তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২০,২১

0
604

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২০,২১
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২০

দুর্জয় ভাইয়া ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন।আমি অবাক হয়ে দেখছি উনাকে।মনের সমস্ত রাগ হঠাৎ কোথায় উবে গেল।এতক্ষণ রাগের বশে উনাকে কতগুলো জঘন্য শুনিয়েছি তার বদলে এত শান্ত থাকছেন কিভাবে?
উনি হাসির রেখা আরো চওড়া করে বললেন,
‘ সকল প্রেমিকদের মতো আমিও বলব রাগলে তোকে সুন্দর দেখায়।’

বলেই আমার নাক টেনে দিলেন।আমি ভড়কে গেলাম।উনি হাসিহাসি মুখ করেই বের হয়ে গেলেন।অথচ আমি স্পষ্ট টের পেয়েছি উনার হাসির আড়ালেও একটা বিষাদের ছাপ। আমার কথাগুলো বোধ হয় উনাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।আমিই বা কি করতাম!অতিরিক্ত রাগের বশে পুরো ধুয়ে দিয়েছি উনাকে।তবে রাগটা তো স্বাভাবিক ছিল।

কিছুক্ষণ পর সুহানা আপু হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে এসে ঢুকল।আমাকে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘ স্যরি বোন।দুর্জয় ভাইয়া তখন বলেছিল তোকে যেন আমার রুমে নিয়ে আসি।ভাইয়ার কথার পিঠে না করার কোনো চান্স ছিল না।বুঝতেই পারছিস ভাইয়াকে দেখলেই আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।কারণটা নিজেও জানি না।’

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ কিন্তু মা কেনো ভাইয়াকে ডাকতে গেল?অযথা একটু আগে এখানে একটা সিনক্রিয়েট হয়েছে।ধ্যাত।’

‘ চাচী কেনো ভাইয়াকে ডাকবে?দুর্জয় ভাইয়া তো এসেছিল ইমন ভাইয়ার কাছে।কি যেন দরকার ছিল।দুর্জয় ভাইয়াকে দেখতে পেয়েই চাচী তোর কর্মকান্ড সম্পর্কে ডিটেইলস বলে দিয়েছে।চাচী তখন অনেক রেগেছিল তো তাই।’

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।তারমানে মা উনাকে ডাকেনি।হায় আল্লাহ আমি শুধু শুধু উনাকে এতগুলো কথা শুনালাম।না জানি কত কষ্ট পেয়েছে লোকটা।একটা বারের জন্যও আমার ভুলটা ভেঙে দিল না!নিজের কাছে নিজেই খুব ছোট হয়ে গেলাম।

‘ তুই কথা বলছিস না কেনো রে?’

সুহানা আপু দিকে করুণ চোখে তাকালাম।একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা ধীরে ধীরে খুলে বললাম।সব শুনে আপু গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ এটা খুবই অন্যায় হয়ে গেল।না জেনে বুঝে কাউকে অপমান করা ঠিক না।দেখ বাড়ির সবাই তোকে প্রচন্ড ভালেবাসে বলেই তোর প্রতি তাঁদের ভয়ের মাত্রাটা বেশি।দুর্জয় ভাইয়াও তেমনি তোকে ভালোবাসে।হয়তোবা নিজের চেয়েও বেশি।তাই তোকে নিয়ে যথেষ্ট ভয়ে থাকে।ভয়ের কারণটাও অজানা নয়।আচ্ছা বুঝলাম ভাইয়া তোর উপর নিজের আদেশ চাপাতে চেয়েছে কিন্তু তুই তো জানিস উনি কতটা ভালোবাসে তোকে।আরে বোকা এর দ্বারাই তো তুই উনাকে সহজে মানাতে পারতিস।তা না করে রেগেমেগে অস্থির।ভাইয়ার জায়গায় আমি থাকলে তোকে মাথায় তুলে আছাড় মারতাম।ভাইয়া কিন্তু কিছুই করেনি।’

আপুর কথা শুনে অনুতাপের মাত্রাটা আরো বেড়ে গেল।একধরনের অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে শরীরে।মানুষটাকে সত্যিই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।কি হবে এখন?কিভাবে উনার সামনে যাব?

