তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব-২৭,২৮
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৭
৬২
গত দুইদিন ধরে যত কিছু দিয়ে বাড়িটা সাজানো হয়েছিলো সব কিছু খুলে ফেলা হচ্ছে। সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে লোকজন। ইভান সেগুলই দেখছে। আশে পাশে চোখ ফেরাতেই চোখ পড়লো ঈশার বাবা এক পাশে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে শুন্যতা। বাবার কাছে মেয়েরা একটু বেশিই আদুরে হয়। মেয়েদের বিদায় একজন বাবাকে ভিতর থেকে কতটা শুন্য করে দিতে পারে তা ইভান এই মুহূর্তে আন্দাজ করতে পারছে। সে ধির পায়ে পাশে দাড়িয়ে বলল
–বড় বাবা তোমার কি মন খারাপ?
ঈশার বাবা ভাবনায় ডুবে থাকায় একটু চমকে উঠলো। ইভানের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বলল
–এই বাড়িতেই আমার দুই মেয়ে বড় হয়েছে। সারা বাড়ি জুড়ে দুজনের খুনসুটি। কিন্তু আজ পুরো বাড়ি শুন্য হয়ে গেলো।
ইভান ঈশার বাবার কাধে হাত রেখে বললেন
–মন খারাপ করোনা। রিহাব খুব ভালো ছেলে। ইরা খুব সুখে থাকবে বাবা। তোমার ওকে নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না।
ঈশার বাবা তার আবেগ ধরে রাখতে পারল না। ইভান কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ইভানও তাকে জড়িয়ে ধরল। কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–আজ থেকে ৬ বছর আগে আমি ঈশার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম অন্য কোথাও। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি সেই সময় ঈশাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। খুব ভয় ছিল মনের মাঝে। কিন্তু তুই যখন ঈশাকে বিয়ে করলি তখন আমি একদম নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। আর কোনদিন ঈশাকে নিয়ে আমার মধ্যে ভয় হয়নি। তুই ওর কাছ থেকে দূরে চলে গেলি তখনও আমার একটুও ভয় হয়নি। কারন আমি জানতাম তুই যেখানেই থাক নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমার ঈশাকে ভালো রাখবি।
ইভান কে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে দাড়িয়ে বলল
–আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোর সাথে অন্যায় করেছি। অনেক বড় অন্যায়।
কথাটা বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না। ইভান দাড়িয়ে দেখছে। উনি চলে যাওয়ার পর চোখ বন্ধ করে একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল
–তুমি হয়ত জাননা বড় বাবা তোমার এই কথার মানে আমার কাছে স্পষ্ট। তোমার এই অপরাধ বোধ কেন আর ঠিক কোথায় থেকে তৈরি হয়েছে তা আমার অজানা নয়। আমি এটার শেষ করেই ছাড়ব তুমি ভাবিওনা। আমি বেঁচে থাকতে কারও কোন ক্ষতি হতে দিবনা।
৬৩
হালকা ঘুমে বন্ধ থাকা চোখের উপরে মাঝে মাঝেই একটা ছায়ার মতো নড়াচড়া করছে। রিহাব একটু ভ্রু কুচকে নিয়ে পিটপিট করে তাকাল সামনে। ইরা নিজের ভেজা চুলগুলো আঁচড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু বার বার চিরুনি সেটার গিট্টুর মাঝে আটকে যাচ্ছে। আর সে বেশ বিরক্তি নিয়ে খোলার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে চিরুনি রেখে হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করছে। রিহাব ঠোটের কোণে ক্ষীণ হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। এবার ইরা বিরক্ত হয়ে জোরে টানতেই একটা চুল ছিঁড়ে যায়। ব্যথায় আহ শব্দ করতেই রিহাব একটু ভারি গলায় বলে
–সব চুল কি টেনে ছিঁড়ে ফেলবে নাকি?
