তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ১৩,১৪
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৩
২৯
সকাল বেলা বেশ চেচামেচিতে ঈশার ঘুম ভাঙ্গল। ঘুমু ঘুমু চোখে তাকিয়ে দেখে সে। এতো সকালে কি নিয়ে জোরে জোরে কথা বলছে সবাই। ভাবতে ভাবতে আবার চোখ লেগে এলো। চেচামেচির শব্দ বাড়তেই লাগলো। ঈশা উঠে বসলো। দুই হাতে চোখ ঘষে ঘুম কাটানোর চেষ্টা করলো। তারপর পাশে রাখা ওড়নাটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সবাই কি যেন নিয়ে খুব চিন্তিত। ঈশা ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে?
ঈশার চাচা বলল
–গ্রামে যে ফারুক মামা ছিল উনি মারা গিয়েছে রাতে।
ঈশা মরার খবর শুনে দোয়া পড়ে নিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো
–এখন কি করবে?
ঈশার বাবা বললেন
–উনি গ্রামের এক মাত্র মুরুব্বি ছিলেন। আমাদের যেতে হবে।
সবাই যাওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। সবার কথা শেষ হলে ঈশার মা বলেন
–আমরা সবাই যাব। ঈশা ইরা তোমরা থাকবে। ইলহাম ইভান ও থাকবে। আজ রাতে হয়ত আমরা আসতে পারবোনা। রাতে তোমরা ৪ জন বাসায় থাকবে।
ঈশা মায়ের কথা শুনে আর কিছু বলতে পারলনা। মেনে নিলো। সবাই চলে গেলো। ঈশার খুব মাথা ব্যাথা করছিলো। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আর অনেক সকালে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। এই মুহূর্তে একটু ঘুমান দরকার। নাহলে আবার ব্যথাটা বাড়বে। তাই সে নাস্তা খেয়ে শুয়ে পড়ল। সব রান্না করা আছে। তাই তাকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হবেনা। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙ্গল ঠিক ১১ টায়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পাশে থাকা মোবাইলটা নিয়ে ঘড়ি দেখল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। এতক্ষন ঘুমিয়েছে ভাবতেই ঈশা অবাক হয়ে গেলো। উঠেই ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়ে টেবিলে বসলো। চারিদিকে ঘুরে দেখল কেউ নেই। এমন সময় পাশের ঘর থেকে চেচামেচির আওয়াজ আসলো। কি হচ্ছে বুঝতে উঠে গিয়ে দেখে ইলহাম আর ইরা কি নিয়ে ঝগড়া করছে। ঈশা এক ধমক দিয়ে বলল
–ঝগড়া করছিস কেন?
ইরা কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–ইলহাম ভাইয়া আমার ফোনের সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছে।
ঈশা ইলহামের দিকে তাকাতেই সে বলল
–আমি ইচ্ছা করে করিনি আপি।
তার কথা শেষ হতেই ইরা বলল
–ইচ্ছা করে করেছো। তুমি মোটেই ভালো না।
বলেই দুজন আবার চেচামেচি শুরু করে দিলো। ঈশার খুব বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। অনেক বুঝিয়ে দুজনের ঝগড়া থামিয়ে দিলো। ঝগড়া থামিয়ে বেশ স্বস্তি পেলো ঈশা। তারপর ইভানের কথা মনে পড়ে গেলো। ইলহাম কে জিজ্ঞেস করলো
–ইলহাম তোর ভাইয়া কোথায় রে?
–ভাইয়া তো অফিসে গেছে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই তোমাকে ডিস্টার্ব করতে নিষেধ করে গেছে।
–কখন গেছে?
–অনেক সকালে।
–খেয়েছে কিছু?