‘ আপু কি হবে এখন?আমার তো সারারাত ঘুম আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না উনাকে স্যরি বলতে পারি।’

সুহানা আপু হাত নেড়ে বলে উঠল,
‘ শান্ত হ শান্ত হ।সমস্যার সমাধান আছে আমার কাছে।’

আমার অশান্ত চেহারায় শান্তির ছায়া নেমে আসলো।উৎসুক হয়ে আপুর দিকে তাকাতেই বলে উঠল,

‘ ভালোবাসার মধ্যে রাগ-অভিমান,ভুল বুঝাবুঝি ভালোবাসা দিয়েই মিটাবি।’

‘ মানে?’

‘ অদ্ভুত মেয়ে তো তুই!এত সহজ এবং সুন্দর একটা কথা তোর মাথাতে ঢুকছে না?এদিকে আয় তোর মাথায় দুটো টুকা মেরে দেই।’

আপুর ঠোঁটে মুচকি হাসি।আমার কুঞ্চিত ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে গেল।হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে আপুও নিশ্চিত হলো আমি কথাটার মানে ধরতে পেরেছি।
মনের খুশিতে আপুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘ হিমু ঠিকই বলে আমার এই জঞ্জাল মাথাকে কেটে ফেলে দিতে হবে।’

______________________________

খুশির বার্তা আসলো রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে।মা বাবা দুজনই রাজি আমার পিকনিকে যাওয়ার ব্যাপারে।আমি খুশির চোটে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইলাম।কিন্তু পরক্ষনেই গপাগপ ভাত গিলতে লাগলাম।হিমুসহ বাকিরা উৎসুক হয়ে বসে আছে আমার খবরটা শোনার জন্য। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে।
তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ভাত গলায় আটকে কাশি উঠে গেল।বিনিময়ে মায়ের কাছ থেকে সুমিষ্ট এক ধমক খেয়ে ফেলেছি।তাতে কি।আমার অবস্থা তো এখন বিনা পরিশ্রমে সোনার হরিণ দেখা পাওয়ার মত।

খাওয়া শেষে রুমে যাওয়ার আগে সুহানা আপু আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল সবকিছুই দুর্জয় ভাইয়ার জন্য সম্ভব হয়েছে।কথাটা সত্যি।উনি কি বলে বুঝিয়েছেন যে এত সহজে মা মেনে নিল?যাই হোক এটা বড় বিষয় নয়।বড় বিষয় হলো অবশেষে আমি পিকনিকে যাচ্ছি। ইয়াহু!

আনন্দের খবরটা বন্ধুমহলের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।আবছা অন্ধকারে চিনি মিনি বেশ আয়োজন করে ঘুমোচ্ছে।ওদের আর ঘাটাতে মন চাইল না।আশেপাশের রাস্তাঘাট এখন নিস্তব্ধ। মাঝেমাঝে দু চারজন পথচারী হেঁটে যাচ্ছে। আকাশে চাঁদের আলো না থাকলেও বেশ পরিষ্কার।সেখানে অসংখ্য ছোট ছোট তারা মিটমিট করে জ্বলছে।চমৎকার একটা পরিবেশ!

ফোনে দুর্জয় ভাইয়ার নাম্বার বের করে ডায়াল করলাম।সময় এখন বারোটার কাছাকাছি। বারোটা বাজার আগেই উনি ঘুমিয়ে যাবেন এটা মোটেও আশা করছি না।দুবার রিং বাজতেই দুর্জয় ভাইয়া রিসিভ করলেন।আমি অত্যন্ত মিষ্টি কন্ঠে বলতে চেষ্টা করলাম,

‘ ঘুমিয়ে গেছেন নাকি?’

ফোনের ওপাশ থেকে খাতাপত্র উল্টানোর আওয়াজ পেলাম।তাহলে ঘুমাননি এখনো।যাক ভালোই হলো।তখনের ব্যবহারের জন্য সুন্দরভাবে স্যরি বলা যাবে।দুর্জয় ভাইয়া হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ ঘুমাইনি।কেনো তুই আসবি নাকি?’

