তোর নামের রোদ্দুর
পর্বঃ৩০
লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
-পাঁচ পাঁচটা বছর ” ভালোবাসি ” শব্দটা শোনার জন্য পাগল হয়ে ছিলাম।আমার বলার দুদিন পরেই,কাঠফাটা রোদ্দুরের মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষনের মতো ভালোবাসি বলে,আমাকে কোনো অতল সমুদ্রে ভাসিয়ে আজ পাঁচ সেকেন্ডেই বলে দিলেন ভালোবাসি না?ঘৃনা করি?আপনার বলা সেই কথাগুলো তারমানে শুধু আবেগের বশে বলে ফেলা সাময়িক মোহ ছিলো।ঘোরে ছিলেন কোনো হয়তো বা।কোনোদিন আপনি আমাকে ভালোবাসেনই নি।তাইনা?মিস ইনসিয়া সারাহ্?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম শুদ্ধের দিকে।কি বলছেন উনি এসব?কি বলে ডাকছেন উনি আমাকে এগুলো?এই সম্বোধন?তীরের মতো বিধলো আমার গায়ে কথাটা।অশোকের বলা শেষে কতোক্ষন কেটে গেছে হিসাব নেই।তবে প্রতিটা মুহুর্তে নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে করেছে আমার।শুদ্ধর শান্ত নতমুখ আরো জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো ভেতরটাকে।কাধে হাত রেখে কাদছিলো মাহি।ওর হাতটা সরিয়ে হুহু করে কেদে একপা সামনে এগিয়ে বললাম,
-শুদ্ধ আমি…
শুদ্ধ আমাকে পাশ কাটিয়ে আয়ানের দিকে এগিয়ে গেলেন।আয়ানের চেহারায় অপরাধবোধ,সাথে একরাশ ক্ষোভ।শুদ্ধ শান্তভাবে বললেন,
-মুনিয়ার অপারেশন হয়েছে।ওকে বলেছিলাম সবটাই মিটে গেছে তোর আমার মধ্যে।ও জানে তুই অফিসিয়াল কাজে বাইরে ছিলি তাই দেখা করতে পারিস নি এ কয়দিন।এখন হয়তো অবশ্যই দেখতে চাইছে তোকে।আন্টিকে নিয়ে চলে যা!সজিব পৌছে দেবে তোদের।
-শুদ্ধ….
-কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
-কিন্তু আমার আছে!নিজের প্রতি আছে।না বুঝে এতোদিন যা করে এসেছি….
-ওসব থাক আয়ান।হসপিটাল চলে যা তোরা।
-কেনো থাকবে শুদ্ধ?সেই ছোটবেলায় আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকেই থেকে আমার কাজে তুই নিয়োজিত প্রায়।আমি তো চাইই নি তোর বন্ধুত্ব।বরং বিরক্ত লাগতো আমার।বাসায় যেতে চাইলেও নিয়ে যেতাম না তোকে।কলেজে,ভার্সিটিতে সবসময় আমার মন গুছিয়ে চলতি তুই।ভরনপোষনটাও করতিস বলে অসহ্য লাগতো তোকে।একসময় নিজেদের কোম্পানিতেই সোজা সিইও পদে জয়েন করিয়ে দিলি আমাকে।আজাদ গ্রুপ শুধু ফিন্যান্সিয়ালি সাপোর্ট করেনি আমাকে,তোর বাসার সবাইও ফ্যামিলি মেম্বার ভাবতো আমাকে।এখনো ভাবে।সেই আমিই তোর এতোবড় ক্ষতি করছি জেনেও আমাকে শাস্তি না দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছিস।মুনিয়ার অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছিস,ওর পাশে থেকে সুস্থ্য করেছিস ওকে,অপারেশন করিয়েছিস ওর।আমাদের জন্য নিজের জীবনকে কেনো এভাবে বিষিয়ে তুললি তুই?কেনো শুদ্ধ?কেনো?
