তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ১৯,২০

0
1745

তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ১৯,২০
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৯

৪৪
ভেজা চুল হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ইভান বাইরে এলো। ঈশা টেবিলে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে ফোনে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। ইভান ঈশার পাশের চেয়ারে বসে বলল
–বাসায় কেউ নেই?
–আমরা ছাড়া ইরা আর ইলহাম আছে। মা আর চাচি ফুপুর বাসায় গেছে। সবাই মিলে কোথায় যেন যাবে। আসতে সন্ধ্যা হবে।
–ওহ আচ্ছা!
ইভানের কথা সম্পূর্ণ না হতেই ইরা পিছন থেকে বলল
–ভাইয়া এভাবে বোরিং টাইম পাস করতে ভালো লাগছেনা। বিরক্ত লাগছে।
বলেই ইভানের পাশের চেয়ারে বসলো। ইভান কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে ইরাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশা ভিতর থেকে একটু মাথা বাকিয়ে দেখে হাস্যজ্জল চেহারা নিয়ে বলল
–আরে রিহাব ভাইয়া কেমন আছেন?
রিহাব একটু হেসে বলল
–ভালো আছি।
ইরাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
–আমাকে দেখা শেষ হয়ে গেলে আমি কি ভিতরে আসতে পারি?
রিহাবের এমন কথা শুনে ইরা বিরক্ত হল। একটু সরে দাঁড়ালো। রিহাব ভিতরে এসে চেয়ারে বসলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার চা কোথায়?
ঈশা একটু হেসে বলল
–আনছি।
ইরা দরজা লাগিয়ে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে পড়লো। রিহাব ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই এখন কেমন আছিস? রেস্ট নিচ্ছিস নাকি অফিসে জয়েন করেছিস?
ইভান খুব শান্ত গলায় বলল
–ভালো আছি। এখনো জয়েন করিনি। সাহিল সব সামলে নিচ্ছে।
রিহাবের দিকে একটু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–তুই কি আমাকে দেখতে এসেছিস?
রিহাব একটু হেসে বলল
–তোদেরকে!
ইভান তার কথা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে ইরার দিকে তাকাল। ইরা চোখ নামিয়ে বসে আছে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। রিহাবের আসাতে যে সে খুশি হয়নি তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ইভান বিষয়টাকে স্বাভাবিক করতে বলল
–ইরা তুই কি যেন বলছিলি?
ইরা চমকে উঠে তাকাল। একটু ভেবে বলল
–কই না তো!
ইভান তার আচরণে একটু অবাক হল। একটু আগেই খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিল কিন্তু এখন চুপ হয়ে গেলো। তাহলে কি রিহাবের আসাতে ইরা বিরক্ত হচ্ছে। আর হবেই বা কেন? রিহাব তো তাকে বিরক্ত করেনি। এমন সময় ল্যান্ড ফোন বেজে উঠলো। ইভান উঠে গেলো ফোনটা ধরতে। ইরা মাথা নিচু করেই আছে। রিহাব তার দিকে তাকিয়ে বলল
–ইরা।
ইরা মাথা না উঠিয়েই বলল
–কিছু বলবেন?
–কোন কারনে তুমি কি আমার উপরে বিরক্ত?
একি অবস্থা থেকেই বলল
–না তো।
–তাহলে কথা বলছনা যে।
–এমনি।
রিহাব এবার একটু ধমক দিয়ে বলল
–লুক এট মি!
ইরা ভ্রু কুচকে তাকাল। একটু কড়া গলায় বলল
–কি বলতে চান ক্লিয়ার করে বলুন। এতো হেয়ালি করার কোন প্রয়োজন নেই তো। এখানে আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই। আমি খুব স্পষ্ট কথা বলতে এবং শুনতে পছন্দ করি।
রিহাব ভ্রু কুচকে তাকাল। ইরা রিহাবের দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন গলায় বলল
–বুঝতে পারছেন না তো আমি কি বলছি? আপনি আমার জীবনে ইন্টারফেয়ার কেন করছেন? আমি এখন আগের মত ছোট না। আমি কিছু করলে সেটা বুঝেই করি। আর আমাকে কেউ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করুক সেটা আমি কোন ভাবেই মেনে নিবনা।
কথা গুলো বলেই ইরা উঠে গেলো। ইভান দরজায় দাড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। ইরার কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারল না। ইরা যে কারও সাথে এভাবে কথা বলতে পারে সেটাও ইভানের ধারণা ছিলোনা। সে রিহাবের কাছে এসে বলল
–ইরা কি বলে গেলো?
রিহাব একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি ইরার ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এক বন্ধুর সাথে ইরার খুব ভালো সম্পর্ক আছে। আমি সেই ছেলের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেই। নিয়ে জানতে পারি সেই ছেলে ইরাকে পছন্দ করে। কিন্তু ইরা তার সম্পর্কে যা কিছু জানে সে সেরকম না। তাই আমি ব্যাক্তিগত ভাবে সেই ছেলের সাথে কথা বলে তাকে ইরার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলি। কিন্তু সে ইরাকে গিয়ে আমার সম্পর্কে অনেক মিথ্যা কথা বলে। এই জন্যই ইরা আমার উপরে রেগে আছে।