আমি প্রশ্নের ধরণ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আমি কেনো আসবো?’

‘ ঘুমাতে।আমার সাথে ঘুমাতে আসবি।’

‘ আশ্চর্য আমি একথা কখন বললাম?আপনি ক বলতেই কলকাতা বুঝে নিচ্ছেন কেনো?’

‘ তাই বুঝি?এত রাতে ফোন দেওয়ার কারণ কি জানতে পারি?ক আর কলকাতার পার্থক্য বুঝাতে নিশ্চয়ই ফোন দিস নি!’

দুর্জয় ভাইয়ার কথার ধাঁচ আমার মোটেও ভালো লাগল।উনি মনে এখনো কষ্ট পুষে রেখেছেন।ইস্ তখন এতটা কঠিন ব্যবহার না করলেও চলতো।কিন্তু উনার কথার উত্তরে কি বলবো সহসা খুঁজে পেলাম না।ভয় ভয় লাগছে।যদি আবার রেগে যায়?

‘ কথা বলছিস না কেনো? সিম কোম্পানি তোকে আনলিমিটেড অফার দিয়েছে নাকি আজ?’

আমি আবারো চুপ।কি করে উনার রাগ ভাঙানো যায় সেটা ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে যাচ্ছে। সুহানা আপু বলেছে ভালোবাসায় রাগ অভিমান ভালোবাসা দিয়েই মিটাতে হবে।ভালেবাসার কোন উপায়টা অবলম্বন করলে উনার অভিমান চুরমার হবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।

‘ পূর্ণতা আমি ফোন রাখছি।আরো চার-পাঁচটা ফাইল চেক করার বাকি আছে।তুই…’

‘ আপনাকে খুব মিস করছি।এতটাই যে বলতে ইচ্ছে করছে আপনি কি আসবেন? এখন এই মুহূর্তে?আমি বারান্দায় অপেক্ষা করছি।’

দুর্জয় ভাইয়ার মধ্যে পিনপতন নীরবতা।খাতাপত্র উল্টানোর আওয়াজও আর পাচ্ছি না।আমার মিনি সাইজের হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করছে।একটু আগের কথাগুলো কিভাবে যেন মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।আমি তো এগুলো বলতে চাইনি।বিকেলে উনাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছি আর এখন বলছি মিস করছি।এ যেন জুতা মেরে গরু দান।নিশ্চয়ই আমাকে এখন ধমকে ধমকে আধমরা করে ফেলবে এই লোক।

দুর্জয় ভাইয়া অতি স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলেন,
‘ রাত ক’টা বাজে খেয়াল আছে?আমাকে কি ক্লাস নাইন টেনে পড়ুয়া আবেগী প্রেমিক মনে হয় যে প্রেমিকা ডাকবে আর আমি সব ছেড়েছুড়ে দৌড়ে যাব?কালকে ক্লাস আছে না তোর?ফোনটা রেখে ঘুমাতে যা।’

অপর পাশ থেকে আবারো নীরবতা টের পেতে ফোনটা সামনে এনে দেখলাম দুর্জয় ভাইয়া সত্যি সত্যি কল কেটে দিয়েছেন।তাজ্জব ব্যপার!উনার রাগ ভাঙানোর জন্য আমি মনের সাথে যুদ্ধ করে এত আবেগ নিয়ে সুন্দর একটা রোমান্টিক কথা বললাম আর উনি পাত্তাই দিল না।আমিই একটু বেশি ভালোমানুষী দেখাতে গেছি।আসলে উনি তো প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে।তখনকার কথাগুলোর জন্য আমার উপর প্রতিশোধ নিল আর কি।থাক তুই তোর প্রতিশোধের আগুন নিয়ে।জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যা।আমি ঢু মারতেও যাব না।

