তোর নামের রোদ্দুর, পর্বঃ৪

0
1641

নিজেকে যতোটা সম্ভব শক্ত রাখার চেষ্টায় আছি।সামনের মানুষটাকে ফিরিয়ে দেওয়া কোনো এক সময় অসম্ভব ভাবতাম আমি।কিন্তু আজ তাকে ফিরিয়ে দেবো।হ্যাঁ।ফিরিয়ে দেবো।কাছে আসতে দেবো না আমার।কাউকে কাছে আসতে দেবো না।কেউ বোঝেনি আমাকে।শুধুমাত্র তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে বেছে নিয়েছে আমাকে।

-তুই আমার সাথেও কথা বলবি না ইনসু?

ব্যালকনির ফ্লোরে পানির বোতলটা রেখে হাত মুঠো করে দাড়িয়ে রইলাম চুপচাপ।সকালে রুমে এসে এই ব্যালকনির মৃতপ্রায় গাছগুলোই আগে চোখে পরেছিলো।পানির অভাবে সবগুলো শুকিয়ে আছে।যীনাত আপু এগিয়ে এসে আমার কপালের সামনের একগোছা চুলে টান মেরে বললো,

-এখন তুইও এমন করবি?সবাইকে তোর হয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজের নানুবাসার সবার চোখের বালি হয়ে গেছি আমি।বিশেষত দুই মামার।বাকিরা সবাই মনে মনে হয়তো আমাকে সাপোর্ট করলেও মুখে কিছুই বলার সাহস করেনি।

……

-যাচ্ছি আমি।না বাসায় যাবো,না শেহনাজ মন্জিল।হারিয়ে যাবো।কাউকে লাগবে না আমার।তুই না,তো কেউ না!

যীনাত আপু বাইরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো।আর থাকতে পারিনি।জরিয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম।আমি জানতাম,আর কেউ বলুক না বলুক,যীনাত আপু ঠিকই বলেছে বিয়েটা না হওয়া নিয়ে।যীনাত আপু আমাকে ছেড়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-কাদিস না ইনসু,কাদিস না।

-যীনাত আপু,আব্বু…

-শান্ত হ ইনসু।একটু শান্ত হ।

যীনাত আপু আমাকে ধরে রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো।ওকে জড়িয়ে কিছুক্ষন কেদে একটু হালকা লাগলো ভেতরটাতে।যীনাত আপু আমার চুলে টান মেরে বললো,

-কিরে বুচি?কেদে কেদে নাক আরো বোচা হয়ে যাচ্ছে তো তোর!এবার তো থাম।

চোখ মুছে গাল ফুলিয়ে তাকালাম ওর দিকে।ও হেসে বললো,

-দেখেছিস তো?তোকে বুচি বললে তোর কান্না থেমে যায়।আই থিংক নামটা তোর খুব পছন্দ।কি বলিস?

অন্যদিক মুখ করলাম।যীনাত আপু জরিয়ে ধরে বললো,

-হয়েছে হয়েছে।বাচ্চা মেয়ে,খালি রাগ করবে।

-বোঝো তুমি?পচাচ্ছো কেনো তবে?

-আচ্ছা সরি।এই ইনসু,শুদ্ধ কোথায় রে?বলে গেছে তোকে?

-না।

-ওহ্!কাল রাতে কিছু বলেছে ও তোকে?আই মিন,কষ্ট দিয়ে কোনো কথা বলেছে তোকে?

কষ্ট দিয়েছে।কড়া কথা শুনিয়েছে বিয়েটা করেছি বলে।কিন্তু আমিও কি বলিনি?তার থেকে সরে যাওয়ার কথা।ওনার এতোটুকো কষ্ট লেগেছে কি তাতে?

-কি হলো?বল?

সবটা খুলে বললাম ওকে।আপু চিন্তার মুখ করে বললো,

-শুদ্ধ কেনো চায়নি বিয়েটা?

-জানি না আপু।

-তুইই বা ডিভোর্সের কথাটা কেনো বললি ইনসু?

আমি যীনাত আপুর দিকে ঘুরে বসে ওর হাত মুঠো করে বললাম,

-আপু,এই লোকটা খুব অদ্ভুত।খুব অচেনা।কখনও মনে হবে সে পাথরের চেয়েও কঠিন,কখনো তার কোমল চাওনিতে,কেয়ারিংয়ে অস্বস্তিতে পরে যাবে।মানুষটা কখনো নিস্পাপ শিশুর মতো বোকাবোকা কথা বলবে,কখনো তার কথা বিষাক্ত তীরের মতো বিধবে তোমার কাছে।একদম বহুরুপী।

-বেশ অনেকটাই চিনে গেছিস?