ইভান তার কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। ইরার আচরণ এক রকম আর রিহাবের কথা এক রকম। দুইটার মধ্যে অনেকটা পার্থক্য। যদি রিহাবের কথা ঠিক হয়ে থাকে তাহলে ইরা অবুঝের মত আচরণ ইচ্ছা করে করছে। কিন্তু এভাবে সবার কাছে নিজেকে অবুঝ প্রমান করার কারন কি? ইভানের গভীর ভাবনার মাঝেই ঈশা চা নিয়ে আসলো। ঈশা টেবিলে চা রাখতেই ইভান একটু নড়েচড়ে বসলো। রিহাব আর ঈশা কথা বলছে। কিন্তু ইভান গভীর ভাবে ভাবছে। কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–বাইরে যাবি?
ইভানের কথায় ঈশা কি বলবে বুঝতে পারল না। ইভান একটু হেসে বলল
–আজ আমরা সারাদিন ঘুরব। বাইরে খাবো। রিহাবও থাকবে আমাদের সাথে। বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি। এখন একটু রিফ্রেশমেন্ট দরকার।
ঈশা আর কিছু না বলে একটু হেসে বলল
–ইরা আর ইলহাম কে বলি।
ইভান হাসল। ঈশার কথা শেষ হতেই রিহাব কিছু একটা বলতে যাবে তখনি ইভান তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। তার ইশারা বুঝতে পেরে রিহাব বলল
–আমি আজ ফ্রি। সারাদিন সময় দিতে পারব।
কথা শুনেই ঈশা উঠে গেলো। ইভান আর রিহাব দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল। এর মাঝেই ইরা এসে বলল
–ভাইয়া আমি বাইরে যাবনা। আমার ইচ্ছা করছে না।
–সারাদিন বাসায় বসে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। একটু তো ঘুরে আসা দরকার। তুই যদি না যেতে চাস তাহলে থাক অন্যদিন না হয় যাব।
হতাশার সূরে বলল ইভান। ইরা তার কথায় না বলতে পারবে না সে জানে। কারন ইভান তাকে খুব ভালবাসে। আর তার সব কথাই প্রায় রাখে। ইরা একটু হতাশ হয়ে বলল
–অন্যদিন না ভাইয়া। আজকেই যাব। আমি রেডি হয়ে আসছি।
সবাই রেডি হয়ে নিচে নামছে। ইরা ইভানের গাড়ির কাছে এসে দাড়াতেই ইভান বলল
–রিহাব একটা কাজ কর তুই ইরা আর ইলহাম কে নিয়ে যা। আমার আর ঈশার একটু কাজ আছে আমরা শেষ করেই আসছি।
কথা শেষ করেই ইলহামের দিকে তাকাল ইভান। ইলহাম মাথা নাড়ল। দুজনে পিছনে বসতে যাবে তখনি ইলহাম বলল
–তুই সামনে বস। আমি পিছনে শুয়ে যাব। আমার ঘুম হয়নি।
ইরা বিরক্ত হয়ে বলল
–আমি সামনে বসব না। আমি পিছনেই বসব। তুমি সামনে যাও।
–বেশি কথা বলছিস তুই। আমি তোকে পিছনে বসতে দিবনা।
বলেই ইলহাম পুরো সিট দখল করে শুয়ে পড়লো। ইরা বিরক্তি নিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া দেখ না। আমি এই গাড়িতে যাবনা। তোমাদের সাথে যাব।
–আহা তোরা এভাবে ঝগড়া করিস না তো। শান্ত হয়ে বস।
একটু রাগ করে ইভান বলল। ইভানের রাগ করা দেখে ইরা আর কিছু বলল না। গিয়ে সামনে বসে পড়লো। কিন্তু মুখ ফুলিয়ে। রিহাব সিটে বসেই গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো। ইভান পিছনে শুয়ে কানে হেড ফোন গুঁজে দিলো। বাইরের কোন কথাই তার কানে যাবে না এখন। এসব আসলে তাকে ইভানই বলে দিয়েছে। সেই অনুযায়ী সে সব কিছু করছে।
ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–কেন মিথ্যা বললে?
ইভান একটু হেসে বলল
–তোকে নিয়ে হানিমুনে যাব তো তাই।
–তুমি কি কখনও সিরিয়াস কথা বলতে পারনা?
–বিয়ের পর প্রথম তোকে নিয়ে বের হয়েছি। ওই দুইটাকে সাথে রাখলে সারাক্ষন বক বক করে মাথা খারাপ করে দিত। রিহাব এখন ওদেরকে কিছুক্ষন সামলাক। আমরা একটু প্রেম করি কি বলিস!
ঈশা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ইভান একটু বাকা হেসে গাড়িতে উঠলো।

