ভোরের আলো ফুটেছে টের পাচ্ছি।কপালে কারো উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পরছে।তা উপেক্ষা করতে হাতের মুঠোতে থাকা কিছু একটা আরো জোড়ে আকড়ে ধরে মুখ এগিয়ে আরো সামনে নিলাম।নাকের ডগায় লোমশ কিছুর স্পর্শে হাচি আসতেই একটু সরে গেলাম।নাকটা ডলে চোখ খুলতেই শুদ্ধ ভাইয়ার প্রায় উদোম শরীরটা চোখে পড়লো।সাদা গেন্জিটার বুকের কাছটায় কয়েকটা লোম উকি দিচ্ছে।হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুঠোতে তার চিকন স্লিভসের গলার দিকটা খামচে ধরে রেখেছি।
তড়িঘড়ি করে হাত ছাড়িয়ে আরো পিছিয়ে গেলাম।ভাগ্যিস ঘুমটা আমার আগে ভেঙেছে।উঠে বসে মাথা চেপে ধরে আগের রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলাম।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশের মানুষটার দিকে তাকালাম আবারো।কেমন যেনো খুতিয়ে খুতিয়ে দেখার ইচ্ছা হলো তাকে।শুদ্ধ ভাইয়া বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন।গালের খোচাখোচা দাড়িগুলো একটু বেশিই,এলোমেলোভাবে বেড়ে গেছে।ঘন ভ্রুজোড়া নির্লিপ্তভাবে থেকে থেকে আবার কুচকে যাচ্ছে কিছুক্ষন পরপরই।চোখ পিটপিট করছেন উনি।কপালের চুলগুলো অগোছালোভাবে কেউ কেউ কপালেই,আবার কেউ বাড়াবাড়ি করতে তার চোখে পরছে।তার বিরক্তির চেহারা বা রাগ সহ্য করার চিন্তা নেই যে ওদের।সাহসটা তাইতো বেশি।
হাত এগিয়ে দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেলাম।ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে কোনো এক অচেনা পাখি বসে।একদম কালো পালকের।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম খুব একটা বেলা হয়নি।পুরো ঘরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো আমার।রাতে যা দেখেছিলাম,তা আরো স্পষ্ট,ঘরটা আরো ভয়ানক, কোনো উথালপাথালের ধ্বংসাবশেষের মতো দেখাচ্ছে।ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে টুকটুক করে এটা ওটা গোছাতে লাগলাম।এ ঘরেই থাকতে হবে আমাকে।যতোদিন এ বাসায় আছি।সেজোমা,সেজোকাকুর আদেশ মানতে বাধ্য আমি।
ঘর গোছাতে গোছাতে আড়চোখে শুদ্ধ ভাইয়াকেও দেখছিলাম।লোকটা উপুর হয়ে ঘুমাতে বেশি পছন্দ করে হয়তো।বাচ্চাদের মতো।তাকে এই মুহুর্তে তেমনি লাগছে দেখতে।শিশুসুলভ,নিস্পাপ।কে বলবে উনি এরকম?কথাটা ভেবে আনমনে নিচের ফুলগুলো জড়ো করছিলাম।হঠাৎই কিছু একটা ফুটলো পায়ে।আহ্ শব্দ করেই মুখ চেপে ধরলাম।উকিঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম লোকটা জেগে গেলো কিনা।নাহ্!উনি জেগে যাননি।পা এগিয়ে দেখি কাচের টুকরো।পাশে থাকা ড্রেসিংটেবিলের ভাঙা আয়নার কথা মনে পরলো।সাথে সাথে শুদ্ধ ভাইয়ার হাতের কথাও।তার দিকে আরেকনজর তাকিয়ে দেখলাম হাত মাথার নিচে দিয়ে ঘুমোচ্ছেন উনি।যেনো কিছুই হয়নি সে হাতে!