শুদ্ধ তাচ্ছিল্যে হেসে বললেন,
-সবগুলো সম্পর্ককে সম্মান করার চেষ্টা করেছিলাম আয়ান।ভাবি নি এটুকো এফোর্ট এভাবে প্রতিদান হয়ে ফিরবে আমার জীবনে।আমি মানি,আন্টি আমার আমারো আম্মু,মুনিয়া আমারো বোন।আর বন্ধুত্বটা তোর কাছে না থাকলেও আমার কাছে ছিলো।আজীবন থাকবে।তুই না চাইলেও।
আয়ান জরিয়ে ধরলেন শুদ্ধকে।উনিও আলতোভাবে পিঠে হাত রাখলেন তার।মাহি এগিয়ে গিয়ে ফুপাতে ফুপাতে বললো,
-শুদ্ধ ভাইয়া।আমি….
-বাসায় নিশ্চয়ই বলে আসিস নি?
মাহি ঘাড় দুলিয়ে না বুঝালো।শুদ্ধ আবারো এগোলেন আমার দিকে।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-ঘটনাপ্রবাহ সবটাই আব্বু জানতো।তিনবছর আগেই ফাইলটা দেখেছিলো সে।সেও ভেবে নিয়েছিলো আমি এসব করেছি।অনেক কথা শুনিয়েছিলো সেদিন।একমাত্র ছেলে বলে বাসা থেকে তাড়াতে পারে নি শুধু।তখনই ভয় ঢুকে যায় আমার মাঝে।কোনো প্রমান ছিলো না আমার কাছে তখন।কি করেই বা থাকবে?মুনিয়ার খোজই পাইনি কোনোভাবে।এসব সবাই জানবে একদিন না একদিন।যারা ভালোবাসে,সবাই দুরে সরে যাবে আমার থেকে।এমনটা ভেবে গুটিয়ে নিতে থাকি নিজেকে।ভেবেছিলাম এসব সবার সামনে আসার আগেই আমি দুরে সরে যাবো।বাজেভাবে না চলেও দেখাতাম সবাইকে,বাবার টাকায় বিগড়ানো সন্তান আমি।যাতে কারো মানতে অসুবিধা না হয় আমি খারাপ ছেলে।
একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় থাকবো না আর।আয়ানের কথাতে আমারো মনে হয়েছিলো হয়তো দুরে গেলে ভুলে যাবে সবাই আমাকে।আমার না করা অপরাধকে।ঠিক সেদিনই ইরাম ফোন করে জানালো সারাদিন দরজা লক করে রেখেছিলো ওর বোন।পাগলপ্রায় হয়ে শেহনাজ মন্জিল ছুটে গিয়েছিলাম।ওখানে গিয়ে জানতে পারি যাকে ভালোবাসি, তার সাথেই বিয়ে ঠিক করেছে আব্বু।খুশি হওয়ার পরিবর্তে দুনিয়া উল্টে যায় আমার।এই এলোমেলো জীবনে জড়াতে চাইনি তাকে।বিয়েতে মত ছিলো না বলে আব্বুকে বলেছিলাম বিয়ে করবো না।কিন্তু সে হয়তো কোনোভাবে জানতো,এই মেয়েটার প্রতি তার ছেলের দুর্বলতা আছে।আব্বুর কথা ছিলো বিয়েটা না করলে আম্মুকে নাকি বাচানো যাবে না।ইনসুকে ছেলের বউ হিসেবে চাই তার।নইলে নাকি অপারেশনে মত দেবেন না উনি।
নিজের দুনিয়ায় এতোটাই হারানো অবস্থায় ছিলাম যে আম্মুর আদৌও কোনো অপারেশন ছিলো কিনা,কথাগুলো আম্মুর কিনা এসব জানার সুযোগটুকো হয়নি আমার। বাধ্য হই বিয়েতে কবুল বলতে।পরে জানতে পারি পুরোটাই মিথ্যে ছিলো।রাগটা সম্পুর্ন গিয়ে পরে তার উপর যাকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলাম।আমি চাইনি বিয়েটা হোক,কিন্তু তাকে তো মানা করেছিলাম বিয়েটা না করতে।সে পারেনি আটকাতে এই বিয়ে।কষ্টও কম দেইনি এজন্য বিয়ের পর।তাকে দেওয়া প্রতিটা কষ্টের চেয়ে হাজারগুন বেশি পুড়তে থাকা মন,দগ্ধ হৃদয়কে কিভাবে সামলেছিলাম তা আমি জানি।অবশেষে খোজ মিললো মুনিয়ার।সত্যটা সামনে আসলেও ঠকে গেলো আমার বন্ধুত্ব।আর হয়তো কোনোভাবে জিতে যাচ্ছিলো আমার পাঁচ বছরে কারো নামের রোদ্দুরে পুড়ে ঝলসে যাওয়া ভালোবাসা!
