তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২২,২৩

0
604

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২২,২৩
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২২

ফোনের এলার্মের মিহি একটা সুরে ঘুম ভাঙলো আমার।অন্যদিন হলে অলসতার বশবর্তী হয়ে বিছানায় শুয়ে আরো কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেতাম।আজ তা হবে না।চটজলদি উঠে বিছানা পরিপাটি করে নিলাম।বারান্দায় এসে দেখি সূর্য উঠি উঠি করছে তবে চারপাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে।
ওয়াশরুমে গিয়ে ঝটপট গোসল শেষ করে এসে মেলে দিলাম ভেজা চুলগুলো।এখন ড্রেস চুজ করার পালা।কাবার্ডের দরজা টানতেই নজরে আসলো সারিসারি হ্যাঙারে ঝুলানো জামাকাপড়। প্রত্যেকটা তাক গোছগাছ করা।কেউ দেখলে হয়তোবা ভাবতে পারে আমার মতো পরিপাটি মেয়ে খুঁজে পাওয়া বিরল। আসলে এগুলো সব মায়ের হাতে গুছানো।আমি তো বরাবরই এলেমেলো। কাবার্ড থেকে একটা কুর্তি এবং জিন্স বের করে নিলাম।পিকনিকে যাওয়ার জন্য এগুলো পারফেক্ট। সকাল সাড়ে সাতটায় ভার্সিটির গেইটে সকলের উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে।এখন ঘড়ির কাঁটা ছ’য়ের ঘরে।
দ্রুত ড্রেস পাল্টে ভেজা চুলগুলো হালকা আঁচড়ে নিলাম।চোখে গাঢ় কাজল টেনে কানে ঝুলিয়ে দিলাম ছোট সাইজের একজোড়া ঝুমকা।ঠোঁটে গোলাপী ম্যাট লিপস্টিক ঘষে তীক্ষ্ণ চোখে নিজের আপাদমস্তক দেখতে লাগলাম।একটা জিনিসের কমতি লাগছে।ড্রয়ার খুলে চমশাটা বের করে চোখে গলিয়ে দিলাম।যদিও চশমা সবসময় ব্যবহার করি না। বেশিরভাগ বাইরে গেলেই পড়া হয়।
নিজেকে আয়নায় দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললাম,
‘ চাশমিস পূর্ণী! নাউ ইউ আর লুকিং পারফেক্ট।’

ড্রয়িংরুমে পৌঁছাতে দেখি মা আমার জন্য টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে। অন্যদিকে বড়মা সিড়ি ঝাড়ু দেওয়ায় ব্যস্ত।আমাকে দেখতে পেয়ে হাসল সামান্য। বিনিময়ে আমিও একটা হাসি উপহার দিয়ে বসে পড়লাম টেবিলে।এবার মা খুলে বসল তাঁর উপদেশ বাণীর ঝুড়ি।

‘ শোন পানিতে বেশিক্ষণ থাকবি না।ভেজা জামাকাপড় খুব তাড়াতাড়ি বদলে ফেলবি।এক্সট্রা জামা নিয়েছিস তো?বাকি মেয়েদের ছেড়ে একা কোথাও পা বাড়াবি না।দুপুরের লাঞ্চ কিন্তু টাইমলি করতে হবে।আমি দুর্জয়কে…….’

মা আচমকা থেমে গেলেন।আমি চোখ সরু করে তাকালাম মায়ের দিকে।এতক্ষণ মাথা হেলিয়ে সবগুলো বাণী হজম করছিলাম আর মেসেঞ্জারে বান্ধবীদের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম।হঠাৎ দুর্জয় নামটা শুনে থেমে যেতে হলো।মা উনাকে নিয়ে কি বলতে যাচ্ছিল?ডাল মে কুচ তো কালা হ্যায়!
আমার সন্দেহজনক দৃষ্টি উপেক্ষা করে মা বলে উঠলেন,
‘ আসল কথা তো বলাই হয় নি।মেডিসিন গুলো সাথে নিয়েছিস তো?’

আমি স্যান্ডউইচে গভীর করে কামড় দিয়ে বললাম,
‘ সব নিয়েছি। কিন্তু দুর্জয় ভাইয়াকে নিয়ে কি বলতে যাচ্ছিলে?বাক্যটা সম্পূর্ণ না করে থেমে গেলে কেনো?’