-জানিনা।তবে এটা জানি এতোটা কনফিউসিং একটা মানুষের সাথে থাকা সম্ভব না আপু।সম্ভব না।

-এসব কি বলছিস তুই ইনসু?তোর বিয়েটা হয়ে গেছে!

-হ্যাঁ।কিন্তু জোর করে।দুটো মানুষেরই অমতে।

-যা হয়েছে মেনে নে ইনসু।শুদ্ধ তো এমন ছিলো না,হয়ে গেছে।হয়তো পরিস্থিতি বাধ্য করেছে ওকে।হয়তো সময়টা এতোটাই বেসামাল ছিলো যে ও এমন জীবনটা তৈরী করে নিয়েছে।তুই তো এখন ওর বউ।ওর অর্ধাঙ্গীনী।তোর কি উচিত নয়,নিজের বরকে বোঝার চেষ্টা করা?ওকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া?পাপীকে নয় ইনসু,পাপকে ঘৃনা করতে হয়।আর সেই পাপী যদি আপনজন হয়,তাকে তো সে পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করতে হয় ইনসু!তাকে দুরে সরাতে নেই।

একবর্ন ভুল বলেনি যীনাত আপু।মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম।সত্যিই তো।শুদ্ধ ভাইয়া তো এমন ছিলেন না।আমাদের পরিবারের ব্রাইটেস্ট স্টুডেন্ট বলতে তো আব্বুকে সবসময় ওনার উদাহরন দিতে শুনেছি।সেজোকাকুর সাথে মানুষটা এতোটাই বন্ধুসুলভ ছিলেন যে তাকে তুমি করে বলতেন উনি।আর আজ?আজকে সারনেইম ধরে আপনি করে বলছিলেন উনি?সেজোমা তো তার চোখের মনি ছিলো,যেমনটা উনি সেজোমার।সেজোমা একটা রাতও শুদ্ধ ভাইয়াকে ছাড়া কোথাও থাকতেন না,আর উনিও।সেই সেজোমাকে যতোদুর সম্ভব এভোয়েড করছেন উনি।কেনো?কিসের জন্য?

-ইনসু?তুই বুঝতে পারছিস তোকে কি বললাম আমি?আমি জানি,তুই পারবি শুদ্ধকে বোঝাতে।জীবনটা যেভাবে লিড করছে ও,এগুলো ওর জন্য নয়।পারবি না তুই?বল?

-আ্ আপু…আমিই কেনো?

-এর উত্তর আমি দিচ্ছি।

ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালাম।সেজোমা এসেছেন।মাহি ওনার হুইলচেয়ারটা ঠেলে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলো।সেজোমা আমার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,

-মা রে,আমার শুদ্ধটা একদমই শুদ্ধ।কোনো ঘোরপ্যাচ বোঝে না ও।মানুষকে সহজেই আপন করে নেয়।বিশ্বাস করে সবার প্রতিই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায়।কাউকে নিজের সাধ্যের মধ্যে সাহায্য করতে না পারলে অপরাধবোধে ভুগতো।আর হয়তো তাই জীবনটাও কোনো কুৎসিত খেলা খেলেছে ওর সাথে।

-কি হয়েছিলো সেজোমা?

সেজোমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।বললো,

-জানি না রে ইনসু,তিনবছর আগে কিছু একটা হয়েছিলো ওর জীবনে।কাউকে বলেনি ও সে কথা।এক সকালে বেরিয়ে গেলো,আর সন্ধ্যায় মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে ফিরে এলো।সেদিনই প্রথম ওর হাতে মদের বোতল দেখেছিলাম।আর সেদিনই শেষ।তারপর নেশার ভঙ্গিমায় বাসায় ঢুকলেও,কখনো ওকে সামনাসামনি ড্রিংক করতে দেখিনি আমি বা তোর কাকু কেউই।টলতে টলতে সে সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে আমার কোলে,এই কোলে মাথা রেখে চিৎকার করে কেদেছিলো ও।কাদতে কাদতে শুধু এটাই বলেছিলো,’ আমার সামনে মেয়েটার জীবন শেষ হয়ে গেলো আম্মু,কিচ্ছু করতে পারিনি আমি।কিচ্ছু করতে পারি নি। ‘ কথাগুলো কেনো বলছিলো,কি ঘটেছিলো আমি অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওকে।বলেনি।