–না।
ঈশার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে জেগে থাকলে হয়ত ইভান কে খাওয়াত। সে ঘুমিয়ে গেছে বলে না খেয়ে চলে গেলো। কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলো। কিন্তু ইভানের কথা তার মাথা থেকে বের হচ্ছেই না। কে জানে এখন অব্দি কিছু খেয়েছে কিনা। ভাবতে ভাবতেই ফোনটা হাতে তুলে নিলো। কি মনে করে ইভানের নাম্বারে ফোন দিলো। কিন্তু রিং বেজে গেলো ফোনটা ধরলনা। তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কি এমন ব্যস্ত যে তার ফোনটাও ধরতে পারল না। তার ভাবনার মাঝেই বজ্র কণ্ঠে ফোনটা বেজে উঠলো। সে চমকে ফোনটা হাতে নিয়ে থমকে গেলো। ইভান ফোন করেছে।রাগ হল তার। একবার ভাবল সেও ফোনটা ধরবেনা। কিন্তু ফোনটা কেটে যাক সেটাও সে চাচ্ছেনা। অবশেষে ফোনটা ধরে ফেললো। ঈশা কিছু বলার আগেই ইভান বলল
–কি হয়েছে জান? কোন সমস্যা?
আসলে ঈশা ইভান কে ফোন দেয়না। আর হঠাৎ ঈশার ফোন করা দেখে ইভান ভয় পেয়ে যায়। কারন সকালে অফিসে আসার সময় সে দেখেছে বাসায় কেউ নেই। ঈশা ইভানের চিন্তার কারন বুঝতে পেরে বলল
–আরে না না কিছু হয়নি।
ইভান এবার খুব আশ্চর্য হল। কোন কারন ছাড়াই ঈশা তাকে ফোন দিয়েছে বিষয়টা তার হজম হলনা। খুব শান্ত কণ্ঠে বলল
–তাহলে ফোন করেছিস কেন?
এবার ঈশা খুব বিপদে পড়ে গেলো। কি কারনে ফোন করেছে বলবে? একটু ভেবে বলল
–ইলহাম বলছিল তুমি নাকি সকালে না খেয়ে গিয়েছ। তাই খেয়েছ কিনা জানতে ফোন করতে বলল।
ইভান একটু হেসে বলল
–তুই ঘুম থেকে ওঠার একটু আগেই ইলহামের সাথে আমার কথা হয়েছে। তখন তো এমন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এখন কি মনে করে তোকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে বলল।
ঈশা এবার অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। ঈশার অবস্থা বুঝতে পেরে ইভান বলল
–মিস করছিস আমাকে?
ঈশা খুব শান্ত ভাবে বলল
–তোমাকে মিস করার মতো সুযোগ তুমি আমাকে দাও?
ইভান একটু হেসে বলল
–এই যে এখন দিলাম।
ইভানের কথা শুনে ঈশা চুপ হয়ে গেলো। তার চুপ করে থাকা দেখে ইভান বলল
–যা জানতে ফোন করেছিস জিজ্ঞেস করবিনা?
ঈশা ছোট করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–খেয়েছ?
–হুম।
ইভানের ছোট শব্দটা ঈশার মনে কেন জানি একটা চাপা কষ্টের অনুভুতি সৃষ্টি করলো। তাই তার সাথে আর একটু শব্দ জুড়ে দিয়ে বলল
–কখন আসবে?