‘ বলছিলাম যে বাসে উঠে দুর্জয়কে একটা ফোন দিয়ে দিস।সে জিজ্ঞেস করেছিল আর কি কখন যাবি, বাস কখন ছাড়বে।আচ্ছা থাক আমিই না হয় ওকে বলে দেব।’

আমার সন্দেহ এখনো কাটেনি।কাহিনী কি!ওই লোক আবার খিচুড়ি পাকাতে ব্যস্ত হয়ে যায়নি তো!উনাকে নিয়ে অলওয়েজ আমাকে তটস্থ থাকতে হয়।বিনা নোটিশে খিচুড়ি পাকানো শুরু করে দেয় যখনতখন। আমার জীবনে আসার পর থেকে উনাকে শুধু এই একটা কাজ করতেই দেখি।তবে গত দুদিন তো উনার সাথে কথা হয়েছে টুকটাক। কই তেমন কিছু গড়বড় মনে হয় নি।
নাস্তা শেষ করতে করতে বাড়ির সবাই উঠে গেল।বড়আব্বু, আব্বু এবং ইমন ভাইয়া একসাথে জগিং করতে যাচ্ছে। আমি সবাইকে গুডমর্নিং জানিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠলাম।ইমন ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল,

‘ পতেঙ্গা জায়গাটা সুন্দর। ভালো করে ইনজয় করিস।বিচের কাছাকাছি একটা পার্ক আছে না কি যেন নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।দেখলি সকাল সকাল আমার ব্রেইন কমজোর হয়ে পড়ে।বয়স-টয়স বেড়ে যাচ্ছে বোধ হয়।যাইহোক ওই পার্কটায় ঘুরতে যেতে পারিস। খুব সুন্দর জায়গা।’

সবার থেকে বিদায় নিয়ে একটা অটো ধরে চলে এলাম ভার্সিটি গেইটে।এখনো সাড়ে সাতটা বাজেনি।এরমধ্যেই গেইটে অনেকেই জড়ো হয়ে গেছে।হিমু আমাকে দেখতে পেয়ে হাত উঁচিয়ে ডাকল।আমার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটল।এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি পিকনিকে যাচ্ছি।মনে মনে দুর্জয় ভাইয়াকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে দিলাম।

‘ কিরে গ্রুপের বাকিরা কোথায়?শেষ সময়ে এসে না যাওয়ার জন্য বেঁকে বসেনি তো!’

হিমু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
‘ না গেলে ওদের আমি থাবড়াতে থাবড়াতে বাঁকিয়ে ফেলব।আমার মনে হয় সব কটা মেকাপ কিট নিয়ে মুখে ঘষাঘষি করছে।ছেলে ভুলানোর ধান্দা নিয়ে ঘুরে সব।’

‘ কি যে বলিস।ওরা শুনতে পেলে তোর হাড্ডি মুচড়িয়ে চুরচুর করে দেবে।বিশেষ করে ঈশিতা!’

‘ আরে ধুর।ও উপর দিয়েই যা মেজাজ দেখায় আসলে ভেতরে কিচ্ছু নেই। একটা ধমক দিলেই টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি যাবে।’

‘ হয়েছে।তোর আর এমন বীরমহিলার মত ভাষণ দিতে হবে না।চল ওরা আসার আগেই আমরা ভালো সিট বেছে বসে পড়ি।’

‘ দ্যাটস্ অ্যা গুড আইডিয়া বেবি!লেটস্ গো! ‘

দুনম্বর বাসে উঠে আমরা পুরোটা দেখেশুনে যুতসই সিট খুঁজে পেয়ে গেলাম।হিমু কিছু বলার আগেই আমি বলে বসলাম,
‘ জানালার পাশের সিট কিন্তু আমার।জানালার সাথে বসে বাস জার্নি আমার কাছে সেই লাগে!আহা!’