৪৫
গাড়ি চলছে আপন গতিতে ইরা ফোনের মাঝে ব্যাস্ত। রিহাব আড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাল। তারপর কঠিন গলায় বলল
–তোমাকে আমি আশে পাশের মানুষকে সময় কম দিতে বলেছিলাম। ভুলে গেছো?
রিহাবের কথা শুনে ইরা ঘাড় বাকিয়ে ইলহামের দিকে তাকাল। সে চোখ বন্ধ করে হেড ফোন লাগিয়ে আছে। রিহাবের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল
–শুনুন রিহাব ভাইয়া। আমি আমার উপরে খবরদারি পছন্দ করিনা। আর বাইরের কেউ হলে সেটা তো কোনভাবেই আমি মেনে নিবনা। আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো। কাউকে এসবের কইফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।

রিহাব খুব জোরে গাড়ি ব্রেক করলো। গাড়ি ব্রেক করা দেখে ইলহাম চমকে উঠে বলল
–আমরা কি এসে গেছি?
রিহাব তার দিকে তাকিয়ে বলল
–খুব গরম পড়েছে কোল্ড ড্রিঙ্কস হলে কেমন হয়?
ইলহাম হ্যা বলে মাথা নাড়াল। রিহাব তাকে টাকা বের করে দিয়ে আনতে বলল। ইলহাম বের হয়ে গেলো। রিহাব ইরার দিকে কঠিন ভাবে তাকিয়ে বলল
–তুমি কি ভাবছ আমি জোর করে তোমার জীবনে হস্তক্ষেপ করছি। তাহলে ঠিক ভাবছ। আমি তাই করছি। আর হ্যা তুমি যার সাথে সব সময় এভাবে মেসেজিং করছ সে তোমার সম্পর্কে কি ভাবে তা কি যান? আমি জানিনা তুমি কত টুকু জানো। কিন্তু যদি জেনেও তার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাও তাহলে খুব ভুল করবে।
তারপর সামনে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলল
–ইরা আমি তোমাকে আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কোন বয় ফ্রেন্ড আছে কিনা। কিন্তু তুমি না বলেছিলে। তাই আমি আমার দিক থেকে এগিয়ে গিয়েছি। যদি সেরকম কিছু থাকতো আমি কখনও তোমাকে জোর করতাম না। আমি যখন নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়েছি তখন তোমার সাথে খারাপ কিছু হোক তা আমি কিভাবে মেনে নিবো। যাই হোক। তবুও তোমার যদি খারাপ লাগে তাহলে আই এম সরি!
রিহাবের কথা শুনে ইরা তার দিকে তাকাল। সেই সময় ইলহাম ড্রিঙ্কস নিয়ে এলো। সবার ক্যান সবার হাতে দিয়ে দিলো। নিজের টা নিয়ে পিছনে বসে পড়লো। ইরা ক্যানটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–ভাইয়া এটা কেন এনেছ? আমার এটা ভালো লাগেনা।
রিহাব একবার ক্যানটার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত ভাবে বলল
–না লাগলে ফেলে দাও। রেস্টুরেন্টে গিয়ে যেটা ভালো লাগে সেটা অর্ডার করবে।
ইরা ক্যানটা সযত্নে পাশে রাখল। ফাকা একটা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। ইরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আশে পাশে তেমন গাড়ি নেই। কোথায় যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু তবুও কোন প্রশ্ন করছে না। রিহাব গাড়িতে উঠার পর থেকেই আড় চোখে তাকে কিছুক্ষন পর পর দেখছিল। এখন তাও দেখছে না। ইরা গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। রিহাবও সামনে তাকিয়ে ভাবছে। তার মনের কথা কি ইরা বুঝবে?

