তোর নামের রোদ্দুর, পর্বঃ৫

0
1567

মাঝরাতে কর্নগোচর হওয়া ঢিপঢাপ শব্দ আমার হৃদস্পন্দনকে হঠাৎই বাড়িয়ে দিলো।হাতটা গুটিয়ে বুকের সাথে আটকে ধরলাম।এ শব্দ এতোটা কাছে কেনো মনে হচ্ছে?কেনো মনে হচ্ছে এই হার্টবিট শুধু আমাকে শোনানোর জন্যই চলছে?এতোটুকো নড়াচড়া না করে শুধু চোখদুটো খুলতেই টের পেলাম কারো বুকের মধ্যিখানে মুখ গুজে শুয়ে আছি আমি।কোমড়ের উপর ভারি কিছুর অনুভব হচ্ছে।কপালে খোচা খোচা দাড়ির স্পর্শে নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছে আমার।মাথাটা না তুলে চোখ উল্টিয়ে নিরবে উপরে তাকালাম।

শুদ্ধ আমার কপালে গাল ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।কোমড় জরিয়ে একদম কাছে টেনে নেওয়া হাতটা তারই।আরেকহাত মাথার পেছন দিয়ে রাখা।শ্বাস দ্রুততর চলতে লাগলো।দুইন্ঞ্চির ব্যবধান নেই দুজনের মাঝে,ওনার বলা সোশ্যাল ডিসট্যান্সের তিন ফুট কিভাবে মানবো?যেচে শুয়েছি তার কাছে।কিন্তু এখন তো এই স্পর্শ শরীরে এক অদ্ভুত কম্পন তুলে দিয়েছে।আগেররাতে তো আমিই এগিয়েছিলাম।আজ কি হলো?ওনার হাতটা তো আমার গায়ে!তবে কি উনিই ইচ্ছে করে আমাকে…না না,তা কেনো হবে?ঘুমের মধ্যে রেখে দিয়েছেন হয়তো হাতটা।

শুদ্ধর প্রশ্বাসবায়ু চোখের উপর পরতেই দু তিনবার চোখ পিটপিট করে বন্ধ খোলার প্রতিযোগীতায় নেমে গেলো।আমার চোখটা একদম তার থুতনি বরাবর।বারবার বন্ধখোলায় পাপড়ি স্পর্শ করেছে সেখানে।হুট করেই‌ চোখ মেলে তাকালেন উনি।এবার দম আটকে গেলো আমার।ফ্রিজড্ হয়ে গেছি একদম।শুদ্ধ নিজেও কিছুটা থমকে গেছেন।ড্রিম লাইটের আলোতে তার রিয়্যাক্টটা বেশ বুঝতে পারছি।গলা ভেজাতে শুকনো ঢোক গেলার সময় আমার শরীরটা একটু নড়ে উঠলো।সাথে সাথেই হাত সরিয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসলেন।যেনো বৈদ্যুতিক তার ছুয়েছেন তিনি।

অসহায়ভাবে গায়ের চাদর গলা অবদি টেনে তার দিকে তাকালাম।উনি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন বসে,ঘেমেও গেছেন।কপালে ঘামের পানিকনা দৃশ্যমান।একসময় গায়ের শার্টটা টেনে খুলে ছুড়ে ফেললেন উনি।আমি ভয়ে আরো নুইয়ে গেলাম।আচমকা পেছন ফিরে আমার মাথার নিচ দিয়ে হাত দিয়ে চুলগুলো মুঠো করে ধরলেন।ব্যথায় একহাতে তার হাত ধরে আরেকহাতে তার গলা জাপটে ধরলাম।চোখ খিচে বন্ধ করে আছি।উনি একদম কাছে মুখ নিয়ে দাতে দাত চেপে বললেন,

-বলেছিলাম কাছে না ঘুমোতে!

বন্ধ চোখের কোনা বেয়েই একফোটা জল গরিয়ে পরলো।চুলের মুঠো করে শক্ত করে ধরে রাখা হাত মুহুর্তেই আলগা হয়ে আসলো।চোখ মেললাম আমি।সামনে শুদ্ধর গভীর চাওনি।হারাতে ইচ্ছে করে সেখানে,ডুবতে ইচ্ছে করে।উনি আলতোভাবে চোখের পানি মুছে দিলেন আমার।মাথা আস্তে করে বিছানায় ঠেকিয়ে দিয়ে বললেন,

-কান্না থামা।

চোখের পানি শুনলো না তার কথা।আমিও বললাম থামতে,গুরুত্ব দেয়নি আমাকেও,ঝরেই চলেছে।আগের রাতেও উনি আঘাতের স্পর্শ করেছেন আমাকে,আজও।কেনো এমন করছেন উনি?আমাকে মানতে এতোটা বাধা কেনো ওনার?কি দোষ করেছি আমি?এখন তো আমি নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে তার সাথে মানিয়ে নিতে চাই,উনি কেনো তবে মানতে পারছেন না আমাকে?কেনো?