ইরা চমকে উঠে। পিছন ঘুরে তাকায়। রিহাবের চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবার সামনে তাকায়। রিহাব একটু হেসে উঠে বসে। নেমে ধির পায়ে ইরার কাছে যায়। হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বলে
–আর চিরুনি করতে হবে না।
ইরা বিরক্ত মুখে বলে
–কাল অতো গুলো কাঁটা লাগানোর পরেই চুলের এই অবস্থা হয়েছে।
রিহাব চিরুনি টা রেখে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলল
–কি দরকার ছিল অতো সাজগোজ করার। অতো মেকাপ খাওয়ার পরে আমি কতটুকু সুস্থ থাকতে পারব সেটা নিয়েই এখন ভাবছি।
বলেই ওয়াশ রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। ইরা চোখ বড় বড় তাকাল সেই দিকে। আর কোন কথা না বলে নিচে চলে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখল তার শ্বশুর শাশুড়ি দুইজনি টেবিলে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। একটু লজ্জা পেলো। দেরি করে ফেলেছে। আর একটু আগে উঠলেই এই লজ্জায় পরতে হতোনা। শাড়ীর আচলটা মাথায় টেনে দিয়ে মাথা নিচু করেই নেমে এলো। সালাম দিয়ে এক পাশে দাঁড়ালো। রিহাবের বাবা বুঝতে পারলেন মেয়েটা অস্বস্তি বোধ করছে। তাই একটু স্বাভাবিক করতে বললেন
–বস।
ইরা সামনে চেয়ারে বসে পড়লো। শান্তা নামের মেয়েটা খাবার নিয়ে এলো। রিহাবের মা উঠতে যাবে তখনি ইরা বলল
–আপনি বসেন মা। আমি দিচ্ছি।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো। আর কারও কথার অপেক্ষা না করেই সবার প্লেটে খাবার দিয়ে দিলো। রিহাবের মা বলল
–তুমি বস। রিহাব কোথায়?
কথাটা কানে আসতেই কেন জানি লজ্জা ঘিরে ধরল ইরাকে।মাথা নত করে ধির কণ্ঠে বলল
–আসছে।
তাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই রিহাব নামছে। তার মা দেখে বলল
–ওই তো এসে গেছে।
ইরা চোখ তুলে উপরে তাকাল। মেরুন রঙের একটা টি শার্ট পরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। সামনের চুল গুলো হালকা উড়ছে। রিহাব চোখ তুলতেই ইরা চোখ নামিয়ে নিলো। ইরার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। ইরা তার প্লেটে খাবার দিলো। রিহাব মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। রিহাবের দিকে তাকিয়ে তার বাবা বলল
–আজকেও কি হসপিটালে যাবে?
রিহাব খেতে খেতেই বলল
–নিজের মরার আগে পর্যন্তও আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
তার কণ্ঠের অসহায়ত্ব শুনে বাবা মা দুজনি মুখ টিপে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষন পর রিহাবের মা বলল
–না গেলে হয়না? খুব বেশি কাজ কি?
রিহাব একটু ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল
–বেশি না। তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
খাবার শেষ করে ঘরে এসে রিহাব রেডি হচ্ছে। ইরা ঘরের এক কোনায় বসে একবার রিহাবের দিকে তাকাচ্ছে আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রিহাব কে কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারছে না। রিহাব আয়নায় তার দিকে ভালো করে দেখে নিলো। কিন্তু কিছু বলল না। কারন মেয়েটার মধ্যে এখনো জড়তা আছে। সে চায় এইসব জড়তা ইরা কাটিয়ে উঠুক। তাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হোক। তাই তার সাথে একটু অস্বাভাবিক আচরণ করছে। রিহাব এপ্রনটা হাতে নিয়ে বের হতে যাবে তখন ইরা পিছন থেকে বলল
–কখন আসবেন?
রিহাব তার কথা শুনে থেমে গেলো। একটু হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পিছনে ঘুরে বলল
–জানিনা। কেন?
ইরা ভাবেনি যে সে এমন প্রশ্ন করবে। তাই একটু অপ্রসতুত হয়ে গেলো। মাথা নামিয়ে বলল
–এমনি।
রিহাব আর কিছু না বলে চলে গেলো। নিচে নামতে নামতে ভাবল এমন আচরণ না করলে মেয়েটা এমনি থেকে যাবে। তাই এমন কিছু করতে হবে যাতে সে নিজে নিজেই তার মনের কথা বলতে পারে। নিচে নেমেই তার বাবা বলল
–তাড়াতাড়ি আসো ইরা একাই আছে।
ইরাও পিছন পিছন নামছিল। আড় চোখে ইরাকে দেখে নিয়ে বলল
–বাড়িতে এতো মানুষ একা থাকবে কেন?