চলবে………

তোর ছায়ার সঙ্গী হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২০

৪৬
ইরা খুব কষ্টে ঠেসে নাস্তা মুখে পুরছে। সকাল সকাল তার খেতেই ইচ্ছা হয়না। কিন্তু কি আর করার ভার্সিটি যেতে হবে। মা না খেয়ে যেতে দিবেনা। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরার মা দরজা খুলে দিয়েই সহাস্যে বললেন
–আরে তুই। এই বাসায় তো আসাই বাদ দিয়ে দিয়েছিস। ঈশা যাওয়ার পর থেকে তোর ছায়াও দেখা যায়না এখন।
–এভাবেই বকতে থাকবে নাকি ভিতরেও যেতে বলবে।
ইভান অসহায়ের মতো বলল। একটু হেসে তিনি সাইড দিলেন ভিতরে ঢুকতে। ইভান ভিতরে ঢুকে টেবিলে বসে পড়লো ইরার সামনে। ইরাকে দেখে বলল
–তোর ক্লাস কখন?
ইরা অবাক হয়ে তাকাল। তারপর ধির গলায় জিজ্ঞেস করলো
–তুমি কিভাবে জানলে আমার এখন ক্লাস আছে?
ইভান সামনে থাকা গ্লাসে পানি ঢেলে একটু খেয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল
–কোন কিছুই আমার চোখ এড়ায় না।
ইভানের কথা গুলো ইরার শরীরে রীতিমতো ভয়ের আভাষ তৈরি করে দিলো। ইভান পানিটা শেষ করে বলল
–তুই রেডি?
ইরা মাথা নাড়াল। ইভান তার দিকে কঠিন ভাবে তাকিয়ে বলল
–চল।
ইরার বুঝতে বাকি থাকলো না যে ইভান তাকে আজ ভার্সিটি নিয়ে যেতেই এসেছে। কিন্তু কারণটা সে বুঝতে পারছেনা। তবুও কোন কথা না বলেই ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার দাঁড়ান দেখে ইভানও উঠে গেলো। একটু হেসে বলল
–আসি বড় মা। ইরাকে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাব।
ইরার মা বলল
–কিছু খেয়েছিস সকালে? খেয়ে যা।
–তোমার মেয়ে কি আমাকে না খেয়ে বের হতে দিবে? এখন আর কিছু খাবনা। আসলাম।
ইভান হেসে ইরার পিছনে পিছনে নামতে শুরু করলো। ইরা নেমে গাড়ির পাশে দাড়িয়ে থাকলো। ইভান গাড়ির দরজা খুলে ইরাকে বলল
–ওঠ।
ইরা উঠে পড়লো। ইভানও গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলো। ইরা কোন কথা বলছে না। চুপচাপ সামনে তাকিয়ে আছে। ইভান নিরবতা ভেঙ্গে বলল
–তোর ক্লাস কখন শেষ হবে?
–১.৩০ এ ভাইয়া।
–আমি নিতে আসবো।
ইভানের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাল ইরা। ইভানের এমন আচরণ ইরার খুব একটা ভালো মনে হচ্ছেনা। এরকম করার কারন কি? তাহলে কি রিহাব কিছু বলেছে ইভান কে? তাই হবে। নাহলে ইভান এমন আচরণ কখনই করত না। ইরার রিহাবের উপরে খুব রাগ হল। গাড়ি থেমে যেতেই ইরার ঘোর কাটে। ইরা চমকে উঠে চার পাশে তাকায় ভার্সিটিতে চলে এসেছে। দরজা খুলে নেমে যায়। ইভান তার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে
–এখন থেকে আমি তোকে নিয়ে আসবো আর আমিই নিয়ে যাব। অন্য কারও সাথে যাওয়ার কোন দরকার নেই।