-প্লিজ কান্না থামা সিয়া!

কাতর আবেদন।গালদুটো মুছে পাশ ফিরে শুয়ে পরলাম।একটু পরেই মাথায় কারো স্পর্শ ।ডুকরে কেদে উঠলাম আবারো মুখ চেপে ধরে।শুদ্ধ ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-খুব লেগেছে তোর?

লেগেছে?হ্যাঁ,লেগেছে।কিন্তু কোথায়?যেখানটা বাইরে থেকে দেখে কোমল স্পর্শে সারিয়ে দিতে আপনি ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন সেখানে?না।অদৃশ্য কোথাও!যা না আপনি দেখতে পারছেন,না আমি নিজেও।শুধু মনে হচ্ছে আপনার ব্যবহার,দুরে যা,দুরে থাক,কথাগুলো ভেতরটাকে খুবলে খাচ্ছে।কিন্তু এগুলো মেনে নিতে হবে আমাকে।পরিবর্তনের চেষ্টাটাও করতে হবে আমাকে।উনি বললেন,

-কথা বলছিস না কেনো?

নিজেকে একটু সামলে উঠে বসলাম।বললাম,

-আপনি এতো কথা বলছেন কেনো?নেশা কেটে গেছে?

শুদ্ধ বিস্ময় নিয়ে তাকালেন আমার দিকে।মুহুর্তেই একরাশ রাগের ছায়া পরলো তার চোখেমুখে।বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে পরে থাকা শার্ট কাধে ঝুলিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন।ওনাকে বুঝতে গিয়ে সত্যিই মাথাব্যথা হচ্ছে আমার এবার।

-হেডেক হচ্ছে।

-ইউ থিংক আ’ম আ ফুল?যা বলবি তাই বিশ্বাস করবো?কিছু বুঝি না আমি?মিথ্যে বলছিস তুই!কাল রাতেও মিথ্যে বলেছিলি।

অন্যসময় হলে ভয় পেতাম।অস্বাভাবিকভাবে রাগ হলো আমার।উঠে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলাম।শুদ্ধ বড়বড় করে তাকালেন আমার দিকে।মুখটাও কিছুটা হা হয়ে গেছে তার।কিন্তু তার এতোটুকো প্রভাব না অনুভব করিনি আমি,রুমে টানতে টানতে এনে বিছানার সামনে এনে দাড় করিয়ে হাত ছেড়ে বললাম,

-যা বুঝেছেন ঠিক বুঝেছেন।কিন্তু তবুও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন আপনি।আপনার হাত মাথায় না থাকলে ঘুম হবে না।

-কিহ?

-জ্বীহ্,অভ্যেস হয়ে গেছে আমার।

-একরাতে অভ্যেস হয়ে গেছে তোর?

-হু।

-পাগল হয়ে গেছিস তুই।

-হ্যাঁ।নাও লিসেন!ইউ আর ড্রাংক।ধাক্কা মেরে বেডে ফেলে মাথার সাথে হাত বেধে দেবো কিচ্ছুটি করতে পারবেন না।মাথায় একদম সিল মেরে বসিয়ে নিন,আপনি ডেইলি ড্রিংক করবেন তো আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন,নইলে আই সোয়ার জবরদস্তি করবো আপনার সাথে।

-হোয়াট?

-বিছানায় ঘুমানো আর মাথায় হাত বোলানো নিয়ে।

-সিয়া,তুই কিন্তু বেশি…

-হুশ্!ঘুমাবো।

কথাটা বলে এক আঙুল তুলে তার উন্মুক্ত বুকে ছোয়ালাম।ওনার চোখ আরো বড় হয়ে গেছে।একটু ধাক্কা মারতেই বিছানায় বসে পরলেন উনি।হাটুতে হাত রেখে ঝুকে দাড়িয়ে বললাম,

-গুড হাবি!

-হোয়াট?