সেজোমা শ্বাস নিয়ে আবারো বললো,

-সেদিনের পর ছেলেটা কোনো এক অপরাধবোধে শুধু কুড়ে কুড়ে মরেছে ভেতরে ভেতরে।আমি মা হয়ে কিছুই করতে পারি নি।ওর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের মতো চলতো,বাসায় থাকতো না।ডিপ্রেসড্ বলে আমরাও ওকে কিছু বলিনি তখন।একদিন শুনলাম পুলিশের গায়ে হাত তোলার অপরাধে ওকে লকাপে যেতে হয়েছে।কিন্তু বিশ্বাস কর ইনসু,আমি জানি,শুদ্ধ কোনো ভুল করতে পারে না।ও যদি কারো গায়ে হাত তুলে থাকে তবে তার পিছনে অবশ্যই কোনো কারন আছে।তোর কাকু সেটা না বুঝে ওর সাথে বেশ রাগারাগিও করেছিলো।এভাবেই চলছিলো।কিন্তু তোর সাথে বিয়ের দুদিন আগে হুট করে বলে উঠলো এ বাসায় নাকি ও থাকবে না।চলে যাবে সবাইকে ছেড়ে।

এটুকো বলে সেজোমা কাদতে লাগলো।যীনাত আপু এগিয়ে তার কাদে হাত রাখলো।ওর চোখেও অপরাধবোধ।হয়তো সেজোমার কথাগুলোই ঠিক।সবটা না জেনে সবাই মিলে লোকটাকে নিয়ে যে সমালোচনাগুলো করেছিলো,তার সবটাই এখন উড়ো খবরের মতো মনে হচ্ছে।সেজোমা নিজেকে সামলে বললো,

-তুইই বল ইনসু,একমাত্র ছেলে আমাদের।জীবনে ওর দিকে তাকিয়ে আর কোনোদিক তাকাইনি।ওকে কি করে কাছছাড়া করবো?কি করে থাকবো ওকে ছাড়া?ওই‌ বা কোথায় যাবে?তাই তোর সেজোকাকু সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের কথা তো ভাবেনি,যদি নতুন কোনো দায়িত্বে বাধা পরে তবে হয়তো চলে যাওয়ার কথা বলবে না ও।

সেসময় তোকে ছাড়া কারো কথা মনে আসেনি আমাদের।শুদ্ধ তোদের ওখানে গেলে কতোটা হাসিখুশি থাকতো তা দেখে আমাদের মনে হয়েছিলো তুই হয়তো ওর দুর্বলতা হয়ে উঠতে পারবি।তাই বয়সে বড় হয়েও তোর আব্বুর হাতে পায়ে ধরে বিয়ের কথা বলে তোর সেজোকাকু।কিন্তু তোর আব্বু কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না।পরে তোর কাকু একপ্রকার ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে তোর আব্বুকে এটা বলে যে সম্পর্ক রাখবে না শেহনাজ মন্জিলের কারো সাথেই।তোর দাদীমা কেদে কেদে বুঝিয়েছিলো তোর আব্বুকে।তখন আর তোর আব্বুর অমতের জায়গা ছিলো না।রাজি হয়ে যায় সে।

তারমানে শুধুমাত্র একটা লোকের পিছুটান বানাতে এই বিয়ে।তাও কোন লোক?শুদ্ধ ভাইয়া!যে নিজেই চায়নি বিয়েটা হোক।তাহলে তার পিছুটান আমি হবো কিভাবে?সেজোমা আবারো বললো,

-তুই দেখ ইনসু,শুদ্ধ কিন্তু বিয়েটাতে অমত করেনি।তারথেকেও বড় কথা,ও একবারো যাওয়ার কথা বলেনি আর।

যাওয়ার কথা বলেননি,কিন্তু বিয়েতে অমত করেন নি উনি?তাহলে আমাকে কবুল বলতে মানা করেছিলেন কেনো?পালিয়ে যেতে বলেছিলেন কেনো?বিয়েটা মানলে কালরাতে আমার সাথে ওমন ব্যবহার করলেন কেনো উনি?ডিভোর্সের কথায় রাজি হয়ে গেলেন কেনো?এতোগুলো কেনোর জবাব কে দেবে আমাকে?কোথায় পাবো এর উত্তর?কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি।সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে।

-ইনসু,মা আমার।তুই পারবি না?পারবি না বল আমার আগের শুদ্ধ কে ফিরিয়ে দিতে?পারবি না এ সংসারটাকে আবার আগের মতো সাজিয়ে নিতে?

