তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ১৭,১৮
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৭
৩৮
অনুভূতিহীন নিরব দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে ঈশা। তার দৃষ্টিতে আজ কোন অনুভুতি নেই। হয়ত মানুষের সব থেকে কষ্টের সময় অনুভুতি শুন্য হয়ে যায়। আশে পাশে সবাই কাঁদছে। কিন্তু ঈশার চোখে কোন পানি নেই। ইভানের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তাই সবাই বেশ চিন্তিত। সবাই কান্নাকাটি করছে। কিন্তু ঈশা কোন কথাই বলছেনা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। নার্সের ব্যস্ত কণ্ঠ শুনে তার ধ্যান ভাঙ্গে
–এখনি আরও এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন।
ঈশা ফিরে তাকায়। রাশিক আর সাহিল রক্ত ম্যানেজ করতে বের হয়ে যায় দ্রুত। ঈশা খুব শান্ত কণ্ঠে নার্স কে জিজ্ঞেস করে
–আমি কি একবার ইভান কে দেখতে যেতে পারি?
নার্স তার দিকে একবার তাকায়। ঈশার মনের অবস্থা বুঝতে পারে তিনি। হালকা হাতে তার মাথা স্পর্শ করে বলে
–আমার হাতে কিছুই নেই মা। তুমি দোয়া কর। আমি তোমাকে অনুমতি দিতে পারবোনা।
নার্সের কথা শেষ হতেই একজনের কণ্ঠ শুনে দুজনেই পিছনে ফিরে তাকায়।
–ওকে যেতে দিন।
কথাটা বলতে বলতে রিহাব সামনে এগিয়ে আসে। ঈশা অসহায়ের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। নার্স কিছু না বলে চলে যায়। রিহাব ঈশার সামনে দাড়িয়ে বলে
–আমাকে চিনতে পেরেছ ঈশা?
ঈশা রিহাবের দিকে তাকিয়ে বলে
–আপনি এতদিন পর?
রিহাব একটু হেসে বলে
–পড়ালেখা শেষ করতে এতদিন দেশের বাইরে ছিলাম। শেষ করে গত সপ্তাহে ফিরেছি। বাবার হসপিটালের দায়িত্ব গুছিয়ে নিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এর মাঝে শুনলাম ইভান এসেছে। ভেবেছিলাম একটু গুছিয়ে নিয়ে তোমাদের সাথে দেখা করতে যাব। কিন্তু আজ সাহিল ফোন দিয়ে খবর দিলো। তখনি আমি তাড়াতাড়ি ওকে এখানে আনতে বলি।
রিহাব ইভানের ছোটবেলার বন্ধু। খুব ভালো সম্পর্ক দুজনের মধ্যে। রিহাব ডাক্তারি পড়ার জন্য দেশের বাইরে চলে যায়। তাই তাদের মধ্যে মাঝখানে তেমন যোগাযোগ ছিলোনা। পড়া শেষ করে ফিরে এসে নিজের বাবার হসপিটালের দায়িত্ব নিয়ে নেয় সে।
ঈশা অসহায়ের মতো বলে
–আপনাকে দেখে মনের মাঝে একটু হলেও স্বস্তি পেলাম রিহাব ভাইয়া।
রিহাব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–তুমি ভিতরে যাও। তোমার ওকে এই মুহূর্তে খুব দরকার। তবে হ্যা কিছু রুলস আছে জেগুলা তোমাকে মানতে হবে।
ঈশা মাথা নাড়িয়ে আই সি ইউর পোশাক পরে ভিতরে চলে গেলো। ভিতরে ঢুকেই দেখল ইভানের জ্ঞান শুন্য দেহটা বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে আছে। ঈশার চোখ ভরে আসলো। কিন্তু সে কাঁদতে পারবেনা। রিহাব স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছে ঈশাকে। চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে ইভানের পাশে বসলো। তার হাত ধরে বলল
–আমি জানি তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।
৩৯
সবার চোখে মুখে খুশির ছটা ইভানের জ্ঞান ফিরেছে। কিছুক্ষন পরেই তাকে কেবিনে শিফট করা হবে। সবাই তার সাথে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে। নার্স এসে বলল
–রুগিকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। আপনারা চাইলে দেখা করতে পারেন।
সবাই ঘরে গেলো। ইভান কে দেখে সবাই খুব খুশি। তার সাথে এক এক করে কথা বলছে। রিহাব এসে রুমে ঢুকতেই ঈশার বাবা বলল
–আমরা এখন বাইরে যাই। ওর রেস্ট দরকার।
তার কথা শুনে সবাই বাইরে চলে গেলো। রিহাব এসে ইভানের পাশে বসলো। রিহাব কে দেখে ইভান অবাক হয়ে বলল
–তুই?