-গুড নাইট।

ওনার বোকাবোকা,আশ্চর্য হওয়া,একটু এলোমেলো চেহারা দেখে হাসি পেলো।ঠোট টিপে হেসে এসে তার পাশেই উল্টোদিক হয়ে শুয়ে পরলাম।নাক মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছি সমানে।ভাইরে ভাই!এইটা কি ছিলো?আমি কিভাবে এতোবড় কাজটা করলাম?ওনাকে থ্রেট দিলাম?কেম্নে সম্ভব?বিছানা নড়েচড়ে উঠলো কিছুটা জোরেই।বুঝলাম ধুপ করে শুয়ে পরলেন উনি।চোখের সামনে শুদ্ধের মতো এক অবয়ব দেখলাম কপালের চুলগুলো দুহাতে উল্টে চোখ গোলগোল করে উপরদিক তাকিয়ে আছেন।কিছুটা সময় পর নিজের মাথাতেই হাতের স্পর্শ খুজে পেলাম।গায়ে জড়ানো চাদরে লেগে থাকা কোনো এক সুগদ্ধ নাকে আসতেই,চোখ বন্ধ হয়ে এলো।

—————-?

অন্ধকার রাতকে ছাপিয়ে আলোর দেখা মিলছে গোটা পৃথিবীতে।তবুও কারো কারো মনে অমাবশ্যার ভয়ানক আধার এখনো ঘনিয়েই আছে। কেউ এখনো এই নতুন সকালের আলোর ছটাকে গ্রহন না করে নিজের মাঝে পুষে রাখা প্রতিহিংসার কালো ছায়া বয়ে বেরাচ্ছে,কেউ পুরোনো কথা আর আত্মগ্লানীর মাঝে ডুবতে ব্যস্ত,তো কেউ আবার নতুনভাবে সকালকে বরন করে নব্য দিনের স্বাগতম করার চেষ্টারত।

-কিরে?দুদিন আসলি না যে!

-ব্যস্ত ছিলাম।কেমন আছিস বল?

-আছি ভালো।তুইতো আবার বিয়ে করে বউ নিয়ে ব্যস্ত!

আয়ানের কথায় চকিত হলো শুদ্ধ।সকাল সকাল ফোন করেই এ কথাটা বলবে তা ধারনায় ছিলো না ওর।ওর বিয়ে নিয়ে জানার কথাও না আয়ানের।

-হ্যালো?আছিস?

-তোকে কে বললো?

-আজাদ গ্রুপের সিইও হয়ে সে গ্রুপের উত্তরাধীকারের বিয়ের মতো এতোবড় খবর শুনবো না?

শুদ্ধ তাচ্ছিল্যে হাসলো।আয়ান বললো,

-বেশ আছিস মনে হচ্ছে ইনসিয়াকে নিয়ে?

একরাশ কালো মেঘ ভর করলো শুদ্ধের মন জুড়ে।এই কথাটার উত্তর হয়তো ও জীবনের প্রাপ্তিগুলোর মধ্যে, সবথেকে বেশি সুখের,হিসেবে বলে দিতে পারতো।কিন্তু পারলো না।

-জানিসই তো কেমন থাকার কথা।

-এবার তো দেখা মেয়েটাকে?

-বাসায় চলে আয়।বেরোতে দেবেনা এ বাসার কেউ ওকে।

-তুই বাসায় থাকবি?শুদ্ধ কেউ বেরোতে দেবেনা সে কথা মানছে?ইনসিয়া তবে জাদু জানে বলতে হবে!

-সবটাই তো জানিস আয়ান।কেনো এভাবে বলছিস?আর যাই হোক,আমার এই কুৎসিত জীবনে রাখবো না আমি ওকে।শুধু একটু….

-হুম।জানি।তবে আজ আসছি তোর ওখানে?

-চলে আয়।

-ওকে বায়।

ফোনটা কেটে দিলো আয়ান।এটুকো তো ওর বোঝা শেষ যে শুদ্ধ বিয়েটা মেনে নেয়নি এখনো।এবার শুধু ওর প্লান অনুযায়ী সবটা করার পালা।আগেরদিন মুনিয়া বেশি অসুস্থ্য হওয়ায় ও যেতে পারেনি আজাদ ম্যানশনে।কিন্তু আর ছাড় নয়,শুদ্ধকে ক্ষতবিক্ষত করার জন্য,ইনসিয়াকে নিজের করার জন্য সে সবটা করবে ও,যা যা ও ভেবে রেখেছে।

——————?