এবার ঈশার কথা ইভানের মন ছুয়ে গেলো। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–এভাবে বললে তো এখনি চলে যাব। কিন্তু অনেক কাজ আছে।
ঈশা মুচকি হেসে বলল
–শেষ করেই আসো।
–তাড়াতাড়ি আসবো। সাবধানে থাকিস। নিজের খেয়াল রাখিস।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। ইভান তার চেয়ারে হেলানি দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবল ঈশার সাথে তার সম্পর্ক ঠিক থাকলে এই সময়টা তার জীবনে অনেক আগেই আসত। দেরি করেই হোক তবুও ঈশা তার প্রতি নিজের অনুভুতি গুলো প্রকাশ তো করছে। এতেই সে অনেক খুশি।
৩০
ইলহাম ঈশা আর ইরা বসে সোফায় টিভি দেখছিল। ইভান এখনো আসেনি। তারা চিপস খাচ্ছিল। ঈশা একটা চিপস মুখে দিয়ে বলল
–ড্রিঙ্কস হলে ভালো হতো।
ইলহাম বলল
–ফ্রিজে থাকতে পারে আপি। আমি ভাইয়াকে দেখেছি কাল দুইটা ক্যান ফ্রিজে রাখতে।
ঈশা চিপস এর প্যাকেট টা টেবিলে রেখে ফ্রিজে দেখতে গেলো। হাঁটু গেড়ে বসে দেখল দুইটা ক্যান ফ্রিজের এক কোনায়। সে দুইটা বের করে আনল। টেবিলে একটা রেখে বলল
–এই টা তোরা দুইজন ভাগ করে খাবি আর এটা আমি একাই খাবো।
ইলহাম আর ইরা দুজনেই ভ্রু কুচকে তাকাল। সে একাই খাবে মানে। তাদের সেসবে পাত্তা না দিয়ে ঈশা ক্যান টা খুলে খাওয়া শুরু করে দিলো। প্রথমে খেতে বাজে লাগলেও পরে ঠিক হয়ে গেলো। ঈশা খেয়েই যাচ্ছে তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। ইলহাম দরজা খুলে দিলো। ইভান ভিতরে ঢুকে টেবিলে রাখা ক্যান টাতেই আগে চোখ পড়লো। ভ্রু কুচকে তাকাল ক্যানটার দিকে। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখল সে একটা ক্যান হাতে ধরে আছে। ইভান রেগে
–ঈশাআআ…।
তার চিৎকারে ঈশার হাত থেকে চিপসের প্যাকেট আর ক্যান দুইটাই পরে গেলো। সবাই ভিত চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ঈশার দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিচে পরে থাকা ক্যানের দিকে তাকাল। অবশিষ্ট কিছুই নেই সেটাতে। ঈশার দিকে তাকাতেই সে ঢুলু ঢুলু চোখে ইভানের দিকে তাকাল। চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো
–চেচাচ্ছ কেন? আসতে ডাকলেও তো শুনতে পাই।
ইভান এবার রেগে ইলহাম কে বলল
–ফ্রিজ থেকে এসব কে বের করেছে?
ইভানের রাগ দেখে ইলহাম ভয়ে ভয়ে বলল
–আপি ড্রিঙ্কস খাওয়ার জন্য ফ্রিজে দেখতে গিয়ে এই দুইটা ক্যান পেয়েছে। আমাদেরকে একটা খেতে বলে নিজে একটা খেয়ে নিয়েছে।
ইভানের এবার রাগ চরম পর্যায়ে উঠে গেলো। টেবিলে থাকা ক্যান টা হাতে নিয়ে ঈশা কে হাত ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। ঈশার হাত ছেড়ে দিতেই সে হেলে দুলে পরে যেতে লাগলো। ইভান আবার তাকে ধরে বলল
–ড্রিঙ্কস আর বিয়ারের মধ্যেও পার্থক্য বুঝিস না ইডিয়েট! খাওয়ার আগে ক্যানের গায়ের লেখা গুলা ভালো করে দেখলে কি খুব ক্ষতি হতো।
ঈশা হেসে বলল
–আমি সব বুঝি।
বলেই জোরে হাসতে লাগলো। ইভান বুঝতে পারছে এভাবে বিয়ারের পুরো একটা ক্যান খেয়ে ফেলার পর ঈশা যথারীতি পাগলামি করবে। কিন্তু এখন ওকে সামলাবে কিভাবে। ঈশা নিচে বসে পড়লো। ঈশার সাথে ইভানও নিচে বসে পড়লো। ইভান ঈশাকে দেখছে। ঈশা ঢুলু ঢুলু চোখে ইভানের টি শার্ট টা খামচে ধরে তার একটু কাছে মুখটা এনে বলল
–তুমি বাজে লোক ! শুধু বকো আমাকে। ভালো করে বললে কি হয়? আমি তো তোমার কথা বুঝতে পারি।
ঈশার কথা শুনে ইভান একটু ভ্রু কুচকাল। পরক্ষনেই কি মনে করে বলল
–এই বাজে লোকটাই তোকে নিজের জিবনের থেকেও বেশি ভালবাসে। সেটাই আজ পর্যন্ত ভালো খারাপ সব ভাবেও বলে বোঝাতে পারিনি।
ঈশা আগের অবস্থায় থেকেই বলল
–জানি তো। আমিও ভালবাসি।
ঈশার কথা শুনে ইভান অসহায় চোখে তার দিকে তাকাল। এই কথাটা সে ঈশার কাছ থেকে শোনার জন্য এতো বছর অপেক্ষা করেছে। আজ শুনতে পেলো কিন্তু মাতাল অবস্থায়। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সে ঈশার দুই হাত তার কাছ থেকে ছেড়ে নিয়ে বলল
–বাজে লোকটা তোর জীবনটা বদলে দিয়েছে। তাহলে কেন ভালবাসিস এই লোকটাকে?