এ ঘরে কি ফার্স্ট এইড বক্স থাকবে?সম্ভবনা কতোটুকো?তবুও কাটা পা চেপে ধরে খোড়াতে খোড়াতে খুজতে লাগলাম।সৌভাগ্যবশত পেয়েও গেলাম।ওটা হাতে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম।এবার কথা হলো ওষুধ লাগাবো কি করে?যদি জেগে যায়?তাহলে তো আবার চেচামেচি করবে।তাই বলে কাটা হাত নিয়েই থাকবে?নাহ্,যা হয় হবে।আগে ওষুধ তো লাগাই।যেমন ভাবা,তেমন কাজ।টেনেটুনে হাত বের করলাম তার।রাতের ব্যবধানে রক্তপড়াটা না থাকলেও খুব বাজেভাবে জখম হয়ে আছে হাতটা।ওষুধ লাগাতেই শুদ্ধ ভাইয়া বড়বড় করে চোখ মেলে তাকালেন।লাফিয়ে নেমে গিয়ে বললাম,
-আ্ আমি কিছু করি নি।
উনি কিছু না বলে আমার দিকেই পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরলেন আবারো।ঘুমের মধ্যেই আছে নাকি?পরখ করতে হাতটা এগিয়ে ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজটা বেধে দিলাম।ওঠেন নি উনি।এতোবড় অপারেশন সাকসেসফুল করায় গর্ব হলো নিজের উপর।তারপর কাচের টুকরোসহ,মেঝেতে পরে থাকা সব ফুল জরো করে যতোদুর সম্ভব গুছিয়ে নিলাম ঘরটাকে।এবার শ্বাস নেওয়া যাবে এঘরে।সোফায় বসে পায়ের যেখানে কাচ ফুটেছে সবে হাত লাগিয়েছি সাথেসাথে দরজায় নক করলো কেউ।চেচিয়ে বললো,
-ইনসিয়া ভাবি,দরজা খোলো।ফুপি ডাকছে তোমাকে।নিচে এসো।আমি চললাম।
মাহি এতোজোড়ে দরজা ধাক্কিয়েছে আর চেচিয়েছে যে শুদ্ধ ভাইয়া চমকে উঠে বসে পরেছেন।আমি দম মেরে বসে আছি।এই লোকটা এখন তার হাতের ব্যান্ডেজ দেখবে আর আমাকে ঝাড়বে।শুদ্ধ ভাইয়া সারাঘরে একবার চোখ বুলিয়ে দৌড়ে উঠে এসে আমার পায়ের কাছে হাটুগেরে বসে গেলেন।ওনার হাটুর উপর আমার পা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বললেন,
-রক্ত কেনো?কি হয়েছে?
চুপ করে ওনার চিন্তাটা দেখে চলেছি।আমাকে নিয়ে এভাবে টেন্সড্ উনি?দুফোটা রক্ত দেখে কেমন করছেন!
-কথা বলছিস না কেনো?কি বাধিয়েছিস আবার?
-ও্ ও ক্ কিছু না।আসলে…
-ঠাটিয়ে এক চড় মারলে সব আসলে বেরিয়ে যাবে তোর!নিজের ক্ষতি করতে যাচ্ছিলিস তুই?
উনি পাশে রাখা ফার্স্ট এইড বক্স হাতে নিয়ে ওষুধ লাগাতে লাগলেন আমার পায়ে।এতোটুকো ছড়ে গেছে।না ব্যথা আছে,না খুব বেশি রক্ত পরছে।এতোটা সময়ের ব্যবধানে শুকিয়েও গেছে কিছুটা।সেই কাটা জায়গা দেখে এভাবে রিয়্যাক্ট কেনো করছেন উনি?
ওষুধ লাগানো শেষে পায়ে ফু দিয়ে সেখানটায় সেলোটেপ লাগিয়ে দিলেন উনি।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি তার দিকে।বাইরে থেকে আবারো আওয়াজ এলো,
-ইনসিয়া ভাবি!নিচে এসো।নাকি দেরি হবে আরো?