ইভানের কথা শুনে ইরা স্বাভাবিক ভাবেই মাথা নাড়াল। ইভান চলে গেলো। রাগে ইরার চোখ মুখ সব লাল হয়ে গেলো। সে ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে সে যে শোভনের সাথে আসে আর তার সাথেই যায় এসব ইভান জেনে গেছে। আর সেই জন্যই এরকম আচরণ করছে তার সাথে। আর এটা রিহাব ছাড়া কেউ বলেনি। কারন এতদিন তো ইভান কিছুই জানতে পারেনি। তাহলে এখন কিভাবে জানলো।
ইভান একটু দূরে গাড়ি দাড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ফোন দিলো। খুব শান্ত ভাবে বলল
–ইরা আর রিহাবের বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে। আজ থেকে ৪ দিন পর। এখন কি করতে হবে তা কি নতুন করে বলতে হবে?
ওপাশে ফোনটা ধরে রাশিক একটু হেসে বলল
–তার দরকার হবে না। আমি বুঝে গেছি।
ইভান সশব্দে হেসে ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটা হাতে ধরেই সামনে তাকিয়ে বলল
–আমি তোর উপরে কখনও জোর করে কিছুই চাপিয়ে দিতাম না ইরা। কিন্তু তুই যা করছিস তা তোর জন্য বিপদ ছাড়া আর কিছুই ডেকে আনবে না। আমি বেঁচে থাকতে তোর বিপদ কিভাবে হতে দেই। কিন্তু এই মুহূর্তে শোভনের সম্পর্কে তোকে কিছু বলেও লাভ হতোনা। তুই যে ওর জালে ফেসে গিয়েছিস। এখন তোর চোখে ওর খারাপ কিছুই পড়বে না। কিন্তু আজ তুই ওর আসল চেহারা দেখতে পাবি। তারপর তুই নিজে থেকেই এই সম্পর্ক ভেঙ্গে দিবি। আমি তো শুধু প্রতিনিধি হয়ে কাজ করবো। বিয়েটা তোর রিহাবের সাথেই হবে। এতেই তোর ভালো ইরা।