ইরার খুব মন খারাপ হল। একদিনেই মানুষটা কেমন বদলে গেলো। এমন তো ছিলোনা। চোখ ছল ছল করে উঠলো। রিহাব বের হয়ে গেলো। ইরা রান্না ঘরে গেলো। তার শাশুড়ি রান্না করছে। রান্না ঘরে পা দিতেই উনি বললেন
–তুমি এখানে কেন? নতুন বউ রান্না ঘরে আসেনা।
ইরা মাথা নিচু করে বের হয়ে যেতেই উনি আবার পিছন থেকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন
–রিহাব চলে গেছে?
ইরা মাথা নাড়াল। উনি বুঝতে পারলেন রিহাব চলে যাওয়ায় ও একা হয়ে গেছে। তাই এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছে। উনি ইরাকে ভিতরে ডাকলেন। ইরা মাথা নিচু করেই ভিতরে গেলো। একটু হেসে বললেন
–তুমি রান্না করতে পার?
ইরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। উনি হেসে বললেন
–আমি যখন থাকবনা তখন তাহলে তোমার কোন অসুবিধা হবেনা।
ইরা মাথা তুলে বলল
–কবে যাবেন মা?
–পরশুদিন।
–যেতেই হবে?
অসহায়ের মতো মুখ করে ইরা জিজ্ঞেস করলো। তার শাশুড়ি মাথায় হাত দিয়ে বলল
–হ্যা মা যেতেই হবে। তোমার বাবার কাজ আছে। শেষ করেই আবার চলে আসবো।
ইরা মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেললো। সবাই চলে গেলে এই বাড়িতে একা হয়ে যাবে সে। রিহাবও থাকবে না। রিহাবের মা আবার বলল
–শান্তা থাকবে। কোন অসুবিধা হলে ওকে বলবে।
তারপর একটু দুষ্টুমির সূরে বলল
–আর চেষ্টা করবে রিহাবকে বাসায় রাখার।
ইরা লজ্জা পেয়ে একটু হেসে ফেললো।
৬৪
দুপুরের খাবার শেষ করে ইরা ঘরে চলে এলো। তার শাশুড়ি বলেছে রেস্ট নিতে। রিহাব এখনো আসেনি। ইরা বিছানায় বসে ভাবছে। ফোনের শব্দে তাকিয়ে দেখে ইভান। খুশি হয়ে ফোনটা রিসিভ করলো
–হ্যালো ভাইয়া।
–কি করছিস?
–কিছুনা রেস্ট নিচ্ছি।
–খাওয়া দাওয়া করেছিস?
–হ্যা করেছি।
–তুই ঠিক আছিস তো?
–হ্যা ভাইয়া আমি একদম্ ঠিক আছি।
–রিহাব কোথায়?
ইরা একটু হতাশ হয়ে বলল
–হসপিটালে গেছে।
–ওহ আচ্ছা!
বলেই শান্ত গলায় বলল
–ইরা তুই ভালো আছিস তো?
ইভানের কথার মানে বুঝতে পেরে ইরা একটু হেসে বলল
–আমি ভালো থাকব তুমি জানতে ভাইয়া। আর না জানলে তুমি এই বিয়েতে কখনও সম্মতি দিতে না।
ইরার কথা শুনে ইভান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–ঠিক আছে রাখছি। পরে আবার ফোন দিবো।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। ইরার শরীরটা ঝিমিয়ে আসছিল। ঠিক হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলো। রিহাব এসে ঘরে ঢুকেই দেখে ইরা ঘুমাচ্ছে। সে নিঃশব্দে ওয়াশ রুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে ইরার পাশে বসে তাকে দেখেছে। হালকা একটু গালে হাত দিতেই সে চমকে উঠে রিহাব কে জড়িয়ে ধরল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রিহাব একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে ইরার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–কি হয়েছে? ভয় পেয়েছ?
