তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ১১,১২

0
2074

তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ১১,১২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১১

২৫
ঈশা নিজের ঘরে তার কাপড় গুছিয়ে রাখছে। অনেক দিন আলমারিতে হাত দেয়নি সে। সমস্ত জিনিস পত্র এলোমেলো হয়ে আছে। এক এক করে সব ঠিক করছে। একটা কাপড় টানতেই পাশ থেকে একটা ওড়না পড়ে গেলো। ঈশা সেটা পরম যত্নে হাতে তুলে নিলো। এক দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক দিন আগে এই ওড়নাটা ইভান তাকে দিয়েছিলো। সেদিন এই ওড়নাটা ইভান পরম যত্নে তার মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলো। আর বলেছিল
–এই রঙটা শুধুই তোর জন্য। তোকে অসম্ভব লাগে এই লাল রঙটায়।
সেই কথাটার মানে সেদিন ঈশা না বুঝলেও কোথায় যেন সেটা ঈশাকে আঘাত করেছিলো। আজও সেই আঘাতের ক্ষত হিসেবে নিজের অপছন্দের লাল রঙটা নিজের সব থেকে প্রিয় হিসেবে জিবনের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কথাটা ভেবে ঈশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে ঘুরে দাড়াতেই দেখল ইভান দাড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে ইভান কে দেখে তার মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষন স্থায়ী হলনা। ইভান সজোরে ঈশার গালে একটা থাপ্পড় মারল। ঈশা ছিটকে পড়ে গেলো। গালে হাত দিয়ে থমকে গেলো কিছু মুহূর্তের জন্য। এই প্রথমবার ইভান তাকে থাপ্পড় মারল। কিন্তু কারণটা তার জানা নেই। ইভান ওর উপরে যত বেশি রাগ করুক না কেন হয় নিজেকে কষ্ট দেয় আর নাহলে তার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে কিন্তু ঈশার গায়ে কখনও হাত তোলেনি। ইভান ঈশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। তারপর এক হাতে ঈশার দুই গাল চেপে ধরে দাতে দাঁত চেপে বলল
–তোর সাহস কি করে হয় আমার কথা অমান্য করার।
ঈশা ইভানের কথা বুঝতে পারলনা। হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো সে ব্যাথা পাচ্ছিলো। বুঝতে পেরে ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। তারপর ঈশার সামনে একটা লকেট সহ চেন ধরে খুব শান্ত ভাবে বলল
–কেন খুলেছিস এটা?
ঈশা সেটার দিকে দেখে চমকে উঠলো। ইভান আবার বলল
–তুই আমাকে কোনদিনও বুঝবিনা তাই না। সব সময় নিজের জেদ আর ইচ্ছা টাকেই প্রাধান্য দিবি। আমার কোন কিছুর কোন মুল্য তোর কাছে নেই।
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি ইচ্ছা করে খুলিনি। বিশ্বাস কর।
ইভান তার দিকে তাকিয়ে করুন সূরে বলল
–তুই জানিস ঈশা আমি আমার ভালোবাসা সব সময় তোর কাছে প্রকাশ করি তাই সেটাকে তুই তুচ্ছ ভাবিস। ভুলে যাস না। আমার এই ভালোবাসা শুধু একটা শব্দ না। আমার জীবন। আমার অস্তিত্ব!
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো। দরজা পর্যন্ত যেতেই পিছনে ঘুরে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–ইউ নো ঈশা! তুই নিজেই জানিস না তুই আসলে কি চাস। আমার ভালোবাসা অনুভব করতে চাস। কিন্তু আমি জখন আমার ভালোবাসার অনুভুতি তোর কাছে প্রকাশ করি তখন সেগুলো তোর কাছে অসহ্য হয়ে যায়। আবার জখন আমি তোর কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখি তখনও তুই কষ্ট পাস। আমি তোর উপরে যত অধিকার খাটাই সব কিছু তোর কাছে অত্যাচার মনে হয়। কিন্তু তুই জানিস আমি কখনও কারন ছাড়া কোন কাজ করিনা। ভেবেছিলাম তুই আমাকে বিশ্বাস করিস।
একটু হেসে বলল
–এই অত্যাচারের পিছনেও অনেক কারন আছে। আমি চাইনা সেগুলো কখনও তোর কানে আসুক। কিন্তু যদি কোন ভাবে এসেই যায় তাহলে সেদিন বুঝতে পারবি আমার কোন আচরণ তোর উপরে কখনও অত্যাচার ছিলোনা। সবটাই আমার ভালোবাসা। তুই আমাকে ঘৃণা করিস তাই না। কিন্তু আমি তোকে নিজের জীবনের থেকেও ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা যদি তোকে এতোটাই কষ্ট দেয় তাহলে আমি দূর থেকেই তোকে ভালবাসব। শুধু তুই ভালো থাকিস। তাহলে তোর এই ঘৃণাটা নিয়েই আমি সারা জীবন কাটিয়ে দিবো। ভালবাসতে হবেনা আমাকে।

কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। ঈশা সেখানে বসে ভাবতে লাগলো। সকালে চেনটাতে চুল আটকে গিয়েছিলো আর সেটা খুলতে গিয়ে চেনটা গলা থেকে খুলে ফেলেছিল ঈশা। পরে সেটা পরতে ভুলে গিয়েছিলো। কিন্তু ইভান কিভাবে জানলো? ঈশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ইভান কে কষ্ট দিতে চায়নি ঈশা। আজ সে খুব কষ্ট পেয়েছে।

ইভান যখন পড়াশুনা করতে এই শহর ছেড়ে বাইরে যায় তখন সে ঈশার গলায় এই চেনটা নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছিলো। আর বলেছিল
–যা কিছু হয়ে যাক এটা গলা থেকে কখনও খুলবি না। আমি বেঁচে থাকতে অন্তত না। আমি মরে গেলে তোর যা ইচ্ছা হয় করিস। কিন্তু প্লিজ আমার কথার অমান্য করিস না।
তারপর থেকে ঈশা সেটা কখনও খুলেনি। নিজের সাথে সব সময় রেখেছে যত্ন করে। কিন্তু আজ ঈশার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো সেটার কথা। সে হয়ত নিজের অজান্তেই ইভান কে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ঈশা মেঝেতে বসেই কাঁদছে। তার কান্না আজ বাধ মানছে না। কেন জানি আজ তার ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছে। ইভান বাইরে দাড়িয়ে দেখছিল। ঈশার কান্না সে সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু আজ দাতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। ঈশাকে কাঁদতে দেখে ইভান মনে মনে বলল “সরি জান। আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোকে আঘাত করতে চাইনি। কিন্তু তুই আমাকে আজ বাধ্য করলি। আজ যা করেছিস খুব বেশি করেছিস। এটার শাস্তি তোকে একটু হলেও পেতে হবে জান।” কথা গুলো ভেবেই ইভান নিজের ঘরে চলে গেলো। ঘরে বসে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে ইভান। সে এই প্রথম ঈশার গায়ে হাত তুলেছে। নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। নিজের উপরে এখন ইভানের খুব রাগ হচ্ছে। কিন্তু ঈশা আসলেই তাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ইভান ঈশার ছোট ছোট পছন্দ অপছন্দ এসবের খেয়াল রাখে। ঈশারও উচিৎ ছিল ইভানের কথার গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু ইভানের অনুভুতি গুলো সে সব সময় সহজেই প্রকাশ করেছে। তাই হয়ত ঈশা সেগুলোর মর্ম বুঝতে পারেনি। সেগুলো হয়ত ঈশার কাছে অতি সস্তা হয়ে গেছে।