কথা শেষ করেই মুচকি হেসে রিহাবের নাম্বারে ফোন করলো ইভান। রিহাব ফোন ধরেই বলল
–তুই এই সময়? সব ঠিক আছে তো।
ইভান একটু হেসে বলল
–সব ঠিক আছে। তোকে একটা কাজ দিলে করতে পারবি?
–কি কাজ বল?
–ইরা ভার্সিটিতে অপেক্ষা করছে। আমার একটা কাজ আছে আনতে যেতে পারবোনা। তুই একটু যাবি?
ইভানের কথা শুনে রিহাব আকাশ থেকে পড়লো। কথাটা তার মাথায় ঢুকল না। ইভান আবার ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–আর কারও উপরে ভরসা করতে পারছিলাম না। তোর কথা মনে হতেই ফোন দিলাম।
রিহাব আর প্রশ্ন না করে চিন্তিত ভঙ্গিতে “হুম” বলল। ইভান তার সম্মতি পেয়েই ফোনটা কেটে দিলো। কারন বেশিক্ষন কথা বললেই রিহাব প্রশ্ন করবে যার উত্তর সে এখন দিতে পারবে না। তাই ফোন রেখেই বলল
–যা নিজের হবু বউকে গুণ্ডার হাত থেকে বাচিয়ে নিয়ে আয়।
তারপর আবার রাশিকের নাম্বারে ফোন করে বলল
–রিহাব আসছে। যা করার তাড়াতাড়ি কর। কিন্তু খেয়াল রাখিস ইরার যেন কোন ক্ষতি না হয়।
বলেই সে সোজা অফিসে চলে গেলো। রিহাব ভাবছে ইভানের হঠাৎ এমন কথার মানে কি? সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি আর করার দায়িত্ব যখন নিয়েছে পালন তো করতে হবেই। তাই মোবাইল আর গাড়ির চাবিটা নিয়ে বের হয়ে গেলো।

৪৭
ইরা ধির পায়ে ভার্সিটির ভিতরে ঢুকছে। এমন সময় শোভন তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সে শোভনের দিকে তাকায়। রাগে চোখ লাল হয়ে আছে। ইরা তার রাগের কারন বুঝতে না পেরে বলল
–কি হয়েছে? এমন রাগ করে আছো কেন?
শোভন চোখ মুখ শক্ত করে বলল
–তোমার সাথে কথা আছে।
–বল।
–এখানে না। আমার সাথে এসো।
ইরা বিরক্তি নিয়ে বলল
–আমার ক্লাস আছে শোভন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। পরে কথা বলি?
শোভন দাতে দাঁত চেপে বলল
–আগে কথা শুনবে। পরে ক্লাস করবে।
কথা শেষ করে ইরাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে ইরার হাত ধরে টানতে টানতে একটা ফাকা রুমে নিয়ে গেলো। তারপর ইরাকে ছেড়ে দিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে বলল
–বিয়ে করছ তাহলে? এখন আমার প্রয়োজন শেষ তাই না।
ইরা ভ্রু কুচকে রেগে বলল
–কি সব বলছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?
শোভন ইরার এক হাত শক্ত করে ধরে বলল
–ও ড্রামা কুইন এইসব আমার কাছে চলবে না। এতদিন ধরে আমার সাথে প্রেম করেছো আর এখন অন্য কাউকে বিয়ে করছ? আমাকে তো হাতও ধরতে দাওনি। আর ওই ডাক্তার কে সব দিয়ে দিবে।

শোভনের মুখে এমন নোংরা কথা শুনে ইরা নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। কারন শোভন কে তার ভালো লাগতো ঠিকই কিন্তু তার সাথে এখনো গভীর প্রেমের সেরকম কোন সম্পর্কই তৈরি হয়নি। আর শোভন এরকম নোংরা কথা কিভাবে বলতে পারল? নিজের রাগটাকে দমন করতে না পেরে ইরা সজোরে শোভনের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। তারপর কঠিন গলায় বলল
–মুখ সামলে কথা বল। তোমার সাথে আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক নেই। আমরা শুধুই বন্ধু ছিলাম। কিন্তু তোমার এই নোংরা কথা শোনার পর থেকে আর এই বন্ধুত্ব আমি রাখবো কিনা সেটা নিয়ে আমাকে ভাবতে হচ্ছে এখন।
–ও তাই নাকি। তো কত গভীর বন্ধুত্ব ছিল তোমার সাথে আমার তাই না? তাই তো সারাক্ষন আমার সাথে চ্যাটিং করতে। আমার জন্য অপেক্ষা করতে রাস্তায় দাড়িয়ে। আমার সাথে ভার্সিটি আসতে আমার সাথে যেতে। আমার দেয়া সমস্ত গিফট যত্ন করে রাখতে। আরও তো বন্ধু আছে। তাদের সাথেও কি এরকম সম্পর্ক ছিল?

