তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_১৪,১৫

0
640

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_১৪,১৫
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৪

‘সে তো ঠিকই আছে তবে তোকে আমি ওয়ার্নিং দিয়ে রাখছি জেরিন থেকে তুই একশো হাত দূরে থাকবি।মেয়েটা যেন তোর আশেপাশে না থাকে আর তোকেও যেন জেরিনের আশেপাশে না দেখি।তোর নিজের বোকামির কারণে তোর যদি কোনো ক্ষতি হয় বিলিভ মি আমি তোকে জানে মেরে দেব।কথাটা যেন মাথায় থাকে!’

দুর্জয় ভাইয়ার হুমকি শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।জেরিন আপুর সাথে উনার সংঘর্ষ কি নিয়ে তা আমি আজও বুঝতে পারলাম না।শুরু থেকেই দেখে আসছি উনি আপুকে সহ্য করতে পারে না।একটু আগের ঘটনায় জেরিন আপুর কি দোষ থাকতে পারে?আপু হয়তোবা ভিড়ের মাঝে মানুষের ধাক্কাধাক্কির কারণে আমাকে খুঁজে পাচ্ছিল না।সে তো আর ইচ্ছে করে এমনটা করেনি।
কিন্তু এখন উনাকে কিছু না বলাই ভালো।যেরকম রেগে আছে কখন না জানি ঠাস ঠাস থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।আসল কাহিনী কি সেটা জেরিন আপুর থেকেই জানা যাবে।উনার সাথে কথা বলা বৃথা।

এমন সময় দুর্জয় ভাইয়ার ফোন বাজতে উনি নিজেকে শান্ত করে কল রিসিভ করলেন।

‘ হ্যাঁ ইমন বল!’
‘………..’

‘ পেয়েছি।আমার সাথেই আছে।তোরা ওইখানে অপেক্ষা কর আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

কল কেটে উনি বললেন,
‘ চল!’

‘কোথায়?’

আমার প্রশ্নের উত্তরে দুর্জয় ভাইয়া এমন চাহনি দিলেন যে আর কিছু বলার সাহসই পেলাম।হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি আমার হাত ধরে ভিড় ঠেলে সামনে হাঁটতে লাগলেন।কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার হৃদপিণ্ড প্রচন্ড শব্দে ধকধক করতে লাগল।যদি এখানে মেলার হৈচৈ আওয়াজ না থাকত তবে নিশ্চয়ই সবাই আমার হৃদপিণ্ডে ঢোল পিটানোর শব্দ স্পষ্ট শুনতে সক্ষম হত।দুর্জয় ভাইয়ার হাতের মুঠোয় আমার হাত ভাবতেই মনে অজানা শিহরণ খেলে যাচ্ছে। নিজের অজান্তে বারবার নজর চলে যাচ্ছে দুটো হাতের ওই বন্দীযুগলের দিকে।অথচ উনার তো কোনোই হেলদুল নেই।বড় বড় পা ফেলে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন। রাগ কি উনার এখনো কমেনি?
হঠাৎ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন দুর্জয় ভাইয়া।আমিও টাল সামলাতে না পেরে উনার সাথে ধড়াম করে খেলাম এক ধাক্কা।উনি ভ্রু কুঁচকে একবার আমার হাতের দিকে দেখছেন আরেকবার পাশের দোকানে সারি সারি করে সাজানো চুড়ি গুলোর দিকে।
উনার মতিগতি না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?কি হলো?’

