নেমে গেলো। দরজা খুলে ঢুকতেই দেখল ইরা সোফায় বসে সিরিয়াল দেখছে। ঈশাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
–আপু তুমি এই সময়?
ঈশার কিছুই ভালো লাগছিল না। মাথায় সেই একি কথা ঘুর পাক খাচ্ছিল। তাই বিরক্ত হয়ে বলল
–কেন আমি রাতে আসলে কি সমস্যা?
ইরা বুঝতে পারল তার এমন প্রশ্নে সে খুব বিরক্ত হয়েছে তাই আর কিছু বলল না। ঈশা বিরক্ত নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল
–তোর ভাইয়া কোথায় রে?
–ঘরে।
ইরা মোটামুটি অবাক হয়েই উত্তরটা দিলো। ঈশা আর দেরি না করে দ্রুত পায়ে ইভানের ঘরে গেলো। দরজা লাগা ছিল। কয়েকবার নক করেও ভিতর থেকে কোন সাড়া আসল না। ঈশা দরজা ঠেলে ঢুকে দেখে ইভান বিছানায় অগোছালো ভাবে শুয়ে আছে। অন্ধকার ঘরটাতে বাইরের ল্যাম্পোস্টের আলো ঢুকে কিছুটা দৃশ্যমান হয়েছে। ঈশা বিছানায় গিয়ে বসলো। ইভানের কোন হেলদোল নেই। ঈশা ভালো করে খেয়াল করে দেখল ইভান ঘুমিয়ে পড়েছে। তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। মনে হল আগের রাতে সারারাত ঘুমায়নি। ঈশা আর বিরক্ত করল না। একবার তার সারা মুখে নিজের হাতটা বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিলো। জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে ডিম লাইট জালিয়ে দিলো। ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই পাশের সাইট টেবিলের উপরে চকচকে একটা বস্তু চোখে পড়তেই সেদিকে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে গিয়ে সেখানে নিচু হয়ে বসে সেটা হাতে নিতেই চমকে গেলো। এটা তো সেই চেন। কিন্তু এখানে এভাবে কেন? এটা তো ইভান কখনও গলা থেকে খোলেনা। এই চেনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটার লকেটটা হার্ট শেপের অর্ধেক আর বাকি অর্ধেকটা ঈশার গলায়। ইভান তাকে এটা তার কোন এক জন্মদিনে দিয়েছিল। নিজে ডিজাইন করে এমন ভাবে লকেটটা বানিয়েছিল যা দুইটা লকেট ভাজে ভাজে মিলিয়ে দিলে বোঝা যায় এটা একটা পুরনাঙ্গ হার্ট শেপ। সবাই খুব পছন্দ করে। কিন্তু এটা এভাবে খুলে রাখা কেন? ইভান তো নিজেই বলেছিল এটা যেন কোন দিন সে গলা থেকে না খুলে আর ঈশা তার পর থেকে খুলেও নি। কিন্তু ইভান আজ কেন খুলে রেখেছে? ঈশার বেশ অভিমান হল। সে একটু রাগ করে চেনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো। বাইরে যেতেই ইভানের মায়ের সাথে ধাক্কা খেল। ইভানের মা তাকে দেখে বলল
–তুই কখন এসেছিস?