ভিক্ষুকের মতো আর্তনাত করে উঠলো সেজোমা।তার অবস্থা দেখে বুকের ভেতরটায় তীব্র কষ্ট হলো।এই মানুষটারই বা কি দোষ?প্যারালাইজড্ জীবনে আর কতো সইবেন উনি?হ্যাঁ টাকার অভাব নেই,কিন্তু সুখ?সেটার অভাবে তো বেচে থাকা যায় না।সেজোমার হাতের উপর হাত রেখে বললাম,

-আমি চেষ্টা করবো সেজোমা।তোমার ছেলে তোমার কাছেই থাকবে।

সেজোমা চোখের পানি তৎক্ষনাৎ মুছে ফেললো।হাসি ফুটিয়ে বললো,

-আমি জানতাম,তুই নিরাশ করবি না আমাকে।আজ থেকে আমি তোর আম্মু,আর শুদ্ধের বাবা তোরও বাবা।পারবি না এই বাসাটাকে সংসার করে তুলতে?পারতে তো তোকে হবেই ইনসু।পারবি তুই!বল মা?তুই পারবি?বল?

শক্ত হাতে সেজোমার হাত মুঠো করে ধরলাম।জানিনা এ হাতে এ সংসার,শুদ্ধ ভাইয়াকে আকড়ে ধরতে পারবো কি না!কিন্তু চেষ্টাটুকো আমাকে করতেই হবে,এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে হলেও শুদ্ধ ভাইয়াকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য যতোটুকো সম্ভব চেষ্টা করবো আমি।

——————-?

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে।সাথে সাথে শুদ্ধ ভাইয়ারও বাসায় ফেরার সময় ঘনিয়েছে।রুমে বসে কি থেকে কি করবো,কিভাবে করবো এসব ভাবছিলাম।বিছানায় বসে টেনশনে দাতে নখ কাটছি।যা রাগী লোক!একটু এদিক সেদিক হলেই হয়েছে।যীনাত আপু ঘরটা ঘুরে ফিরে দেখে আমার দিকে এগোলো।চুল টেনে দিয়ে বললো,

-হাইজিন বলে একটা ওয়ার্ড আছে পৃথিবীতে।সেটাকে নেই ভেবেছিস,নাকি তুই নিজেই পৃথিবীতে নেই ভাবছিস?ইনসু!তুই এই নোংরা কাজটা করিস না!

হাত সরিয়ে বললাম,

-আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে!

-হ্যাঁ,তা থাকবো কি করে?আপনি তো এই গ্যালাক্সিতেই নেই!নাকি বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডও পেরিয়ে গেছেন?

-আছি।তবে অন্যগ্রহে।শনি চেনো?শনি?ওইটা তার দশ দশটা উপগ্রহ সমেত আমার মাথার উপর ঘুরছে।সেজোমা যা বলে গেলো,ওই লোককে…নাহ্!অসম্ভব!

-কি ওই লোক,সেই লোক করছিস বলতো ইনসু?তোর বর হয়!

-হলো হলো।

গাড়ির আওয়াজ পেলাম।লাফিয়ে দাড়িয়ে গিয়ে বললাম,

-শুদ্ধ ভাইয়া এসেছে!

-হুম,হয়তো।ওয়েট!ভাইয়া?

বিরক্তি নিয়ে বললাম,

-অভ্যস।

যীনাত আপু একদম কাছে ঘেষে বসলো আমার।বললো,

-অভ্যাস পাল্টাও বেব।ব্রো টু বর হয়ে গেছে সে তোমার।

সরে বসলাম।আপু আবারো গা ঘেষে বসে বললো,

-কি বলতো ইনসু,শুদ্ধটা এতো হ্যান্ডসাম না,আই উইশ আমি ওর ছোট হতাম।বিশ্বাস কর,ভাইয়া বেরোতোই না আমার মুখ দিয়ে।তার উপর হয় খালাতো ভাই।আম্মুকে ঠিক ম্যানেজ করে নিতাম।কিসব লোকজনের কথায় ছেলেটাকে এতো খারাপ ভাবতাম।

-কি চাও কি তুমি?

-এই ভাইয়া টাইয়া ছাড় তো!যদি মনে মনে সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়া শুরু করতে পারিস তবেই তো সেটা বাস্তবে এগোবে তাইনা?