ইরা কোন জবাব দিতে পারল না। কারন সত্যিই সে শোভন কে বন্ধুর চেয়ে একটু বেশিই ভাবতো। এই কারনেই তার প্রতি একটু দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। কিন্তু আজ এই অবস্থায় তার সমস্ত দুর্বলতা রাগে পরিণত হয়েছে। ইরা রেগে বলল
–শোভন তুমি কিন্তু বেশি বেশি করছ। তোমার সাথে কথা বলে নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। আর তোমাকে বিয়ের কথা কে বলেছে? আমি কোন বিয়ে করছিনা।
শোভন ইরার অনেকটা কাছে চলে এলো। ইরা অপ্রস্তুত হয়ে দূরে সরে যেতেই তার ফোন বেজে উঠলো। হাতে থাকা ফোন উঠে নাম্বার টা চোখে পড়তেই একটু স্বস্তি পেলো সে। ফোনটা ধরেই বলল
–রিহাব ভাইয়া।
ইরা রীতিমতো হাপাচ্ছে। রিহাব একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–তুমি কোথায় ইরা? আমি তোমার ভার্সিটির সামনে দাড়িয়ে আছি।
ইরা এবার আরও সাহস পেয়ে গেলো। একটা ঢোক গিলে বলল
–আমি ১০২ নাম্বার রুমে। এখনি আসছি।
ইরা ফোন কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি বের হতে যাবে তার আগেই শোভন তার হাত ধরে টেনে বলল
–তোমার নায়ক এসেছে বুঝি? তার কাছে যাবে? তাহলে আমার কি হবে? আমি তোমার জন্য এতদিন অপেক্ষা করলাম তার প্রতিদান কি শুধুই একটা থাপ্পড়?
ইরা এবার ভয় পেয়ে গেলো। শোভন একটু হেসে ইরাকে নিতেই পিছন থেকে বজ্র কণ্ঠের হুঙ্কারে থেমে যায়।
–হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ হার?
রিহাবের দিকে ঘুরে তাকায় দুজনি। ইরা শোভনের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। ইরা শত নড়াচড়া করেও পারছে না নিজেকে ছাড়াতে। রিহাব খুব শান্ত ভাবে বলে
–তোমার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই আর আমি তৈরিও করতে চাইনা। ওকে ছেড়ে দাও।
শোভন স্বাভাবিক ভাবে বলল
–এক্সাকলি! আমিও সেটাই বলছি। আপনি কি জানেন ওর সাথে আমার কত দিনের প্রেমের সম্পর্ক। এতো কিছু জানার পরেও কিভাবে ওকে বিয়ে করবেন। আর জানতে চাইবেন না সম্পর্ক কতটা গভীর।
ইরা চিৎকার করে বলল
–তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। রিহাব ভাইয়া ঠিক ছিল। আমিই তোমাকে চিনতে পারিনি। পারলে কোন দিন তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতাম না।
কথা শেষ করে ইরা এক ঝটকায় নিজের হাত ছেড়ে নিলো। এক দৌড়ে এসে রিহাবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। রিহাব এক হাতে ইরাকে ধরে আরেক হাতের আঙ্গুল শোভনের দিকে তাক করে বলল
–এতদিনে যা করেছো সেই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু আজ বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। এটার জন্য তুমি মাফ পাবে না। মনে রেখো।
শোভন খুব শান্ত ভাবে বলল
–কেন শুধু শুধু আমার গার্ল ফ্রেন্ডকে নিজের বউ বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ছেড়ে দিন না আমার হাতে।
রিহাব একটু হেসে বলল
–গার্ল ফ্রেন্ড তোমার কিন্তু তোমার থেকে আমার বুকেই নিজেকে বেশি সেফ মনে করে। দেখতে পাচ্ছ তো কত নিশ্চিন্তে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

