তোর নামের রোদ্দুর, পর্ব- ১৯

0
1824

-তুই না আমার বউ!মাহির রুমে এতো কি তাহলে?

দুহাত মুড়িয়ে পেছনে নিয়ে আমাকে জরিয়ে রেখেছেন শুদ্ধ।এতোক্ষন ছাড় পাওয়ার চেষ্টারত ছিলাম।কথাটা শুনে মুখপানে চাইলাম তার।একরাশ বিরক্তি!সকালে উঠে যখন দেখবো আমার ওড়না নিজের গলায় পেচিয়ে তাতে মুখ গুজে উনি আরামছে ঘুমোচ্ছেন,চাদরটাও ঠিকমতো নেই আমার গায়ে,কোন মুখ নিয়ে ওইরুমে থাকবো আমি?একটানে ওড়না ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে মাহির রুমে চলে এসেছিলাম তাই।মাহি দরজা নক করতেই খুলে দিলো।আমি সোজা ওর বেডে উঠে হাটু জরিয়ে বসে পরলাম।মাহি চোখ ডলতে ডলতে হাই তুলে বললো,

-এসো ইনসিয়া ভাবি,তোমার অপেক্ষাই করছিলাম।আজও বলবে শুদ্ধ ভাইয়া পাগল হয়ে গেছে তাইনা?ছ সেকেন্ড ধরে সেদিন তোমাকে,তারপর আর না বলে আটকে যাবে।আমি ঝাকিয়ে,তুলে আছড়েও আর বাকিটুক বের করাতে পারবো না তোমার মুখ থেকে।তা আজ তোমার চুল শুক্…

কাদোকাদোভাবে ওর দিকে তাকালাম।মাহি একটা জোরে শ্বাস ফেলে পাশে বসে বললো,

-আচ্ছা,এটা বলো তো!শুদ্ধ ভাইয়াকে এতো ভয় পাও কেনো তুমি?

-প্লিজ মাহি!বিশ্বাস করো,তোমার ভাইয়া সবটা আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই করে।সে চায়,আমি দম আটকেই মারা যাই।তারপর তার ঘাড় থেকে নেমে গেলেই সে বাচে।অদ্ভুত আচরন ইদানিং তার।আর তোম্…

-আমি আমার বউয়ের সাথে অদ্ভুত নাকি ভুত আচরন করবো সেইটা পাবলিক করার অধিকার তোকে কে দিয়েছে সিয়া?

আতকে উঠে দরজার দিক তাকালাম।শুদ্ধ এসেছেন।ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুজে ঘাড় বাকিয়ে দাড়িয়ে আছেন উনি দরজায়।ওনার ভাব দেখলেই ভয় করে আমার।কই?দুদিন আগেও তো সবটা আলাদা ছিলো।এখন এমন কেনো হয় আমার সাথে?হুটহাট কাছে চলে আসেন বলে?মাহি বিচলিত কন্ঠে বললো,

-শ্ শুদ্ধ ভাইয়া,ত্ তুমি?

উনি এসে সোজা হাত ধরলেন আমার।মাহির দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন,

-তোর মামাবাড়িতে আর্লি ল্যান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করছি দাড়া।

-আমি কি করলাম?

-রুমটাতে তুই আছিস বলেই ও আসে।মামাকে আসতে বলছি।তুই এ বাসা থেকে বিদেয় হবি।এজ সুন,এজ পসিবল।

মাহি হা করে তাকিয়ে আছে শুদ্ধর দিকে।একবার আমার দিকে তাকালো।মনের কথাটা পরতে কষ্ট হলো না।দুজনেরই একই কথা।শুদ্ধ সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন।শুদ্ধ ধমকে বললেন,

-তুই হেটে রুমে যাবি?নাকি কোলে নিবো?

মাহির সামনেও এভাবে বলতে বাধছে না তার?মিলিটারী ম্যানের মতো তাড়াতাড়ি উঠে সোজা হয়ে দাড়ালাম।উনি হাত ধরেই রুমে আনলেন আমাকে।তারপর রুমে এসেই আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরলেন।

-বলেছিলাম না সকালে তোর ভেজাচুলে মুখ না ডুবিয়ে অফিস যেতে ইচ্ছে করে না।এভাবে থাকিস কেনো তবে তুই?নাকি তুই কারন আদায়ের জন্য এমন করিস?