বারান্দার গ্লাস আটকে পর্দা ফেলে দিলাম।একটা উজবুকের সাথে কথা বলে বৃথা সময় নষ্ট করাতে বড্ড আফসোস হচ্ছে।মেজাজও খারাপ হচ্ছে ধীরে ধীরে।ঝটপট বিছানা গুছিয়ে এসে শুয়ে টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলাম।পুরো রুম ছেঁয়ে গেল অন্ধকারে।মাথার পাশের খোলা জানালা দিয়ে হালকা বাতাস প্রবেশ করছে।জানালার পর্দাগুলো কাঁপছে মৃদুভাবে।সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ লেগে আসলো।এমন সময় বারান্দা থেকে চিনি মিনির কর্কশ আওয়াজ শুনে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।ওরা এভাবে ডাকছে কেনো?কান খাড়া করতেই পাখা ঝাপটানির আওয়াজও শুনতে পেলাম।আশ্চর্য ওরা কি কোনোকারণে ভয় পেয়েছে নাকি।এখনি দেখতে হবে আমাকে।
তড়িঘড়ি করে বারান্দার থাই গ্লাস সরাতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।

চলবে…

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২১

কোনো এক ঝড়ের রাতে অজানা এবং না দেখা এক আগন্তুক আমার বারান্দায় উঠে এসেছিল।লোকটি বলেছিল তাঁর পেছনে নাকি পুলিশ লেগেছে।চেহারা ঢাকা ছিল বলে ওই লোকটার মুখ দেখতে পাইনি।প্রচন্ড ভয় কাবু করে ফেলেছিল তখন।আমার সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি দেখে সেই রাতের কথা স্মরণ হচ্ছে। পার্থক্য শুধু সেদিন বৃষ্টি ছিল আজ বৃষ্টি নেই।তবে ভয়ের কারণে বুক ঢিপঢিপ করছে অথচ মনোবল হারাচ্ছি না।কারণ আমি জানতে চাই কে এই লোক এবং আমার বারান্দা উনার কেনো এত পছন্দ যে প্রত্যেকবার এখানেই উঠে আসতে হবে?
আগে যেমন কালো কোট পরা অবস্থায় দেখেছি আজও তেমনি।খুব জানতে ইচ্ছে করছে উনার কি এই কোট ছাড়া আর কোনো জামা কাপড় নেই!অবশ্য পুলিশের নজর থেকে পালানো কোনো মানুষের জামাকাপড় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ভালো দেখায় না।এই লোকটারও বোধ হয় একই অবস্থা।

লোকটা এখনো আমার থেকে কয়েকহাত দূরে।আমার চেহারায় ভয়ের চিহ্ন না দেখে ভড়কে গেছে নিশ্চয়ই। কিছুটা ঝাঁঝের সুরে বললাম,

‘ আপনি আবার এসেছেন?এত লম্বা দেওয়াল টপকে উঠে আসেন কিভাবে বুঝি না।পুলিশের হাত থেকে পালানোর পেশায় কত বছর ধরে আছেন?’

ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ছাড়া চারদিকেও আর কোনো আওয়াজ নেই।
আমি আবার বলে উঠলাম,
‘ বোধ হয় আপনি কথা বলতে পারেন না।কিন্তু আমি একটাই কথা বলতে চাই, এলাকায় এত বাড়িঘর থাকতে আপনি এখানে কেনো আসেন?এটা কি গা ঢাকা দেওয়ার জায়গা হিসেবে পারফেক্ট?আমার তো তা মনে হয় না।চোর ডাকাতেরা কবে থেকে এত নির্বোধ হলো?’

এটুকু বলেই থামলাম।দুর্জয় ভাইয়ার উপর জমানো রাগ এই ব্যক্তির উপর ঝেড়ে দিয়েছি।কিন্তু এখনো আমার মন শান্ত হতে পারছে না।
আগন্তুক এবার দুপা সামনে এগিয়ে আসলো।রুম থেকে তীর্যকভাবে আসা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় দুর্জয় ভাইয়াকে দেখে বিষম খেলাম।দু তিনবার চোখের পাতা ফেলে পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলাম সামনের মানুষটা আমার স্বপ্ন নাকি বাস্তব।রাত-বিরেতে এমন নিখুঁত স্বপ্ন দেখার মত পাগল তো হইনি এখনো। এই ব্যক্তিটি তাহলে সত্যিই দুর্জয় ভাইয়া যিনি এখন চেহারায় হাজারো বিরক্তি ধরে রেখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
বিস্ফারিত নয়নে বললাম,