২৬
সকাল থেকেই ইভান কে দেখা যাচ্ছেনা বাসায়। দুইদিন ধরে ঈশা ইভান কে মানাতে চেষ্টা করছে কিন্তু ইভান তার সামনেই আসছেনা। এমন কি ঈশাকে দেখলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ঈশা। ভাবছে কিভাবে ইভান কে মানাবে। ইভান কে মানানো এতো সহজ না। কিছু একটা ভেবে ঈশা একটু হাসল। তারপর আলমারি থেকে একটা লাল রঙের শাড়ী বের করে নিলো। তারপর মনে মনে বলল “এবার দেখি তুমি কিভাবে আমার কাছ থেকে দূরে থাকো।“ ওয়াশ রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে শাড়ীটা পরে বের হল। ঈশা ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই দেখে তার চাচি দাড়িয়ে আছে। ঈশা কে লাল শাড়ী পরতে দেখে তিনি ভালো একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন। তারপর বললেন
–কোথাও যাচ্ছিস?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে না বলল। তার চাচি একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
–তাহলে?
–আলমারি গোছাতে গিয়ে এই শাড়ীটা চোখে পড়লো। তুমি দিয়েছিলে আমাকে। পরতে ইচ্ছা করলো তাই পরে ফেললাম।
ঈশার চাচি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। ওনার চোখে পানি এসে গেলো। ঈশা বুঝতে পেরে কাছে গিয়ে বলল
–কাদছ কেন চাচি?
তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–আমি তোদের দুজনকে সুখি দেখতে চেয়েছি। তোরা দুজন সুখে থাকবি এটাই আমার শেষ চাওয়া। জানিস ঈশা এই শাড়ীটা ইভান পছন্দ করেছিলো তোর জন্য। ওর ইচ্ছা ছিল তুই এই শাড়ী পরে আমাদের বাসায় বউ হয়ে আসবি। আমি মন থেকে দোয়া করি তোরা সুখি হ।
ঈশা তার চাচির হাত ধরে একটু হেসে বলল
–আমার জন্য দোয়া কর চাচি তোমার ওই জেদি ছেলেটাকে যেন সারাজীবন সামলাতে পারি।
ঈশার কথা শুনে তার চাচি হেসে ফেললো। তাদের কথার মাঝখানে কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরা দরজা খুলে দেখে ইভান দাড়িয়ে আছে। ইভান কে দেখেই ইরা বলল
–ভাইয়া তুমি এতো দেরি করলে কেন?
ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–সরি রে একটু দেরি হয়ে গেলো।
ইভানের আওয়াজ শুনে তার মা ঈশাকে বলল
–ওই যে এসে গেছে। দেখ তার রাগ ভাঙ্গাতে পারিস কিনা।
ঈশা একটু হেসে বলল
–এটা শুধু আমিই পারব চাচি। তুমি ভেবনা।
বলেই দুজন হেসে দিলো। ইভানের মা বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। ইভান ডাইনিং টেবিলে এসে পানি গ্লাসে ঢেলে খেতে যাবে তখনি সামনের বেসিনের আয়নায় চোখ পড়তেই থেমে গেলো। ঈশা নিজের ঘরের দরজায় দাড়িয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান নিস্পলক সামনের আয়নায় তাকিয়ে আছে। পিছনে ঘুরে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা তার তাকানো দেখে একটু মুচকি হেসে ঘরে চলে গেলো। ইভান বুঝতে পারল ঈশা তার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এসব করছে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। তারপর হাতে থাকা গ্লাসটার পানি শেষ করে গ্লাসটা সামনে রেখে মুচকি হাসল। হেসে চারপাশে ভালো করে দেখে নিলো। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। তারপর ধির পায়ে ঈশার ঘরের দিকে গেলো। দরজায় হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো। ঈশা উলটা ঘুরে জানালায় দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভালো করে ঈশাকে দেখে নিলো। আজ ঈশাকে একদম নিজের স্বপ্নের মতো লাগছে ইভানের। আজ চাইলেও সে নিজেকে ঈশার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারবেনা। তাকে কিভাবে কন্ট্রোল করতে হয় সেটা ঈশাই ভালো করে জানে। ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিলো। ইভানের মা বাইরে দাড়িয়ে দেখছিল। ইভান কে ঈশার ঘরে যেতে দেখে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। দরজা লাগানোর শব্দে ঈশা পিছনে ঘুরে তাকায়। ইভান নেশা ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়েই বলল
–কেন এসেছ এখানে?
ঈশার কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাল। ঈশা আবার বলল
–কি বলেছি শুনতে পাওনি?
ইভান এবার ঈশাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে এক হাতে গাল চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বলল
–তোকে কোন কইফিয়ত দিতে আমি বাধ্য না।
ঈশা ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ঈশার চোখের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলনা সে। ঈশার ঠোঁট দুটো নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো। ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেললো। বেশ কিছুক্ষন পর ঠোঁট দুটো ছেড়ে ঈশাকে উলটা দিকে ঘুরিয়ে তার পিঠ নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে দিলো ইভান। তারপর পিঠের চুল গুলো সরিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দিলো। ঈশা একটু কেঁপে উঠলো। তারপর সামনে হাত দিয়ে তার গলায় স্লাইড করতে শুরু করলো। কিন্তু গলায় হাত পড়তেই ঈশার গলা ফাকা দেখে তার চেনের কথা মনে পড়ে গেলো। সে ঈশাকে এবার একটু শক্ত করে ধরে বলল
–কি ভেবেছিস এসব করে আমাকে ভুলিয়ে রাখবি। আমি এতো সহজে ভুলিনা সেটা তুই ভালো করেই জানিস।
বলেই ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো। ইভান যাওয়ার পর ঈশা একটু হেসে বলল
–ভুলে তো গিয়েছিলেই। আমিও দেখি কতদিন মনে রাখতে পার।