জমে গেলাম আমি।আজকাল কাজের পাশাপাশি কথাগুলোও লাগামছাড়া বলতে শুরু করেছেন উনি।শুদ্ধ একটু হেসে ছেড়ে দিলেন আমাকে।চোখ দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে তার হুকুম তামিলের জন্য বললেন।করলামও তাই।আর উনিও নিজেরটুক আদায় করেই ছেড়েছেন।ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই পেছন থেকে জরিয়ে চুলে নাক ঘষেছেন আমার।স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম শুধু।শরীরের কম্পনটাকে লুকানোর বৃথা চেষ্টা।

.
ডাইনিং টেবিলে শুদ্ধর পাশের চেয়ারটা আমার জন্য বরাদ্দ।বাবা,মাহি,শুদ্ধ ওরা খাচ্ছেন।আসমা খালাই সার্ভ করে দিচ্ছিলো সবাইকে।সেজোমাকে ঠিকমতো বসিয়ে দিয়ে আমিও বসে প্লেটে ভাত নিতে লাগলাম।খালা সবে আমার প্লেটে মাংসের তরকারীটা দিতে যাবে শুদ্ধ বললেন,

-তরকারী আজ ঝাল হয়েছে খালা।

-আমাকে দাও,আমি নিয়ে নিচ্ছি।

কথাটা বলেই বাটিটা খালার হাত থেকে নিতে যাচ্ছিলাম।শুদ্ধ ওটা একপ্রকার ছিনতাই করে নিলেন।আজব তো!ঝাল বলে না খেয়ে থাকবো নাকি?মুখ বাকিয়ে ডাল নিতে যাবো,শুদ্ধ নিজের প্লেট থেকে মাংস তুলে দিলেন আমাকে।ভ্রুকুচকে তাকালাম তার দিকে।উনি প্লেটের দিকে তাকিয়েই বললেন,

-ঝাল ছাড়িয়ে দিচ্ছি।ওটাই খা!এন্ড নো মোর আর্গুমেন্ট!

নুইয়ে গেলাম।এই লোকটা সবার সামনেও এভাবে অস্বস্তিতে ফেলবে আমাকে।আড়চোখে সবার দিকে চোরের মতো তাকালাম।ওমা!সবাই খেতে ব্যস্ত!যেনো এটা খুব স্বাভাবিক কোনো কথা।পাশে আসমা খালাকে শুধু ঠোট চেপে হাসতে দেখলাম।ব্যস!হয়ে গেলো!আবারো লজ্জায় নতজানু হয়ে বসে ওটাই খেয়ে নিলাম।

—————-?

বৈশাখের বিকেল।দুপুরের গরমটার রেশ বর্তমান।আরো বেশি ভ্যাপসা গরম অনুভুত হচ্ছে।একটু দক্ষিনা বাতাসের লোভে মাহির সাথে ছাদে যাচ্ছিলাম।সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মাহি বললো,

-ইনসিয়া ভাবি,তোমাকে শুদ্ধ ভাইয়া ওর সব ফ্রেন্ডদের সাথে মিট করিয়েছে?

-সব ফ্রেন্ড?আমি তো শুধু আয়ান ভাইয়াকেই চিনি।ওই যে সেদিন এসেছিলো।

-হ্যাঁ।উনি তো আজাদ গ্রুপের সিইও শুনেছি।বাসায় আসে নাকি প্রায়ই।

-হুম।তাইতো জানি।

-এরমধ্যে আসেনি কেনো?

থেমে গিয়ে ভ্রুকুচকে তাকালাম ওর দিকে।মাহি কিছুটা হচকিয়ে গেছে তাতে।নিজেকে সামলে বললো,

-ন্ না,মানে তোমার রিসেপশনের দিন দেখলাম না।তাই বললাম।শুদ্ধ ভাইয়ার একমাত্র ফ্রেন্ড!

কথা সত্য।সেদিন আসলেন না কেনো উনি?আবার বাসায়ও আসেন নি।লোকটার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।যতই হোক,শুদ্ধের ডাইরিটা উনিই দিয়েছিলেন আমাকে।

-বললে না?