ঈশা এবার একটু মন খারাপ করে বলল
–দিয়েছে তো। কেন বলল না আগে আমাকে ভালবাসে?
–তুইও তো বলিস নি?
–আমি তো বলিনি ভয়ে। যদি রাগ করে।
— তোকে কি কখনও রাগ দেখিয়েছি?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে না বলে। ইভান তার দিকে তাকিয়ে বলে
–তাহলে?
–জানিনা। ভয়ে বলিনি। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভয় পাওনা তাহলে কেন বলনি?
–বলতাম। সেটার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে সময়ের অপেক্ষা করতে করতে দেরি হয়ে যাবে। তাই বলে তুই আমাকে ভালবেসেও অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবি?
–রাজি হইনি তো। বাবার ব্যবসায় লস হয়ে গিয়েছিলো। ওরা অনেক টাকা দিয়েছিলো বাবাকে। আর বলেছিল আমার সাথে ওই আরাফের বিয়ে হলে সেই টাকা ফেরত দিতে হবেনা। তাই তো বাবার কথা ভেবে রাজি হয়েছিলাম।
এবার ইভান খুব অবাক হল। এসব কথা এতদিন কেউ জানতোনা। ঈশার বাবা এসব কাউকেই বলেনি। আজ হয়ত ঈশা এরকম অবস্থায় না থাকলে জানাও হতনা। ইভান ঈশাকে দেখছে। ঈশা এবার ইভানের শার্ট চেপে ধরে বলল
–খুব রাগ হয়েছিলো। আমাকে তুলে কেন নিয়ে গিয়েছিলে? সবাই বলছিল আমাকে রেপ করেছে।
ইভান এবার আকাশ থেকে পড়লো ঈশার কথা শুনে। তার মানে এসব কথার কারনেই ঈশা তাকে ভুল বুঝেছিল। আর তার উপরে অভিমান করেছিলো। এসব নিয়ে ঈশা কখনও কথা বলেনি। বললে হয়ত সব ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়ে যেত। বিয়ের আগে ইভান ঈশাকে কখনও স্পর্শ করেনি। তাহলে ঈশা এটা মেনে নিলো কেন? প্রতিবাদ করলনা কেন? ইভান খুব শান্ত সরে জিজ্ঞেস করলো
–সেদিন কি আমি তোকে স্পর্শ করেছি?
–করনি তো সেটা আমি জানি। কিন্তু সবাই অন্য জানে।
–আমি বুঝতে পারিনি এরকম কিছু হয়ে যাবে। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোকে পেতে। ওই মুহূর্তে আমার মাথায় আর কিছুই ছিলোনা।
হতাশা নিয়ে ইভান কথাটা বলল। কথা শেষ করে হাতে থাকা ক্যানটা খুলে একটা চুমুক দিলো। ঈশা এবার ইভানের বুকে আঙ্গুল দিয়ে ঠেলা দিয়ে বলল
–আমাকে আদর কর।
ইভান ঈশার কথা শুনে মুখে থাকা বিয়ার গিলে ফেলে। কিন্তু গিলে ফেলার সময় মনে হল তার গলায় আটকে যাচ্ছিলো। ঈশা যে এমন কিছু বলবে সেটা সে ভাবেইনি। তারপর ক্যানটা পাশে রেখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলে
–আমার কাছ থেকে আদর নিতে ইচ্ছা করে তোর?