দম আটকে প্রতিটা কথা শুধু শুনছিলাম তার।এতোটা গভীর চিন্তা?তার দ্বারাই সম্ভব।বন্ধুত্ব,পরিবার সবটার কথা ভেবেছেন উনি।ভালোবাসার জন্য নিজের সর্বস্বটাকে কোনো দায়ে ফেলে রেখেছিলেন।নিজেকে এভাবে সরিয়ে নিয়েছিলেন সবার থেকে।কিন্তু এসবের কি খুব দরকার ছিলো?ছিলো।যদি আমি এতোগুলো কথা বলে দিতে পারি,সবাইও এভাবেই ভুল বুঝতো ওনাকে।
-শুনে নিয়েছেন সবটা মিস ইনসিয়া সারাহ্?আই হোপ আমার মতো নিকৃষ্ট,জঘন্য কারো সম্পর্কে আর এতোটুকো জানার কোনো আগ্রহ আপনার নেই রাইট?
-আ্ আমি…
উনি আবারো হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন আমাকে।জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললেন,
-ওয়েট মিস ইনসিয়া।নো নিড টু এক্সপ্লেইন ইউরসেল্ফ।এজ অলওয়েজ।আপনাকে বলেছিলাম সবটা বলবো আপনাকে।সো আপনার মনে থাকা বাকি কেনোগুলোরও উত্তর দিয়ে দিলাম আপনাকে আমি আজ।
আর সহ্য হলো না তার ওই সম্বোধন।চেচিয়ে বললাম,
-চাইনা কোনো উত্তর।নেই কোনো প্রশ্ন আমার।কোনো কেনো নেই।ছিলো না কোনোদিন।আজ যে ভ্…
-ছিলো।কেনোটাই ছিলো।আমার তরফ থেকেও ছিলো কিছু।কেনো আমার জীবনটা হুট করে আপনিময় হয়ে গেলো?কেনো এই পুড়তে থাকা,দগ্ধ হওয়া হৃদয় জুড়ে হঠাৎই প্রেমের বর্ষন?কেনো এতোটা সুখ এসেছিলো আমার মতো কারো জীবনে?আজও আছে।কেনো ভালোবেসেছিলাম আপনাকে?কেনো আমি নিজের জীবনটা কেমন তা জেনেও পাঁচ পাঁচটা বছর পুড়েছি শুধু আপনার কাছ থেকে এই ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্যে?কেনো আপনার মতো কাউকে নিজের এই নিকৃষ্ট জীবন থেকে সরাতে পারি নি?কেনো সেদিন সন্ধ্যায় মাঠের খোলা প্রান্তের সূর্যাস্তকে সাক্ষী রেখে ভালোবাসার সবটা স্বীকার করেছিলাম আপনার সামনে?কেনোই বা আপনি কিছু মুহুর্তের আবেগকে আকড়ে ধরে সে সন্ধ্যার বৃষ্টিতে প্রেম ঝড়িয়েছিলেন?ভালোবাসি বলেছিলেন আমাকে?কেনো?
-শুদ্ধ প্লিজ….