ধ্যান ভেঙে বাস্তবে ফিরলাম।পা টা যে কোথায় সে হুশ আসতেই তা সরিয়ে নিতে উদ্যত হলাম।শুদ্ধ ভাইয়া আরো শক্তিতে পা ধরে রাখতে যাচ্ছিলেন আমার পা।কিন্তু ব্যথায় কুকড়ে উঠলেন।হয়তো হাতের ব্যান্ডেজে টান পরেছে।আমাকে নিয়ে এতোটা ব্যস্ত ছিলেন উনি নিজের হাতটাও খেয়াল করেননি এতোক্ষন।সেটা দেখেই কটমটে চোখে তাকালেন আমার দিকে।গলা উচিয়ে বললেন,
-মাহি তুই যা।নিচে গিয়ে বল তোর ইনসিয়া ভাবির দেরি হবে।
ওপাশ থেকে আর কোনো আওয়াজ এলো না।মানে মাহি চলে গেছে।নিচে গিয়ে কি সত্যি এটাই বলবে ও?কি ভাববে সবাই?দরজা থেকে চোখ সরিয়ে শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই মনে পরলো মাহিকে কেনো চলে যেতে বললেন উনি।এবার শুরু হলো আরেক ভয়।দাতে দাত চেপে উনি বললেন,
-তোকে বলেছিলাম কেয়ার দেখাবি না আমাকে!
-আ্ আমি তো…
-ভুল করবি আর তোতলাবি।
কথাটা বলে উনি হাতের ব্যান্ডেজ খুলতে যাচ্ছিলেন।ব্যস্ত হয়ে বললাম,
-খুলবেন না প্লিজ!রক্ত…
শুদ্ধ ভাইয়া ভ্রুকুচকে তাকালেন আমার দিকে।রাগের সুরেই বললেন,
-বলেছি আমাকে নিয়ে না ভাবতে।
উনি আবারো ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলেন।বিরবির করে বললাম,
-আমিও সেলোটেপ খুলে ফেলবো।
-কি বললি তুই?
-সেলোটেপ খুলে ফেলবো।
-একটু বেশিই কথা বলছিস মনে হচ্ছে?
-আপনার মনে কি হয় তা আমি কি করে বলবো?
সেন্টার টেবিলে হাতের পাশে থাকা টিস্যুবক্সটা কনুই দিয়ে রাগে ঠেলে সরিয়দ দিলেন।আমার পা আস্তে নামিয়ে শুদ্ধ ভাইয়া উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।বসে থেকেই জোরে আওয়াজ করে বললাম,
-ভেজাবেন না বামহাত।
কোনো উত্তর আসেনি।একটা শ্বাস ফেলে দরজা খুলে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসলাম।নিচে এসে দেখি সেজোমা হুইলচেয়ারে বসে সোফায় বসা দুজন মহিলার সাথে কথা বলছেন।কাজিনগুলো ডাইনিং টেবিলে বসে টুকটাক কথা বলছে।আমাকে আসতে দেখেই মাহি বললো,
-এইতো ইনসিয়া ভাবি এসে গেছে।
সবার দৃষ্টি আমার দিকে।চোখ নামিয়ে এগিয়ে গেলাম সেজোমার দিকে।সেজোমা বললো,
-ইনসু,কোনো সমস্যা হচ্ছে তোর মা?
ঘাড় নাড়িয়ে না বোঝালাম।সেজোকাকু পাশে বসেই চা খাচ্ছিলেন।বললেন,
-শুদ্ধ কোথায়?
-রুমেই আছেন।
মাহি আর তাপসি আপু এগিয়ে আসলো।মাহি বললো,
-চলো ইনসিয়া ভাবি,খাবে চলো।
-বাকি সবাই?
-সবাই খেয়ে নিয়েছে।
আড়চোখে উপরে তাকিয়ে বললাম,
-সবাই?
তাপসি আপু বুকে হাত গুজে বললো,
-সবাই বলতে কাকে বোঝাচ্ছো বলোতো ইনসিয়া?
-কাকে আবার?অবশ্যই শু…
-মাহি,আসছি আমি।ফিরতে লেইট হবে।
মাহির কথা শেষের আগেই শুদ্ধ ভাইয়া সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে কথাগুলো বললেন।এই গরমে ওভাবে জ্যাকেট পরে বেরোচ্ছেন কেনো উনি?মানুষটা ভীনগ্রহের প্রাণী হবে হয়তো।উপস্থিত সবাই কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।শুদ্ধ বেরোনোর সময় কাউকে বলে বেরোয় না।আজকে বলছে তবে?তাপসি আপু বললো,
-মাহিকে কেনো বলছিস শুদ্ধ?বউ আছে এখন তোর,তাকে বলে যা।
শুদ্ধ ভাইয়া একনজর তাকালেন আমার দিকে।সেজোকাকু বললেন,
-কোথায় যাচ্ছো তুমি শুদ্ধ?