–এই তো ছোট মা একটু আগেই।
–ওহ! এসেছিস যখন খেয়ে যাবি কিন্তু। ইভান কে ডেকে নিয়ে আয় খাবে।
–তোমার ছেলে ঘুমাচ্ছে ছোট মা। ডেকনা। ভিশন টায়ার্ড।
–ওহ! কাল রাতে ঘুমায়নি। আবার সেই সকালে বেরিয়ে গেছে। আচ্ছা থাক ঘুম থেকে উঠে নিজেই খেয়ে নিবে। তুই খেয়ে নে।
–আমি খাবনা ছোট মা। খিদে নেই।
বলেই ঈশা আর উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলো।
———-
ঘড়ির অ্যালার্ম বাজতেই ঈশা চোখ বন্ধ করেই এক হাতে সেটা বন্ধ করে দিল। রাতে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডা। কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাতে বেশ লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। এখনি উঠতে হবে। ভার্সিটি জেতে হবে। উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে নামলো। গিজার টা অন করে দিয়ে আলমারি খুলল কাপড় বের করার জন্য। শাওয়ার নিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছিল তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রিমার কল। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বাজখাই কণ্ঠে রিমা বলল
–কই তুই কখন থেকে তোর বাসার নিচে দাড়িয়ে আছি।
রিমার কথা শুনে ঈশা নিজের ঠোট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–আসছি।
কথা শেষ করে ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে হাতে ঘড়ি পরতে পরতে নিচে নামলো। ঈশার মা টেবিলে খাবার দিচ্ছিল। ঈশাকে এভাবে বের হয়ে জেতে দেখে থামিয়ে দিয়ে বলল
–না খেয়ে কোথায় জাচ্ছিস?
–দেরি হয়ে যাচ্ছে মা খাবনা।
বলেই দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। ঈশা লিফটের সামনে দাড়িয়ে আছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বারবার বাটন প্রেস করছে যেন জতবার প্রেস করবে তত তাড়াতাড়ি লিফট এসে যাবে। লিফট এসে থামতেই সেটাতে উঠে গেলো। দো তলায় গিয়ে লিফট আবার থেমে গেলো। দরজা খুলতেই একটা সাদা মাটা কিন্তু বেশ সুন্দরি মেয়ে উঠে পড়লো। ঈশাকে দেখে একটু হাসল। ঈশাও এক রাশ বিরক্তি নিয়ে হাসি দিল। মেয়েটা খুবি নরম সরে ঈশাকে জিজ্ঞেস করল
–আপনি কয় তলায় থাকেন?
–৫ তলায়।
ঈশা বিরক্তিকর সরে উত্তর দিল। ঈশার উত্তর শুনে মেয়েটা আবারো বলল
–আমি দো তলায় থাকি। গত মাসে উঠেছি। আপনার নাম…।
–ঈশা মাহমুদ।
–ওহ! আমি সারিকা।
ঈশা ঠোট এলিয়ে হাসল। কোন কথা বলল না। লিফট নিচে এসে থামতেই মেয়েটার পিছু পিছু ঈশা বের হয়ে গেলো। বাইরে গিয়ে সামনে তাকাতেই থেমে গেলো। রিমা ইভানের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে। ঈশা ধির পায়ে সামনে তাকিয়েই আগাতে লাগল। ঈশাকে দেখেই রিমা হেসে বলল
–কত দেরি করলি বলত? কখন থেকে দাড়িয়ে আছি।
ইভান পিছনে ঘুরে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশাও ইভান কেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়ায় ঈশা নিজের চোখ নামিয়ে নিল। ইভান একটু হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে এক ছেলে এসে ঈশার সামনে দাড়িয়ে হাসি মুখে বলল
–অনেক্ষন থেকে দাড়িয়ে আছি। দেরি হল যে? কোন সমস্যা?
ঈশা ছেলেটার দিকে একবার তাকিয়ে সামনে তাকাল। ইভান গাড়িতে হেলানি দিয়ে হাত গুজে খুব সাভাবিক ভাবেই ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার মাথা নামিয়ে না সুচক মাথা নাড়াল। ছেলেটা আবারো বলল
–এবার চল না হলে ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে।
ঈশা চোখ নামিয়ে খুব ছোট্ট করে “হুম” বলল।
–কি হল কথা বলছ না যে? তোমার কি শরীর খারাপ?