দুর্জয় ভাইয়া কোনো কথা না বলে দোকানের প্রতিটি চুড়ি স্ক্যান করে অবশেষে নীল রঙের কাচের চুড়ির গোছাটা বেছে নিলেন।আমি চোখ বড়বড় করে দেখছি উনার কর্মকান্ড।মেয়েদের চুড়ি দিয়ে উনি করবেনটা কি?
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।সাথে-সাথেই উত্তর পেয়ে গেলাম।দুর্জয় ভাইয়া আমার বামহাত অতি সন্তর্পণে নিজের হাতে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে সবগুলো চুড়ি পড়িয়ে দিলেন।অবাক হয়ে তাকালাম উনার দিকে।উনি বাঁকা হেসে বললেন,

‘এতক্ষণে চুড়িদের আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছে।’

দুর্জয় ভাইয়া মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দোকানির হাতে ধরিয়ে আবার আগের মত হাঁটতে শুরু করলেন।এত হট্টগোলের মধ্যেও আমার হাতের চুড়িগুলোর টুংটাং শব্দ তীব্রভাবে শুনতে পাচ্ছি। উনি কি একটু আগে আমার প্রশংসা করলেন?হ্যাঁ এটা প্রশংসা ছাড়া আর কি?আমার তো এখনো সবটা স্বপ্নের মতো লাগছে যে দুর্জয় ভাইয়া আমাকে চুড়ি কিনে দিয়েছে আবার নিজহাতে তা পরিয়েছে।হঠাৎ করেই মনের ভেতর রঙিন হাওয়া বইতে লাগল।এমন তো আগে কোনোদিন অনুভূত হয়নি!মন কেনো মানতে চাইছে না আমি দুর্জয় ভাইয়ার চোখে শুধুমাত্র বোনের মতই।যেমনটা সুহানা আপু।চোখে ভেসে উঠল একটু আগে উনার বিধ্বস্ত চেহারা।আমাকে খুঁজে না পেয়ে উনি কি এতটাই উতলা হয়ে গেছিলেন!আচ্ছা আমার জায়গায় যদি সুহানা আপু থাকতেন তাহলেও কি উনি এমন চোখ রাঙিয়ে ধমকাতেন আবার কিছুক্ষণ পর নিজের পছন্দমতো চুড়ি কিনে পরিয়ে দিতেন?

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমন ভাইয়াদের দেখা পেলাম। ওরা সবাই ফুচকার দোকানের সামনে টুলে বসে ফুচকা খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে মামা উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে লাগলেন,
‘ এসব কি পূর্ণী?তোকে বলেছিলাম না আমাদের না বলে কোথাও যাবি না।কতটা টেনশনে ফেলে দিয়েছিলি জানিস?’

আমি কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললাম,
‘ স্যরি মামা।আর হবে না।’

‘ আর হতে দিলে তবে তো হবে!এক্ষুনি ফুচকা খেয়ে সবাই বাড়ির দিকে রওনা দিবে।’

আমি মন খারাপ করে আপুদের সাথে বসলাম।সবসময় আমার জন্য সবার আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়।
জেরিন আপুকে দেখতে পেয়ে আমি নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ ব্যাপার কি আপু তোমাকে আমি খুঁজে পেলাম না কেনো?
আপু আমতাআমতা করে বলতে লাগল,
‘ আ’ম স্যরি পূর্ণী।আসলে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে আমি কিভাবে যেন তোমার থেকে দূরে চলে গেছিলাম।আমার এক ফ্রেন্ড কল দিয়েছিল ওর সাথে কথা বলতে বলতে এমনটা ঘটে গেছে।এরপর তোমাকে আর কোথাও দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করেছিলাম কিন্তু পাইনি।’

‘ আমিও এটাই সন্দেহ করেছিলাম আপু।এখন এসব নিয়ে আর কথা বলো না।আমি তো ঠিকঠাক ফিরে এসেছি।’

‘ ঠিক বলেছো…’

জেরিন আপু কথা থামিয়ে আমার চুড়িভর্তি হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।এই প্রথম আপুর সামনে আমার কেনো জানি অস্বস্তি লাগল।নিশ্চয়ই চুড়িগুলোর কথা জিজ্ঞেস করে বসবে।দুর্জয় ভাইয়া দিয়েছে বললে কি ভালো দেখাবে?
কিন্তু না আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।আপু কিছুই বলল না।তাহলে কি সে সব আন্দাজ করে ফেলেছে?আমিও কি ভেবে চুড়িভর্তি হাত লুকিয়ে ফেললাম উড়নার তলায়।