চলবে………

তোর ছায়ার সঙ্গী হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১২

২৭
ইভানের নতুন অফিস শুরু হয়েছে। সে খুব ব্যস্ত। সারাদিন প্রায় বাইরেই থাকে। মাঝরাতে আসে বাসায়। কখন আসে কখন যায় কোন ঠিক নেই। ঈশার সাথে কয়েক দিন ধরেই তার দেখা হয়না। বাড়ির সামনে এসে ইভান খুব সাবধানে দরজা খুলল। কারন এখন সবাই ঘুমাচ্ছে। শব্দ হলে ঘুমের ডিস্টার্ব হবে। ভিতরে ঢুকে টাই টা খুলে সোফায় বসে পড়লো। সামনে ঘড়িটাতে দেখল রাত ১ টা বাজে। ভীষণ টায়ার্ড! কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলানি দিয়ে থাকলো। তারপর উঠে ডাইনিং টেবিলে পানি খেতে গেলো। পানি খেয়ে গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই ঈশার ঘরের দরজায় চোখ পড়লো। ঈশাকে এই মুহূর্তে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। ঈশা দরজা ভেতর থেকে দরজা লক করে ঘুমায়। তবুও কি মনে করে ইভান দরজার সামনে গিয়ে হাতলটা ঘুরাতেই দরজা খুলে গেলো। বেশ অবাক হল। কিন্তু মনে মনে খুশিও হল। একবার ঈশার ঘুমন্ত চেহারাটা দেখলে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। ভিতরে ঢুকে দেখে সারা ঘরময় অন্ধকার। দরজাটা শব্দহীন ভাবে লাগিয়ে দিয়ে ঈশার পাশে বিছানায় খুব সাবধানে বসলো। ফোনের ফ্ল্যাশ অন করতেই ঈশার ঘুমন্ত চেহারাটা চোখে পড়লো। নিস্পলক তাকে দেখছে ইভান। কি অপূর্ব লাগছে। ঈশার কপালে গভীর একটা চুমু দিলো। তার গালে আলতো করে এক আঙ্গুল ছোঁয়াল। এতে ঈশা কিছুটা নড়ে উঠলো। ইভান একটু সরে গেল।জাতে ঈশার ঘুম ভেঙ্গে না যায়। কিন্তু ঈশা ঘুমের ঘোরেই ইভানের খুব কাছে এলো। ইভান ঈশার এতোটা কাছে আসা দেখে নিজেকে আটকাতে পারলনা। সেও ঈশাকে এক হাতে জড়িয়ে নিলো। ঈশা একদম ইভানের বুকের ভিতরে ঢুকে ঘুমের ঘোরেই আধো আধো কণ্ঠে বলল
–তোমার এই পারফিউমের ঘ্রান আমাকে পাগল করে দেয়।
ঈশার এমন কথা শুনে ইভান নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে ভালো করে তাকে দেখতে লাগলো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারল ঈশা ঘুমের ঘোরেই এসব বলছে। ইভান এখনো ঈশার উপরে রাগ করে আছে। তার সাথে ঠিক মতো কথা বলেনা। কিন্তু তাকে দেখে ইভানের সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেলো। যত রাগই থাকনা কেন এই মেয়েটা তার সাথে ভালবেসে কথা বললে সে কিছুতেই তার উপরে রাগ করে থাকতে পারেনা। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সে ঈশাকে আলতো করে ছুয়ে বলল
–আমাকে মিস করেছিস?
ঈশা আবারো আধ আধ কণ্ঠে বলল
–অনেক। তুমি তো আসইনা আমার কাছে।
–এতো মিস করিস তাহলে বলিস না কেন?
–তুমি বঝনা কেন?
–সবই বুঝি জান। তবুও তোর কাছ থেকে শুনতে চাই।
–বলবনা শুধু ভালবাসব।
ইভান এবার ঈশার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বলে
–আমাকে আদর করতে ইচ্ছা করেনা তোর।
ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান এবার বলল
–তাহলে এখনি আদর কর।
বলেই ইভান নিজের ঠোঁট ঈশার ঠোটের কাছে নিয়ে গেলো। আর ঈশা নিজে নিজেই কাছে এসে ইভানের ঠোঁটে তার ঠোঁট ছুয়ে দিলো। ইভান ভাবল ঘুমের মাঝেই নাহয় ঈশা তার প্রতি নিজের অনুভুতি তো প্রকাশ করলো। অনেকক্ষণ ঈশার রুমে থাকার পর সে উঠতে যাবে তখন ঈশা তার শার্টের হাত টেনে বলল
–যাবেনা।
ঈশার কথা শুনে ইভান একটু হেসে তার পাশে শুয়ে পড়লো। ইভান ভালো করে শুয়ে পড়তেই ঈশা আরও বেশি তার কাছে চলে এলো। একদম বুকের ভিতরে ঢুকে পড়লো। ইভান তাকে দুই হাতে জড়িয়ে বলল
–এভাবে ভালবেসে ডাকলে আমি কিভাবে তোর কাছ থেকে দূরে থাকব জান।
বলেই ঈশার মাথায় একটা চুমু দিলো। ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে ফেললো। সারাদিনের ক্লান্তির কারনে কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলো ইভান।