রিহাবের গলা শুনে ইরা স্বস্তি পেলো। একটা জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল
–স্বপ্ন দেখেছিলাম।
রিহাব কে এভাবে জড়িয়ে ধরায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকে ছেড়ে দিলো। রিহাব একটু হাসল। ইরা মাথা নামিয়েই বলল
–কখন এসেছেন?
রিহাব গম্ভীর গলায় বলল
–অনেকক্ষণ হল।
–আমাকে ডাকেন নি কেন?
–তুমি কি আমার অপেক্ষা করছিলে? করলে তো শুয়ে পড়তে না। আমি কখন আসবো সেটা ভেবে বসে থাকতে।
ইরা ভ্রু কুচকে তাকাল। রাগ করে বলল
–আমাকে ব্লেম করার আগে নিজেই একটু ভেবে দেখেন। বিয়ের পরের দিনে বউকে রেখে কাজে গিয়েছিলেন। একবার ফোনও করেন নি।
–তুমিও তো করনি? দায়িত্ব টা কি আমার একার?
রিহাবের এমন কথা শুনে ইরা উলটে কাদ কাদ গলায় বলল
–বিয়ের আগে তো কত মিষ্টি কথা। আমার সব দায়িত্ব নিবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শত্রুকে বিয়ে করেছি আমাকে আর সহ্যই করতে পারছেনা।
ইরার কথা শুনে রিহাব একটু হেসে তাকে এক টানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। ইরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠতে গেলে আরও জোরে চেপে ধরে। কোমল সরে বলে
–এক্সপেকটেশন প্রকাশ করতে হয় নাহলে কিছুই পাওয়া যায়না।
চলবে…….
তোর ছায়ার সঙ্গী হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৮
৬৫
দরজা ঠেলে রুমে ঢুকেই ঈশা দেখল ইভান ফাইলে মুখ ডুবে ভ্রু কুচকে ভাবছে আর তার সামনে চেয়ারে বসে এক সুন্দরি মেয়ে তাকে দর্শন করে যাচ্ছে। আচমকা এমন দরজা খুলে কাউকে ঢুকতে দেখে দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল। কারন ইভানের কেবিনে কেউ কখনও নক না করে ঢুকেনা। ইভান ঈশাকে দেখে আরও বেশি অবাক হল। কারন সে যে আসবে কোন ভাবেই ইভান জানতোনা। হা করে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঈশা একটু বিরক্ত হয়ে ধির পায়ে এগিয়ে এলো। ইভান ফাইল বন্ধ করে রেখে সামনে থাকা মেয়েটাকে বলল
–আমি এই ফাইল গুলা পরে দেখবো। এখন আপনি আসুন।
মেয়েটা ইভানের কথা শুনে কিছু বলল না ঠিকই কিন্তু খুশিও হতে পারলো না। ঈশার দিকে তাকাল। তার চোখে এক রাশ বিরক্তি। সে ঈশাকে ভালো করে দেখে নিলো। ঈশার মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো। সে ভ্রু কুচকে মেয়েটার দিকে তাকাল। ঈশার যে মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি তা ইভান ভালো করে বুঝতে পেরে একটু হেসে বলল
–মিস রিনি মিট মাই ওয়াইফ মিসেস ঈশা ইভান মাহমুদ।
ঈশার রাগ করার কথা থাকলেও আশ্চর্য জনক ভাবে সব রাগ কোথায় হারিয়ে গেলো। ঈশা শান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। কিন্তু মিস রিনি অবাকের সুর টেনে বলল
–স্যর আপনার ওয়াইফ মানে?
তার কথায় দুজনি তার দিকে ঘুরে তাকায়। ইভান একটু হেসে বলে
–ইয়েস মাই ওয়াইফ!
রিনির কথাটা যে পছন্দ হয়নি সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রিনি আর কথা না বলে চলে গেলো। ইভান নিজের চেয়ারে বসেই ঈশাকে তর্জনী আঙ্গুলে ইশারা করলো তার কাছে আসতে। কিন্তু ঈশা আসলো না। পাশেই দাড়িয়ে থাকলো। ইভান হালকা চেয়ার থেকে উঠে ঈশার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনল। তারপর তার কোলে বসিয়ে নিলো। ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–রাগ করার কারণটা জানতে পারি?