__________________________

দোতলার করিডোরে রেলিঙ ঘেঁষে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি আমি।পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই এখন নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। একমাত্র আমিই সজাগ প্রাণী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন দুপুর হলেও আকাশের অবস্থা দেখলে হঠাৎ সন্ধ্যে বলে মনে হয়।পশ্চিম দিকে কালো মেঘ স্তূপাকারে ধেয়ে আসছে।ভাপসা গরমে পরিবেশ কেমন থম মেরে আছে।মেঘের ঘনঘটা দেখে মনে হচ্ছে তুমুল বৃষ্টি আসবে।কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস বইতে লাগল এবং তা একসময় গতি বাড়িয়ে গাছের ডালপালা উড়িয়ে নিতে উদ্যত হলো।আমি খুশিখুশি মনে একলা দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছি। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো।উপরের ছাদের কার্নিশ বেয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে আসছে।হাত বাড়িয়ে দিলাম বৃষ্টির ঠান্ডা স্পর্শ পেতে। আমার হাতে এখনো দুর্জয় ভাইয়ার দেওয়া নীল চুড়ি। বৃষ্টির ফোঁটা স্বচ্ছন্দ্যে চুড়িগুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ মাথায় একটা চমৎকার খেয়াল আসতেই ভেতরটা নেচে উঠল। এখন তো সবাই ঘুমোচ্ছে আমি যদি টুক করে ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আসি তাহলে কেমন হয়?অবশ্যই ভালো হয়।বাসায় থাকলে এমন আইডিয়া মাথায় আসার আগেই মায়ের অগ্নিমূর্তি সামনে চলে আসে।এতদিন পর এরকম একটা সুন্দর সুযোগ পেলাম।অবশ্য আপুরা থাকলে আরো ভালো হত।সমস্যা নেই আমি আজ একাই ভিজে ভিজে বৃষ্টিবিলাস করব।
পা টিপে টিপে পৌঁছে গেলাম ছাদে। বৃষ্টির ফোঁটা সমস্ত ছাদকে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে ঠান্ডায় মাখামাখি দমকা হাওয়া বেসামাল করে দিচ্ছে সবকিছু। আমি উৎফুল্ল মন নিয়ে চলে এলাম ছাদের মধ্যখানে। আকাশ থেকে ঝরতে থাকা স্নিগ্ধ ফোঁটা ভিজিয়ে দিতে লাগল আমায়।খোলাচুল এতক্ষণ অগোছালো হয়ে উড়ছিল এবার পানির স্পর্শে যেন নেতিয়ে পড়ল।আমিও দুহাত মেলে আপন করে নিলাম বৃষ্টির আগমনকে।

জানি না এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল।বৃষ্টিবিলাসের এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি।হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়তে সজাগ হয়ে উঠলাম।বাড়ির কেউ উঠার আগে আমাকে জামা চেঞ্জ করে ফেলতে হবে।নাহলে…
দরজার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই থমকে গেলাম।দরজার পাশে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ধারা ছাপিয়ে যখন ওই চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠল তখন জমে গেলাম।অবয়বটি দুর্জয় ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নয়।আমার সিক্ত শরীরে হঠাৎ কাঁপুনি উঠে গেল।তবুও মনে সাহস জুগিয়ে এগিয়ে গেলাম।থাক না উনি দাঁড়িয়ে। হয়তোবা আমারই মত বৃষ্টি দেখতে এসেছে।তাতে ক্ষতি কি!কিন্তু উনি কখন এলেন এখানে?

নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে উনাকে পাশ কাটিয়ে যেতেই আটকা পড়লাম।যখন বুঝতে পারলাম আমার হাত দুর্জয় ভাইয়ার শক্ত হাতের মাঝে বদ্ধ হয়ে আছে তখনই শরীরে রক্ত চলাচল তরতর করে বাড়তে লাগল।উনি কি কিছু বলতে চায় আমায়?নাহলে এমন নির্জন পরিবেশে আমাকে কেনো আটকাচ্ছে?
কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি একটানে আমাকে দাঁড় করিয়ে ফেললেন উনার মুখোমুখি। আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি।পেছনে দেয়াল থাকায় তার সাথে সেঁটে রইলাম একদম।দুর্জয় ভাইয়া একহাত পাশের দেয়ালে ঠেকিয়ে অন্যহাত পকেটে ঢুকিয়ে আমার সামনে বিশাল পর্বতের মত দাঁড়িয়ে থেকে বললেন,

‘ আমাকে পাগল করে বৃষ্টিতে নেচে-কুঁদে বেড়ানো হচ্ছে?’

দুর্জয় ভাইয়ার দুচোখে দুষ্টুমির হাসি। এদিকে আমার মনে প্রশ্নের খই ফুটছে।তাঁর কথাবার্তা আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।যদিও উনার থেকে আমার দূরত্ব কয়েক ইঞ্চি তবুও উনার উপস্থিতি আমাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না।

‘ তোর এই চুড়িতে যখন টুংটাং শব্দ শুনি তখন আমার কি ইচ্ছে করে জানিস?ইচ্ছে করে তোকে ঘন্টার পর ঘন্টা চোখের সামনে বসিয়ে রেখে এই চুড়ির ধ্বনি শুনি।কিন্তু পারি না। কেনো জানিস?’

কথাগুলো বলতে বলতে দুর্জয় ভাইয়া আমার হাত সামনে এনে চুড়িগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন।আমি কোনোরকমে শ্বাস বন্ধ করে উনার সব কথা শুনে যাচ্ছি।ভেজা কাপড়ের ঠান্ডায় কাঁপছি ঠকঠক করে।তবুও দম খিঁচে দাঁড়িয়ে আছি আমাকে নিয়ে দুর্জয় ভাইয়ার মনের অভিব্যক্তি শোনার অপেক্ষায়।
আমার নীরবতা দেখে উনি বললেন,
‘ তুই তো জানিস না কিছুই।পারিস শুধু আমার থেকে পালিয়ে বেড়াতে!আমাকে যন্ত্রণা দিতে।একবার আমার চোখের দিকে তাকা!আমার চোখ তোকে প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে বলে যায় আমার মনের কথা অথচ তুই বুঝিস না! নাকি বুঝেও না বোঝার মত থাকিস?’

বাইরে বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে।হুহু করে বাতাসের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ছে।এই মুহূর্তে দুর্জয় ভাইয়ার কথা ছাড়া আমার কানে জগতের আর কিছুই ঢুকছে না।বাড়িভর্তি লোকজন যে কেউই এখানে হাজির হতে পারে। আমাদের দুজনকে এমন অবস্থায় দেখলে কি অঘটন ঘটতে পারে সেই ভয়টাও যেন মন থেকে দূর হয়ে গেছে।অধীর আগ্রহ নিয়ে দুর্জয় ভাইয়ার চোখে চোখ মিলিয়ে রেখেছি যদি আরো কিছু বলেন সেই আশায়।

দুর্জয় ভাইয়া এবার কাতর গলায় বলে উঠলেন,
‘ পূর্ণতা, আবার চলে আয় আমার জীবনে। তোর থেকে এই দূরত্ব আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না।পূর্ণতাকে ছাড়া সবদিকে দিয়েই আমি অপূর্ণ। এতদিন দূরে ছিলাম বলে আমার কিছুই করার ছিল না।আমার জন্যই তোর উপর এতবড় আঘাত এসেছে।কিন্তু এখন আমি এসে গেছি। আমার দম থাকতে একটা আচড়ও তোর উপর পড়তে দেব না পূর্ণতা।আই প্রমিস।’