-তার কৈফিয়ত কি এই তিনবছরে দিয়েছি আপনাকে মিস্টার আজাদ?
নিজের বাবাকে নাম ধরে সম্মোধন করতে এতোটুকো গলা কাপলো না লোকটার?কেনো?আমার আব্বুও তো আমার উপর এতোবড় একটা জিনিস চাপিয়ে দিলো।অভিমানে হয়তো ও বাসায় যাবো না আমি,কিন্তু তা বলে তার প্রতি ভালোবাসাটা তো কমেনি এতোটুকো।উল্টো তাদের ছেড়ে দুরে আছি ভাবতেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।সেজোকাকু বললেন,
-সময়টা বদলেছে শুদ্ধ।
-সাথে আপনার প্রতি আমার ধারনাও।ঠকিয়েছেন আপনি আমাকে।
বাবা ছেলের কোনো কথাই বুঝলাম না আমি।সেজোকাকু বললেন,
-আমাকে না বললে,একজন মানুষের দায়িত্ব এখন তোমার।তার কথা ভুলে যেও না অন্তত!
উনি নিজের মতো হাটা লাগালেন।সেজোমা বললো,
-খেয়ে যা শুদ্ধ।
-খিদে নেই।
দরজা খুলে বেরিয়েই যাবে তখনই মাহি পেছন থেকে বললো,
-ইনসিয়া ভাবি,ভেবে দেখো,কতোদিন এভাবে না খেয়ে থাকবে তুমি?
মাহির কথায় ওর দিকে অবাক চোখে তাকালেও শুদ্ধ ভাইয়ার চোয়াল শক্ত করে রাখা চেহারা চোখ এড়ায়নি আমার।লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে বললেন,
-ব্রেকফাস্ট করিস নি তুই এখনো?
চারপাশে চোখ বুলিয়ে সবার ঠোট টিপে নিশব্দে হাসা দেখলাম।এই মানুষটা নিজের বাবা মার সাথে ওমন ব্যবহার করে আমার সাথে ওভাবে কথা বলছে।যে আমাকে আগেই বলে দিয়েছে দুরে থাকবি।চায়নি বিয়েটা হোক।বহুরুপী নাকি লোকটা?
-কি হলো?বল?খাস নি কিছু তুই?
মাথা ডানেবামে নাড়লাম।পাশের এক মহিলা হেসে হেসেই বললেন,
-বাব্বাহ,শুদ্ধ?এতো দেখছি প্রথম দিনেই মায়ের চেয়ে বউয়ের প্রতি টান বেশি তোর!জাদু জানে নাকি ইনসিয়া?
শুদ্ধ ভাইয়া হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছেন।ওনার কথায় হয়তো জবাব দিবেন উনি।কিন্তু কি জবাব দেবেন?কি জবাব আছে ওনার কাছে?বাকিরা সবাই বেশ থমথমে হয়ে আছে দেখলাম।মাহি বললো,
-জানে তো আম্মু,কাল দেখলে না?চুপ থেকেও তোমাদের যোগ্য জবাব দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিলো ইনসিয়া ভাবি।
-সিয়া ওঠ!
সিয়া নামটা শুনে আতকে উঠলাম।এটা কি আমার জন্য ছিলো?সন্দিহান চোখে শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকালে উনি আবারো বললেন,
-এখান থেকে ওঠ সিয়া!
আমি দাড়িয়ে গেলাম।উনি আমার হাত টানতে টানতে ডাইনিংয়ে বসিয়ে দিলেন আমাকে।ওখানে তিনচারজন বসে যারা ছিলো তারা আড্ডা ছেড়ে আমার দিকে তাকালো।আমাকে বসিয়ে শুদ্ধ ভাইয়া হাক ছাড়লেন,
-আসমা খালা?অল্প ঝালে কিছু বানিয়ে আনো।
বরাবরই ঝাল কম খাই আমি।তবে সেটা তো শুদ্ধ ভাইয়ার জানার কথা না।কার জন্য খাবার আনতে বললেন উনি তবে?এক মধ্যবয়স্কা মহিলা এসে প্লেটে খাবার দিয়ে গেলেন।উনি প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-শেষ কর।
বিস্ময়ের সীমা পার করে বারবার নতুন সীমা আকছি আমি।আর প্রতিবার উনি সে সীমাটাও পার করতে বাধ্য করছেন আমাকে।ধমকে বললেন,
-খাবারটা খেয়ে নে সিয়া!