রিহাব রেগে বলল
–আমিই তোর ট্রিটমেন্ট করেছি।
ইভান খুব শান্ত কণ্ঠে বলল
–তুই কবে এসেছিস? আর আমার সাথে দেখা করিস নি।
রিহাব বলল
–১ সপ্তাহ হল এসেছি। সব গুছিয়ে নিয়ে ভেবেছি তোর সাথে দেখা করবো। কিন্তু তার আগেই তো তোর এই অবস্থা!
ইভান খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো
–ঈশা কোথায়?
রিহাব একটু হেসে বলল
–তোর কাছেই সারা রাত ছিল। তাই আমিই একটু রেস্ট নিতে বাসায় পাঠিয়েছিলাম। চলে আসবে।
ইভান চিন্তিত হয়ে বলল
–ঠিক আছে তো?
–ভাবিস না। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো। পরে ওর অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে তোর কাছে থাকার পারমিশন দেই। তারপর একটু শান্ত হয়।
তাদের কথার মাঝেই রাশিক আর সাহিল ঢুকে পড়লো। দুজনি তাদের দিকে তাকাল। সাহিল এসে রিহাবের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–তুই না থাকলে যে কি হতো?
রিহাব ওকে হালকা হাতে মেরে বলল
–এতদিন পর দেখা হল বলে পর ভাবছিস তাই না? তাই তো এরকম কথা বলছিস। আমি বিপদে পড়লে কি তোরা আমাকে ফেলে চলে যেতিস?
তার কথা শুনে সবাই একটু হাসল। রাশিক ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–ঠিক করে বলত কিভাবে হল এটা?
ইভান নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
–যা ভেবেছিস তাই। কিন্তু এই বিষয়ে আর কোন কথা না। কারও কানে যেন কিছুই না যায়। মনে রাখিস।
ইভানের কথা শেষ হতেই ইরা ভিতরে ঢুকে এক গাল হেসে বলল
–ভাইয়া কেমন আছো?
তাকে দেখে ইভান হেসে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। ইরা তার কাছে আসতেই বসতে বলল। সে পাশে চেয়ারে বসে পড়লো। ইভান তার হাত ধরে বলল
–আমি ভালো আছি। কিন্তু তোর কথা বল। কেঁদে কেঁদে কি অবস্থা বানিয়েছিস?
ইরা একটু মন খারাপ করে বলল
–খুব ভয় পেয়েছিলাম। তুমি কিভাবে বুঝবে তুমি কি দেখেছ নিজের অবস্থা?
ইরার এমন অবুঝের মতো কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। ইরা একটু লজ্জা পেলো। ইভান ইরাকে জিজ্ঞেস করলো
–খেয়েছিস?
ইরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো
–ইলহাম কে দেখছিনা?
