তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ৯,১০
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৯
২০
ঈশা আর রিমা রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। রোদের তেজ অনেক বেশি। ঈশার মাথা ধরে আসছে। বিরক্ত হয়ে ঈশা বলল
–চল এক পাশে ছায়ায় দাড়াই।
রিমা তার কথা শুনে পাশে থাকা একটা গাছের নিচে দাঁড়ালো। ঈশাও তার পিছু পিছু গিয়ে দাঁড়ালো।
–কেমন আছো ঈশা?
কিঞ্চিত পরিচিত কণ্ঠে দুজনি ঘুরে দাঁড়ায়। আরমান কে দেখে ঈশা একটু বিরক্ত হয়। ঈশা তাকে অনেক বার নিষেধ করার পরও সে তাকে বিরক্ত করে যায়। ঈশা বিরক্ত নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঈশার এমন চাহুনি দেখে আরমান বলে
–আমি তোমাকে খুব বিরক্ত করি তাই না ঈশা। কি করবো বল। এই মনটা কে যে বোঝাতে পারিনা। মনের মধ্যে কোথাও একটা ক্ষীণ আশা এখনো থেকে গেছে। তোমাকে পাওয়ার আশা।
কথা শুনে ঈশা একটু চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর বলল
–দেখুন আরমান ভাই আপনি আমার সম্পর্কে সবটা জানেন না। আমি জানাতে চেয়েছি কিন্তু আপনি আমাকে জানাতে দেন নি।
–আজও আমি জানতে চাইনা ঈশা। তোমার কোন কিছুই আমি জানতে চাইনা। আমার কোন প্রয়োজন নেই।
ঈশা এবার রেগে বলল
–আমাকে আর বিরক্ত করবেন না প্লিজ। আমি আপনার কাছে অনুরধ করছি।
বলেই ঈশা ওখান থেকে চলে এলো।রিমাও তার পিছু পিছু চলে এলো। আরমান তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা সামনে একটা রিকশা পেতেই ডাকল
–এই মামা যাবেন?
রিকশা এসে দাঁড়ালো। দুজনি রিক্সায় উঠে গেলো। রিমার ঈশার সাথে তাদের বাসায় যাওয়ার কথা। কিছুক্ষন দুজনি চুপ করে থাকার পর রিমা বলল
–আরমান ভাই যে কবে বুঝতে পারবে। কেন যে লোকটা এমন অদ্ভুত। কথা শুনলেই সব কিছু পরিস্কার হয়ে যায়। কিন্তু উনি তো কোন কথা শুনতেই রাজি না।
ঈশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল
–লোকটা কেন বুঝতে চায়না আমি তাকে এভয়েড করি। এভাবে উনি আমার সাথে নিজের বিপদ বাড়াচ্ছে।
রিকশা এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। দুজনি রিকশা থেকে নেমে সামনে তাকাল। ইভান কঠিন দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ভয় পেয়ে একটু ঢোক গিলে ফেললো। ঈশা ভয় পাচ্ছে আরমানের সাথে কথা বলা ইভান জেনে গেলো না তো। ঈশা ভয়ে ভয়ে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। ঈশার অবস্থা ইভান বুঝতে পারল। ঈশার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ইভান রিমার দিকে তাকাল। একটু হেসে বলল
–কেমন আছো?
রিমা ইভানের কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে বলল
–খুব ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?