‘ আপনি এখানে?আপনি তো বলেছেন আসবেন না।এসেই যখন পড়েছেন তখন এভাবে চোরের মত…’

হঠাৎই মনে পড়ল সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে কালো কোট পড়া ব্যক্তিটিও কি উনিই ছিলেন?
আমার সন্দেহজনক দৃষ্টি লক্ষ্য করে দুর্জয় ভাইয়া বলে উঠলেন,

‘ হ্যাঁ ওই রাতে আমিই এসেছিলাম তোর বারান্দায়। আজও আমিই।’

স্থির ভাবে তাকালাম উনার দিকে।মাথায় একটা সূক্ষ্ণ রাগের উৎপত্তি হচ্ছে। দাঁতে দাঁত ঘষেও রাগ কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না।
চাপা গর্জন করে বললাম,
‘ এসব কি নাটক হ্যাঁ?প্রথম দিন আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম জানেন?আজও ভয় দেখাতে এসেছেন তাই না?প্রতিশোধ নিতে এমন করছেন তাই তো?দুপুরের কথাগুলোর জন্য এখনো রাগে ফুঁসছেন।কিছুক্ষণ আগে আপনাকে মিস করছি এটা বলার পরও আপনি ভাব দেখিয়ে ইগনোর করলেন।তাহলে আবার কেনো এসেছেন এখানে?কি চাই?’

‘ তোকে চাই।শুধুমাত্র তোকে।’

দুর্জয় ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন কথাটা।আমার নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে।উনার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে ভস্ম করার প্রয়াস করছি কিন্তু উনি যেন এতে মজা পাচ্ছেন।মিটিমিটি হেসে আমার সামনে এসে বললেন,
‘ আমাকে সত্যিই মিস করছিলি?’

এবার আমি সম্বিত ফিরে পেলাম।রাগের মাথায় কি বলতে কি বলে ফেলেছি উনি এখন সেটা টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন।আমি তো একটা কথাও বলব না আজ।এই খারাপ লোকটার ছায়াও দর্শন করব না।
যেই কথা সেই কাজ। দুহাত ভাঁজ করে অন্যদিকে তাকিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

‘ তোর ধারণা দুপুরের কথাগুলোর জন্য আমি কষ্ট পেয়েছি অথবা রাগ করেছি তাইতো?ধারণাটা সত্যি কি মিথ্যে এটা জানতেই তখন ফোন দিয়েছিস তা আমি জানি।এজন্য আমিও একটু বাজিয়ে দেখলাম আমার রাগ ভাঙাতে কি কি করতে পারিস তুই।অবশেষে কিছু খুঁজে না পেয়ে চট করে বলে ফেললি মিস করছিস।এখন এই মুহূর্তেই আমাকে দেখতে চাস।’

দুর্জয় ভাইয়া মৃদুতালে হাসতে হাসতে বলছেন কথাগুলো।আমি এখনো অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে রেখেছি আর ভাবছি কতটা চতুর এই লোক।ঠিক বুঝে ফেলেছে মিস করার কথাটা আমি এমনিই বলেছি।

দুর্জয় ভাইয়া হঠাৎ আমার কোমড় চেপে উনার মুখোমুখি দাঁড় করালেন।অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম।কিছু বলার আগেই উনি হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে দুজনের মাঝখানের ফাঁকটা পূরণ করে নিলেন।এবার আমার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল।উনার এত কাছাকাছি থাকা আমার জন্য সবসময়ই বিপদজনক। মনের ভেতর টালমাটাল ঝড় বইতে থাকে শুধু।গলা শুকিয়ে পানির তেষ্টা পায় ভীষণ।কেমন যেন হাসফাস লাগে।
আমি ছাড়া পাওয়ার জন্য উনার বুকে ধাক্কা দিতেই উনি চোখ রাঙালেন যা দেখে আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলাম।চোখ ছোট ছোট করে বললেন,

