তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব ৯,১০
লেখক-এ রহমান
ধোঁয়া উঠা এক কাপ কফির সাথে উটকো গন্ধ যুক্ত নিকোটিনের ধোঁয়ার কম্বিনেশন টা ইভানের বেশ প্রিয়। তার একাকিত্তের খুব ভাল বন্ধু। নির্ঘুম রক্তিম চোখ জোড়া দিয়ে বেল্কুনিতে দাড়িয়ে সামনের সকালের সূর্য উঠার দৃশ্য উপভোগ করছে সেই কফি আর সিগারেটের সাথে। কাল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি সে। জেগে জেগে নিস্পলক প্রেয়সীর ছবির দিকে তাকিয়ে ছিল। ঈশাকে হারানোর ভয়টা তাকে দিনদিন তীব্র ভাবে গ্রাস করছে। কোন ভাবেই এই ভয় থেকে বের হতে পারছে না। আর না পারছে ঈশাকে বোঝাতে। এই ভেবেই তার রাত পার হয়ে যাচ্ছে। সূর্যটা তার তেজ ছড়াতে শুরু করেছে। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে ফেলে দিল। রুমে এসে কফির কাপটা রেখে শাওয়ার নিতে গেলো। শাওয়ার নিয়ে অফিসের জন্য রেডি হয়ে নিচে নামলো। সালেহা বেগম নাস্তা রেডি করে রেখেছে ছেলের জন্য। নিচে এসে ইভান হালকা কিছু খেয়েই বেরিয়ে গেলো। সাদা শার্ট এর সাথে ব্ল্যাক প্যান্ট বেশ মানিয়েছে তাকে। শার্টের দুইটা খোলা বোতামের ভাজে সানগ্লাসটা ঝুলান। এক হাতে ব্লেজারটা নিয়ে আরেক হাতে ফোন টিপতে টিপতে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল। বাটন প্রেস করে ফোনের দিকে তাকিয়েই অপেক্ষা করছে। লিফট এসে থেমে গেলো। দরজা খুলতেই চোখ তুলে তাকাল ইভান। লিফটের মাঝখানে ঈশা দাড়িয়ে আছে। ঈশাকে খুব শান্ত দৃষ্টিতে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে চোখের পলক ফেলে ভিতরে ঢুকল। এদিকে ইভান কে দেখে ঈশার ভয়ে দম বন্ধ হয়ে জাওয়ার উপক্রম। কারন কালকের পর থেকে তাদের দেখা হয়নি। ঈশা ভাবছে ইভান হয়ত কালকের ঘটনার জন্য তাকে রাগ দেখাবে। তাই গুটি সুটি মেরে এক কোনায় গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ঈশার সমস্ত ধারনা ভুল প্রমান করে দিয়ে ইভান লিফটের দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে ফোনের মধ্যে আবারো ব্যস্ত হয়ে গেলো। ঈশা লিফটের সামনের দেয়ালে ইভানের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ইভানের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে চোখ তুলে একবারও ঈশার দিকে তাকাল না। লিফট এসে আগের দিনের মত দো তলায় দাঁড়াল। দরজা খুলতেই সেই সুন্দরি মেয়েটা লিফটে উঠেই একটা হাসি দিয়ে অবাক হয়ে বলল
–আপনি ইভান ভাইয়া না?
ইভান এতক্ষন ফোনেই ব্যস্ত ছিল। মেয়েটার গলা শুনে চোখ তুলে তাকাল। একটু হেসে বলল
–হ্যা। কিন্তু আপনাকে…।
ইভানের কথা শেষ করতে না দিয়েই মেয়েটা আবার বলল
–আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার সাথে আমার বাবা কোন একটা প্রজেক্টে কাজ করেছেন। উনি সব সময় আপনার কথা বলেন। আমি আসলে তার কাছেই আপনার ছবি দেখেছি। আজ সামনা সামনি দেখলাম।
ইভান একটু হাসল। সারিকা ঈশার দিকে ঘুরে বলল
–আরে ঈশা কেমন আছেন?