–ভাইয়া আপুকে নিয়ে বাসায় গেছে। চলে আসবে এখনি।
রশিক আর সাহিল তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে গেলো। ছেলে গুলো খুব খেটেছে। তাই একটু বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবে। ইভান কিছু বলতে যাবে রিহাব কে তাই পাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখল রিহাব নিস্পলক ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন রিহাবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
–এটা হসপিটাল তাই ডাক্তার এর মন সব সময় পেশেনটের উপরেই থাকা উচিৎ।
ইভানের কথা শুনে রিহাব ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাল। ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রিহাব তার কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন ভাবার পর রিহাবের বুঝতে বাকি থাকলো না সে কি বুঝাতে চেয়েছে। তাই একটু হেসে বলল
–ডাক্তার হওয়ার আগে আমি একজন মানুষ। হসপিটালে আসার সময় নিজের অনুভুতি গুলো বাসায় রেখে আসিনি। সাথে করে এনেছি।
ইভান তার কথা শুনে হাসল। ইরা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া তুমি রেস্ট নাও। আমি একটু আসছি। আপু আসলে আবার আসবো।
বলেই বের হয়ে গেলো। রিহাব ইরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
–ভেবেছি প্রতিদিন একবার তোর বাসায় চা খেতে যাব। নিয়ম করে।
ইভান কঠিন গলায় বলল
–আমি ওর বড় ভাই এখনো বেঁচে আছি।
রিহাব তার দিকে তাকিয়ে বলল
–প্রেমিক পুরুষেরা এসবের ভয় করেনা।
–ও কিন্তু ঈশার মতো নয়। খুব স্ট্রিক্ট।
–আমি ডাক্তার। স্ট্রিক্ট কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় সেটা আমি ভালো করেই জানি।
তাদের কথার মাঝেই ঈশা আর ইরা ঢুকল। ঈশাকে দেখে রিহাব তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি এতো তাড়াতাড়ি এলে কেন? তোমাকে আমি রেস্ট নিতে পাঠিয়েছিলাম।
ঈশা ধির কণ্ঠে বলল
–আমার রেস্ট নেয়া হয়ে গেছে ভাইয়া।
রিহাব চোখ ফিরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। সে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি বস আমি যাই।
বলেই উঠে পাশে দাঁড়ালো। ঈশা চেয়ারে বসে পড়লো। ঈশাকে বসতে দেখে রিহাব ইরার সামনে দাড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির কণ্ঠে বলে
–ওরা কথা বলুক। তুমি আমার সাথে আসো।
রিহাবের কথা শুনে ঈশা আর ইভান দুজনেই তার দিকে তাকাল। রিহাব তাদের দিকে একবার তাকিয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ধমকের সূরে বলল
–কি হল চল!
ইরা রিহাবের ধমকে একটু হকচকিয়ে গেলো। তারপর কোন কথা না বলে ঈশা আর ইভান কে একবার দেখে নিয়ে বাইরে চলে গেলো। রিহাব ইভানের দিকে তাকিয়ে হাসল। তাদের দুজনের বাইরে যাওয়ার দিকে ঈশা তাকিয়ে থাকলো। ইভান ঈশার দিকে তাকাতেই ঈশাকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে বলল
–এতো টেনশন করার কিছুই নেই। তুই জানিস রিহাব কেমন ছেলে! তাছাড়া আমি আছি তো এসব নিয়ে ভাবতে। তোর এই মলিন মুখটা আমাকে খুব কষ্ট দেয় জান।
ইভানের কথা শুনে ঈশা তার দিকে তাকাল। ইভানের দিকে তাকাতেই ঈশার চোখ ভরে এলো। চোখ নামিয়ে নিতেই দুই ফোটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। ইভান তার হাত শক্ত করে বলল
–আমার শারিরিক কষ্টের চেয়ে তোর চোখের পানিটা আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। তুই কি বুঝতে পারিস না?
ইভানের কথা শুনে ঈশা চোখের পানি মুছে ফেললো। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছেনা কিছুতেই। আবার দু চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। ইভান আবার বলল
–তুই জানিস তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি। তুই এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আমি কিভাবে ঠিক থাকি বল।
ঈশা দুই হাতের পিঠ দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল
–কত ভয় পেয়েছিলাম জানো?
–কি ভেবেছিলি আমি মরে গেছি!
ঈশা রাগ করে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি কি কখনও ভালো কথা বলতে পারনা?
ইভান একটু হেসে বলল
–পারিনা যে সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। পারলে এতদিনে কবেই তোকে পোটেই ফেলতাম।
ঈশা এবার আরও রেগে গেলো। কঠিন দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইভান মুচকি হেসে বলল
–আমার এই ঈশাকেই বেশি ভাললাগে। জেদি রাগী কিন্তু ইনোসেন্ট! ইমোশনাল ঈশা আমার একেবারেই পছন্দ না।
ঈশা খুব বিরক্ত হয়ে বলল
–আমি তোমার উপরে বিরক্ত হচ্ছি।
–জানি তো! তোর আর আমার সম্পর্কটাই এরকম। আমি বিরক্ত করবো আর তুই বিরক্ত হবি।
ইভানের কথা শুনে ঈশা কি বলবে বুঝতে পারলনা। কিন্তু না চাইতেও হেসে দিলো। কারন সত্যিই ইভান আর ঈশার সম্পর্কটা এরকমই। ভালবাসাময় খুনসুটিতে ভরা এই মিষ্টি সম্পর্ক।
৪০
রিহাব ইরার সামনে দাড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
–তুমি এখন কি করছ ইরা?