‘ এভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাখলে আমি কিন্তু মেরে মেরে মুখ ভেঙে দেব।খুব সাহস বেড়ে গেছে না?একটু আগে কিভাবে তেজ দেখিয়ে কথা বলছিলি ভাবতেই অবাক লাগে।আমার জায়গায় যদি সত্যিই কোনো স্ট্রেঞ্জার হত তাহলে এতক্ষণে তোকে দুচারটা ঘুষি মেরে চিঁড়াচেপটা বানিয়ে ফেলে রাখত। ‘

দুর্জয় ভাইয়ার কথায় কৌতুকের ছাপ স্পষ্ট। আমার রাগ উনার কাছে কোনো পাত্তাই পাচ্ছে না এটা দেখে কষ্টে দেয়ালে মাথা ঠুকতে মন চাইছে।উনি ইচ্ছে করেই আমাকে আরো রাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন তা ভালোই বুঝতে পারছি।

‘ দেখুন আমি এই মুহূর্তে আপনার প্রতি খুবই বিরক্ত। দয়া করে দূরে গিয়ে দাঁড়ান।আপনার সংস্পর্শে আমার ফোবিয়া আছে।আচ্ছা আপনি যেহেতু আগেই বুঝতে পেরেছেন আমি মিস করার কথা এমনিই বলেছি তাহলে আসলেন কেনো?’

‘ তুই মিস করছিস না কিন্তু আমি তো মিস করছিলাম।আর তোর কাছে আসতে আমার কোনো নির্দিষ্ট কারণ লাগে না।যখন মন চাইবে তখনই আসব।ভুলে যাস কেনো তুই একান্তই আমার।’

আস্তে করে ঢোক গিললাম আমি।দুর্জয় ভাইয়ার ঘোর লাগা কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে আমায়।নিজের ভেতরের রাগটাকে ধরে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছি।উনার নির্নিমেষ চোখের চাহনি বিদ্ধ করে রেখেছে আমাকে।অনিচ্ছা সত্বেও উনার থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছি না।
আমার দুগালে হাত রেখে নিচু গলায় বলে উঠলেন,

‘ তখনকার কথাগুলোর জন্য আমি একটুও কষ্ট পাইনি।তোর উপর রাগও করিনি।তুই এরচেয়েও খারাপ কিছু বললেও সেসব আমি গায়ে মাখতাম না।কারণ হিসেবে একটা কথাই বলব। যা ইচ্ছা কর আমার সাথে শুধু আমার থেকে দূরে যেতে পারবি না।এই শর্তের বাইরে গেলে তুই খুন হয়ে যাবি।আমি সব মেনে নেব কিন্তু দূরত্ব না।’

আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনে যাচ্ছি।আমার দৃষ্টি এখনো উনার উপর নিবদ্ধ। উনার দুচোখের মাতাল চাহনি জানান দিচ্ছে আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসার গভীরতা।চুম্বকের মতো টানতে টানতে আমাকে সেই ভালোবাসার সমুদ্রে ডুবাতে চাইছে।উনার ঠোঁটের মুচকি হাসিতে ফুটে উঠছে অজস্র প্রেমের আভাস।এবারের যাত্রায় আমি বোধ হয় দুর্জয় নামের ব্যক্তিটিতে বাজেভাবে ফেঁসেই গেলাম।
মাথা নামিয়ে ফেললাম আমি।
দুর্জয় ভাইয়া কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন,

‘ একবার ভালোবাসি বল না!’