–ভালো।
ঈশার বিরক্তিকর ভয়েস শুনে ইভান তার দিকে তাকাল। ঈশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান চোখ সরিয়ে আবারো ফোনের দিকে তাকাল। ঈশার সেই দৃষ্টির মানে ইভানের বুঝতে বাকি থাকল না। আবার চোখ তুলে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আপনি কি এই বিল্ডিঙে থাকেন মিস……।
–সারিকা। হ্যা আমরা দো তলায় থাকি।
–ওহ! নাইচ টু মিট ইউ।
ইভান একটু হেসে বলতেই মেয়েটা নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। ইভান আড় চোখে একবার ঈশার দিকে তাকিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের হাত মেলানোর মাঝেই লিফট নিচে এসে থেমে যায়। দরজা খুলতেই ঈশা দ্রুত পায়ে বের হয়ে যায়। ঈশার পিছনে ইভানও বের হয়ে আসে। সামনে এসেই দেখে ইলহাম দাড়িয়ে আছে। আজ ইলহাম ঈশাকে ভার্সিটি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। তাই সে ঈশার আগেই নিচে এসে দাড়িয়ে আছে। ইভান আর ঈশাকে এক সাথে আসতে দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেলে। ইভান সামনে এসে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে
–কোথায় জাচ্ছিস?
–সাইটে যাব। ক্লায়েন্ট এসেছে। তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
ইলহাম বলেই ঈশার দিকে তাকাল। ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–বল?
–তুই একটু ঈশাকে ভার্সিটি নামিয়ে দিবি। আমি গেলে দেরি হয়ে যাবে।
ইভান ইলহামের কথা শুনে অভিমানের সুরে বলে
–তোর বোন যাবে আমার সাথে?
ইভানের কথা শুনে ইলহাম ঈশা দুজনে বেশ অবাক হল। ইভান আগে কখনো এভাবে কথা বলেনি। কিন্তু আজ কি হল। ইলহাম বুঝতে পারল কোন কারনে ইভান ঈশার উপরে অভিমান করেছে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে বলল
–কেন যাবেনা? কি যে বলিস না। আচ্ছা আমি গেলাম আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ইলহাম কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই গাড়িতে উঠে চলে গেলো। ইভান ঈশার দিকে না তাকিয়েই গাড়ির লক খুলে দিল। ঈশাকে কিছু বলার আগেই সে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। ইভান একটু অবাক হল। কিন্তু নিজেকে সাভাবিক করে নিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে খুব জোরে চালাতে লাগল। ইভান সামনে দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। কোন কথা বলছেনা এমন কি ঈশার দিকেও তাকাচ্ছে না। ঈশার ভার্সিটি জেতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। দুজনেই বেশ চুপচাপ। কিন্তু এই নিরবতা ঈশাকে অস্থির করে দিচ্ছে। ইভান এরকম তো আগে কখনো করেনি। আজ এই ব্যাবহার ঈশা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। নিরবতা ভেঙ্গে ঈশা বলল
–আচ্ছা ওই যে ড্রাইভার আঙ্কেলটা যে ছিল ওনাকে দেখিনা কেন?
সামনে তাকিয়েই ইভান বলল
–ছুটিতে আছে।
ঈশা ছোট্ট করে “ওহ!” বলল। আধা ঘণ্টা পর তারা ভার্সিটি এসে পৌছাল। ঈশা নেমে গেলো কিন্তু ইভান সামনে তাকিয়েই থাকল। অন্য দিনের মত তাকে হেসে বাই বলল না। ঈশা এই মুহূর্তে ওই ইভান কে খুব মিস করছে। তাই নিজে থেকে বলেই ফেলল।
–আমাকে নিতে আসবে?