ইরা এতক্ষন নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার কথা শুনে মাথা তুলে বলল
–অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি ভাইয়া।
–খুব ভালো। পড়া শেষ করে কি করবে ভাবছ?
–আপাতত তেমন প্ল্যান নেই। সময় হলে ভাববো।
রিহাব হাত গুঁজে ভালো করে দাড়িয়ে বলল
–আর বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছ?
ইরা রিহাবের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে
–ভাবার কি আছে? যখন সময় হবে তখন ভাববো।
–কেমন ছেলে পছন্দ তোমার?
ইরা এবার আরও অবাক হয়ে তাকায়। কি বলবে বুঝতে পারেনা। তার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে রিহাব বুঝতে পারল ইরা তার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে বলে
–জাস্ট কিউরিসিটি থেকেই জিজ্ঞেস করলাম।
ইরা আবার ফোনে মনোযোগ দিলো। তারপর কি মনে করে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল
–ইভান ভাইয়াকে আমরা কবে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারব?
–একটু সুস্থ হলেই নিয়ে যেতে পারবে।
ইরা আবার ফোনের মাঝে চোখ ডুবিয়ে দিলো। রিহাব কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–তোমার কি কোন বয় ফ্রেন্ড আছে?
ইরা চোখ তুলে রিহাবের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাল। এমন প্রশ্ন করার কারন বুঝতে চাইলো। কিন্তু না বুঝেই মাথা নাড়িয়ে না উত্তর দিলো। রিহাব ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে একটু কঠিন গলায় বলল
–তাহলে এতো মনোযোগ দিয়ে কার সাথে চ্যাটিং করছ?
ইরা এবার একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। রিহাব এভাবে তাকে জেরা করছে কেন? আর সেই বা বুঝল কিভাবে যে ইরা চ্যাটিং করছে? রিহাবের এমন আচরনের মানে বুঝতে না পেরে ইরা তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রিহাবও ইরার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছেনা। এমন সময় নার্স এসে বলল
–স্যার আপনাকে একটু ৬ নাম্বার রুমে ভিজিটে যেতে হবে।
রিহাব নার্সের দিকে তাকিয়ে ইশারায় যেতে বলল। তারপর ইরার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল
–এখন থেকে আশে পাশের মানুষকে সময়টা একটু কম দিবে। কথাটা মাথায় রেখো!
কথাটা শেষ করেই সে সামনের দিকে চলে গেলো।
চলবে………।
তোর ছায়ার সঙ্গী হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৮
৪১
বারান্দায় সামনে তাকিয়ে ভাবছে ইভান। এই কয়দিনে ঈশার সাথে ভালো করে কথাই হয়নি তার। এমন কি ঈশা যে একবারেই তার কাছে চলে এসেছে সেটাও তাকে জানায়নি। আজ সকালে হসপিটাল থেকে বাসায় এসে জানতে পেরেছে। সে এখন পুরপুরি সুস্থ। তবে রিহাব বলে দিয়েছে কয়দিন বাসায় রেস্ট নিতে। এখনি যাতে অফিসে না যায়। তাই কয়দিন বাসাতেই থাকবে। ভাবতেই তার মুখে এক প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। এই কয়দিন ঈশার সাথেই কাটাবে।
ঈশা মাত্র ওয়াশ রুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। চুল গুলো ভালো করে মুছে ভেজা টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিতে গিয়ে দেখে ইভান বারান্দায় হাত গুঁজে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা শান্ত ভাবে বলল
–কিছু বলবে?
ইভান গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–তুই উপর থেকে একবারেই চলে এসেছিস আমাকে বলিস নি কেন?
ঈশা টাওয়ালটা মেলে দিতে দিতে বলল
–বাসায় এসে তো দেখতেই। তাই বলিনি।
ইভান কঠিন গলায় বলল
–আর যদি মরে যেতাম তাহলে তো জানতেই পারতাম না।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–জীবনের হিসাব না মিটিয়েই মরে যাবে? হার মেনে গেলে?
ঈশার কথা শুনে ইভান তার কাছে এসে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলে
–তোর সাহস খুব বেশি হয়ে গেছে। আমার কথার জালে আমাকে ফাসাতে চাস?