–এতক্ষন ভালো ছিলাম কিন্তু তোমাকে দেখার পর খুব ভালো আছি।
এক গাল হেসে কথাটা বলল ইভান। রিমা খুশিতে আর কথা বলতে পারলনা। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ইভান তার সাথে একটা কথাও বলল না। তার দিকে কঠিন ভাবে তাকাল। ইভানের সেই কঠিন দৃষ্টি ঈশার ভয় বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু তার এই দৃষ্টির কারন ঈশা বুঝতে পারলনা। ইভান ঈশাকে ভালো করে দেখে নিয়ে রিমাকে বলল
–তোমরা বাসায় যাও আমি আসছি।
বলেই ঈশার দিকে একবার দেখে চলে গেলো। ঈশা পিছনে ফিরে ইভানের যাওয়ার দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঈশা রিমাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ঈশারা ভিতরে যাওয়ার পর ইভান পিছনে ঘুরে তাকাল। একটু ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ফোন দিয়ে বলল
–বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বি কেয়ার ফুল।কেউ যেন কিছুই বুঝতে না পারে।
কথাটা শেষ করেই ঈশাদের বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে একটু বাকা হাসল ইভান।
২১
ঈশা আর রিমা বেশ হাসাহসি করছে কি নিয়ে। ইভান দরজায় দাড়িয়ে ঈশাকে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। এই মেয়েটার হাসিতেই তার সমস্ত সুখ। ঈশাকে এমন হাসি খুশি দেখলে ইভান তার সমস্ত দুঃখ ভুলে যায়। নিজেকে দুনিয়ার সব থেকে সুখি মনে হয়। তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ইলহাম ইভান কে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে পাশে এসে দাড়িয়ে ধির কণ্ঠে বলল
–ভিতরে গেলে তোমাকে কেউ ফাসি দিবেনা।
তার কথায় ইভান একটু চমকে গেলো। তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশার তাদের দিকে চোখ পড়তেই ইলহাম কে বলল
–ওখানে কি করছিস? ভিতরে আয়।
ঈশার কথা শুনে ইভান তার দিকে তাকাল। ঈশাও ইভানের দিকে তাকাল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কত বছর পর দুজন কে দেখছে। ঈশার এভাবে তাকানো দেখে ইভান হেসে দিলো। রিমা ঈশাকে ধাক্কা দিয়ে বলল
–তুই এতো লাল পরিস কেন বলত? আলমারি খুললেই লালের ছড়াছড়ি।
বলেই একটা লাল ওড়না হাতে তুলে নিলো। ইভান ওড়নাটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা আড় চোখে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ধির পায়ে এসে ওড়নাটা রিমার হাত থেকে নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে বলল
–উত্তর টা দে ঈশা।
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ওড়না থেকে চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। তার উত্তরের অপেক্ষা করছে। ইভানের কথা শুনে ঈশার বুকের ভিতরে সব কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। কি উত্তর দিবে ঈশার জানা নেই। চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান একটু হেসে রিমার দিকে তাকিয়ে বলল
–এই রঙটা ওর মনের খুব কাছের।
বলেই ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা মাথা নামিয়ে বসে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। কারন ঈশার লাল রঙ কখনই পছন্দ ছিলোনা। কিন্তু ইভানের চোখে ঈশাকে লাল রঙ্গে অনেক ভালো লাগতো। সে সব সময় চাইত ঈশা তার সামনে লাল পরুক। তাই ছোট বেলা থেকে ইভান ঈশাকে যা কিছু দিয়েছে সব লাল রঙের। কিন্তু ঈশা এই কারনে ইভানের উপরে খুব বিরক্ত হতো। সে ইভানের জেদের কারনেই শুধু জোর করে লাল পরত। এই মুহূর্তে রিমার প্রশ্নের কারনে ঈশা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলো। কারন সে তো লাল কখনই পছন্দ করত না। কিন্তু গত ৫ বছরে মনে হয় সে শুধু লাল রঙটাই আঁকড়ে ধরে আছে স্মৃতি হিসেবে। সেই সময়ে ইলহাম বলল
–কিন্তু আপি তোমার লাল রঙ তো পছন্দ না!