-ওইদিন কেনো আসেননি তা জানি না।তবে এখন নাকি উনি অফিসিয়াল কাজেই বাইরে।শুদ্ধই বললেন।

-ও।

ছাদে উঠে কার্নিশের দিকে এগোচ্ছিলাম দুজনেই।কিন্তু রোদটা আরো বেশি বরং এখানে।মাহি মাথায় হাত রেখে বললো,

-এখানে এখন বিকেলবিলাস সম্ভব না আমার ইনসিয়া ভাবি।ফুপির মতো রুমে গিয়ে ঘুমানোটাই ভালো হবে।শরীরে কাজে দিবে।চলো নিচে।

ঘাড় দুলিয়ে চলে আসলাম।রুমে এসেই দেখি শুদ্ধ সেন্টার টেবিলে ল্যাপটপ রেখে ঝুকে দাড়িয়েই কিছু করছেন।উনি ফিরেছেন?আজ এতো তাড়াতাড়ি?ওভাবে দাড়িয়ে কাজ করতে হবে?তো এতো জরুরি কাজ বাসায় আসলো কেনো?কিছু না বলে বিছানার পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে ব্যালকনির দিকে এগোচ্ছিলাম।শুদ্ধ ল্যাপটপে চোখ রেখে বললেন,

-চল আমরা বেরোবো।

-কোথায়?

-গেলেই দেখতে পাবি।রেডি হ।

-কিন্তু যাবোটা কোথায়?আর এখনই বা…

উনি সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললেন,

-তুই সোজা কথার মানুষ না।

ভরকে গেলাম।উনি একপা এগোতেই যাচ্ছি যাচ্ছি বলে হাত দিয়েও থামতে বললাম তাকে।উনি থামলেন।গুটিগুটি পায়ে গিয়ে কাবার্ড থেকে একটা জামা বের করলাম।শুদ্ধ ওটা কেড়ে নিয়ে কাবার্ড থেকে অন্য একটা জামা ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-এটা পর।

কালো জামা?কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলাম ওটার দিকে।

-হোয়াট?

-এই গরমে কালো পরবো না।

-পরবি।আর গরমটা থাকবে না দশ মিনিট পরই।

আর কি যুক্তি দেখাবো?চেন্জ করে ওইটাই পরলাম।তারপর ভেতরে ঢুকে গেলে।চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে উচুতে ঝুটি করে বাধলাম।কি সাজ দেবো?কাকে দেখাবো?নাকি দেখাবো না বলেই সাজবো না বুঝে উঠতে পারছি না।যদি সাজলে ওই চোখজোড়া আমাতে আটকে যায়?সহ্য করতে পারবো তো?যদি আমিও ওই‌ চোখের অতলে ডুবে যাই?কে বাচাবে তোকে ইনসু?নাহ্!কোনো সাজ লাগবে না।আয়না থেকে সরে এসে বিছানায় বসে মোবাইলে মন দিলাম।

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে চোখ তুলে তাকাতেই আবারো নুইয়ে যেতে বাধ্য হলাম।শুদ্ধ ওয়াশরুম থেকে খালি গায়ে শুধু প্যান্ট পরে বেরিয়েছেন।মাথার ভেজা চুলগুলো হাতে ঝাড়ছেন।এখন শাওয়ার?ফর্সা শরীরে লেগে থাকা পানিকনাও চোখে পরছে।তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম।লোকটার লোকলজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি?

-তুই এভাবে বসে কেনো?

-তো কি করবো?

-রেডি হতে বললাম না?

-আর কি করবো?আ’ম ডান।

-মাথা তোল!

-না।

-হোয়াই?

-এমনি।

-তাকা আমার দিক!

উফ্!এতো জোরাজুরি!বিরক্তিতে বলে উঠলাম,

-আগে ড্রেস পরে আসুন আপনি।

কথাটা বলেই জিভ কাটলাম।খুব কি দরকার ছিলো ওভাবে বলার?শুদ্ধর সুর তোলা আওয়াজ পেলাম।

-ওওওও!এই সমস্যা?

চুপ রইলাম।কি বলবো?কেস খাওয়ার জন্য যা বলার,তা তো বলেছই দিয়েছি।শুদ্ধ টেনে দাড় করালেন আমাকে।হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মেরেছেন ওটা।

-চল,এবার চোখ তুলে তাকা।

-পারতাম না।

-তুই চাস তোকে ফোর্স করি?