আসলেই তো!ভাইয়া কেনো বলবো তাকে?বর হন আমার।বর?হ্যাঁ বর হন উনি আমার।আর ভাইয়া বলবো না।চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে দৃঢ়ভাবে কথাটা মাথায় বসিয়ে নিলাম।কিছু বলার আগেই ধরাম করে রুমের দরজা খুলে গেলো।শুদ্ধ এলোমেলোভাবে হাটতে হাটতে রুমে ঢুকলেন।চোখটা লাল,মেরুন শার্টটার গলার নিচের দিকটা ভেজা,উপরের দুটো বোতাম খোলা,চখজোড়াও টলোমলো।যীনাত আপুকে দেখে সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললেন,

-কখন এসেছো আপু?

-তুই ড্রিংক করে এসেছিস শুদ্ধ?

উনি তাচ্ছিল্যে হাসলেন।বললেন,

-এ বাসায় নতুন তুমি।

-হ্যাঁ,আর ইনসুও।সেটা ভুলে গেছিস তুই?

শুদ্ধ এতোক্ষনে তাকালেন আমার দিকে।বললেন,

-না।ভুলিনি।সিয়া,তুই ওষুধ খেয়েছিলি?

-কিসের ওষুধ শুদ্ধ?তুই টর্চার করেছিস ওকে?

ভাব দেখেই বুঝলাম এতোটুকো গায়ে লাগলো না তার যীনাত আপুর কথাটা।এগিয়ে ওষুধের বক্স থেকে ওষুধ চেক করে বললেন,

-জানতাম খাসনি।

পরক্ষনেই চেচিয়ে বললেন,

-খাসনি কেনো?

যীনাত আপু এগিয়ে বললো,

-তুই ওর সাথে এভাবে কথা বলতে পারিস না শুদ্ধ!বউ হয় ও তোর!

-হ্যাঁ।যে বউ বিয়ের রাতেই ডিভোর্স চায়।

-তোর মানতে কষ্ট হচ্ছে সেটা?

উনি চোয়াল শক্ত করে বললেন,

-ওকে ওষুধ খেতে বলো যীনাত আপু।

-তুই ডিনার না করলে ওষুধ খাবে না ও এটাই বলেছে ইনসু।

বড়বড় চোখ করে আপুর দিকে তাকালাম।এভাবে হাড়িকাঠে মাথা না ঢুকালেও পারতো আমার।শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখলাম রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।একটা শুকনো ঢোক গিললাম।উনি জোরে ডাক লাগিয়ে বললেন,

-আসমা খালা?খাবার আনো!

শুদ্ধের আওয়াজে পুরো আজাদ ম্যানশন নড়েচড়ে উঠলো।আসমা খালা একছুটে খাবার বেড়ে আনলো।মাহি আম্মুকে নিয়ে আসলো।বাবা বাদে বাসার প্রায় বাকি সবাই বাইরে থেকে উকিঝুকি দিচ্ছে।উনি টের পেয়ে হাত মুঠো করে বললেন,

-এখানে সার্কাস হচ্ছে?

যীনাত আপুসহ সবাই গটগট করে চলে গেলো।একটার পর একটা লোকমা গিলে প্লেট সাফ করে পানি না খেয়েই বললেন,

-এবার ওষুধ না খেলে তোর খবর আছে সিয়া!

তাড়াতাড়ি গিয়ে ওষুধ বেরে করে খেয়ে নিলাম।একটা বের করে তার সামনে ধরে বললাম,

-আ্ আপনারটা?

-এটা কেনো?

-আপনার হাতেও তো…

-তোকে বলেছি আমার…

-কেয়ার না করতে।তাইতো?নিজের জন্য করছি।ড্রিংক করে এসেছেন,গা গুলাচ্ছে আমার।এটা খেয়ে দুরে যান।ঘুমিয়ে পরুন।

-হোয়াট?

মিথ্যা বললাম।ধরা পরার ভয়টার লেভেল হুরহুর করে বাড়ছে।ধুপধাপ শব্দ শুনতে পাচ্ছি নিজের ভেতরটার।উনি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে থেকে ওষুধ হাতে নিয়ে খেয়ে নিলেন।তারপর উপুর হয়ে শুয়ে পরলেন বিছানায়।এতোটা শান্ত থাকতে দেখে মনে হলো আম্মুর কথামতো আমি ওনার দুর্বলতা না হলেও আমার সুস্থ্যতা ওনার দুর্বলতা।তবে তাই হোক।আপনার দুর্বলতাতেই আমি আঘাত হানবো মিস্টার শুদ্ধ।জোরে শ্বাস ফেলে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় তার পাশে শুয়ে পরলাম।উনি লাফিয়ে উঠে বললেন,

-এখানে কেনো শুচ্ছিস তুই?