–এমন কথা বল কেন যেটাতে নিজেই ফেসে যাও।
ইভান ঈশার হাতের বাধন আলগা করে দিয়ে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ঘাড়ে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলে
–তুই আমাকে তোর জালে অনেক আগে ফাসিয়েছিস। এখন আমি চাইলেও সেখান থেকে বের হতে পারবোনা। আর আমি চাইওনা।
ঈশা ইভানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা একটু দূরে গিয়ে বলল
–আমি তোমাকে ফাসাইনি। তুমি নিজেই ফেসেছ।
ইভান ঈশাকে আবার ধরে উলটা ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে তার পিঠ লেপটে নিয়ে বলল
–তোর মাঝে এক অদ্ভুত মায়া আছে। যেখান থেকে বের হওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। কি করেছিস আমাকে বল তো! কেন এমন হয়? কেন তোকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারিনা।
এমন সময় ইভানের মা ঈশাকে ডাকে। ইভান আলতো করে ঈশার গালে একটা চুমু দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। ঈশা ছাড়া পেয়ে তার কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে উলটা ঘুরে বলল
–জাদু করেছি। যাতে সারা জীবন এভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারি। আমার এই মায়ার জাল কেটে বের হওয়া এতো সহজ না মিস্টার ইভান মাহমুদ।
ঈশার কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে একটু চিল্লিয়ে বলল
–কি বললি তুই?
ঈশা তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে একটু হেসে চলে গেলো। তার হাসি দেখে ইভান হেসে ফেললো। দেয়ালের সাথে হেলানি দিয়ে বলল
–তোর মায়ার জাল থেকে আমি কখনই বের হতে চাইনি। আর তোকেও আমার মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছি। তাই তো আজ তুই আমার কাছে। তোকে আমি অনেক সুখে রাখব জান। তোর জীবনে কষ্ট বলে কিছুই থাকবে না।
৪২
বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশের বিশাল চাঁদটার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে ইভান। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। ঈশা পিছনে দাড়িয়ে বেশ বুঝতে পারছে ইভান কোন বিষয় নিয়ে ভাবছে। ঈশা ধির পায়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়েই বলল
–কি ভাবছ?
ইভান ঈশার কথা শুনে চমকে উঠলো। পাশে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–আর তো ভাবার কিছু নেই। সব ভাবনা আজ থেকে শেষ। তুই এখন আমার কাছে।
ঈশা ইভানের কথার গুরুত্ব না দিয়ে একটু হেসে বলল
–কি এমন কথা যা আমাকে বলতে চাইছনা?
ইভান ঈশার কথা শুনে একটু ভাবল। সত্যিই এমন কিছু কথা আছে যা সে ঈশাকে বলতে চায়না। হয়ত এটা ঈশার সাথে অন্যায়। কিন্তু তারই বা কি করার আছে। ঈশা যে তার অনেক সাধনার প্রাপ্তি। তাকে সে যে কোন উপায়েই ভালো রাখতে চায়। আর সবটা দিয়েই ভালো রাখবে। তাই তো এতো লুকচুরি। ঈশার দিকে ঘুরে একটু হেসে বলল
–তুই জানিস আমি কোন কারন ছাড়া কিছুই করিনা। কখনও যদি জানতে পারিস কিছু লুকিয়েছি তাহলে সেটারও কারন আছে। বিশ্বাস করিস তো আমাকে?
ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
–তোমাকে আমি কতটা বিশ্বাস করি সেটা বোধ হয় এখনো বলার প্রয়োজন নাই। বিশ্বাস করেই এতো বছর ছেড়ে দিয়েছিলাম।
ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–বিশ্বাসের কত টুকু মর্যাদা রাখতে পেরেছি সেটা তুই কিভাবে সিউর হচ্ছিস?
ঈশা একটু হেসে বলল
–তোমার একটা বান্ধবি ছিল তন্নি। মনে আছে?
ইভান মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। একটু ভেবে বলল
–কিন্তু তার সাথে অনেক দিন কোন যোগাযোগ নেই।
–কত বছর হল বলতে পারবে?