-আমার চাওয়ার কি দাম দেবেন?চাইনা ফোর্স করুন।

এতো স্পষ্ট উত্তর দিতে পেরে বেশ লাগলো।কথাটা তো বুদ্ধি করেই বললাম।কানে তুলবেন তো উনি?শুদ্ধ আমাকে ঘুরিয়ে নিজের সামনে দাড় করালেন।হাতের তিনআঙুলে ঘাড়ে স্লাইড করালেন উনি।কেপে উঠে বললাম,

-ছ্ ছাড়ুন!

-তাকাবি?

-তাকাচ্ছি,তাকাচ্ছি আমি।

হাত সরিয়ে আয়নার সামনে টেনে নিয়ে আসলেন উনি আমাকে।একপলক তাকিয়ে আবারো চোখ নামিয়ে নিলাম।কেমন একটা হাসি তার মুখে।হুট করে চুলটা খুলে দিয়ে বললেন,

-এভাবে যাবি তুই।

-কিন্তু…

শুদ্ধ আয়নার একটু সাইডে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করলেন।আমার কথা থামিয়ে দিয়ে কপালে আঙুল ছোয়ালেন তার।সামনে যতোটুকো চোখে পরছে তাকে তাতেই প্রচন্ড লজ্জা করছে।চোখ বন্ধও রেখেছি কিছুক্ষন।কিন্তু এবার আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম একদম ছোট একটা কালো টিপ আমার কপালে।কালো জামা,ছাড়া চুল,কালো টিপে মন্দ লাগছে না।তবুও টিপ পরা হয়না অনেকদিন।শেষ কবে পরেছি মনে নেই।বেশ কিছুটা সময় ওভাবে থেকে খুলে ফেলতে যাচ্ছিলাম ওটা।শুদ্ধ হাত আটকে দিয়ে বললেন,

-খুলিস না।

-টিপ পরি না আমি।

-তাপসী আপুর বিয়েতে তো পরেছিলি।

মনে পরলো না।শুদ্ধ আবারো বললেন,

-সরি।বিয়েতে ছিলো না।বিয়ের পরদিন।গোসল শেষে কালো স্কার্ট আর নেভি ব্লু টিশার্টের সাথে,ছাড়া ভেজা চুলে।এই ছোট কালো টিপটাই পরেছিলি সেদিন।

এই টিপ?এটা ওনার কাছে কেনো?কিভাবে এলো?এতো যত্নে এখনও?এতো আগের কথা এতোসব মনে আছে তার?আস্তেধীরে মাথা তুলতে লাগলাম।শুদ্ধ সরে গেছেন অনেকটাই।সাদা পোলো গেন্জির উপর কালো জ্যাকেট পরছেন উনি।জ্যাকেটে হাত ঢুকাতে ঢুকাতে বললেন,

-ওইদিন তোর টিপটা খুব মানিয়েছিলো তোকে।একটু বেশিই ভালোলাগছিলো তোকে দেখতে।সইতে না পেরে স্ট্যান্ডফ্যান ঘুড়িয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম ওটাকে।অবশ্য পরে খুজে পেতে মেঝের সব ধুলো শুকতে হয়েছিলো আমাকে।

ফিক করে হেসে দিলাম আমি।কিন্তু কথাটা বুঝে মনটা খুশি অনুভব করে তৃপ্ত হলো যেনো।ভাবতেও অবাক লাগে।এই মানুষটা এভাবে ভাবে আমাকে নিয়ে।ভাবতেন!হয়তো এখনও ভাবেন।শুদ্ধর দিকে তাকিয়েই আছি।জ্যাকেটের হাতা টেনে গুটিয়ে নিয়ে কালো সানগ্লাস চোখে দিলেন উনি।চুলগুলো উল্টাচ্ছেন হাতে।তার এই রুপটাও অচেনা আমার।কোনোদিন দেখেছি কি?নাহ্!দেখিনি।দেখলে এভাবেই আটকে থেকে দেখতাম,ভুলতাম না।অসম্ভব মোহনীয় দেখাচ্ছে মানুষটাকে।কিন্তু এতো সাজের কি দরকার?কাকে দেখাতে যাচ্ছেন এই সাজ উনি?মুহুর্তেই ভেতরটা অজানা কারনে রাগে ফুসে উঠতে লাগলো।

#চলবে…

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here