উঠে বসে চোখ ছোট ছোট করে বললাম,

-ইউ আর ড্রাংক।

উনি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন।জিভ দিতে ঠোট ভিজিয়ে আবারো ঢুলতে ঢুলতে বললেন,

-হ্ হ্যাঁ,তো?তুই বিছানায় কেনো শুচ্ছিস?

-তো ঘুমাবো কোথায়?

-যেখানে খুশি ঘুমা।তবে এখানে না।বেড শেয়ার করতে পারবো না তোর সাথে।

বিছানা থেকে নেমে দাড়ালাম।কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,

-যেখানে খুশি মানে?আমি তো আপনার খুশিমতো ঘুমাবো।রুমটা যেহেতু আপনার।

-আমার খুশিমতো বিছানা ছেড়ে দুরে থাক।

-কালই তো বললেন আপনার খুশিমতো বিছানায় ঘুমোতে।আজ কথা পাল্টাচ্ছেন?আজ অন্য ব্রান্ডের খেয়েছেন নাকি?

উনি অবাক হয়ে বললেন,

-কাল তুই আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছিস?

-হ্যাঁ।আপনি নেশার ঘোরে জোর করেছিলেন আমাকে।

-মানে?

-ঘুমোতে।

উনি ফু দিয়ে নিশ্বাস বের করে বললেন,

-আজ বলছি,এক বিছানায় ঘুমাবো না তোর সাথে।ফ্লোরে যা।

-ব্যাকপেইন হবে।

শুদ্ধ বালিশ পাশের সিঙ্গেল সোফায় ছুড়ে মারলেন।বললেন,

-একটা কথা না বলে ওখানে ঘুমা।

বালিশটা হাতে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে বললাম,

-সিঙ্গেল সোফায় বসা যায়,শুয়ে ঘুমানো যায় না।

-তুই বেশি কথা বলছিস সিয়া!

বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম।শুদ্ধ একটু চমকে পিছিয়ে গেলেন।বিরক্তি নিয়ে উঠে গিয়ে ঘরের কোনে রাখা বিনব্যাগে মাথা চেপে ধরে বসে গেলেন।অর্ধেক চোখ খুলে তাকে দেখলাম।কিছুটা দিশেহারা লাগছে।হয়তো আমার এমন ব্যবহার একদমই আশা করেননি উনি।ওনারই বা কি দোষ?আমি নিজেই নিজের এ রুপ বিশ্বাস করতে পারছি না।ইরহাম আজাদ শুদ্ধের মুখের উপর কথা বলেছি।একদফা নোবেলের জন্য আবেদন করাই যায়।নিশব্দে হেসে মাথা ধরে একটু কাতরভাবে বললাম,

-একদম ঠিক বলেছেন।কথা বলা বেশি হয়ে গেছে।উফ্ বড্ড মাথাব্যথা করছে।আহ্!!!

বিছানা নড়ে উঠলো।বুঝলাম উনি বেডে উঠে বসেছেন।চোখ মেলে তাকালাম তার দিকে।শুদ্ধ ভাইয়ার বিরক্তির চাওনির বদল ঘটেছে।চোখেমুখে শুধুই অস্থিরতা।উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

-খুব ব্যাথা করছে?বলেছিলাম বেশি কথা না বলতে।

-কখন বললেন?

-আবার তর্ক করিস?

-আহ্!

উনি আরো বেশি অস্থির হয়ে আমার মাথা নিজের কোলে নিয়ে হাত বুলাতে লাগলেন।জানিনা কি হলো আমার,তাকে দুহাতে জরিয়ে ধরে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম।মাথাব্যথা না থাকলেও,কপালে তার স্পর্শে শান্তি লাগছিলো প্রচন্ড!বন্ধ ঘরেও কোথা থেকে আসা এক দমকা হাওয়া কানে কানে বলে গেলো,
‘ কাটুক না এভাবেই দিনগুলো,নয়তো যাক না থেমে এ সময়টা।স্বস্তির পরশে,কোনো এক অজানা আবেশে জরিয়ে নিতে শেখ না নিজেকে। ‘

#চলবে….

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here