ঈশা এবার ইভানের টি শার্ট টেনে তার মুখের কাছে নিজের ঠোঁট নিয়ে গিয়ে বলে
–তুমি আমার ঠোঁটে চুমু দিলে অনেক ভালো লাগে।
কথাটা শেষ করেই ঈশা অপেক্ষা না করে ইভানের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। ইভান ঈশার এরকম কাণ্ডে হা হয়ে যায়। কিছুক্ষন হা করে ঈশার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
–আর কি কি ইচ্ছা করে তোর?
–তোমার কাছে থাকতে। তোমার সাথে গল্প করতে।
ঈশার কথা শুনে ইভান ঈশার গালে দুই আঙ্গুলে স্লাইড করতে করতে বলে
–কত ভালবাসিস আমাকে?
ঈশার চোখে পানি চলে আসে। মনের সমস্ত আবেগ দিয়ে বলে
–কত ভালবাসি তা বলতে পারবোনা। কারন সেটা প্রকাশ করার মতো যথেষ্ট শব্দ আমার জানা নেই। শুধু বলব এই জীবনের প্রাপ্তির হিসাবে শুধুই তুমি। আমি যার জন্য বাঁচি সেটাই তোমার ভালোবাসা।
“তোমার প্রতি এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি। তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ জড়িয়ে যাই আমি। আমার কিছুই আর করার থাকে না। তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে যেতে চাই। যেখানেই যেতে চাই, সেখানেই বিছিয়ে রেখেছো তোমার অনুভুতি। তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনো সম্ভব!!”
ঈশার চোখ বেয়ে অঝরে পানি পড়তে থাকে। ইভান ঈশাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে
–তোর মুখ থেকে এই কথাটা শোনার জন্য এতো বছর অপেক্ষা করেছি। সজ্ঞানে না হলেও বলেছিস তো। আমি আজ খুব খুশি জান।
ইভান কথা শেষ করে দেখে ঈশা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে কোলে তুলে নেয়। বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিজে পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। ইভানের চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। আজ যে তার জীবনে পরম সুখের মুহূর্ত।
চলবে………
(মনের কথা তো অজান্তেই বলে ফেললো। এবার কি হবে?)
তোর ছায়ার সঙ্গী হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৪
৩১
চোখে আলো পড়তেই ঈশা বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে ফেলে। কিন্তু চোখ খুলে যা দেখল সেটা দেখেই সে শক খেলো। ইভান তাকে আস্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হল। ইভান খালি গায়ে শুয়ে আছে। ঈশার এবার হার্ট বিট বেড়ে গেলো। সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। একটু সময় নিয়ে আগের কথা মনে করতে চেষ্টা করলো কিন্তু সে কাল চিপস খাওয়া পর্যন্তই মনে করতে পারল। তারপর কি হয়েছে কিছুই মনে পড়ছেনা। সে একটু শুকনো ঢোক গিলে ইভান কে আবার ভালো করে দেখে নিলো। খালি গায়ে ঈশা কে ধরে সে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। ঈশা এবার নিজেকে দেখল। তার কাপড় ও এলোমেলো। ওড়না কোথাও খুজে পাচ্ছেনা। ঈশার শরীর ঘামতে শুরু করলো। কি করবে বুঝতে পারছেনা। সে এক ঝটকায় ইভান কে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো। ইভানের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় রাগ করে বলল
–হচ্ছেটা কি?
ঈশা একটু ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। কিন্তু তারপরে কাদ কাদ হয়ে বলল
–তুমি এখানে কেন?