-আ্ আপনি?
-বলেছি না?পতীব্রতা হতে হবে না তোকে,কানে যায়না?নাকি মাথায় ঢোকে না?
মুখ ছোট করে খাবার প্লেটের দিকে তাকালাম।শুদ্ধ ভাইয়া তার দিকে প্লেটটা টেনে ভাত মাখিয়ে আমার মুখের সামনে লোকমা উঠিয়ে বললেন,
-হা কর!
আমি বাসার সবার দিকে তাকালাম।সবার দৃষ্টি আমার দিকেই স্থির।সেজোমা মাথা নেড়ে খেয়ে নিতে ইশারা করলো আমাকে।মুখে নিলাম খাবার।মাহি উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
-ইনসিয়া ভাবি,যীনাত আপু আসছে আজই।আর তোমাদের বৌভাতের রিসেপশন…
খাবার চিবানো থেমে গেলো আমার।শুদ্ধ ভাইয়া তীক্ষ্মচোখে তাকালেন মাহির দিকে।ও চুপ মেরে গেলো তখন তখনই।উনি পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-ওষুধ খেয়ে নিস সিয়া।
তাপসি আপু বললো,
-ওমা?ওষুধ কেনো?কি হয়েছে তোমার ইনসিয়া?
-ও্ কিছু না আপু।
-পায়ে কাচ বিধেছিলো।
শুদ্ধ ভাইয়ার কথায় সেজোমা এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
-কিভাবে?কিসের কাচ?
-এমা,শুদ্ধ ভাইয়া?তোমার বা হাতে ব্যান্ডেজ কেনো?
মাহির কথায় কিছু না বলে শুদ্ধ ভাইয়া সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলেন।বললেন,
-মাহি,সিয়াকে পেইনকিলার দিয়ে দিস।সেলোটেপটা যেনো না খোলে ও।বাসায় কেউ আসলে বলিস আমি সন্ধ্যায় ফিরবো,তখন দেখা করতে।
কথা শেষ করে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন উনি।এটুকো কাটাতে পেইনকিলার খেতে হয় তা কোনো চিকিৎসাশাস্ত্রে আছে বলে আমার তো মনে হয় না।সেজোমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দেখলাম।শান্তির।একই অবস্থা সেজোকাকু সহ বাকি সবার চেহারার।সেজোমা বললো,
-শুদ্ধর হাতে তুই ব্যান্ডেজ করেছিস?
মাথা উপরে নিচে নাড়ালাম।তার মুখের হাসি আরো প্রসারিত হলো।কারন বোধগম্য হলো না আমার।চুপচাপ খাবার শেষ করে ভাইবোনগুলোর আড্ডার দিকে কর্নপাত করলাম।ছেলে কখন ফিরবে সে হদিস পেয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন মিসেস আজাদ।হুইলচেয়ার ঠেলে স্বামীর মুখে একই হাসি দেখে চোখ বেয়ে সবার অগোচরে দু ফোটা সুখের বর্ষন বেরিয়েই এলো।
—————-?
হসপিটালের কেবিনের সাদা পর্দার পেছনে জানালায় সকালের বাকা রোদ পরেছে।সেদিকেই একধ্যানে তাকিয়ে বেডে শুয়ে আছে মুনিয়া।আয়ান ওর হাত মুঠো করে পাশে বসে আছে।কিছুক্ষন আগে এসে নার্স একবার শাষিয়ে গেছে ওকে।যেনো মুনিয়াকে কোনো বিষয় নিয়ে এতোটুকো উত্তেজিত না করে আয়ান।মুনিয়ার চোখ স্থির।আয়ান বললো,
-মুন?খাবি না?