এবার ঈশার কথা শুনে ইভান অবাক না হয়ে পারল না। একটু অবাক হয়েই তার দিকে তাকাল। এর আগে ঈশা এভাবে কখনও বলেনি। ইভান নিজে থেকেই আসতে চাইত কিন্তু ঈশা না করত। সে তার বন্ধুদের সাথে জেতে চায় তাই। ইভান নিজেকে সাভাবিক করে নিয়ে বলল
–দেখি।
বলেই চলে গেলো। ঈশা অসহায়ের মত ইভানের জাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। ইভান লুকিং গ্লাসে ঈশার মুখটা দেখল। ঈশার মলিন মুখ দেখে তার খুব কষ্ট হল। কিন্তু তার যে কিছুই করার নেই। একটু কষ্ট সহ্য করলে যদি ঈশা নিজের মনের কথা গুলো বলে দেয় তাহলে এই কষ্টটা সার্থক। সেটা ভেবেই ইভান একটু হাসল।
———
গেটের সামনে দাড়িয়ে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। গল্পে মশগুল থাকলেও ঈশার চোখ রাস্তার দিকে। কারন সে জানে ইভান আসবেই। একটু আগেই ক্লাস শেষ হওয়ায় এই অপেক্ষা নাহলে এতক্ষন ইভান এসে দাড়িয়ে থাকত। ক্লাস শেষ হওয়ার পর যদি সে ফোন করত তাও হয়ত এতক্ষন চলে আসত। কিন্তু আজ ঈশার অপেক্ষা করতেই কেন জানি ভালো লাগছে। তাই সে কোন কিছু না ভেবেই কাঙ্খিত মানুষটার খোজেই নিজের চোখ জোড়া ব্যস্ত রেখেছে।
–এখানে দাড়িয়ে আছ যে? বাসায় যাবেনা? কারও অপেক্ষা করছ বুঝি?
পিছন থেকে মেঘের কণ্ঠ শুনেই ঈশা ঘুরে তাকায়। মেঘ হাসি মুখে তার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। ঈশা একটু হেসে মাথা নাড়ায়। কিছু বলার আগেই ইভানের গাড়ি এসে সামনে দাড়ায়। আবারো মেঘের সাথে এভাবে হেসে কথা বলতে দেখে ইভান রেগে যায়। ঈশা কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। ইভান গ্লাস নামিয়ে ঈশার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
–গাড়িতে ওঠ।
ইভানের গলার আওয়াজ শুনে ঈশার ভিতরে কেঁপে উঠে। ইভান এই মুহূর্তে কতটা রেগে আছে সেটা আন্দাজ করতে ঈশার কষ্ট হল না। ঈশাকে এভাবে দাড়িয়ে ভাবতে দেখে দাতে দাত চেপে আবারো বলল
–আই এম গেটিং লেট।
ঈশা ইভানের দিকে তাকাতেই চোখের ইশারা করে বলল
–ফাস্ট!
ঈশা তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ইভান সাথে সাথেই গাড়ি চালাতে শুরু করল। সারা রাস্তায় ঈশার সাথে কোন কথা বলল না। বাড়ির সামনে এনে নামিয়ে দিল। ঈশা গাড়ি থেকে নেমে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভান গাড়ি নিয়ে আবার চলে গেলো। ঈশা কিছুক্ষন দাড়িয়ে দেখে বাড়ির ভিতরে চলে এলো।
———–
রাত ৩ টা। ঈশার চোখে ঘুমের ছিটে ফোটাও নেই। কারণটা তার অজানা নয়। আজ দুইদিন হল ইভানের কোন খবর নেই। ইরাকে জিজ্ঞেস করেছিল সেও বলতে পারেনি। কারন দুই দিন ধরে সে বাসাতেই আসেনি। ঈশার খুব চিন্তা হচ্ছে। সেই যে দুইদিন আগে তাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে তারপর থেকে নাকি আর বাসাতেই আসেনি। কিন্তু কেন? কোন কাজে গেছে? কোন বিপদ হল না তো আবার। ঈশা আর ভাবতে পারছে না চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশার সারা ঘরে পায়চারি করছে। তার দম যেন আটকে আছে। ইভানের কোন খবর না পাওয়া পর্যন্ত ঠিক হবে না। যত সময় যাচ্ছে আজে বাজে চিন্তা মাথায় গ্রাস করছে। এরকম তো আগে কখনো হয়নি। ইভানের খবর কেউ না কেউ জানত। আসলে কেউ না জানলেও ঈশা ঠিকই জানত। কারন ইভান ঈশাকে বলে তবেই জেত। কিন্তু ঈশার সাথেই তো কথা বলছে না তাহলে কিভাবে সে জানবে। ঘড়ির কাটার পরিবর্তনের সাথে সাথে ঈশার হার্ট বিট এরও পরিবর্তন হচ্ছে। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন এভাবে হাঁটাহাঁটি করার পর ফজরের আজান কানে আসল। ঈশা অজু করে নামাজে দাড়িয়ে গেলো। নামাজ শেষ করে বারান্দায় বসে আছে। সামনে তাকিয়ে দেখছে ভোরের আলো ফোটা। চারিদিকে আলো পড়তেই ঈশা আবারো অস্থির হয়ে গেলো। কি করবে বুঝতে না পেরে ভাবল এবার ইভান কে একটা ফোন দিবে। তার কাছেই জানতে চাইবে সে কোথায়। কিন্তু ইভান কি তার ফোন ধরবে? সে তো তার উপরে রাগ করে আছে। জতই রাগ করুক ঈশা ইভানের রাগ ভাঙ্গাবেই। যে করে হোক। এতদিন ইভান ঈশার রাগ ভাঙ্গাত কিন্তু এখন ঈশা ভাঙ্গাবে। সে ঘরে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে ইভানের নাম্বারে ফোন দিল। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। এবার ঈশার ভয় আরও বেড়ে গেলো। কারন ইভান কখনো তার ফোন বন্ধ করে রাখেনা। তাহলে এখন কেন ফোন বন্ধ। ইভানের কোন বিপদ হল না তো। কারন সবাই এটা ভেবেই নিসচিন্ত যে ঈশা জানে ইভান কোথায়। এটাই এতদিন হয়ে এসেছে। কিন্তু আজ তো সেও জানেনা। এখন সবাইকে জানাতে হবে। কোন বিপদ হওয়ার আগেই। ঈশা দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বাইরে ইলহাম কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ইলহাম ঈশাকে এভাবে দেখে বুঝে গেলো কিছু একটা হয়েছে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল
–কি হয়েছে? তোর শরীর খারাপ?
–ভাইয়া ইভান কোথায়?
ঈশার এমন প্রশ্ন ইলহাম বুঝতে পারল না। উলটা প্রশ্ন করে বসলো
–কোথায় মানে?
–ইভানের ফোন বন্ধ। গত দুইদিন ধরে সে বাসায় আসেনি।
–তুই জানিস না কোথায়?
ঈশা না সুচক মাথা নাড়ায়। ইলহামের মুখেও এবার চিন্তার ছাপ। আসলেই কোন বিপদে পড়লো না তো?
চলবে……..
তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০
সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে ইভানদের বাসায়। ইলহাম কয়েক জায়গায় ফোন করছে। ঈশা নিরবে চোখের পানি ফেলছে। কোথাও কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সকাল থেকে খবর নেয়ার চেষ্টা করছে এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তাও কোন খোজ পাওয়া যায়নি। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। সবাই দরজার দিকে তাকাল। ঈশা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ইভান কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশা চিৎকার করে বলল
–কোথায় ছিলে তুমি?