আমি চমকে উঠলাম।উনার কন্ঠের আকুলতা স্পষ্ট টের পাচ্ছি। কিন্তু আমার অস্থিরতা তিনগুন বেড়ে গেছে।মনের ভেতর অনুভূতি গুলো সব জট পাকিয়ে যুদ্ধে নেমেছে।কেমন যেন অসহায় লাগছে।ভালোবাসি বলা কি এতই কঠিন?চার অক্ষরের একটা শব্দ অথচ এর গভীরতা যেন বিশাল।
দুর্জয় ভাইয়া ফিক করে হেসে ফেললেন।অবাক হয়ে তাকাতে আমার গাল টেনে বলতে লাগলেন,

‘ তুই এত সহজে ভালোবাসি বলবি না জানি আমি।আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস কিন্তু সেটা স্বীকার করতে নারাজ তাই না?ঠিক আছে আমিও অপেক্ষায় থাকি কবে তুই ধরা দিবি আমার কাছে।দেখিস বেশি দেরি করিস না কিন্তু। আমার দিকটাও একটু ভেবে দেখ।তোর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নাস্তানাবুদ আমি!’

দুর্জয় ভাইয়ার হাসি দেখে আমিও স্বাভাবিক হয়ে আসলাম।এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কেউ আমার গলা চেপে ধরে আছে।নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না ঠিকমতো।

ঘুমে চোখ বুজে আসছে এমন ভান ধরে বললাম,
‘ আমাকে ঘুমাতে হবে এখন।আপনি যেভাবে এসেছেন সেভাবেই আবার চলে যান।তবে সাবধান! রাস্তার পাহারাদার গুলো যেন চোর ভেবে আপনাকে ধোলাই না দেয়।যদি ধোলাই খেয়েও থাকেন তো সমস্ত দায় আপনার।’

রুমের দিকে পা বাড়াতেই দুর্জয় ভাইয়া খপ করে আমার হাত ধরে ফেললেন।ঘাড় ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকালাম আমি।
উনি ঠোঁট কামড়ে বললেন,
‘ আবারো পালাতে চাইছিস?পূর্ণতা তুই কিন্তু ভীষণ আনরোমান্টিক!ওয়েদারটা কি চমৎকার দেখ।প্রেম করার জন্য একেবারে পারফেক্ট।এই যে আমি এত কষ্ট করে আধাঘন্টার রাস্তা পনেরো মিনিটে পার হয়ে এসেছি,তোদের বাড়ির দেয়াল টপেকছি এসবের জন্য আমার পারিশ্রমিক কই?’

‘ মানে?আমি আপনাকে কি পারিশ্রমিক দেব?’

‘ দাঁড়া প্র্যাক্টিক্যালি বুঝিয়ে দিচ্ছি। ‘

দুর্জয় ভাইয়া আমার দিকে এগুতে নিলে হঠাৎ রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো।এবার আমার প্রাণপাখি উড়ে যাবার জোগাড়।ভীত সঙ্কিত হয়ে দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনার কপালও কুঁচকে গেছে।

বিড়বিড় করতে করতে বললাম,
‘ আমি তো আজ খতম।নিশ্চয়ই বাড়ির কেউ আমাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছে।আমার এখন কি হবে দুর্জয় ভাইয়া?এতরাতে আপনাকে আমার বারান্দায় দেখলে কি হবে ভাবতে পারছেন?’

দুর্জয় ভাইয়া নিচুস্বরে ধমকে উঠে বললেন,
‘ পাগলের প্রলাপ বকছিস কেনো?যা গিয়ে দরজাটা খোল।কেউ কিছু টের পায়নি।স্বাভাবিক থাক।’

‘ টের পায়নি মানে?অন্যদিন এই সময়ে আমার রুমে কেউ আসে না।বেছে বেছে আজকেই কেনো আসবে?আপনি তাড়াতাড়ি পালান প্লিজ!’

‘ রিল্যাক্স।তুই আগে দরজা খোল যা।আমি চলে যাচ্ছি।’

আমি ঝটপট চলে এলাম রুমে।দরজা খুলতে গিয়েও আবার চলে এলাম ড্রেসিং টেবিলের সামনে।হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে চটজলদি দরজা খুলে উঁকি মারলাম।মা দাঁড়িয়ে আছে।
নিজেকে যথাসম্ভব নরমাল রেখে কৃত্রিম হাই তুলে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ মা এত রাতে? কি হয়েছে?’