–প্রায় ৪ ব……।
কথাটা শেষ না করেই ঈশার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা সামনে তাকিয়ে আছে। ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–এই তন্নির সাথে যখন আমার বন্ধুত্ব হয়েছিলো তার কিছুদিন পরেই তোর সাথে আমার বিয়ে হয়। আর তারপর পরিস্থিতির স্বীকারে আমি তোকে ওর কথা বলতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎই ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমন কি আমি করার চেষ্টা করলেও ও কোন রকম রেসপন্স করেনা। কিন্তু তুই জানলি কিভাবে?
ঈশা একটু হেসে ইভানের কাছে আসে। তার কপালে ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। সেগুলো আলতো করে সরিয়ে দেয়। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে
–আমার বর কোথায় কি করছে সেটা আমাকে জানতে হবেনা? নাহলে বউ হলাম কিভাবে?
ইভান ঈশার কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। একটু ভেবে বলে
–এই তোর বিশ্বাসের নমুনা! বড় বড় লেকচার দিলি তো ঠিকই কিন্তু পরক্ষনেই আবার সন্দেহও করলি।
ঈশার মুখের হাসি বন্ধ হয়ে চোখ মুখ কুচকে গেলো। রাগ নিয়ে বলল
–বিশ্বাস করেছি বলে কি মেয়েদের মাঝে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসবো? এটাই কি আশা করছ? মোটেই না।
ইভান মুখ টিপে হাসল। ঈশার কোমর আঁকড়ে ধরে বলল
–কি করেছিস মেয়েটার সাথে?
ঈশা নরম গলায় বলল
–নাম্বার খুঁজে বের করে ফোন করে হুমকি দিয়েছি। আমার বরের কাছে আমি কোন মেয়েকে এলাউ করিনা। তোমার থেকে যেন দূরে থাকে।
ইভান অবাকের সূরে বলল
–কি মেয়ে রে বাবা! তোকে বিয়ে করে কি জীবনের সব সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছি? কি যে ভুল করলাম এখন বুঝতে পারছি।
ঈশা রেগে ইভানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ইভান মুচকি হেসে ভিতরে এসে দরজাটা লক করে দিলো। পিছন থেকে ঈশাকে জড়িয়ে ধরে। পকেট থেকে চেনটা বের করে ঈশার গলায় পরিয়ে দেয়। তারপর সামনে ঘুরিয়ে লকেট টাতে একটা চুমু দেয়। লকেটে আই লেখা আছে। ঈশা নিজের ওড়নার মাথা মুঠ করে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইভান ঈশাকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুয়ে দিলো। ঈশা উঠে বসতে চেষ্টা করতেই ইভান তাকে চেপে ধরল বিছানার সাথে। ঈশার মুখে ফু দিয়ে সামনের চুল গুলা সরিয়ে দিলো। ঈশার গলা শুকিয়ে আসছে। সে চোখ বন্ধ করে শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। ইভান ঈশার গলায় কিস করতে লাগলো। ঈশা আর সহ্য করতে না পেরে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান তাকে আরও জোরে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল
— পৃথিবীর সব সুখ তখনি নিজের মনে হয়, যখন ভালোবাসার মানুষটি ভালোবেসে পাশে থাকে। আর তখনি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয় যখন ভালোবাসার মানুষটি বিশ্বাস দিয়ে বিশ্বাস রাখে। আজ আমার সুখের শেষ নেই। কিন্তু এই মুহূর্তটা আরও সুখের করতে চাই। আমাকে একটু ভালোবাসা দিবি? যে ভালোবাসায় থাকবে না কোন দুঃখ । থাকবে না কোন,না পাওয়ার যন্ত্রনা। থাকবে না মায়া কাঁন্না। থাকবে শুধু সীমাহীন অনুভূতি । যেই অনুভূতি কে সাথি করে কাটিয়ে দিবো সারাটা জীবন।
ইভানের কথা শুনে ঈশা লজ্জায় মিইয়ে গেলো। ইভান ঈশার সম্মতি বুঝতে পেরে তাকে ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে দিতে লাগলো। আজ দুজন দুজনকে ভালোবাসার পরম স্পর্শে ভরিয়ে তুলছে। দুজনের ভালোবাসার মাঝে তারা একে অপরকে বিলিন করিয়ে দিচ্ছে। সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়া তাদের ভারি নিশ্বাস অফুরন্ত ভালোবাসার সিমাহিন অনুভূতির সাক্ষ্য দিচ্ছে আজ।
৪৩
ইভান ঘুম থেকে উঠে দেখে ঈশা নেই। পাশে পড়ে থাকা টি শার্টটা পরে নিয়ে বাইরে গেলো। পুরো বাড়ি কেমন নিস্তব্ধ। কেউ নেই। রান্না ঘরে চোখ পড়তেই দেখল ঈশা কিছু একটা করছে খুব মনোযোগ দিয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষন আগেই গোসল করেছে। চুলের পানিতে কোমরের নিচে ভিজে গেছে। ইভান ধির পায়ে তার কাছে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঈশা চমকে উঠতেই বলল
–রিলাক্স জান। আমি।
ঈশা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে। আমি ভয় পেয়েছিলাম কত।
–আমি ছাড়া তোকে এভাবে কেউ ধরবে সেই সাহস কারও নেই। সেটা মাথায় রাখলেই এতো ভয় পেতিনা।
ঈশা ইভান কে একটু ধাক্কা দিয়ে তার দিকে ঘুরে বলল
–ফ্রেশ হয়ে এসো চা খাবো।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল। এক আঙ্গুল দিয়ে ঘামে লেপটে থাকা কপালের ছোট ছোট চুল গুলো সরিয়ে দিলো। ঈশা ইভানের চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু তার চোখে আজ পূর্ণতা। ঈশাকে পুরপুরি ভাবে পাওয়ার প্রশান্তি। সেই শান্তির দৃষ্টি ঈশাকে অস্থির করে দিচ্ছে। বেশিক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান বুঝতে পেরে নিশব্দে হাসল। তারপর হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলল
–আমি তোর এই ভালবাসাটাই সব সময় দেখতে চেয়েছিলাম। জোর করে নিতে চাইনি। চাইলে অনেক আগেই অধিকার ফলাতে পারতাম। তুই আটকাতেও পারতিস না।
তার কথায় ঈশার রাগ করার কথা থাকলেও আশ্চর্য জনক ভাবে সে ইভানের কাছে এসে বলল
–আমি আটকাতাম না। তোমার ভুল ধারণা।
ইভান একটু হেসে ঠোঁটে কিস করার জন্য তার মুখ ঈশার মুখের কাছে নিয়ে যেতেই পিছন থেকে ইরা বলল
–ভাইয়া তুমি কি করছ?
ইভান তার গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পিছনে ঘুরে বলল
–কিছুনা। চা খেতে এসেছিলাম।
ইরা ভ্রু কুচকে বলল
–ওঃও চা খাবে তো কাপে নিয়ে বাইরে যাও। এখানে তো অনেক গরম। আর তুমি আপিকে ওভাবে কেন ধরে রেখেছিলে। এমনিতেই অনেক গরম ওভাবে ধরে রাখলে আরও গরম লাগবে। তুমি বের হয়ে যাও তো এখান থেকে।
বলেই ইরা চলে গেলো। ইভান তার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর ভ্রু কুচকে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সিরিয়াসলি! ইরা এতো বোকা না অভিনয় করে। আমি তোকে জড়িয়ে ধরে কি করছিলাম সেটা একটা ছোট বাচ্চাও বুঝতে পারে। আর ও বুঝতে পারল না নাকি বুঝতে চাইলো না। অবশ্য তোর বোন। একটু হলেও জিন গত ব্যাপার তো থাকেই। বুঝেও অভিনয় করে।
ঈশা এবার রেগে গেলো।
–কি বলতে চাচ্ছ?
ইভান একটু হেসে বলল
–এই যে এই দিনটার জন্য আমি সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি। আর এতো বছর পর এসে তুই বুঝলি। তাও আমার কাছে আসলে লজ্জা পাস। আল্লাহ জানে এতো লজ্জা কোথায় থেকে আসে।
ঈশা কিছু না বলে ঘুরে যায়। ইভানও বের হতে যায় রান্না ঘর থেকে তখনি ঈশা বলে
–এতদিন তো আমি অপেক্ষা করতে বলিনি। অনেক আগেই চান্স দিয়েছিলাম। তুমিও যদি এখন ইরার মত অবুঝ হও তাহলে তো আমার কিছুই করার নেই।
ঈশার কথা শুনে ইভান থেমে ঘুরে অবাক হয়ে তাকায়।
চলবে………।