দুর্জয় ভাইয়া থেমে গেলেন।হয়তোবা আমার ভ্রুঁ কুঁচকানো দেখে থামলেন।উনার শেষের কথাগুলোর কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাচ্ছি না।উনার জন্য আমার উপর আঘাত এসেছে এটা আমার মাথায় অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে।
দুর্জয় ভাইয়া আমার থেকে দূরে সরে ছাদের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন,
‘ জানি তোর মাথায় এখন হাজার প্রশ্ন ঘুরছে। তোর প্রশ্নের সব উত্তরই আমার কাছে আছে তবুও আমি কিছুই বলব না।কারণ সবকিছুরই একটা উপযুক্ত সময় আছে।সেই সময়টা এখনো আসেনি তাই তুই আমাকে কোনোরকম প্রশ্ন করবি না।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে উঠলেন,
‘ এভাবে স্ট্যাচু হয়ে কি দেখছিস আমাকে?অবাক হয়েছিস নাকি শক খেয়েছিস?ব্যাপার না।তবে এটা মাথায় ঢুকিয়ে নে তুই আমার ছিলি,আমার আছিস,ইন ফিউচার আমারই থাকতে হবে।আমাদের মাঝে যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তাঁকে গুম করে দেওয়ার ব্যবস্থা আমি নিজের হাতে করব।’

দুর্জয় ভাইয়া চলে গেলেন।সিড়িতে উনার নেমে যাওয়ার আওয়াজ পেতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালাম।আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা এখনো যায়নি।বোধহয় আজ আর এই বৃষ্টি থামবে না।ছাদের উপর বৃষ্টির পানি জমে গিয়ে ছোটখাটো একটা নদীর মতো হয়ে গেছে।সেখানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি যেন হারিয়ে গেলাম অন্য এক জগতে।

চলবে…

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৫

সন্ধ্যার পর থেকেই টের পেলাম শরীরে বেশ উত্তাপ। মাথায় হালকা ব্যথা।চোখদুটো টনটন করছে।নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভেজার ফল এসব।আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে চলেছে।ছাদ থেকে আসার পর থেকে সন্ধ্যা অবধি মায়ের সামনে যাইনি।যদি আমার চুল ভেজা এটা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় তাহলে দফারফা হবে।তবে এখন চুল শুকিয়ে এসেছে প্রায়।
দোতলার করিডোরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি।আশেপাশে কেউ নেই।বাইরে এখনো টিপটিপ বৃষ্টি। ঠান্ডা হাওয়া শরীরে জ্বর আসার অনুভূতি জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসবে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।মন পড়ে আছে অন্যকোথাও।এই ঠান্ডা হাওয়াতেও যেন সুখের ছোঁয়া পাচ্ছি। আমার অবাধ্য চোখ সবদিকে সেই মানুষটাকে খুঁজে চলেছে।কিন্তু তাঁর কোনো পাত্তা নেই।তবে সে যদি আমার সামনে উপস্থিত হয় আমি কি তাঁর চোখে চোখ রাখতে পারব?
তাঁর সেই চাহনি, অদ্ভুত ব্যবহার সবই তো খোলাশা এখন।সে ভালোবাসে আমায়!তাঁর কন্ঠের সেই আবেদন,দুচোখে জড়ানো মায়া কোনোমতেই ভুলে থাকতে পারছি না।বাকি রইল সেই উত্তর না জানা প্রশ্নগুলো।সে তো বলেছে সময় আসলে আমাকে জানিয়ে দেবে।আমার কাছে এই মুহূর্তে একটা জিনিসই সত্য এবং মুখ্য।আমাকে ছাড়া অপূর্ণ সে!

‘ পূর্ণী একা বসে আছিস কেনো রে?’

অহনা আপুর আওয়াজ পেতে সোজা হয়ে বসলাম।আমার দেখাদেখি আপু ঘর থেকে চেয়ার নিয়ে পাশে বসল।কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ মন খারাপ বুঝি?নিচে চল সবাই বসে আছে।খালামণি বারবার খুঁজছে তোকে তাই আমায় ডাকতে পাঠাল।’

‘ আমার মন ভালই আছে আপু।তুমি নিচে যাও আমি আসছি।’

‘ তা হবে না।আমার সাথেই চল।খালামণি বলেছে তোকে সাথে নিয়েই যেন যাই।উঠ্।

অহনা আপু আমার হাত ধরতেই চমকে উঠে বললেন,
‘ একি রে! তোর শরীর তো গরম।জ্বর টর আসছে নাকি।হায় হায় এজন্যই বুঝি চুপচাপ বসে আছিস?’