সকালে ঈশার ঘুম হালকা হয়ে গেলে সে ঘাড়ের উপরে উষ্ণ অনুভূতির ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলে ফেললো। চোখ খুলে দেখল। ইভান তাকে পিছন থেকে নিজের বুকের সাথে তার পিঠ লাগিয়ে জড়িয়ে আছে। তার এক হাত ঈশার হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে। তার উষ্ণ নিশ্বাস ঈশার ঘাড়ে পড়ছে। মাথাটা হালকা ঘোরাতেই দেখল ইভান বেশ আরামে ঘুমাচ্ছে। একটু অবাক হয়ে গেলো। আরও ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল সে ফর্মাল ড্রেসে। তার মানে অফিস থেকে সোজা তার ঘরে এসে ঘুমিয়ে গেছে। ইভান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঈশা নড়লেই তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে। তাই সে নড়তেও পারছেনা। ওভাবেই শুয়ে ভাবছে। ইভানের এভাবে জড়িয়ে ধরাতে এক অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। খারাপ লাগছেনা। একটু ভেবে তার ঠোটের কোণে একটা তৃপ্ত হাসি ফুটে উঠলো। ইভান জেগে থাকলে এই হাসি দেখে হয়ত ঈশার মনের কথা বুঝে যেত। কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর ইভান একটু নড়ে উঠলো। এতে ইভানের হাতের বাধন আলগা হয়ে গেলো। ঈশা উঠে বসলো। ইভানের চোখ খুলে গেল। সে ঈশাকে বসতে দেখে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। ঈশা তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
–তুমি এখানে?
ইভান কোন কথা বলল না। নিস্পলক ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা তার চুপ করে থাকা দেখে আর কোন কথা বলল না। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমের দিকে যেতেই ইভান বলল
–থ্যাঙ্ক ইউ জান!
ইভানের কথা বুঝতে না পেরে ঈশা পিছনে ঘুরে তাকায়। ইভান ঈশার বালিশটা জড়িয়ে ধরে তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান আবার বলল
–কাল রাতে এতো সুন্দর একটা মুহূর্ত গিফট করার জন্য।
ঈশা কিছুই বুঝতে পারলনা। ইভানের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকলো। ইভান উঠে বসে বালিশটা জড়িয়ে ধরে একটু হেসে বলল
–তুই এতো রোমান্টিক আমার সত্যিই ধারনা ছিলোনা।
ইভানের কথা শুনে ঈশার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ইভান উলটা পাল্টা কথা বলে তাকে জালাবে সেটা সে বুঝতে পেরে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–সকাল সকাল কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো? উলটা পাল্টা কথা বলছ।
ইভান বালিশটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঈশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এক আঙ্গুল দিয়ে কপাল থেকে ছোট ছোট চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে বলল
–আপনি যেভাবে আমাকে আদর করেছেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ!
ইভানের কথা শেষ হতেই ঈশা একটু জোরেই বলল
–মানে?
ইভান একটুক্ষণ ঈশার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
–তুমি যদি সত্যিই কাউকে এতো ভালবাস তাহলে সেটাকে সম্পূর্ণ ভাবে ভালবাস। নিজের সবটা দিয়ে ভালবাস। সব থেকে বড় কথা সেটাকে প্রকাশ করতে শেখ। দেখাতে শেখ যাতে সামনের মানুষটাও বুঝতে পারে যে তুমি তাকে কতটা ভালবাস।
ইভানের কথার মানে ঈশা কিছুই বুঝতে পারলনা। বিরক্ত হয়ে বলল
–এভাবে হেয়ালি না করে যা বলতে চাও স্পষ্ট করে বল।
ইভান একটু হেসে টেবিলে থাকা মোবাইল টা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল
–কিছুনা। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।
বলেই বের হয়ে যেতে নিলে কি মনে করে আবার পিছনে ঘুরে তাকায়। ঈশা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি। আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে ইভানের ঈশাকে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। ঈশার সেই হাসির মানে সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। ঈশা তার হাসিটা প্রশস্ত করে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ইভান ভ্রু কুচকে দাড়িয়ে তার সেই হাসির রহস্য বুঝতে চেষ্টা করছে।