ঘুম ভাঙতেই দেখলাম শুদ্ধ ব্যালকনিতেই দাড়িয়ে আছেন।রেলিংয়ে হাতের কনুই রেখে মাথা নিচু করে।পাশে গত সকালে দেখা সেই কালো পাখিটাও আছে।কাক নয় ওটা,একটু ছোটখাটো,তবে লেজটা বেশ বড়।দেখতে বেশ মায়াবী।শুদ্ধর খুব কাছেই বসে,যেনো ওনার সাথেই দেখা করতে এসেছে।বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুমের এটা ওটাতে হাত লাগিয়ে ঠুসঠাস শব্দ করলাম।ওনার সাড়া নেই।এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-আপনি এখানে এভাবে?

আমার আওয়াজে পাখিটা উড়ে চলে গেলো।মাথা তুলে শুদ্ধ একটু অস্ফুটস্বরে বললেন,

-শ্যামাপাখি….

-কি?

উনি নড়েচড়ে দাড়িয়ে বললেন,

-কিছুনা।আবার এখানে কেনো তুই?

-রুমটা আমারো।সাথে ব্যালকনিটাও।

উনি ভ্রুকুচকে তাকালেন।

-একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন বলে রাগ করেছেন?

……

-বুঝলাম,আমি আপনার পাশে ঘুমানোর অযোগ্য।

উনি আমার দিকে ফিরে বললেন,

-অযোগ্য তুই নস সিয়া!তোর পাশে অযোগ্য তো আমি।কেনো আমার সাথে নিজেকে জড়াতে চাচ্ছিস?আগেররাতে তুই ডিভোর্স চাইলি না?তোকে তো বলেও দিয়েছি দিয়ে দেবো।আর কিছুদিন….

ধুপ করে গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো আমার।চেচিয়ে বললাম,

-আমার পাশে কে যোগ্য কে অযোগ্য তা ঠিক করার আপনি কেউ নন।আজ শুধুমাত্র সেই জোর খাটানোর কারনে আব্বু আমার থেকে দুর।আর রইলো কথা ডিভোর্সের?কান খুলে শুনে রাখুন,কোনো ডিভোর্স হচ্ছে না।চাই না আমি ডিভোর্স!বুঝেছেন?

শুদ্ধ বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন আমার দিকে।কিছুটা রেগে বললেন,

-কি বলছিস কি তুই এসব?

-ঠিকই বলছি।যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি।আর আপনি!(আঙুল উচিয়ে)আপনিও এই বিয়ে মেনে নিবেন।এইযে,এইযে সো কলড্ খারাপ মানুষ সেজে মুখোশধারী জীবনযাপন করছেন না আপনি?টেনে খুলে ফেলবো আমি ওই মুখোশ!

-সিয়া!!!

-দিন।আরো জোরে ধমক দিন।বিশ্বাস করুন,ভয় হচ্ছে না আমার।এ বাসায় একটু সুখের জন্য তড়পাতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে ভয়টাকে আর ভয় পাচ্ছি না আমি।

-তারমানে তুই বলতে চাচ্ছিস আমার জীবন থেকে যাবি না তুই?

দু পা এগিয়ে আঙুলের উপর ভর করে উচু হয়ে দাড়ালাম।বললাম,

-আপনার ছদ্মবেশী জীবনে ছন্দ এনে দেবো আমি।যাবো না।

উনি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষন।পরপরই রেগে রুমে ঢুকে গেলেন।গায়ের সবটুকো শক্তি দিয়ে টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারে লাথি মারলেন।ওটা মাটিতে দুবার উল্টানি খেলো।ওড়না খামচে ধরে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।ভেতর থেকে সত্ত্বাটা বলছে,ভয় পাসনা ইনসু,কিছু করবেন না উনি তোর সাথে।তোকে পাশে না চাইলেও তোর এতোটুকো কষ্ট সইতে পারেন না উনি।আর তুইও তো ভুল বলিসনি।ভয় পাস না একদম!

-বেশ!থাক তুই এ বাসায় তোর সারেগামা আর ছন্দ নিয়ে।আমিই চলে যাবো।

শুদ্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।ধপ করে মেঝেতে বসে পরলাম।
তীরের মতো বিধলো কথাটা আমার।চলে যাবেন মানে?এদিকটা তো ভেবে দেখিনি আমি।মানুষটাই যদি না থাকে,কাকে নিয়ে এ সংসার সাজাবো আমি?কিভাবে আটকাবো ওনাকে?

#চলবে..

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here