‘ আপু আস্তে কথা বলো।আমি ঠিক হয়ে যাব এসব কিছুই না।’

‘ একদম চুপ।বৃষ্টি ভিজেছিস এই কথাটা তোর রিকোয়েস্ট রাখতে খালামণিকে জানাইনি আমি।আর এখন গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে চলেছে তাও বলছিস ঠিক হয়ে যাবি।আমি এক্ষুনি খালামণিকে ডেকে আনছি।আজ তোকে বকা না খাইয়ে ছাড়ছি না।কেনো গেলি বৃষ্টি ভিজতে?’

আপু হম্বিতম্বি করে সিড়ির কাছে দাঁড়িয়েই মাকে ডাকতে লাগল।ব্যস্ হয়ে গেল আর কি!
মাও চলে এল ছুটতে ছুটতে।অহনা আপু মুখ গম্ভীর করে মায়ের কাছে কবিতার মতো সব বলে দিল।মা আমার দিকে কটমট তাকাচ্ছে আর আমি অসহায় মুখ করে বসে আছি।একে একে খালামণি,নানু এবং মামীও হাজির।মা এসে কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে বলতে লাগল,
‘ এতবড় মেয়ে হয়েও তুই এমন বাচ্চাদের মত গেছিস বৃষ্টি ভিজতে।ঠান্ডার দোষ জেনেও এই কাজটা করলি!আমাকে না জ্বালিয়ে তোর শান্তি নেই।এখন তোর বাবা জানতে পারলে কি হবে ভাবতে পারছিস?যদি শুনে তুই জ্বর বাঁধিয়েছিস তাহলে সব চোট তো আমার উপর দিয়ে যাবে।’

মায়ের শাসনও আজ মধুর লাগছে।মায়ের চিন্তিত চেহারায় দিকে তাকিয়ে হাসছি মিটিমিটি। এটা ঠিক যে বাবা জানতে পারলে খুব বকবে।আমাকে নয় মাকে।

‘ আশ্চর্য মেয়ে।এদিকে জ্বর বেড়ে চলেছে আর হাসছিস তুই?উঠ এখন হালকা কিছু খেয়ে তারপর ওষুধ খাবি।’

খালামণির কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠলাম।তখনই বুঝতে পারলাম শরীর অনেকটাই দুর্বল লাগছে।তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম রুমে।

.

প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে চোখ খুললাম।সবকিছুই ঘোলাটে দেখছি।প্রবল ঠান্ডায় কাঁপছি ঠকঠক করে।কেউ একজন গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিল ভালোভাবে।ঘরে লাইটের তীব্র আলোতে চোখ মেলা দুষ্কর। সমস্ত শরীরে অসম্ভব দুর্বলতা।ঘরে পরিচিত মানুষদের গলার আওয়াজ পাচ্ছি। পরক্ষণেই টের পেলাম কেউ আমার মাথায় পানি ঢালছে।এবার মনে হচ্ছে চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছে।ধীরে ধীরে সকলের কথা অস্পষ্ট হয়ে এল।এরপর আর কিছুই মনে নেই।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘরের মেঝেতে ঝকঝকে রোদ্দুর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই দেখি অহনা আপু খাটের পাশে টুলে বসে ফোন টিপছে।আমার দিকে খেয়াল হতে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন রেখে বলতে লাগল,
‘ এখন কেমন লাগছে রে?আর জ্বর নেই তো?’