রিহাবের কথা শুনে ছলছল চোখে ইরা তার দিকে তাকাল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে রিহাব কে ছেড়ে দিতেই সে আরও শক্ত করে ইরাকে জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে। ইরা তার এরকম কাণ্ডে অবাক হয়ে দেখছে তার দিকে। রিহাব তার দিকে না তাকিয়েই ইরাকে জড়িয়ে ধরেই নিয়ে চলে গেলো। গাড়ির কাছে এসে দরজা খুলে ইরাকে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইরা কেদেই যাচ্ছে। সে মেনেই নিতে পারছে না তার সাথে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে। রিহাব একটু দূরে ফাকা জায়গায় গাড়িটা দাড় করাল। পানির বোতলটা ইরার কাছে এগিয়ে দিলো। ইরা মাথা নিচু করেই বোতলটা হাতে নিয়ে একটু পানি খেলো। তারপর রিহাবের হাতে বোতলটা দিয়ে বলল
–রিহাব ভাইয়া আ…।
ইরার কথা শেষ হওয়ার আগেই রিহাব ধমক দিয়ে বলল
–শাট আপ! এই সব কিছু তোমার নিজেকে বেশি বুদ্ধিমতি ভাবার ফল। কেমন সব ছেলের সাথে তোমার বন্ধুত্ব এখন বুঝতে পারছ তো? নাকি এখনো আমিই খারাপ আর সেই সব বন্ধুই ভালো। অদ্ভুত একটা মেয়ে তুমি। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর পরেও তোমার মাথায় কিছুই ঢুকে না। অবশ্য তুমি তো ভাবো আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছি। তাই এই সব নাটক করছি। ভুল ভাবছ ইরা। আমি তোমার বন্ধুর মত না যে জোর করে তোমাকে বিয়ে করবো।

ইরা কোন কথা বলল না। মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। রিহাব ইরার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–বি স্ট্রং! এতো ভেঙ্গে পড়ার কিছুই নেই। অনেক কিছুই হতে পারতো আমি সময় মত না পৌঁছালে। কিন্তু হয়নি। ভুলে যাও সবটা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা কর।
তার কথা শুনে ইরা চোখ মুছে কাপা কাপা গলায় বলল
–আপনি এই সময় আমার ভার্সিটিতে কি করছিলেন? আর আমাকেই বা কেন ফোন দিয়েছিলেন?
তার কথায় রিহাবও একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কোন উত্তর না দিয়েই সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে থাকে। বিষয়টা তার কাছেও একটু অন্য রকম লাগছে। এতো সূক্ষ্ম ভাবে সবটা কোন কো-ইন্সিডেন্স হতে পারেনা। সে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। আর ইরা তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এই মানুষটা আজ ফেরেস্তার মত তাকে বাঁচাতে এসেছে। না থাকলে অনেক কিছুই হতে পারতো। এই মানুষটাকে সে কত অপমান করেছে ওই শোভনের কথায়। ভাবতেই তার মধ্যে অপরাধবধ তৈরি হল। সে খুব শান্ত গলায় বলল
–রিহাব ভাইয়া সরি!
রিহাব ইরার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনে তাকাল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল
–তোমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে থাকলেও আমি একি কাজ করতাম। তুমি এমন স্পেশাল কেউ না।
ইরা চোখ ঘুরিয়ে নিলো। বুঝতে পারল রিহাব তার উপরে রাগ করেছে। করবেই না বা কেন সব দোষ তো তার। সে রিহাব কে অপমান করেছে। রিহাব কি তাকে মাফ করবে?

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here