এবার ছেলেটার কথা শুনে ঈশা শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। সে ভাল ভাবেই বুঝতে পারছে তার কপালে শনি আছে। এভাবে ঈশার সাথে কেউ কথা বলুক সেটা ইভান কোন ভাবেই মেনে নিবেনা। এর আগেও বেশ কয়েকজনকে এই অপরাধে মন মত পিটিয়েছে। এবার মনে হয় এর পালা। ঈশার এই মুহূর্তে ইভানের চেহারাটা খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু সাহস হচ্ছে না। সে চোখ নামিয়েই জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। সেই সময় রিমা এগিয়ে এসে বলল
–ইভান ভাইয়া ও হচ্ছে মেঘ আমাদের বন্ধু।
রিমার গলার আওয়াজ শুনে মেঘ ঘুরে তাকাল পিছনে। ইভান গাড়ির সাথে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল
–আমি মেঘরাজ।
ইভানও একটু হেসে হাত মিলিয়ে বলল
–আমি ইভান মাহমুদ।
–ইভান মাহমুদ? আপনিই সেই যে অল্প বয়সে বিজনেসে অনেক ফেমাস হওয়ার জন্য বেস্ট বিজনেস ম্যান এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মেঘ। ইভান হেসে মাথা নাড়ল। মেঘ এবার বেশ অবাক হয়ে বলল
–আপনি এখানে?
ইভান উত্তর দেয়ার আগেই রিমা বলল
–ঈশার কাজিন।
–ওহ আচ্ছা! বেশ ভাল। ভাইয়ার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল।
ইভান অনিচ্ছাকৃত হেসে বলল
–আমারও।
–আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ আসি। অন্য দিন বাসায় আসব আপনার সাথে গল্প করতে।
–সিওর।
ইভানের উত্তর পেয়েই মেঘ ঈশার দিকে ঘুরে বলল
-চল।
ঈশা মাথা তুলে একবার ইভানের দিকে তাকাল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। কারন গতকাল ইভান ব্যস্ত ছিল বলে ঈশা তাদের সাথে গিয়েছিলো। কিন্তু আজ সে নিজেই তাকে নিয়ে জাওয়ার জন্য দাড়িয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারল না। পরিস্থিতিটাই এমন যে তারা ঈশাকে নিতে অনেক্কখন যাবত দাড়িয়ে আছে। না বলাটা শোভনীয় নয়। আবার এই দিকে ইভান। ঈশার এমন ইতস্তত বোধ দেখে ইভান গাড়িতে বসে পড়লো। জানালার গ্লাসে ঈশার দিকে একবার দেখে নিয়ে স্টার্ট দিলো। ঈশা সেদিকে তাকাতেই ইভানের চোখে চোখ পড়লো। ভয় পেয়ে মাথা নামিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। ওরা তিনজন গিয়ে মেঘের গাড়িতে বসলো। ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের যাওয়া দেখছে। গাড়িটা চলে যেতেই ইভান পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ফোন করে বলল
–মেঘরাজের সব ডিটেইল আমার আজকের মধ্যে চাই।
কথা শেষ হতেই ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে গাড়িতে বসে সামনে তাকিয়ে বলল
–আমি যে এসব কোন ভাবেই মেনে নিব না। তুই শুধু আমার। তোর উপরে সমস্ত অধিকার শুধুই আমার। তোকে নিয়ে সব ভাবনা শুধু আমার হবে। এই অধিকারটা আর কাউকে আমি দিবনা। আর কেউ তোর উপরে অধিকার দেখালে সেটা ছিনিয়ে নিতে আমার একদম সময় লাগবে না।
একটু থেমে আবার অসহায়ের মত বলল
–অনেক সহ্য করেছি জান। তোর সব অন্যায় আবদার এতদিন আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু আর সম্ভব না। এতদিন তুই আমার ভালবাসা দেখেছিস। কিন্তু আফসোস সেটা কাছ থেকে দেখেও বুঝতে পারিস নি। আর এখন আমার আরেকটা রুপ দেখবি। আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি তোর সাথে এমন করার। তুই আমাকে বাধ্য করছিস। আমি তোর প্রতি যতটা সফট হতে পারি ঠিক ততটাই রুড হতে পারি।
চলবে………