আপু উঠে এসে গায়ে হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো।হাঁফ ছেড়ে বলল,
‘ জ্বর নেই।তুই রাতে যে কারিষ্মা দেখিয়েছিলি মনে আছে কিছু? প্রত্যেকটা মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি!তোর আক্কেল থাকলে আর কখনো বৃষ্টি ভেজার নাম করিস না। ‘

খাটে হেলান দিয়ে বসে গতরাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলাম।শুধু মনে পড়ছে আমার মাথায় কেউ পানি দিচ্ছিল।এই মুহূর্তে মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।আমার মমতাময়ী মা নিশ্চয়ই ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।কে জানে এতক্ষণে বোধ হয় বাবার কানেও খবর চলে গেছে আর বাবা হুমকি ধমকি দিয়ে শহরে ব্যাক করতে বলেছে।আমার এক্সিডেন্টের পর থেকে মা বাবা দুজনই সবসময় আমাকে নিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই চিন্তিত থাকেন।

‘ কাল রাতে তোর গা জ্বলন্ত উনুনের মত গরম হয়ে গেছিল।তোর তো কোনো জ্ঞানই ছিল না।এমন অবস্থা দেখে খালামণির চোখ ভিজে উঠছিল বারবার।তখন রাত প্রায় দশটা।গ্রামে এমন সময়ে ডক্টর পাওয়া খুব মুস্কিল।কিন্তু দুর্জয় ভাইয়া কি করেছে জানিস?গ্রামে যিনি ডাক্তার উনাকে সোজা ঘর থেকে তুলে নিয়ে এসেছে।’

দুর্জয় ভাইয়া নামটা শুনতে পেয়ে চোখ থেকে ঘুমের রেশ কেটে গেল।কাল বিকেল থেকে একবারও উনার দেখা পাইনি।আমার জ্বর হয়েছে শুনে নিশ্চয়ই খুব ঘাবড়ে গেছিল নাহলে কি এমনি এমনি ডাক্তারকে তুলে নিয়ে এসেছে?

‘ তারপর কি হলো?’

‘ তারপর আর কি!ডাক্তার আংকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল।পরে অবশ্য হাসতে হাসতে বলল কিছুসময়ের জন্য ভেবেছিল উনাকে বুঝি ডাকাত দলের কোনো লোক কিডন্যাপ করেছে।কিন্তু পূর্ণী তোকে আরো একটা কথা বলার ছিল।’

‘ হ্যাঁ বলে ফেলো।’

আপু চারদিকে একবার সজাগ দৃষ্টি দিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল,
‘ কালরাতে তুই আরো একটা ঘটনা ঘটিয়েছিস!’

আমার দুই ভ্রু কুঞ্চিত হলো।আপু এসব পাত্তা না দিয়ে আবার বলল,
‘ রাতে ডাক্তার তোকে চেক করে মেডিসিন দিয়ে যাওয়ার পর সবাই যার যার রুমে চলে গেছিল।সুহানা আর জেরিন অন্য রুমে ঘুমিয়েছে।শুধুমাত্র আমি ছিলাম তোর সাথে।রুম খালি হওয়ার পর দুর্জয় ভাইয়া এসেছিল তোকে দেখতে।ভাইয়া তোর কপালে হাত রেখে জ্বরের মাত্রা চেক করছে তখন তুই হঠাৎ চোখ খুলে ভাইয়ার হাত জাপটে ধরে আবার ঘুম।সেই মুহূর্তে ভাইয়ার ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম।আমি তোর হাত ছাড়াতে চাইলে ভাইয়া রাজি হয়নি।এরপর কতক্ষণ ভাইয়া এই রুমে ছিল জানি না।আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সকালে উঠে আর দেখিনি।’

আপু কথা শুনে লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে উঠল।ঘুম এবং জ্বরের ঘোরে আমি বুঝি এসব করেছি!এতক্ষণ উনাকে একপলক দেখার জন্য মনটা আনচান করছিল কিন্তু এই কথা শুনে মনে হচ্ছে উনার ছায়াও মাড়াতে পারব না।
খাট থেকে নামতে যাব এমন সময় রুমে দুর্জয় ভাইয়ার আগমন।উনাকে দেখে হঠাৎ ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম।উনি আমার মুখোমুখি কিছুটা দূরে খাটে ধপ করে বসে পড়লেন।দেখে মনে হচ্ছে সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে।
অহনা আপু হেসে বলল,
‘ গুডমর্নিং ভাই!’