ঈশা মুখটা ফুলিয়ে বলল
–রাগ করিনি তো।
ইভান একটু হেসে ঈশার মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে বলল
–তাহলে আমার হৃদয়ের আকাশে পূর্ণিমার বদলে ঘোর অমাবস্যা কেন?
ইভানের কথা শুনে ঈশা একটু হাসল। ইভান আলতো করে ঈশার গালে চুমু দিয়ে বলল
–তুই এখানে হঠাৎ?
ঈশা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কেন আমি আসায় খুব অসুবিধা হল বুঝি?
ইভান চিন্তিত হয়ে বলল
–বেশ না হলেও একটু হয়েছে।
ঈশা রাগ করে উঠে যেতে নিলে ইভান ঈশার চুল খুলে দেয়। ঈশা খুব বিরক্ত হয়ে যায়। তার চুলে মুখ ডুবিয়ে ইভান ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে
–তুই আমার কাছে থাকলে আমি কিভাবে কাজে মনোযোগ দিবো। আমার সমস্ত মনোযোগ তো তোর উপরেই।
ঈশা নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল
–ইরার বাসায় যেতে হবে।
ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
–কেন? কি হয়েছে? ইরা ঠিক আছে তো।
ঈশা মুচকি হেসে বলল
–সব ঠিক আছে মাই ডিয়ার হাসবেন্ড!
ঈশার মুখে এমন কথা শুনে ইভানের মুখের হাসি প্রশস্ত হয়ে গেলো। হাসি মুখে ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা আর একটু হেসে বলল
–আজ ইরার জন্মদিন। ভুলে গিয়েছ? আমরা সারপ্রাইজ দিতে যাব।
ইভান চোখ বন্ধ করে ভ্রু উচিয়ে কিছুক্ষন ভাবল। তারপর বলল
–কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম।
ঈশা সামনের টেবিলে থাকা তার ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এক রাশ ভালো লাগা সারা শরীরে ছড়িয়ে গেলো। এতো কিছুর মাঝেও ঈশার ছবিটা যত্ন করে সামনে রাখতে সে ভুলেনি। সেটা হাতে নিয়ে বলল
–চিন্তা নেই। এসবের জন্য আমি আছি তো।
ঈশার কথা শুনে ইভানের মনে তৃপ্তির জোয়ার বয়ে গেলো। ভালো করে চেয়ারে হেলানি দিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা ছবিটা তার জায়গায় রেখে দিয়ে বলল
–ইলহাম কে আমি ফোন করে দিয়েছি। ক্লাস শেষ করে সোজা চলে যাবে।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়েই থাকলো। ঈশা ইভানের এভাবে চুপ করে থাকা দেখে বলল
–আমাকে দেখা শেষ হয়ে গেলে এখন আমরা যেতে পারি?
–তোর এই রুপ সারাজীবন নিস্পলক দেখেলেও শেষ হবেনা।
ইভান একটু হেসে রিনি কে ফোন করে সব মিটিং ক্যান্সেল করে দিতে বলে। তারপর সামনের টেবিলে থাকা সব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঈশার সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে
–চল।
ঈশা একটু হেসে তার হাতে হাত রাখে।
৬৬
ইরার খুব মন খারাপ। আজ তার জন্মদিন অথচ কেউ মনে রাখেনি। রাতে একবার শুকনো মুখে রিহাব উইশ করেছিলো শুধু। মন খারাপ করে তাই রান্না করছিলো রান্না ঘরে। বাড়িতে এই মুহূর্তে সে রিহাব আর একজন কাজের লোক আছে। তার শ্বশুর শাশুড়ি দুইদিন হল চলে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। আজ রিহাব হসপিটালে যায়নি। ইরা সকাল থেকে অনেক বার কারন জিজ্ঞেস করেছে সে এক কথায় উত্তর দিয়েছে
–শরীর ভালো লাগছেনা।
ইরা আর কথা বাড়ায় নি। রান্না করতে রান্না ঘরে চলে গেছে। কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে ঘুরতেই দেখতে পায় রিহাব দাড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–কিছু লাগবে?
রিহাব পানির বোতল হাতে নিয়ে ইরার কাছে ধির পায়ে এগিয়ে আসছে। ইরা একটু শুকনো ঢোক গিলে আবার জিজ্ঞেস করলো
–কিছু কি লাগবে?
রিহাব তার কাছে এসে থেমে গিয়ে বলল
–যা লাগবে সেটা কি দিবে?
ইরা তার কথা মানে বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। একটু পিছিয়ে গিয়ে তাকের সাথে লেগে গেলো। রিহাব একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল
–আমাকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? তুমি বউ হয়ে আমাকে যতটা ভয় পাও আমার হসপিটালের নার্স রাও আমাকে এতোটা ভয় পায়না।
রিহাবের কথা শুনে ইরার লজ্জা সংকোচ ভয় কিছু সময়ের জন্য উধাও হয়ে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–তাহলে হসপিটালেই জান। বাসায় থাকার কি দরকার।
রিহাব আর একটু কাছে এসে বলল
–হসপিটালে তো আর বউ থাকেনা। বাসায় থাকে।
–কিন্তু বউয়ের কাছে তো কিছুই পাওয়া যায়না। হসপিটালে চাইলেই পেতে পারেন।
ইরার কথা শুনে রিহাব নিশব্দে দাঁত বের করে হাসল। মুখটা আরও একটু কাছে এনে বলল
–বউটা একটু কষ্ট করলেই আমার আর এতো কষ্ট হয়না।
ইরা রিহাবের কথা শুনে একটু হাসল। রিহাব কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল
–আমাকে আমার কাজ করতে দিন আর নিজেও নিজের কাজ করেন।
রিহাব ইরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। ভয়ে ইরার ঠোঁট কাঁপছে। রিহাব সেই ঠোটের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার কম্পমান ঠোঁট আমাকে দুর্বল করিয়ে দিচ্ছে।
ইরা রিহাবের কথা শুনে দুই হাতে মুখ চেপে ধরল। রিহাব ভ্রু কুচকে বলল
–তুমি কি ভাবছ আমি তোমার ঠোঁটে কিস করবো? একটু বেশিই ভাবছ।
রিহাবের কথা শুনে ইরা আশস্ত হয়ে ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে নেয়। রিহাব দেরি না করে ইরার ঠোঁট দুইটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। আচমকা এমন হওয়াতে ইরার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ইরার এমন নড়াচড়ায় রিহাব তাকে দুই হাতে দেয়ালের সাথে জোর করে চেপে ধরে। দুজনের নিশ্বাস ভারি হয়ে যায়। ইরা নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে শান্ত হয়ে যায়। তার হাত পা অবশ হয়ে আসে। রিহাব বেশ কিছুক্ষন পর তাকে ছেড়ে দেয়। ইরা চোখ বন্ধ করে হাপাতে থাকে। রিহাব তাকে ভালো করে দেখে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। ইরা চোখ খুলে রিহাব কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। রিহাব একটু কাছে এসে নিশব্দে দাঁত বের করে হেসে বলল
–তুমি একদম ঠিক ভাবছিলে।
ইরার গালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বলে
–হ্যাপি বার্থ ডে সুইট হার্ট!
রিহাবের কথায় ইরার সারা শরীর কেঁপে উঠে। কাল রাতেও সে উইশ করেছিলো কিন্তু এভাবে না। এক অন্যরকম অনুভুতি। এই অনুভূতির নাম তার জানা নেই। এক অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করে তার মাঝে। রিহাবেরর প্রতি এক অন্য রকম আকর্ষণ। এই মানুষটাকে আজ চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করছেনা। ইরা কিছু না ভেবেই রিহাব কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রিহাব ইরার এরকম স্পর্শে বিচলিত হয়ে যায়। একটু ভেবে সেও ইরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কলিং বেলের তীব্র আওয়াজে দুজনেরি ঘোর কাটে। ইরা লজ্জা পেয়ে রিহাবকে ছেড়ে দেয়। উলটা ঘুরে যায়। রিহাব একটু হেসে বলে
–তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
ইরা ঘুরে রিহাবের দিকে তাকায়। ভ্রু কুচকে বলে
–কি সারপ্রাইজ?
–সারপ্রাইজ কেউ বলে নাকি বোকা মেয়ে।
বলেই দরজা খুলতে গেলো। ইরা গ্যাসের চুলাটা অফ করে রিহাবের পিছে পিছে বেরিয়ে এলো। রিহাব দরজা খুলে একটা হাসি দিলো। ইভান রিহাব কে জড়িয়ে ধরল। ইরা পিছন থেকে দেখে অবাক হয়ে বলল
–ভাইয়া তুমি?
ইভান রিহাব কে ছেড়ে দিতেই ইরা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ইভান তাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার সিস্টার!
ইরা খুব খুশি হল। মাথা বাকিয়ে একটু দেখতেই ঈশাকে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গেলো। তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ঈশাও কেঁদে ফেললো। তারপর তাদের সবাইকে নিয়ে ভিতরে এলো। ইরা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–ইলহাম ভাইয়া কোথায়?
–ক্লাসে। শেষ করে সোজা চলে আসবে।
সোফায় বসতে বসতে ঈশা কথাটা বলল। ইরা একবার রিহাবের দিকে তাকাল। ইভানের সাথে গল্পে ব্যস্ত। সত্যিই মানুষটা তার খুশির কথা ভাবে। এই মুহূর্তে তার কি প্রয়োজন ছিল তা সে ঠিকই বুঝে নিয়েছে।
৬৭
বাসার মাঝখানে সোফায় বসে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এক রাশ গল্প আর হাসাহাসিতে মশগুল সবাই। শুধু ইভান নেই। একটু আগেই অফিস থেকে এক জরুরী কাজের জন্য ফোন আসে। তাড়া হুড়ো করে বের হতে হতে বলে সে এসে ঈশাকে নিয়ে যাবে। অল্প কাজ আছে। বেশি সময় লাগবেনা। তাই তারা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে আর ইভানের জন্য অপেক্ষা করছে। ইরা খুব খুশি। রিহাব তার দিকে তাকাতেই ইরার চোখে চোখ পড়ে। ইরার তখনের কথা মনে পড়তেই এক রাশ লজ্জা নিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। রিহাব বুঝতে পেরে একটু মুচকি হাসে। ইলহাম ইরাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তুই যে এতো ভালো রান্না করতে পারিস আমার সত্যিই ধারনা ছিলোনা।
ইরা এক গাল হেসে বলল
–ভালো লেগেছে?
ইলহাম মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। ইরা হেয়ালি করে বলল
–বিয়ে করে বউ কে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। রান্না শেখাব।
তার কথায় সবাই হেসে ফেললো। এর মাঝেই রিহাবের ফোন বেজে উঠলো। বিরক্তিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–ছুটি নিয়ে একদিন বাসায় বসে থেকেও শান্তি নেই।
ঈশা একটু হেসে বলল
–ছুটি নিয়ে কয়েকদিন দূর থেকে ঘুরে আসেন ভালো লাগবে।
রিহাব ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–তাই ভাবছি। কয়েকদিন ছুটি নিয়ে হানিমুন সেরে আসি।
ইরা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। কি মানুষ রে বাবা। সবার সামনে এমন কথা কেউ বলে। লজ্জা বলতে কিছুই নেই। আবার ফোনের শব্দে চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন নিয়ে উঠে গেলো রিহাব। একটু দূরে গিয়ে কি যেন কথা বলে বিচলিত হয়ে এলো। তার আসা দেখে সবাই তার দিকে তাকাল। ঈশা জিজ্ঞেস করলো
–রিহাব ভাইয়া কোন সমস্যা?
রিহাব ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমাদের তাড়াতাড়ি হসপিটালে যেতে হবে ঈশা।
সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। তার এমন কথার মানে বুঝতে। রিহাব ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–হসপিটাল থেকে ফোন করেছিলো ইভানের…।
চলবে………।