২৮
আজ ইভানের অফিস ছুটি। সে সারাদিন বাসায় বসেই অফিসের কাজ করছে। সকালে খেয়ে ঘরে গিয়েছে তারপর থেকেই কাজে ব্যস্ত। ঘর থেকে বের হয়নি। ঈশা ইভানের কথা ভাবছে। এই মুহূর্তে তার ইভানের সাথে কথা বলা দরকার। কারন ঈশা বুঝতে পারছে কাল রাতের পর ইভানের রাগ অনেক টা কমে গিয়েছে। কিন্তু তার অভিমানটা ভাংতে হবে। যতক্ষণ সে তাকে ওই চেনটা পরিয়ে দেয়নি ততক্ষন পুরপুরি তার অভিমান ভাংবেনা। সেটাই এখন ঈশার লক্ষ্য। ইভানের হাতে আবার সেই চেনটা পরিয়ে নেয়া। আর সেটার জন্য তাকে কি করতে হবে তা সে খুব ভালভাবে জানে। নিঃশব্দে হেসে সে ইভানের ঘরের দিকে গেলো। দরজায় দাড়িয়ে দেখছে। ইভান মনোযোগ দিয়ে বিছানায় হেলানি দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে। ঈশা ধির পায়ে এগিয়ে গিয়ে ইভানের সামনে বসলো। ইভান তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঈশাকে দেখে মুচকি হেসে আবার কাজে মনোযোগ দিলো। ঈশা অবাক হল। সে এমন একটা আচরণ করলো যেন জানতো ঈশা আসবে। ইভান ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বলল
–যেই ভালোবাসা যত গোপন সেই ভালোবাসা তত গভীর। তোরটাও কি এমন?
ঈশা তার দিকে তাকিয়ে বলল
–কাল রাতে কি করেছি আমি?
ইভান ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বলল
–শুনতে পারবি তো?
ঈশা একটু বাকা হেসে বলল
–তোমার হাতে প্রথম বার থাপ্পড় খেয়েও হজম করতে পেরেছি। এখন কি এমন বলবে যা শুনতে পারবোনা।
কথাটা শুনে ইভানের একটু রাগ হল। কিন্তু সে এই মুহূর্তে ঈশার উপরে রাগ করতে চাইছেনা। এমনিতেই কয়েকদিন রাগ করে ঠিক মতো কথা বলেনি। ইভান ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–থাপ্পড় টা কেন মেরেছি সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। আর সেটার জন্য আমি কোন ভাবেই সরি না।
ঈশা একটু রাগ করে বলল
–আমি যেটা জানতে এসেছি সেটা বল।
সে ঈশার চোখে চোখ রেখে বলল
–তুই এখন আমার উপরে রাগ করে আছিস। কিন্তু আমি আমার কাজের জন্য তোকে সরি বলবনা। কারন তুই অপরাধ করেছিস আর আমি শাস্তি দিয়েছি। এটা ছাড়া আর কিভাবে তোর রাগ ভাঙ্গাতে পারি? তুই চাইলে নিজের জানটা বের করে তোর হাতে ধরিয়ে দিবো। লাগবে?
ইভানের কথাটা ঈশার হৃদয় ছুয়ে দিলো। এক রাশ ভাললাগা ছুয়ে গেলো সারা শরীরে। ইভানের দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকলো। ইভানও তার দৃষ্টি ঈশার দিকে রেখেছে। ইভান একটু হাসল। তার হাসি দেখে ঈশা মুগ্ধ হয়ে গেলো। না চাইতেও ঈশার ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। ইভান একি অবস্থা থেকেই মুখে হাসি নিয়ে বলল
–একেকজনের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ একেক রকম। কারওটা সফট। কারও বেলায় খুবই অ্যাংরি। কারওটা কখনও কখনও স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়েও পড়ে। কেউ অধিকার খাটায়। আবার কেউ নিরবে ভালবেসে যায়। আমার ভালোবাসা তোর প্রতি হয়ত একটু রুড। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোকে সবটা উজাড় করে ভালবাসি। তোর স্বপ্ন তোর অনুভুতি সবটা আমার জানা হয়ে গেছে। আমি তোর নিশ্বাস শুনেই বলতে পারি তুই কি ভাবিস। তোর চোখ দেখে বলতে পারি তোর সমস্ত না বলা কথা। তোর এই নিরব ভালোবাসা টাই নাহয় আমার জন্য বরাদ্দ থাকলো। বলতে হবেনা ‘ভালবাসি’। এই শব্দটা তোর অনুভূতির চেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ না। আমার প্রতি তোর সমস্ত অনুভুতি একটু প্রকাশ করলেই হবে। আমি তোকে আর তোর সেই অনুভুতি নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিবো।
ইভানের কথা শুনে ঈশা আর তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলনা। চোখ নামিয়ে উঠে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইভানের কথা শুনে থেমে গেলো
–কাল রাতের অনুভুতি প্রকাশের ধরনটা কিন্তু সত্যিই অনেক ভালো ছিল। বেশি চাইনা। প্রতিদিন এরকম একবার করে ভালোবাসার স্পর্শ পেলেই আমার চলবে।