মুনিয়া চুপ।খাওয়া বা কথা বলার ইচ্ছে নেই ওর।ইচ্ছে থাকলেও কথা বলতে পারবে না ও।তিনবছর আগে সেই ভয়ানক রাতে ওই মানুষরুপী পশুগুলো ওর সম্মানের সাথে সাথে কথা বলার শক্তিও নিয়ে গেছে।তিন তিনটে বছর নিজের বাসা ছেড়ে,মা ভাইকে ছেড়ে পরে আছে এই হসপিটালের চার দেওয়ালে।আয়ান স্বেচ্ছায় রেখেছে ওকে এভাবে।বোনের হাত ছেড়ে গালে একহাত রেখে বললো,
-মুন?মা নিজে হাতে তোর জন্য পাটিসাপটা বানিয়েছে।খেয়ে নে বোন।
মুনিয়ার চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পরতে লাগলো।মায়ের হাতের রান্না তো কতোই খেলো,কিন্তু মায়ের হাতে শেষ কবে খেয়েছে মনে নেই ওর।আয়ান কখনো আনেনি ওর মাকে এই হসপিটালে।মায়ের মন।দুর্বল হয়ে গেলে বারবার আসতে চাইবে,হয়তো লুকিয়ে লুকিয়েও আসবে।যদি কারো চোখে পরে?এজন্যই মাকেও আনেনি ও এখানে।মুনিয়ার চোখের পানি আয়ানের মনের আগুনকে জ্বালিয়ে দিলো আবারো।হাত দিয়ে চোখজোড়া মুছে দিয়ে বললো,
-শুদ্ধকে ছাড়িনি আমি মুন।কোনোদিন ক্ষমা করবো না ওকে আমি।ইনসিয়াকেও কেড়ে নেবো ওর কাছ থেকে আমি।আপনজন হারানোর ষন্ত্রনায় দিশেহারা করে দেবো ওকে।আজ যাবো আমি আজাদ ম্যানশনে।শুদ্ধের বিবাহিত জীবনের জন্য নতুন উপহার নিয়ে।যে উপহারের বদৌলতে ইনসিয়াকে হারাতে শুরু করবে ও।মজার বিষয় কি জানিস তো মুন?এই উপহার শুদ্ধ নিজে হাতে সাজিয়েছে।কিন্তু সেটা গুটি হিসেবে আমি ব্যবহার করবো।আমি!
মুনিয়া ছটফট করতে লাগলো।যেনো ওর বিছানায় কেউ জ্বলন্ত কয়লা ফেলে গেছে।আয়ান উঠে দাড়িয়ে মুনকে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে শান্ত হতে বলছে।এক নার্স কোলাহল শুনে দৌড়ে ভেতরে এসে আবারো ছুটে চলে গেলো।দুজন ওয়ার্ড বয় এসে একপ্রকার ধাক্কিয়ে,জাপটে ধরে আয়ানকে রুম থেকে বের করে নিয়ে গেলো।নার্সটা কেবিনের দরজা লাগিয়ে দিলো সাথে সাথে।আয়ান দরজার কাচের অংশটুকো দিয়ে বোনের অস্থির দেহে জোর করে নার্সকে ইনজেকশন পুশ করতে দেখলো।মুহুর্তেই শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো মুনিয়া।আর শুদ্ধের প্রতি তীব্র ঘৃনায় হাত মুঠো হয়ে আসলো আয়ানের।ভেতরে জ্বলতে থাকা লেলিহান আগুন যেনো বেরিয়ে এসে ঝলসে দেবে সবটা।সে আগুনের শিখা যেনো বলে চলেছে,
‘ তোকে শাস্তি পেতেই হবে শুদ্ধ।আমি দেবো তোকে শাস্তি।আমার আদালতে তোর সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার রায় হয়ে গেছে।বাবা মা তো ছেড়েই দিয়েছিস।যদি ভুলেও ভেবে থাকিস ইনসিয়াকে আকড়ে ধরে বাচবি,সেটাও ভুল প্রমান করে দেবো আমি।এই আয়ানের যেমন ইনসিয়াকে চাই,তেমন তোকে তোর প্রাপ্য সাজা দেওয়াও চাই।কোনোভাবেই তোর নিস্তার নেই শুদ্ধ।কোনোটাতেই তোকে ছাড় দেবো না আমি! ‘
#চলবে…
লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা