তোর নামের রোদ্দুর, পর্বঃ২৭

0
1879

#তোর_নামের_রোদ্দুর
পর্বঃ২৭

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

রুমের লাইট অফ।কিন্তু আলোর অভাব নেই কোনো।নানা রঙের ছোটছোট মোমের আলোতে পুরো ঘর আলোকিত।ল্যাম্পশেডের টিমটিমে আলোটাও আছে।মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি আর লাভ শেইপের বেলুন ছড়ানো।সেন্টার টেবিলটার মাঝে একমুঠো লাল গোলাপ রাখা।ওটার সাথেই একটা নীল রঙের গিটার হেলান দিয়ে দাড় করানো।হয়তো এভাবে বিয়ের দিনটাতেও এ ঘর সাজানো হয়নি।হয়নি?নাকি চোখেই ধরে নি আমার?জীবনে কোনোদিন কোনো রুম এমন চোখ ধাধানো সাজানো দেখেছি?মনে পরে না তো!

দরজা লাগানোর শব্দে চমকে উঠে পিছন ফিরলাম।সাদা শার্টের উপর গাঢ় নীল ব্লেজার,কালো প্যান্ট পরে দরজার পাশের দেয়ালে একপা ঠেস দিয়ে ঠোটে একটু হাসি নিয়ে শুদ্ধ দাড়িয়ে আছেন।শার্টটার হাতা গুটানো।হাতে সাদা ঘড়ি।বরাবরের তার খোচাখোচা দাড়িগুলো নজর কাড়ে আমার।কপালের সিল্কি চুলগুলো কোথাকার কোন বাতাসে মৃদ্যু বাতাসে নড়ছে।মোমের আলোতে ওই চেহারার মোহনীয়তা যেনো কোটিগুনে বেড়ে গেছে।

কিছুক্ষন আটকে দাড়িয়ে ছিলাম।শুদ্ধ সোজা হয়ে দাড়ালেন।শিউরে উঠে পিছন ফিরলাম।ব্যালকনির থাই গ্লাস কিঞ্চিত খোলা।তার পাশের সাদা আর নীল রঙা পর্দাগুলো উরছে।ওটুকো ফাক দিয়েই ঠান্ডা বাতাস আসছে।রুম থেকে বাইরে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোর ঝলকানি চোখে পরলো।বৃষ্টি?বৃষ্টি হবে আজও?

হঠাৎই ডানহাতে আলতো স্পর্শ।
এই স্পর্শ চিরচেনা আমার।শুদ্ধ তার দিকে ঘুরালেন আমাকে।এতোক্ষন চোখ মেলে সবটা দেখলেও আর পারছি না তাকিয়ে থাকতে।চোখ নামিয়ে নিলাম।আজ লজ্জার রঙ বুঝি নীল।আড়চোখে পাশে তাকালাম।নীল গিটার।চোখ সরিয়ে অন্যপাশে তাকালাম।নীল পর্দা।মেঝের দিকে তাকালাম।ছড়িয়ে থাকা নীল গাউন।আর কোথায় যাবো আমি?কোথায় আটকাবো এই চোখ?খিচে বন্ধ করে নেওয়াই একমাত্র উপায়।করলামও তাই।কিন্তু দুমিনিট আগে দেখা পৃথিরবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটার মুখোচ্ছবিই চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবারো।শুদ্ধ।গায়ে সেই নীল রঙেরই ব্লেজার।চোখ খুললাম না।শুদ্ধ সে হাত বুকে ধরলেন তার।ধীর আওয়াজে বললেন,

-আজও শ্যামাপাখির বর্ননা দেবো আমি।শুনবি না তুই সিয়া?

মনে হচ্ছিলো শুধুমাত্র তা শোনার জন্যই জীবন আমার।জীবনের সমস্ত সার্থকতা তাতেই।এজন্যই আয়নায় দেখিনি নিজেকে।চোখ না খুলেই মাথা নাড়লাম।শুদ্ধ তার আরেকহাতে আমার ঠোট স্পর্শ করলেন।ভেতরটা ধক করে উঠলো‌ যেনো।উনি ঠোটে লেগে থাকা লিপস্টিক মুছিয়ে দিলেন অতি সন্তর্পনে।এবার অন্যহাত ধরলেন উনি।কেপে উঠলাম।সে হাতেই যে জড়ানো ওড়না মুঠো করে ধরে রেখেছি আমি।ভেবেছিলাম লজ্জায় এই শক্ত মুঠো খুলতে পারবো না আমি আজ নিজেও।কিন্তু শুদ্ধর ছোয়া পেতেই আলগা হয়ে আসলো হাত।দ্রুত পিছন ফিরলাম।আত্মসুপ্তির বৃথা চেষ্টা।

শুদ্ধর স্পর্শ নেই শরীরে আমার।উল্টোদিক ফিরে চোখ মেলেছি।একটু পরেই পিঠ ঠেকে গেলো শুদ্ধের বুকে।এগিয়েছেন উনি।মাথায় হাত দিয়ে খুলে দিলেন উচুতে করা খোপাটা।ঈষৎ কোকড়ানো কোমড় অবদি চুলগুলোর কয়েকটা সামনে এসে পরতেই মনে পরলো,সে তো তার শ্যামাপাখিকে খোলা চুলেই বেশি ভালোবাসে।শুদ্ধ আমাকে না ধরে পিছন থেকেই চুলে নাক ডুবিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন,

-শ্যামাপাখি জানিস?আজকের এই মুহুর্তগুলো আমার কাছে কি?আজকে তুই আমার কাছে কি?ঠিক উনত্রিশ ঘন্টা আগে কাল যখন তুই আমাকে ভালোবাসি বলেছিস,মনটা আরো বেশি উতলা হয়ে উঠেছে।আরো বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তোকে কাছে পাওয়ার জন্য।সত্যি বলতে এই জামা,সাজ কোনোটাই তোর সৌন্দর্যকে এতোটুকো বাড়ায় নি।তুই তো বরাবরই অপরুপা।তোকে উপস্থাপন করতে তুই নিজেই যথেষ্ট।এগুলো তো উপলক্ষ্য মাত্র।এগুলো যদি কিছু বাড়িয়েই থাকে,তবে সেটা আমার তৃষ্ণা।এতোগুলো বছরের।আজ নিজেকে আটকানো বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে সিয়া।বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে!এই চারপাশে তাকিয়ে দেখ!সবটা যেনো চেচিয়ে বলছে,আজ শুদ্ধর সিয়া শুধুই শুদ্ধর।শুদ্ধর শ্যামাপাখি,আজ শুধুই ওর!

এক নতুন অনুভুতি আবিস্কার করলাম।লজ্জা,ভয়,শিহরনের সংমিশ্রন।ছুটে এসে ব্যালকনির কাচ ঘেষে দাড়ালাম।তাকাতে পারবো না তারদিক।বাইরে ঢল নেমেছে।বৃষ্টি শুরু হয়েছে প্রচন্ড।এই বৃষ্টি?তোর ঢলের সাথে এই লজ্জাকেও নিয়ে যা না!কিভাবে মানুষটার কাছে যাবো আমি?তার কথাতেই যে পাগলপ্রায় হয়ে যাই।কিছুটা সময় পরই গিটারের টুংটাং আওয়াজ।ওড়না আরো শক্ত করে ধরে পিছন ফিরলাম।শুদ্ধ গিটার হাতে নিয়ে দাড়িয়ে।স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে গাইতে লাগলেন,

“Tarpaye mujhe Teri sabhi baate
Ek baar ay dewaani
Jhutha hi sahi,payaar to kaar
Mein bhula nehi hasi mulakate
Bechain karke mujhko
Mujhse yu naa,phir najar
Ruthega,na mujhse
Mera sathiya ye wada kaar
Tere bina,mushkil hai
Jina mera mere dilbar

Zara Zara..
bahekta hai,bahekta hai
Aj tu mera,tan badan
Main payasa hu,
Mujhe bhar le apni baho mein,
Suun,mere sanam,Tujhko kasam
Duur kahi na ja
Ye duri, kehti hai
Paas mere aa ja re….

গান থামিয়ে শুদ্ধ গিটারটা পাশে নামালেন।একহাতে ধরে মেঝেতে ঠেকিয়ে রেখেছেন ওটা।কাতর স্বরে বললেন,

-আজ অন্তত তোর নামের রোদ্দুরে পুড়তে দিস না সিয়া আমাকে!

জাপটে ধরলাম তাকে।চেচানোপ্রায় আওয়াজে বললাম,

-পুড়তে দেবো না আপনাকে শুদ্ধ।আজ সত্যিই আপনার সিয়া শুধুই আপনার।শুধুই আপনার।

গিটার ছেড়ে শুদ্ধও দুহাতে জরিয়ে ধরলেন আমাকে।দুবার জোরে শ্বাস নিলেন উনি।আমাকে জরিয়ে রেখেই ব্যালকনির দিকে এগুলেন উনি।কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-দেখ সিয়া!বৃষ্টি!

-আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বর্ষন আমি কাল দেখে নিয়েছি শুদ্ধ।আর চাইনা।বিশ্বাস করুন।আর চাইনা আমার।

শুদ্ধ আমার থুতনি ধরে মাথা উচিয়ে বললেন,

-কিন্তু আমার তো চাই সিয়া।তোর নামের বর্ষন।

কথাটা বলে উনি আমাকে সামনে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলেন।তার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে গলার কাছে মাথাও ঠেকালাম।বৃষ্টির রিনরিন সুরে তাল মিলিয়ে গেয়ে উঠলাম,

“Yuhi baaras baaras Kali ghata baarse
Hum yaar bhig jaye
Iss chahat ki,baarish mei

Meri khuli khuli latoon ko suljha de
Tu apni ungli ose
Main to hu iss khoawahish mei
Saardi ki,raato mei
Hum soye raahe ek chadar mei
Hum doono,Tanha ho
Na koyi bhi raahe iss gharme

গানের কথার সাথে শুদ্ধ তার আঙুলে চুল পেচিয়েছেন আমার।আমার গায়ের ওড়না মুঠো থেকে ছাড়িয়ে দুজনকেই জরিয়ে নিয়েছেন।দ্রুতচলা শ্বাসপ্রশ্বাস যেনো তার বক্ষপিন্জরে খুসে দিচ্ছি।আজ আর নিজের না,শুদ্ধের হৃদপিন্ডের ধুকধুক শব্দ কানে বাজছে আমার।শুদ্ধ বললেন,

-আমি জানি,তুই ভালোবাসিস আমাকে।তুই চাস আমি কাছে আসি তোর।তবুও!আমি পরিস্কারভাবে জানতে চাই সিয়া।তোকে নিজের করতে চাই আমি আজ।মে আই?

বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তার দিকে।কিসের তৈরী এই মানুষটা?এতোকিছুর পরেও উনি এভাবে বলছেন?যে সময়টার জন্য এতোগুলো বছর অপেক্ষা করেছেন,কোনোদিন জোর খাটান নি,আমার পরোক্ষ সম্মতি জেনেও এখনও অনুমতি নামক বস্তুতে আটকে আছেন?এমনও মানুষ হয়?গোড়ালি তুলে পায়ের আঙুলে ভর করে উচু হয়ে দাড়ালাম।একহাতের কনুই শুদ্ধর কাধে ঠেকিয়ে আরেকহাতে চুল মুঠো করে নিলাম তার।শুদ্ধ সে হাতের দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকে তাকালেন আমার দিকে।কোনোরুপ তোয়াক্কা না করে চোখ বন্ধ করে ছুইয়ে দিয়েছিলাম তার ঠোট।ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তার সেই ছ সেকেন্ড।আস্তেধীরে‌ নেমে গিয়ে আবারো তার বুকে মুখ লুকালাম।

দম মেরে দাড়িয়ে ছিলেন শুদ্ধ।হয়তো এভাবে উত্তরটা আশা করেননি।ওড়না ছেড়ে দিলেন উনি।ঠান্ডা বাতাস উন্মুক্ত ঘাড় ছুইয়ে দিতেই কেপে উঠলাম।চুলগুলো একপাশে দিয়ে আমার গলায় ঠোট ছোয়ালেন শুদ্ধ।আরো জোরে শ্বাস নিয়ে খামচে ধরলাম তার ব্লেজার।

-ভালোবাসি সিয়া।

প্রশান্তিময় কন্ঠ আর উষ্ণ নিশ্বাস।কিন্তু কথাটার সাথে ফোনের ভাইব্রেশনও কানে ভেসে আসলো।তিক্ত চোখে দেখলাম বেড সাইড টেবিলে জ্বলছে ফোন।শুদ্ধের ফোন ওটা।এতো রাতে এই বৃষ্টিতে কে ফোন করবে?কোনো বিপদ হয় নি তো কারো?শুদ্ধের বুকে মাথা রেখেই বললাম,

-শুদ্ধ?আপনার ফোন।

শুদ্ধ তার মাঝে নেই।নেশা জরানো কন্ঠেই বললেন,

-আজ না সিয়া।প্লিজ!আজ না!

শব্দহীন হেসে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম তাকে।শুদ্ধ কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলেন আমাকে।চোখ নিবদ্ধ রেখেছিলাম তার চোখে।হয়তো উত্তরের সাথে সাথে লজ্জাটাকেও বিলিয়ে দিয়েছিলাম।মনে হলো বৃষ্টির মৃদ্যু আওয়াজটা কানে কানে বলে গেলো,”আজ এই বর্ষন সার্থক,তোর নামের রোদ্দুরও সার্থক”।
কপালে ঠোট ছুইয়ে ল্যাম্পশেড অফ করতে যাচ্ছিলেন শুদ্ধ।কিন্তু জ্বলতে থাকা ফোনে চোখ পরতেই চেহারা বদলে গেলো তার।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here