ইলহামের কথা শুনে ঈশা তার দিকে তাকাল। রিমা ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলল
–পছন্দ না মানে? লাল ছাড়া তো আমি তাকে খুব কম সময়ই পড়তে দেখি।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। ইভানের দৃষ্টিতে আজ হাজারো প্রশ্ন যার কোনটার উত্তর ঈশার কাছে নেই।
ঠিক সেই সময় ইরা এসে বলল
–রিমা আপু তুমি আমাকে না মেহেদি পরিয়ে দিবে।
–ওহ হ্যা একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
বলেই রিমা উঠে গেলো। ইলহামও তাদের সাথে বেরিয়ে গেলো। ঈশা নিচের দিকে তাকিয়েই বসে আছে। ইভান মাথার নিচে একটা হাত দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সত্যি কথা বলার সৎ সাহস টা রাখতে হয়। তাহলে অনেক কিছু পাওয়া যায় জীবনে।
ঈশা একটু কঠিন হয়ে বলল
–ঠিক তাই। মাঝে মাঝে এই সত্যি কথা বলার অভাবে অনেক মানুষের জীবন পরিবর্তন হয়ে যায়। আর সেটা কেউ বুঝতেও পারেনা।
কথাটা যে ইভান কে উদ্দেশ্য করে বলা সেটা বুঝতে ইভানের দেরি হল না। সে উঠে ঈশাকে বিছানার সাথে চেপে ধরল। তার দিকে চোখ মুখ শক্ত করে বলল
–সারা জীবন আমি বলে যাব আর তুই শুনবি তা হবেনা। এবার তোকেও বলতে হবে। আমি কাউকে ছেড়ে দেইনা। সবার সব কিছুর হিসাব সুদে আসলে ফেরত দেই। যতটা ভালবাসতে পারি ঠিক ততটাই কষ্ট দিতেও পারি। আমার কাছ থেকে তুই কিছু লুকাবি সেই সাধ্য তোর নেই। আর কখনও চেষ্টাও করিস না তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবেনা।
ঈশাকে ইভান এতো জোরে চেপে ধরেছিল যে ঈশার ব্যাথা লাগছিলো কিন্তু ইভানের সেদিকে কোন খবর নেই। কথা শেষ করেই ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো। ঈশা ইভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। দুই ফোটা পানি চোখ বেয়ে পড়লো। মাঝে মাঝে ঈশার ইভান কে বুঝতে কষ্ট হয়। ঈশা জানে ইভান তাকে খুব ভালবাসে কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে তার আচরণ ঈশার প্রতি খুব কঠোর হয়। ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইলহাম কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকল
–আপি আজ বিকেলে ফুচকা খেতে যাবে?
ইলহামের কথা শুনে ঈশা নিজের চোখের পানি আড়াল করে মুছে ফেললো। খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
–ঠিক আছে যাব।
–আজ তোরা কোথাও বাইরে জাবিনা।
ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতে বলতে ঘরে ঢুকল। ইভানের কথা শুনে ইলহাম জিজ্ঞেস করলো
–কিন্তু কেন ভাইয়া?
–আমি বলেছি তাই।
ইলহাম আর কিছু বলতে যাবে ইভান ফোন থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–আর একটা কথা বললে রোদের মধ্যে ছাদে দাড়িয়ে রাখবো দুই ঘণ্টা।
ইভানের কথা শুনে ইলহাম ভয় পেয়ে গেলো। তার কোন বিশ্বাস নেই। এমনটা করতেও পারে। তাই সে আর কোন কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা মাথা নিচু করে বসে আছে। ইভানের আচরনে সে যে কষ্ট পেয়েছে সে ভালো করে বুঝতে পারছে। ঈশার মুখ দেখে ইভানের খুব কষ্ট হল। ঈশার সামনে বসে তার সামনের চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল
–সরি জান। মেজাজ টা ঠিক নেই। আমার উপরে রাগ করেছিস?