ইভান ঈশার কথার উত্তর না দিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–কাল সারা রাত ঘুমাতে দিস নি। এখন আবার সকাল সকাল উঠে কেন নাটক করছিস?
ইভানের কথা শুনে ঈশা শুকনো ঢোক গিলে বলল
–সারা রাত ঘুমাতে দেইনি মানে? কি করেছি?
ইভান এবার মাথা তুলে অবাক চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সিরিয়াসলি ঈশা! তোর কিছুই মনে নেই!
ঈশা অসহায়ের মতো মাথা নাড়াল। ইভান এবার সোজা হয়ে শুয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে বলল
–কি করেছিস সেটা মুখে কিভাবে বলব। প্রাক্টিক্যালি রাতে করে দেখাব। তখন দেখে নিস। এখন ঘুমা আর আমাকেও ঘুমাতে দে।
ঈশা এবার চোখ বড় বড় করে বলল
–কি বলছ এসব?
ইভান এবার বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। ঈশাকে পুরোটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–নিজের অবস্থা দেখেও বুঝতে পারছিস না নাকি বুঝতে চাইছিস না।
ইভানের কথা শুনে ঈশা নিজের দিকে ভালো করে দেখে নিলো। চুল গুল এলোমেলো। কাপড় ও এলোমেলো। ইভানের গলায় হালকা ঈশার কাজলের কালির অংশ লেগে আছে। মাথার পিন গুলো বিছানায় ছড়ানো। একটু ঘুরতেই চোখে পড়লো তার ওড়না আর ইভানের শার্ট মেঝতে পড়ে আছে। পাশে থাকা বিয়ারের ক্যান টা চোখে পড়তেই ঈশা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে চিৎকার করে বলল
–ওই যে ওই ড্রিঙ্কস টা আমি খেয়েছিলাম। কিন্তু তার পরে আর কিছু মনে নেই কেন?
ইভান বিয়ারের ক্যানের দিকে তাকিয়ে বলল
–ওটা ড্রিঙ্কস না বিয়ার ছিল। আর ওটা খেয়েই তো তুই আমা……।
বলেই থেমে গেলো ইভান। ঈশা চোখ বড় বড় করে বলল
–বিয়ার মানে? তুমি আমাকে বিয়ার খাইয়েছ?
ইভান এবার রাগি চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–একটা থাপ্পড় মেরে সোজা বানিয়ে দিবো। আমি তোকে কখন খাওয়ালাম। আমি যদি ঠিক সময় মতো না আসতাম তাহলে তুল কালাম কাহিনি ঘটিয়ে ফেলতিস। আমার সাথেই যা করেছিস। আল্লাহ জানে আমি না থাকলে কি হতো!
ঈশা এবার একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল
–ওটা খেয়ে আমি কি করেছি?
ইভান ঈশার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কি করিস নি সেটা জিজ্ঞেস কর। অবশ্য তোর এই নতুন রুপের সাথে পরিচিত হয়ে ভালই লেগেছে। খারাপ হয়নি। নিজের সমস্ত আবেগ দিয়ে তোকে ভালবেসেছি। মন ভোরে আদর করেছি সারা রাত।
ইভানের কথা শুনে ঈশা এবার ঘাবড়ে গেলো। একটু ভেবে বলল
–কিন্তু তুমি যে বলেছিলে আমাকে জোর করবেনা। তাহলে?
ইভান এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলল
–জোর করিনি তো! তুই তো বললি ভালবাসিস তাই আদর নিবি। আর তুই আমার কাছে কিছু চাইলে সেটা আমি তোকে না দিয়ে থাকতে পারি না। তুই তো জানিস।
ঈশা ইভানের কথা শুনে চমকে গেলো। এরকম কথাও কি ঈশা বলেছে। বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার। সামনে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে বলল
–আমি কি এরকম বলেছি?
ইভান একটু হেসে ঈশার একদম কাছে চলে আসে। তার কানে আসতে করে একটা কামড় দিয়ে বলে
–এখন এখানে এভাবে বসে থাকলে যে কোন সময় আমার মুড চেঞ্জ হতে পারে। তখন কিন্তু তুই চাইলেও আমি তোকে ছাড়বনা।
ঈশা ইভানের কথা বুঝতে পেরে এক দৌড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। দরজা বন্ধ করে দরজায় হেলানি দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ভাবতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু মনে পড়ছেনা। আবার ইভানের কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাসও করেত পারছেনা। মনে একটা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সামনে থাকা আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো। চোখের কাজল লেপটে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুই বুঝতে পারছেনা। মাথাটাও প্রচণ্ড ব্যাথা করছে। বেশ খানিকটা সময় ওয়াশ রুমে বসে থাকলো ঈশা। বাইরে ইভান মুচকি মুচকি হাসছে। ঈশার এতোটা সময় ওয়াশ রুমে থাকায় ইভান এবার চিৎকার করে বলল
–এতক্ষণ ওয়াশ রুমে কি করছিস? তুই নিজে বের হবি নাকি আমি বের করে আনবো?
ইভানের কথা শুনে ঈশা বের হয়ে এলো ওয়াশ রুম থেকে। ইভান তার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। ইভানের ওভাবে তাকানো দেখে ঈশা নিচে পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। ঈশাকে আর একটু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে ইভান বলল
–সারা রাত এতো কিছু হল তখন তো লজ্জা পেলিনা। বরং মজা নিলি। আর এখন লজ্জা উপচে পড়ছে?
তার কথা শুনে ঈশার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
৩২
সারা শরীর কাপুনি দিয়ে জর আসছে। অনেকটা দুর্বল ও লাগছে। খাবার রুচি নেই একদম। ঈশা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সব কিছু কেমন অসহ্য লাগছে। এর মাঝে ইরা খাবার নিয়ে আসলো। কিন্তু সে খুব বিরক্ত হল। ধমক দিয়ে বলল
–এভাবে বিরক্ত করলে কিন্তু আমি বাড়ি থেকে চলে যাব।
ইরা তার আচরনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কই যাবে আপু?
চোখ বন্ধ করেই ঈশা বলল
–কেন আমার যাওয়ার জায়গা নেই? তোরা কি ভাবিস আমি এই বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে পারব না।
–কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা আছে একটু শুনি?
ইভানের ভারি গলার আওয়াজ শুনে ঈশা চমকে উঠে বসলো। ইরা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–আরে ভাইয়া তুমি! অফিস থেকে কখন এলে?
–মাত্র এলাম।
ইরার মাথায় হাত দিয়ে একটু হেসে বলল
–ওটা আমাকে দে। আমি খাইয়ে দিবো। তুই যা।
ইরা ইভানের হাতে খাবার দিয়ে চলে গেলো। ইভান ঈশার সামনে খাবারের প্লেট ধরতেই ঈশার উকি আসলো। ঈশা মুখ চেপে উকাতে লাগলো। ইভান প্লেট টা সরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে । ঠোঁটে তার সেই ডেভিল হাসি। ঈশা নিজেকে সামলে নিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে তার হাসি দেখে একটু অবাক হল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে একটু ভাবল তার হাসির কারন। একটু ভেবেই ইভানের দিকে তাকাল। সে তখনও হাসছে। ঈশা এবার একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–হাসছ কেন?
ইভান তার হাসিটা বন্ধ করে বলল
–এতো বড় একটা খুশির খবর আর আমি হাসবনা।
ঈশা বুঝতে না পেরেও ভ্রু কুচকে বলল
–কিসের খুশির খবর?
ইভান হতাশা নিয়ে বলল
–তুই কি সব ভুলে গেলি?
ঈশা এবার ভয় পেয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল
–কি বলতে চাইছ তুমি?
ইভান নিরুত্তর হাসল। ঈশা আবার জিজ্ঞেস করলো
–ঠিক করে বলত তুমি কি নিয়ে কথা বলছ?
ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–সেই দিন রাতের পর থেকে তোর খাবারে অরুচি হয়। বমি পায়। এসব তো আর এমনি এমনি হয়নি।
ঈশা একটু ভেবে আনমনে বলে
–হ্যা।
বলেই ইভানের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। ইভান ঈশার একটু কাছে এসে সামনের চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বলে
–তুই কি এখনো কিছুই বুঝতে পারছিস না?
কথাটা শুনে ঈশার মাথা ঘুরে উঠে। সে ঘামতে থাকে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। তার অবস্থা বুঝতে পেরে ইভান পানির গ্লাসটা ঈশার সামনে ধরে। ঈশা পুরো গ্লাসের পানিটা একবারে শেষ করে ফেলে। ভয়ে ভয়ে ইভানের দিকে তাকায়। ইভান তার হাত থেকে গ্লাস টা নিয়ে টেবিলে রেখে দেয়। তারপর ঈশার একটু কাছে এসে প্লেট থেকে খাবার নিয়ে ঈশার মুখে ধরে বলে
–খেয়ে নে। তোর জন্য না হলেও আরেক জনের কথা তো ভাবতে হবে।
ঈশা ইভানের কথা শুনে হা হয়ে গেলো। আর ইভান তার মুখে জত্নে খাবার দিতে লাগলো। ঈশাকে সব খাবার খাইয়ে দিয়ে ইভান উঠে গেলো। খাবার প্লেট টা বাইরে রেখে হাত ধুয়ে আবার এলো। ঈশা আনমনেই ভাবছে। ইভান ঔষধের বক্স থেকে ঔষধ টা বের করে ঈশার সামনে ধরল। ঈশা ঔষধের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে সরে গেলো। ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–আমি খাইয়ে দিবো?
ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–না না। আমি একাই খেতে পারব।
–তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।
ঈশা আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলো। সাথে সাথে ইভান তার হাতে চকলেট টা ধরে দিলো। ঈশা প্যাকেট টা খুলে চকলেট টা মুখে নিয়ে নিলো। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–রেস্ট নে।
ঈশা কোন কথা না বলে বসে থাকলো। ইভান এবার ঈশার পাশে বসে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–শুয়ে পড়! মাথা টিপে দিবো?
ঈশা ইভানের দিকে ঘুরে তাকাল। মাত্র অফিস থেকে এসেছে। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। আবার সেই কিনা তার মাথা টিপে দিবে। এই মানুষটা এতো এনার্জি কোথায় পায়। ঈশার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে ইভান একটু হেসে বলল
–তোর এই চেহারাটা দেখলেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
ঈশার গালে হালকা স্পর্শ করে বলল
–আমার সব এনার্জি এখান থেকে আসে।
ঈশা অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটা মানুষ কিভাবে এতো নিখুঁত ভাবে আরেকটা মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। এটাও কি সম্ভব। ইভান ঈশাকে বিছানায় শুয়ে দিলো। তারপর তার মাথা টিপে দিতে দিতে বলল
–নিজেকে সব সময় ভালো রাখার চেষ্টা করিস। তাহলেই আমিও ভালো থাকব।
ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইভান একটু হেলে ঈশার কিছুটা কাছে গেলো। ইভানের মাতাল করা সেই পারফিউম ঈশাকে আজও সেদিনের মতো তার কাছে টানছে। এভাবে বেশিক্ষন থাকতে না পেরে ঈশা বলল
–তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। আমি ঘুমিয়ে যাব।
ইভান আর কিছু না বলে উঠে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে ঈশার দিকে একবার ঘুরে বলল
–শুধু নিজের খেয়াল রাখলেই কি হবে? আরেকজনের খেয়ালও তো রাখতে হবে!
ইভানের কথা শুনে ঈশা চোখ খুলে বড় বড় করে তার দিকে তাকাল। ইভান একটু হেসে বের হয়ে গেলো।
চলবে………।
(ইভান এটা কি বলল??)