ঈশা তার দিকে ছোট ছোট চোখে তাকাল। ইভান ঈশার কাছে এসে দাঁড়ালো। ঈশা একটু রেগে বলল
–কি বলছ এসব?
–যা করেছিস তাই বলছি।
–কি করেছি?
ঈশা একটু কাপা গলায় বলল। ইভান ঈশার আরও একটু কাছে গিয়ে তার ঠোঁটে এক আঙ্গুলে স্লাইড করতে করতে বলল
–এই উষ্ণ ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ আমাকে এক অন্য রকম নেশার জগতে নিয়ে গিয়েছিলো। যেখানে ছিল এক অনাবিল স্বর্গীয় সুখ। আর সীমাহীন ভালোবাসার অনুভুতি।
ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে ইভানের কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে কাপা কাপা গলায় বলল
–তু…তুমি মিথ্যা বলছ।
ইভান একটু কঠিন গলায় বলল
–জানতাম তুই বিশ্বাস করবিনা। সেই জন্যই বলতে চাইনি।
ঈশা কোন কথা বলল না। ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইভান ঈশার আরও একটু কাছে এসে বলল
–তোর মাঝে জমে থাকা এই অনুভুতি গুলো প্রকাশ করলে ক্ষতি নেই তো। বরং লাভ আছে।
ঈশা ইভানের চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর নিজেই তার আর একটু কাছে আসলো। ঈশার এভাবে কাছে আসা দেখে ইভান একটু অবাক হল। বুঝতে চাইছে ঈশা ঠিক কি করতে চাইছে। ঈশা ইভানের মুখের কাছে নিজের মুখ এনে বলল
— এতোটা কাছে এসনা যাতে তোমার এই পারফিউমের ঘ্রান আমাকে পাগল করে দেয়।
কথাটা শেষ করেই ঈশা তার দিক থেকে উলটা ঘুরে দাঁড়ালো। দরজা খুলে একটু দাড়িয়ে মুচকি হেসে আবার তার দিকে ঘুরে বলল
–আর হ্যা! এভাবে রাতের অন্ধকারে ঘুমের ঘোরে ভালোবাসার স্পর্শ নেয়াটাকে সুযোগ নেয়া বলে। জাগ্রত অবস্থায় এইভাবে স্পর্শ করতে বাধ্য করাকে সাহস বলে। পারলে সাহস করে দেখাও।
বলে সেই সকালের রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলো। এই দিকে তার যাওয়ার পর ইভান ভাবতে লাগলো ঈশার কথার মানে। এসব কি বলে গেলো। সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো।

চলবে……।

(আজ ঈশার আচরণ কেমন রহস্যময়! এর কারন কি?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here