ইভানের এমন কথা শুনে ঈশা তার দিকে তাকাল। একটু সময় তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে না বলল। ইভান অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার প্রতি তোর কত অনুভুতি ছিল। জেদ করতিস আমার সাথে। রাগ করতিস। আমি খুব যত্ন করে তোর রাগ ভাঙ্গাতাম। সেই ঈশাকে খুব মিস করি। খুব বেশি মিস করি।
ইভানের এমন কথা শুনে ঈশার মনে খুব কষ্ট হল। ইভান উঠে চলে যাচ্ছিলো। ঈশা তার দিকে তাকিয়ে বলল
–রাগ করিনি অভিমান করেছি। সেটা মুখে বলা যায়না। বুঝে নিতে হয়।
ঈশার কথা শুনে ইভান পিছনে ঘুরে তাকায়। একটু হেসে দরজার সাথে হেলানি দিয়ে হাত গুঁজে বলে
–আমার মান ভাঙ্গানোর স্টাইলটা অন্য রকম। আমি সেটা এই মুহূর্তে প্রয়োগ করতে গেলে মানতো ভাংবেই না উলটা তুই রাগ করবি।
ঈশা ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। ইভান তার কাছে এসে বসে বলে
–কথাটা শুনেই রাগ করলি। আর ভাঙ্গাতে গেলে ফাসিই দিয়ে দিস কিনা!
ঈশা এবার খুব বিরক্ত হল। খুব শান্ত সরে বলল
–আমি যে তোমার উপরে বিরক্ত হচ্ছি সেটা কি বুঝতে পারছ?
ইভান ঈশার হাত ধরে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে তার আঙ্গুল গুলোতে আলতো স্পর্শ করতে করতে বলল
–তুই যে আমার কাছ থেকে বিরক্তই হতে চাস। এই জন্যই তো উঠে পড়ে লাগি তোকে বিরক্ত করতে।
ঈশা একটা বিরক্তিকর শব্দ করে বলল
–তুমি কি কখনও একটু সিরিয়াস হবেনা?
ইভান ঈশার হাত ছেড়ে দিয়ে ঈশার গালে এক হাত দিয়ে আলতো করে ধরে বলল
–তোর কি মনে হয় তোর ব্যাপারে আমি কখনও হেয়ালি করেছি।
তারপর নাকে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলল
–ইউ আর মাই লাইফ অ্যান্ড আই এম ড্যাম সিরিয়াস এবাউট ইউ!
কথা শেষ করেই ঈশাকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু ঈশা ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ইভান কিছুক্ষন ভালো করে ঈশাকে দেখে নিয়ে একটু হেসে বলল
–তোমার এই নিরব ভালোবাসার জালে আমাকে আর কতদিন জড়িয়ে রাখবে গো প্রেয়সী। একবার তো বল ভালোবাসি। আমিও অনুভব করি তোমার এই মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা।
ইভানের কথা শুনে ঈশা চোখ খুলে ফেলে। তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখে একটা মিষ্টি হাসি নিয়ে ইভান তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই হাসির মায়ায় পড়ে গেছে ঈশা। ইভান নিজের হাসি একটু প্রশস্ত করে বলল
–আর বিরক্ত করবোনা।
বলেই উঠে গেলো। দরজা পর্যন্ত যেতেই ঈশা বলল
–প্লিজ করোনা। তোমাকে আমার অসহ্য লাগে।
ইভান পিছনে ঘুরে একটু হেসে বলল
–দূর থেকে ভালবাসলে সহ্য করতে পারবি তো?
ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান একি অবস্থাতে থেকেই বলল
–আমি যেদিন তোর কাছে অসহ্য হয়ে যাব সেদিন তুই নিজেই নিজের কাছেই আর সহ্য করার মতো থাকবিনা। কারন তোর মন প্রান সবটা জুড়েই আমার অস্তিত্ব।
ইভান নিজের কথা শেষ করে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। রিমা হাপাতে হাপাতে এসে বলল
–আরমান ভাইয়ার এক্সিডেন্ট হয়েছে। হসপিটালে ভর্তি।
কথাটা শুনে ঈশা বাইরে দাড়িয়ে থাকা ইভানের দিকে তাকাল। সে ভাবলেশহীন ভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কথাটা তার কানে গেলো কিনা সেটাও ঈশা বুঝতে পারলনা।
চলবে……
তোর ছায়ার সঙ্গী হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০
২২
ইভান দরজা খুলে ঢুকতেই তাকে দেখে সামনের মানুষটা চমকে গেলো। ইভান খুব শান্ত সরে বলল
–রিলাক্স! আপনার জন্য এতো উত্তেজনা ভালো না। এমনিতেই অনেক কষ্ট করে আপনার জ্ঞান ফেরান হয়েছে।
ইভানের কথা গুলো শুনে আরমান জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইভান সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল
–সো স্যাড! এভাবে দেখতে সত্যিই আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো তুই যে আমার কোন উপায় রাখলিনা।
আরমান নিস্তব্ধ হয়ে ইভানের কথা গুলো শুনছিল। কারন আরমানের এই এক্সিডেন্টের পিছনে যে ইভানের হাত আছে তা বুঝতে আর তার বাকি থাকলো না। সে ভয়ে চুপসে গেলো। ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–আগেও তোকে ওয়ার্নিং দিয়েছি। তুই শুনিস নি। আমি বলেছিলাম এর পর খারাপ কিছু হলে সেটার জন্য আমি দায়ী থাকব না। দেখ তুই নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলি।
আরমান এবার ভিত কণ্ঠে বলল
–তোর এই রুপ ঈশা জানতে পারলে তোকে ঘৃণা করবে।
আরমানের কথা শুনে ইভান তার মুখ চেপে ধরল। তারপর দাতে দাঁত চেপে বলল
–ঘৃণা করুক আর ভালবাসুক ওকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আমি ওকে কখনও নিজের থেকে আলাদা হতে দিবনা।
আরমান কে ছেড়ে দিয়ে ইভান উঠে দাঁড়ালো। তারপর আবার ঘুরে বলল
–শেষ বারের মতো তোকে বেঁচে রাখলাম। একি ভুল আবার করলে আর বাঁচার সুযোগ পাবিনা। ঈশা আমার জান। ওর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি তাকে কখনও ছেড়ে দিবনা। তুই ঈশাকে নিয়ে যে নোংরা খেলায় মেতেছিস সেটা আমি হতে দিবনা। বলে দিস তোর গড ফাদারকে। আমার ঈশার থেকে দূরে থাকতে। নাহলে ওর অবস্থাও তোর মতই হবে।
বলেই সেখান থেকে বের হয়ে গেলো ইভান। বাইরে এসে সাহিল কে বলল
–ওর ট্রিটমেন্ট ঠিক মতো যেন হয়। খেয়াল রাখিস। আর ওর সাথে কেউ যেন দেখা করতে না পারে।
সাহিল কে সব বুঝিয়ে দিয়ে ইভান সেখান থেকে বাড়ির দিকে চলে গেলো।
২৩
কয়দিন ধরেই মাইগ্রেনের ব্যথাটা বেড়েছে ঈশার। আগে মাঝে মাঝে হতো। কিন্তু এখন প্রায় সময়ই হচ্ছে। তীব্র ব্যাথায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে বসে পাশের টেবিলে রাখা বোতল টা হাতে নিয়ে দেখল পানি নেই। দরজা খুলে বাইরে ডাইনিং টেবিলে জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নিলো। গ্লাস টা রেখে পাশে ঘুরতেই চোখে পড়লো সোফায় শুয়ে ইভান ফোনে গেম খেলছে। ঈশা ধির পায়ে গিয়ে পাশে দাড়াতেই ইভান তাকে দেখে উঠে বসে পড়লো।
–তুই এখানে?
ঈশা শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি কি করছ?
ইভান রেগে বলল
–তুই উঠেছিস কেন?
–ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই পানি খেতে এসেছিলাম। তোমাকে দেখে এদিকে আসলাম। তুমি ঘুমাওনি।
ইভান উঠে ঈশার হাত ধরে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরের দরজা টা বন্ধ করে দিল। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে বলল
–ঘরের চারিদিকে একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেই আর বাইরে যেতে হতনা।
ইভানের কথা শুনে ঈশা চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। টেবিলের এক পাশে পানি ভর্তি একটা বোতল রাখা আছে। সচরাচর যে পাশে থাকে তার বিপরিত পাশে আছে। তাই খুঁজে পায়নি। বোতলটার দিকে তাকিয়ে বলল
–এটা তুমি রেখেছ?
ইভান মাথা নেড়ে হ্যা বলল। তারপর ঈশাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। টেবিলে থাকা ঈশার ঔষধের বক্স টা হাতে নিয়ে খুলে ফেললো। সব ঔষধ একবার করে দেখে নিলো। একটা ঔষধের স্ট্রিপ হাতে নিয়ে বলল
–ঔষধটা খেলেই শান্তি মতো ঘু্মাতে পারতিস। খাস নি কেন?
ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–তুমি জানো আমি ঔষধ খেতে পারিনা।
ইভান ঔষধের স্ট্রিপ টা হাতে নিয়ে ঈশার সামনে বসে বলল
–খেতে না পারলেও খেতে তো হবেই। নাহলে মাথা ব্যাথা কমবে কিভাবে?
এবার ঈশা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি কিভাবে বুঝলে আমার মাথা ব্যথা।
ইভান একটু হেসে ঈশার অনেকটা কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলল
–তোর চোখ দেখে।
ঈশা অবাক দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এই ছেলেটা তাকে এতোটা কিভাবে বোঝে। ঈশা নিজেকে যতটা বুঝেনা তার থেকে বেশি ইভান তাকে বুঝে। একটা মানুষকে ঠিক কতটা ভালবাসলে তাকে এভাবে বোঝা যায় তা ঈশার জানা নেই। এই মুহূর্তে সে আন্দাজও করতে পারছেনা। হয়ত ইভানের ভালোবাসার গভীরতা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান বলল
–কেন শুধু শুধু মাঝরাতে আমাকে এভাবে পাগল বানাচ্ছিস? এভাবে নেশা ভরা চোখে তুই তাকিয়ে থাকলে আমি কতক্ষণ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারব জান? তুই কি বুঝিস না আমি তোর প্রতি কতটা দুর্বল।
আর একটু কাছে এসে নেশা ভরা কণ্ঠে বলল
–এবার যদি আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে কিছু করে বসি তাহলে তার জন্য কিন্তু আমি দায়ী থাকবনা।
ইভানের কথা শুনে ঈশা একটু সরে গেলো। মাথা নিচু করে ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইভান স্ট্রিপ থেকে ঔষধ খুলে ঈশার মুখের সামনে ধরল। ঈশা মুখ সরিয়ে নিলো। ইভান ঈশার কাছে এসে বলল
–ঔষধ তোকে খেতেই হবে। কিভাবে খাবি সেটা তোর ডিসিশন!
ইভানের কথা বুঝতে পেরে ঈশা মুখটা কাছে এনে ঔষধ টা মুখে নিয়ে নিলো। ইভান পানি খাইয়ে দিলো ঈশাকে। ঈশার ঔষধ খেতে খুব কষ্ট হয়। তাই ইভান অনেক গুলা চকলেট ঈশাকে দিয়েছে। যাতে সে ঔষধ খাওয়ার পর সেগুলা খেতে পারে। ঈশা তার বালিশের নিচে থেকে চকলেট বের করে মুখে পুরে দিলো। ইভান ঈশাকে দেখছিল। ঈশা চকলেট শেষ করে ইভানের দিকে তাকাল। ইভানের তাকানো দেখে ভ্রু কুচকে বলল
–কি দেখছ?
ইভান কোন কথা না বলে মুচকি হেসে ঈশাকে বিছানায় শুয়ে দিলো। ঈশা ভালো করে শুয়ে নিয়ে বলল
–তুমিও এখন ঘুমাও। অনেক রাত হয়ে গেছে।
ইভান কিছু বলল না। ঈশা আবার জিজ্ঞেস করলো
–না ঘুমিয়ে কি করছিলে এতো রাতে?
–ঘুম আসছিলনা। তাই গেম খেলছিলাম।
পাশে খোলা জানালাটা লাগিয়ে দিতে দিতে বলল। ঈশা ইভানের কথা শুনে আবেগি কণ্ঠে বলল
–মন খারাপ?
ইভান তার দিকে তাকাল। তারপর জানালার পর্দাটা সরিয়ে থাইয়ের বাইরের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–সব দোষ তো এই মনটারই। এটাকে যদি নিজের আয়ত্তে আনতে পারতাম তাহলে কিছুই হতনা।
ঈশা এবার বিছানা থেকে উঠে বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে বসলো। ইভানও তার সাথে বারান্দায় বসে পড়লো। সামনে তাকিয়ে বলল
–ঘুমাবিনা?
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। সে সামনে তাকিয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়েই বলল
–এখানে একটু বস মন ভালো হয়ে যাবে।
ইভান সামনে তাকিয়েই হাসল। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই কি জানিস তুই আমার আশে পাশে থাকলেই মন ভালো হয়ে যায়।
–কই দেখতে পাচ্ছিনা তো?
ঈশার কথা শুনে ইভান তাকে এক টানে কাছে আনল। গালে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলল
–এটা এমন একটা অনুভুতি যা দেখা যায়না। অনুভব করতে হয়। বুঝে নিতে হয়। কবে বুঝবি তুই?
ঈশা এতক্ষন চোখ বন্ধ করে ইভানের কথা শুনছিল। ইভান তাকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের অনুভুতি বুঝতে না পেরে চোখ খুলে ফেললো। ইভানের দিকে তাকাতেই এক অদ্ভুত অনুভুতি হল। ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–মন ভালো হয়েছে?
ইভান একটু হেসে ঈশার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে। আমি তোকে সুস্থ দেখতে চাই। তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব।
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো। ইভান চলে গেছে কিন্তু ঈশা বারান্দায় বসেই তার দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছে। আজ ইভানের কষ্টটা সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তার মনে যে ঈশাকে না পাওয়ার কষ্ট ক্ষত তৈরি করেছে সেটা ঈশার বুঝতে বাকি থাকলো না।
২৪
চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে ঈশা। দরজায় দাড়িয়ে তাকে দেখছে ইভান। ঈশা এখনো পুরপুরি সুস্থ না। একটানা ব্যথায় দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। কোন একটা বিষয় নিয়ে সে টেনশন করছে। যার কারনে মাইগ্রেনের ব্যথাটা কমছেনা। ঈশার রিলাক্সেশন দরকার। ইভান ঘরে ঢুকল। পাশে বসতেই ঈশা চোখ খুলে ফেললো। ইভান কে দেখে উঠে বসলো। ঈশা জন্ত্রনায় চোখ খুলে ঠিক মতো তাকাতে পারছেনা। ইভান তার দিকে তাকিয়ে বলল
–খুব কষ্ট হচ্ছে?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। ইভান তার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–বাইরে যাবি?
ঈশা খুব কষ্ট করে চোখ খুলে তাকাল তার দিকে। মিন মিনে কণ্ঠে বলল
–কোথাও যাবনা। ভালো লাগছেনা।
ঈশাকে এই অবস্থায় দেখে ইভানের খুব কষ্ট হচ্ছে। ঈশার গালে হাত দিয়ে বলল
–সবাই মিলে বাইরে থেকে ঘুরে আসি দেখবি ভালো লাগবে।
ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভান আবার বলল
–বাইরে যেতে না চাইলে জোর করবোনা। ছাদে তো যেতেই পারিস।
ঈশা আর কিছু বলতে পারল না। হেসে মাথা নাড়ল। ইভান ঈশাকে নিয়ে ছাদের দিকে গেলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দুজন। উপর থেকে গীটারের আওয়াজ কানে আসতেই ঈশা বলল
–উপরে কে?