‘ গুডমর্নিং! অহনা তুই যা তো মাকে বল আমার জন্য এককাপ চা দিতে।মাথা ধরেছে খুব।’

‘ এখনি যাচ্ছি। ‘

দুর্জয় ভাইয়ার খপ্পরে আমাকে একা করে আপু চলে গেল।মনে মনে ভাবছি আমার কারণেই উনার মাথা ধরেছে।কাল সারারাত নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারেনি।কিন্তু এখন একা উনার সামনে আমি কোনোমতেই থাকতে পারব না।খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে।
দুর্জয় ভাইয়া বোধ হয় আমার মনের ভাব বুঝে ফেলেছে।ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
‘ পালাই পালাই স্বভাব কবে দূর হবে তোর?’

আমি একপলক উনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম,
‘ কি করব! আপনাকে দেখলেই আমার পালাই পালাই ফিলিংস আসে।’

‘ তাই? কাল বিকেলে যা যা বলেছি এরপরও এমন ফিলিংস?’

এবার যেন লজ্জায় সিঁটিয়ে গেলাম আমি।ঝোপ বোঝে কোপ মারতে চাইছে উনি।কাল উনি আমার কতটা কাছে ছিলেন এটা ভাবতেই মাথা ঘুরছে।আর আমিও নির্বাকের মত দাঁড়িয়ে সব শুনে গেছি।
‘ দ..দেখুন আপনি সকাল সকাল কেনো এখানে এসেছেন!নিজের ঘরে যান দয়া করে।’

‘ যাব না।সারারাত তো আমাকে জাপটে ধরে ঘুমিয়েছিস আর এখন ভাগিয়ে দিচ্ছিস?দিস ইজ নট ফেয়ার।’

দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনে আমি শিহরিত।পাগল লোক কি বলছে এসব!একটু আগেই অহনা আপু বলে গেছে ঘুমের তাড়নায় আমি উনার হাত ধরেছিলাম আর উনি বলছে উনাকে…ছি ছি! জীবনে আজ প্রথম নিজের কানে তিল থেকে কিভাবে তাল হয় তা শুনলাম।
থমথমে গলায় বললাম,
‘ কিসব আবোলতাবোল বকছেন! আমার মত সহজ সরল একটা মেয়ের নামে শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছেন কেনো?’

দুর্জয় ভাইয়া ফিক করে হেসে দুহাতের আঙুল মটমট করে ফোটাতে লাগলেন।কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ভাবুক হয়ে বললেন,
‘ তুই সহজ সরল বলেই তোকে নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই।কে জানে কখন কোনদিক দিয়ে কেউ ক্ষতি করার জন্য বসে থাকে।’

‘ মানে?আমার ক্ষতি কে করবে?’

‘ কেউ না কথার কথা বললাম।তবে আমি যে কাল তোকে আমার মনের কথা জানিয়ে দিলাম তার উত্তরে তুই তো কিছু বললি না।হ্যাঁ অথবা না!’

দুর্জয় ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে বলল কথাগুলো।কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার ওই ঘটনা টেনে আনছেন।
আমি তো এখনো নিজের মন থেকেই সঠিক কোনো উত্তর পাইনি তাহলে উনাকে কি জবাব দেব।তবে এটা ঠিক যে উনার মনের কথা জানার পর থেকে অন্যরকম একটা ভালোলাগা ঘিরে রেখেছিল আমায়।আমি অনুভব করেছি যে উনার প্রতি আমার আলাদা একটা টান আছে। কিন্তু এটাকে তো ভালোবাসা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না।আমার আরো সময় দরকার।উনার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো আসলে কোন পর্যায়ের তার হদিস আমি পাইনি এখনো।
চোখ বন্ধ করে বললাম,
‘ যদি উত্তর না হয়?’

দুর্জয় ভাইয়া আমার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালেন।আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
‘ একবার না বলে দেখ্ তোকে দিয়ে হ্যাঁ বলানোর দায়িত্ব আমার।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here