-মিথ্যেটা বিশ্বাস করে যদি ভালোবাসি না বলতে পারেন,ঘৃনা করেন এটা বলতে পারেন,তবে আজ সত্যিটা জেনে নিন।আমি চাইনা আমার জীবনে আপনাকে।চলে যান আমার জীবন থেকে।শুদ্ধর কাউকে লাগবে না।শুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।শেষ হয়ে গেছে শুদ্ধ!
কথাটা বলে পিছন ফিরলেন উনি।জাপটে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে বললাম,
-প্লিজ শুদ্ধ।এভাবে বলবেন না।ক্ষমা করে দিন আমাকে।কোনো সত্যি জানতে চাই না আমি।প্লিজ শুদ্ধ!প্লিজ আমাকে….
উনি একটানে ছাড়িয়ে সরিয়ে দিলেন আমাকে।জোর করে হেসে বললেন,
-ক্ষমা?কিসের ক্ষমা?কি বিষয়ে ক্ষমা?আপনাকে ক্ষমা করার আমি কে?কেউ নই তো আপনাকে ক্ষমা করার আমি।দুমিনিট আগে আপনিই তো বললেন কতোকিছুর অযোগ্য আমি।তবে এখন কেনো মনে হচ্ছে আপনাকে ক্ষমা করার মতো মহৎ যোগ্যতা সম্পন্ন আমি?এটা কেমন কথা মিস ইনসিয়া?
-কে ইনসিয়া সারাহ্?কেউ নেই ও নামে।যদি কেউ থেকে থাকে সেটা মিসেস ইরহাম আজাদ শুদ্ধ।আপনার বউ।আপনার সিয়া।আপনার শ্যামাপাখি শুদ্ধ!প্লিজ আমাকে….
-হাহ্!হাসালেন।জেনে রাখুন,আপনি এখন থেকে ইনসিয়া সারাহ্ ই।আমার কাছে এই মুহুর্ত থেকেই।আর অফিসিয়ালিও যেনো তাই হয় তার ব্যবস্থাও খুব দ্রুত করবো আমি।সাথে এটাও জেনে রাখুন,শুদ্ধ মরে গেছে।মরে গেছে শুদ্ধ!অশোক?উনি যেনো না আসেন আমার পিছনে!এখনও অবদি আজাদ ম্যানশনের আমানত উনি।পৌছে দিয়ে আসো ওনাদের।
শুদ্ধ বেরিয়ে গেলেন।দৌড়ে যাচ্ছিলাম তার পিছন পিছন।অশোক আটকে দিলেন আমাকে।শুদ্ধর পেছনে আয়ানও ছুটেছেন।অশোক হাত ধরে রেখেছেন আমার।আমি চেচাচ্ছি,কাদছি চিৎকার করে,কিন্তু শুদ্ধ একটাবারও ফিরে তাকাননি।মাহি এসে দুকাধে হাত রেখে কাদতে লাগলো।এতোটা পাথর হয়ে গেছেন উনি?আমার কান্নাও সয়ে যাচ্ছে ওনার?কোথায় যাচ্ছেন উনি?আমার থেকে দুরে?আরো জোরে চেচিয়ে বললাম,
-শুদ্ধ?আপনার সিয়া কাদছে।আপনার শ্যামাপাখি কষ্ট পাচ্ছে।কোথায় যাচ্ছেন আপনি?আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন?আমি কি নিয়ে বাচবো শুদ্ধ?প্লিজ যাবেন না!আপনার সিয়া মরে যাবে!মরে যাবো আমি শুদ্ধ!মরে যাবো!প্লিজ ফিরে আসুন!ভালোবাসুন আপনার সিয়াকে!প্লিজ যাবেন না আপনার শ্যামাপাখিকে ছেড়ে!প্লিজ যাবেন না শুদ্ধ!প্লিজ থেমে যান!প্লিজ ফিরে আসুন!ফিরে আসুন শুদ্ধ!প্লিজ!
#চলবে…