–ইলহাম আর ইরা গীটার বাজিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করছে।
ছাদে উঠে ঈশা দেখে ইরা বিরক্তি নিয়ে ইলহামের দিকে তাকিয়ে আছে আর ইলহাম এলোমেলো ভাবে গীটার বাজিয়েই যাচ্ছে। ইরা খুব বিরক্ত হয়ে কানে হাত দিয়ে বললো
–বন্ধ কর ভাইয়া। খুব বিরক্ত লাগছে। তুমি তো বাজাতেই পারনা।
ইরার কথা শুনে ঈশা শব্দ করে হেসে ফেললো। ইভান পাশে তাকিয়ে ঈশাকে দেখছে। অদ্ভুত সুন্দর হাসি। ঈশা হেসেই যাচ্ছে। ঈশার হাসি শুনে ইরা দৌড়ে ইভানের কাছে এসে বলে
–ভাইয়া দেখ না ইলহাম ভাইয়া কখন থেকে শুধু শব্দ দূষণ করেই যাচ্ছে। কিছুই পারছেনা। গান শুনতে আমাকে ডেকে নিয়ে আসলো। এখন তো আমার মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচি।
ইরার কথা শুনে এবার ঈশা আর ইভান দুজনেই হেসে দিলো। ইলহাম খুব অপমান বোধ করলো। ইরা ইভানের দিকে তাকিয়ে করুন সূরে বলল
–ভাইয়া তুমি আর আপু আগে কত সুন্দর গান গাইতে। আজকে একটা গান গাও না।
ইরার কথা শুনে ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–অনেক বছর গান গাইনা। এখন আর ইচ্ছাও নেই। তোরা তোদের মতো কনটিনিউ কর।
বলেই সামনে এগিয়ে গেলো। পিছন থেকে ঈশা বলল
–আমি বললেও না বলবে?
ইভান তার কথা শুনে একটু চোখ বন্ধ করে ফেললো। পিছনে ঘুরে ঈশার কাছে এসে বলল
–তুই কিছু চাইলে আমি সেটা কখনও না বলব সেই ক্ষমতা কি আমার আছে? তবে আজ ইচ্ছা নেই। তোকে না বলতেও পারবোনা। এক কঠিন পরিস্থিতিতে ফেললি আমাকে।
বলেই ইলহামের কাছে গিয়ে বসে পড়লো। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল তার মন কোন কারনে খুব খারাপ। কিন্তু সে নিজের কষ্ট গুলো কখনও কারও সাথে শেয়ার করেনা। এমন কি ইশাকেও বুঝতে দেয়না। ছোট বেলা থেকেই শুধু সুখটা সব সময় ঈশার সাথে ভাগ করে নিয়েছে। আজ এতো মন খারাপের মাঝেও সে ঈশার কথাই ভাবছে। তার মন ভালো করতে চেষ্টা করছে। ঈশাও ইভানের মন ভালো করতে চায় আজ। তাই একটু হেসে তার পাশে গিয়ে বসল। ইভান ইলহামের হাত থেকে গীটারটা নিয়ে বাজাতে শুরু করলো।
Duniya yeh jeet gayi dil haar gaya..
Nahi socha tha mil kar kabhi honge judaa..
ঈশাও তার সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করলো।
O Khuda
Bata de kya lakeeron mein likha
Humne toh
Humne toh bas ishq hai kiya
গান শেষ করে ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে একবার দেখল। ঈশা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ধির কণ্ঠে ইভান জিজ্ঞেস করলো
–এখন ভালো লাগছে?
ঈশা তার হাসি প্রশস্ত করে সামনে তাকিয়ে বলল
–তুমি জানো আমার কখন কি প্রয়োজন!!
চলবে………