মা বাইরে থেকেই কেমন যেন চিন্তিত হয়ে বলল,
‘ কিছু না।ঘুম ভেঙে গেল তাই ভাবলাম তোকে দেখে যাই।’

মায়ের অগোছালো কথাবার্তা শুনে সন্দেহ হলো।মুখটাও কেমন শুকনো লাগছে।
‘ সত্যি করে বলো তো মা কি হয়েছে?বাবার শরীর খারাপ করেছে নাকি?’

‘ তোর বাবা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আসলে তোর খালামণি কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়েছিল।বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম।ভেবেছি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল নাকি।আপা বলল দুর্জয় নাকি বাড়িতে নেই।ফোনও ধরছে না।রাতে খেয়ে দেয়ে রুমে গেছে ঘুমাতে।এরপর অহনা নাকি কি একটা দরকারে দুর্জয়ের রুমে গিয়ে দেখে রুম ফাঁকা।সমস্ত বাড়ি খুঁজে ফেলেছে ছেলেটা কোথাও নেই।আপা তো টেনশনে অস্থির হয়ে গেছে।ফোনে কেঁদেও দিয়েছে।’

আমি কয়েক সেকেন্ডর জন্য হতভম্ব হয়ে মা’র দিকে চেয়ে রইলাম।ব্রেইন আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে এখনই খিলখিল করে হেসে উঠ তুই পূর্ণী।বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখলাম।কপালে চিন্তার ভাঁজ তুলে বললাম,

‘ আশ্চর্য লোক তো উনি!কাউকে না বলে কোথায় চলে গেলেন?বন্ধু বান্ধবদের সাথে যাননি তো আবার?খালামণিকে ভালো করে জিজ্ঞেস করেছো?’

‘ নারে বন্ধুদের সাথে যাবে না এতরাতে।এমন ছেলে সে নয়।যাই হোক।আমি আরেকটু পর আপাকে কল করে জিজ্ঞেস করব।তুই ঘুমিয়ে যা।ঘুম ডিস্টার্ব হলে সকালে উঠে বলবি মাথা ধরেছে।’

‘ আচ্ছা মা।’

বাধ্য মেয়ের মত মাথা নেড়ে দরজা আটকে দিলাম।মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যাচ্ছে আমার।
কোনোরকমে বারান্দায় গিয়ে উঁকি মারতে দেখি দুর্জয় ভাইয়া দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।পাশ ফিরে আমাকে এভাবে হাসতে দেখে আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ পূর্ণতা কিরে হাসছিস কেনো?দরজায় কে নক করেছিল?’

উনার চোখেমুখে বিস্ময় যা দেখে আমার আমার হাসির বেগ আরো বেড়ে গেল।
‘ মা ছিল।আপনাকে খুঁজে না পেয়ে খালামণি বোধ হয় এতক্ষণে থানায় ডায়রী করে ফেলেছেন।তাড়াতাড়ি গিয়ে উনাদের ঠান্ডা করুন আগে।’

দুর্জয় ভাইয়া চকিতেই আমার হাসি এবং কথার অর্থ বুঝে ফেলেছে।কোট এবং জিন্সের পকেট হাতড়ে হাতড়ে বললেন,

‘ ফোনটা…শিট! ফোনটা গাড়িতে রয়ে গেছে।মা নিশ্চয়ই অনেকগুলো কল করেছে।পূর্ণতা আমি যাই এখন।কাল দেখা হবে।ক্লাস শেষে অপেক্ষা করিস।’

দুর্জয় ভাইয়া তাড়াহুড়ো করে রেলিং পেরিয়ে নিচে নেমে গেলেন।উপর থেকে মাথা ঝুকিয়ে দেখলাম উনি চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে ধীরে ধীরে মিশে গেলেন আবছা অন্ধকারে।সেদিকে তাকিয়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।এই লোকটা আমাকে ভালোবাসে এটা ভাবতেই মনের ভেতর দিয়ে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়।হাজারটা ভালোলাগা ঘিরে ধরে আমাকে।একদম আলাদা একটা অনুভূতি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here