ঈশার চিৎকারে সবাই সেদিকে তাকায়। ইভান ঈশাকে দেখতেই ব্যস্ত। ঈশাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক কান্নাকাটি করেছে। ইভানের কষ্ট হলেও মনে একটা অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করল। ঈশার মনে সে তার মত ভয় তৈরি করতে চেয়েছে। আর সে সার্থক। কারন ঈশার চোখে আজ তাকে হারানোর ভয় দেখতে পেয়েছে সে। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল
–অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছিলাম।
বলেই ঈশাকে পাশ কাটিয়ে বাসায় ঢুকেই চোখ কপালে উঠে গেলো। সবাই ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। সবার চোখে একি ভয়। ইলাহাম এর মাঝেই এসে কলার ধরে বলল
–সব সময় নিজের মতই চলবি? কারও গুরুত্ত নাই তোর কাছে।
ইভান বুঝতে পারল সবাই খুব টেনশনে আছে। তাই আর কথা না বাড়িয়েই বলল
–সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি এরকম একটা পরিস্থিতি হয়ে যাবে।
ইভানের কথা শুনে কেউ আর কথা বাড়াল না। ঈশার বাবা শান্ত ভাবে বলল
–এসব নিয়ে পরে কথা হবে। ফ্রেশ হয়ে নাও।
বলেই যে জার মত চলে গেলো। কিন্তু ঈশা দরজার কাছেই দাড়িয়ে থাকল মাথা নিচু করে। তার চোখ দিয়ে এখন পানি পড়ছে। ইভান তার দিকে তাকাল। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে তাকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে। তার এই চোখের পানি ইভানের ভিতরে জালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ঈশা জতক্ষন নিজেকে তার কাছে প্রকাশ করবে না ততক্ষন এই কষ্টটা তাকে সহ্য করতেই হবে। তাই কিছু না বলেই উপরে চলে গেলো। ঈশা ইভানের দিকে চোখ তুলে তাকাল। সে সহ্য করতে না পেরে বের হয়ে চলে গেলো নিজের বাসায়। ইভান ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। খেয়ে আবার ঘরে গেলো। ভিশন টায়ার্ড! বারান্দায় গিয়ে সিগারেট জালিয়ে কয়েকটা টান দিতেই বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির ফোটা চোখে মুখে পড়তেই কেন জানি ভিজতে ইচ্ছা করল তার। সিগারেট টা ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে গেলো। বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল।
ঈশা বিছানায় শুয়ে কাদছিল। বৃষ্টির শব্দ শুনে তার মন কেমন আনমনা হয়ে উঠলো। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু তাতেও তার মন শান্ত হল না। সে ভিজতে চায়। এক রাশ অভিমান জমে আছে ইভানের উপরে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধির পায়ে নিশব্দে দরজা খুলল। তারপর চারিদিকে ভালো করে দেখে নিয়ে ছাদের দিকে গেলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাবে তাতেই ছাদে কারও অবয়ব দেখে হতাশ হয়ে উলটা দিকে ঘুরে নেমে জেতে লাগল। কিন্তু পরক্ষনেই কি মনে করে আবার ঘুরে দাঁড়াল। বিজলির ঝলকানিতে ভালো করে দেখে বুঝে গেলো মানুষটা কে। মনে মনে খুশি হল। একটু হেসে ছাদে গিয়ে ইভানের পিছনে দাঁড়াল। ইভান এতো রাতে ছাদে কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে ঘুরতেই ভুত দেখার মত হা হয়ে গেলো। ইভান কে এভাবে দেখে থাকতে দেখে ঈশা একটু হেসে বলল
–ভুত না আমি।
ইভান রাগি চোখে তাকিয়ে বলল
–এতো রাতে কেন এসেছিস ছাদে?
–বৃষ্টিতে ভিজতে।
ঈশার নিরলিপ্ত উত্তরে ইভানের রাগ আরও বেড়ে গেলো। এগিয়ে এসে ঈশার এক হাত জোরে চেপে ধরে বলল
–আমার সাথে মজা করিস?
ঈশা ভয় পেয়ে না সুচক মাথা নাড়াল। ইভান ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলল
–বলেছি না আমাকে না বলে কোথাও জাবিনা। যদি আমি এখানে না থাকতাম তখন কি হত?
ঈশা অভিমান করে বলল
–না বলে জাওয়ার অভ্যাস তোমার। আমার না।
ঈশার অভিমান বুঝতে পেরে ইভান খুব শান্ত গলায় বলল
–না বলে গেলে কি হয়?
ঈশা এরকম কথায় রেগে গেলো। কোন উত্তর দিলনা। ইভান হাত টেনে ঈশাকে একটু কাছে আনল। কিন্তু এখনও কিছুটা দূরত্ব থেকেই গেলো। আবেগি কণ্ঠে আবারো প্রশ্ন করল
–টেনশন হয়? কষ্ট হয়?
কিন্তু এবারের কথায় এমন কিছু তো ছিল যা ঈশাকে নাড়িয়ে দিল। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে নিস্পলক। ইভান ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু হেসে বলল
–এই ওয়েদারে এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার প্রেমে পড়ে যাবি। তার থেকে ভালো নিচে গিয়ে শুয়ে পড়।
বলেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। ঈশা বিড়বিড় করে বলল
–পড়তেই তো চাই।
পুরো কথা ইভানের কানে না আসলেও। ঈশা কিছু বলেছে সেটা ঠিকই শুনতে পেয়েছে। তাই দাড়িয়ে আবার ঘুরে বলল
–কিছু বললি?
ঈশা ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে না সুচক মাথা নাড়াল। ইভান সামনে হাটতে হাটতে বলল
–নেমে আয়।
ঈশা একটু হেসে তার পিছনে পিছনে গেলো। ইভান কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতেই ঈশার চিৎকার শুনে পিছনে ঘুরে তাকায়। ঈশা সিঁড়ির উপরে বসে আছে পায়ে হাত দিয়ে। ইভান দৌড়ে উপরে চলে আসে। ঈশার পায়ে হাত দিয়ে বলে
–কোথায় লেগেছে জান? কিভাবে পড়ে গেলি?
ঈশা আদুরে গলায় বলল
–পা পিছলে।
ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–বেশি ব্যাথা পাস নি। চেষ্টা করলেই নামতে পারবি।
বলেই উঠে নামতে যাবে তখনই ঈশা আবার বলল
–আমার পায়ে লেগেছে তোমার না। আমি নামতে পারব না সেটা আনি জানি। এই অবস্থায় আমাকে কিভাবে রেখে জাচ্ছ। এতো নিষ্ঠুর তুমি?
ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশার মুখে এমন কথা এই মুহূর্তে সে আসা করেনি’। শান্ত গলায় বলল
–কি বলছিস?
ঈশা এবার রেগে ঝাঝাল গলায় বলল
–চোখে সমস্যা না কানে? কি বলছি কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছ না?
ইভান উঠে এসে ঈশার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে পিছনে চুল ধরে মুখটা কাছে টেনে এনে বলল
–শুনতেও পাচ্ছি আর ভালো মত বুঝতেও পারছি। তোকে বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়না।
ঈশার কানে ইভানের কোন কথাই গেলো না। কারন ইভান এই প্রথম ঈশার এতো কাছে এসেছে। ঈশা একদম জমে গেছে। নড়াচড়া করার কোন শক্তি নেই। সে একটা শুকনো ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান ঈশার অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোট কামড়ে হেসে চুল ছেড়ে দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল।
ঈশা এবার চোখ খুলে ফেলল। কিন্তু ইভানের দিকে তাকাচ্ছে না। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে ঠোটের কোনে হাসি নিয়ে। ঈশা দেখেলে হয়ত সেই হাসির মানে বুঝে জেত। কিন্তু সে তো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান সিঁড়ি বেয়ে নেমে ৫ তলায় এসে দরজার সামনে ঈশাকে নামিয়ে দিল। ঈশা এতক্ষন ঘোরের মধ্যে ছিল। এখন বাস্তবে ফিরে এলো। সে ইভানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এভাবে তাকে নামিয়ে দিল কেন? ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এখান থেকে হেটে হেটে ভিতরে যা। আমি জানি তুই এখন চেষ্টা করলেই পারবি।
ঈশা বোকার মত দাড়িয়ে আছে। ইভান সামনে যেতে যেতে বেশ জোরেই বলল
–পা মচকালে গোড়ালি চেপে ধরতে হয় হাঁটু না। ড্রামাবাজ!
ঈশার এবার হুস ফিরল। সে হাঁটু চেপে ধরে বসে ছিল তাই ইভান তার নাটক বুঝতে পেরেছে। এতো কিছুর মাঝে ভালো করে খেয়াল করেনি যে হাঁটু চেপে ধরার জন্য আরও জোরে পড়ে জাওয়ার দরকার ছিল। কিছুক্ষন ইভানের জাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হেসে বাসায় ঢুকে গেলো নিসশব্দে। নিজের ঘরে গিয়ে জামা পালটে শুয়ে পড়লো। কাল আবার সকালে উঠতে হবে। ভার্সিটি জেতে হবে।
ইভান নিজের ঘরে এসে সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেলো। চেঞ্জ করে বারান্দায় গেলো। একটা সিগারেট জালিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাসল। কারন ঈশাও যে নিজের ভালবাসা প্রকাশ করতে শুরু করেছে সেটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে ইভান। এখন শুধু মুখে বলার অপেক্ষা। সিগারেট শেষ করে শুয়ে পড়লো।
———–
সকালে বরাবরের মত লিফটের দরজা খুলতেই ঈশাকে দেখতে পেল ইভান। সে লিফটে উঠে ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। ইভানের চোখে চোখ পড়াতে ঈশা চোখ নামিয়ে নিল। ইভান একটু একটু করে ঈশার দিকে এগিয়ে গেলো। ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকাল। ইভানের চোখ আজ অন্য রকম। ঈশা একটু ভয় পেয়ে শুকনো ঢোক গিলে লিফটের দেয়ালের সাথে আটকে গেলো। ইভান একটু হেসে পকেট থেকে চকলেট বের করে ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিতেই বরাবরের মত লিফট এসে দো তলায় থেমে গেলো আর সারিকা লিফটে উঠলো। সারিকা ওভাবে দুজন কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল। ইভান সরে দাঁড়াল। ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। সে অবাকের সুরে বলল
–আপনারা কি একে অপরকে চেনেন?
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। একটু ভাবল। তারপর বাকা হেসে বলল
–আমরা কাজিন।
ঈশা ইভানের দিকে বাকা চোখে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না। সারিকা বলল
–ওহ! আমি জানতাম না।
বলেই ইভানের দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু ঈশার বিষয়টা ভাললাগল না। প্রতিদিন একি সময় এই মেয়েটার তাদের সাথে দেখা হওয়া কোন কো-ইন্সিডেন্স হতে পারেনা। তাহলে কি মেয়েটা ইচ্ছা করে প্রতিদিন এই সময় বের হয়। কারন এই বিল্ডিঙে অনেকেই থাকে তাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হলেও এই মেয়ের সাথে কয়দিন যাবত প্রতিদিন দেখা হয়। কিন্তু তার এমন করার কারন টা কি? ঈশা নিজের ঘড়িটা দেখল। অন্য দিনের চেয়ে আজ প্রায় তারা ১০ মিনিট লেট করে বেরিয়েছে। ঈশা আর ইভান নাহয় একে অপরের বের হওয়ার সময় জানে কিন্তু সে কিভাবে এতো পারফেক্ট সময় জানতে পারে। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা সারিকার দিকে তাকাল। সে লিফটের সামনের দেয়ালে ইভানের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ঈশার বিষয়টা আন্দাজ করতে কষ্ট হল না। কিন্তু এই মেয়েকে জব্দ করতে হলে এমন কিছু করতে হবে জাতে সে নিজে থেকেই সরে যায়। ঈশা ইভানের অনেকটা কাছে এসে দাঁড়াল। ইভান ফোন থেকে চোখ তুলে ঈশার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন আকাশ থেকে পড়লো। কিন্তু এরকম করার কারণটা বুঝতে পারল না। লিফট নিচে চলে আসায় তারা তিনজনই লিফট থেকে নামলো। মেয়েটাকে ইভানের কাছাকাছি আসতে দেখে ঈশা ইভানের সামনে দাড়িয়ে গেলো। ঈশার এমন কাজে ইভান কিছুক্ষনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিজের খাওয়া চকলেট তার বাকি অংশ ইভানের মুখের কাছে ধরল। ইভান কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ ঈশার কাণ্ড দেখছে। যে মেয়ে বাড়িতেই কখনও এসব করেনি সে আজ বাইরে তাকে নিজের খাওয়া চকলেট খাওয়াচ্ছে। বিষয়টা ইভানের মাথায় কোন ভাবেই ঢুকছে না। হঠাৎ পাশে সারিকার উপরে চোখ পড়তেই দেখল সে নিস্পলক তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ঈশা আড় চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। ইভান সবটা বুঝতে পেরে ঈশার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল
–ম্যানারস শেখনি। এটা তোমার বাড়ি না যা ইচ্ছা করবে।
ইভানের কথা শুনে ঈশার খুব কষ্ট হল। তার চোখে পানি চলে এলো। সে ঝাপ্সা চোখে তাকাল। চোখের পাতা পিটপিট করে পানি আটকাতে চেষ্টা করল।
চলবে……।