হিমু ভীষণ অনিচ্ছায় বলে উঠল,
‘ যা যা বোস।রোগী মানুষের কথা না শুনলে পাপ হতে পারে।’

আমি হিমুর মাথায় একটা গাট্টা মেরে সিটে আরাম করে বসলাম।
আধাঘন্টার ভেতরই সমস্ত বাস ছেলেমেয়েদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।আমাদের গ্রুপের সবগুলোই হাজির।সবার সাথে হাসিঠাট্টার মাঝেই বাস ছেড়ে দিল।পুরো বাসে ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।কিছুক্ষণের মধ্যেই মিডিয়াম ভলিউমে ডিজে গান বেজে উঠল বাসে।গানের উৎস কোথায় সেটা খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলাম কিন্তু গানের তালে কেউ কেউ সিটে বসে থেকেই হাত উঠানামা করে নাচছে এটা দেখে হাসি থামাতে পারছি না।আমি তো আর ভালো করে নাচতে পারি না তাই একটু আফসোসও হচ্ছে। আজ নাচতে পারলে ওদের মত হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে লাফাতে পারতাম।কিন্তু হাততালি তো দিতে পারি।হাততালিও একপ্রকার নাচের মধ্যেই পড়ে।অনেক জায়গাতেই দেখেছি যারা নাচতে পারে না তারা হাততলি দিয়ে সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করে ফেলে।আমারও এখন এই অবস্থা। ?

হঠাৎ হিমু আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল,
‘ এই জানালা দিয়ে একটু বাইরে তাকা।দু দুটো হ্যান্ডসাম হিরো।আমাদেরকেই দেখছে মনে হচ্ছে। ‘

আমি হিমুর কথা অগ্রাহ্য করে একপলকের জন্যও বাইরে দেখলাম না।জানি বখাটে ছেলে হবে যারা বাসে মেয়ে দেখে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে।হাড়ে হাড়ে চিনি এসব ছেলেদের।

‘ এই তুই না বাসে উঠার আগে বলেছিলি বাকি মেয়েরা ছেলে ভুলানোর ধান্দায় থাকে।এখন তাহলে তুই বাইরে ছেলেদের কেনো দেখছিস?’

‘ আরে ছেলে ভুলানো আর হ্যান্ডসাম ছেলে দর্শন করা এক হলো নাকি?দেখ না একবার কি সুন্দর বাইকে উড়ে উড়ে বাসের সাথে চলছে।তুই এবার আমার সিটে বোস প্লিজ! আমার এখন জানালার পাশে বসতে শখ জেগেছে।’

‘ রাগ উঠাস না হিমু! তোর শখ জাগার উদ্দেশ্য যে কি তা আমি ভালো করেই জানি।এবার দেখ কি করি!’

আমি তিক্ত বিরক্ত হয়ে জানালার গ্লাস লাগাতে উদ্যত হলাম।তখনই নিজের অজান্তে বাইকে বসা দুজন ব্যক্তির দিকে চোখ চলে গেল।উনাদের দেখে ভিড়মি খাবার জোগাড়।গ্লাস লাগানোর কথা ভুলে গিয়ে থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলাম বাইরে।বাইকে বসা দুজন হলেন দুর্জয় ভাইয়া এবং তুষার ভাইয়া।দুর্জয় ভাইয়া ঠোঁটে মনভুলানো হাসি ঝুলিয়ে রেখে বাইকের ড্রাইভারের দায়িত্ব পালন করছেন।উনার চোখে কালো সানগ্লাস।গায়ের ব্রাউন কালারের শার্ট বাতাসের কারণে শরীরে সেঁটে আছে।তুষার ভাইয়া আমাকে দেখতে পেয়ে হাত উঁচিয়ে ডাকলেন।আমি অপ্রস্তুতের মত কিছুটা হাসলাম।উনাকেও দেখতে দুর্জয় ভাইয়ার মত লাগছে যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই বহুদিন পর একত্র হয়েছে।মানতে হবে হিমুর হ্যান্ডসাম বলার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু উনারা কোথায় যাচ্ছেন? আমাকে আবার ফলো করছে না তো!

পাশ থেকে হিমু উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ কিরে কিরে পেছনের জন তোকে ইশারা করল যে?চিনিস উনাকে?’

আমি বিরসমুখে বললাম,
‘ চিনি।তুষার ভাইয়া।উনার দিকে তোর নজর দিয়ে লাভ নেই।উনার সুন্দর ফুটফুটে একটা বউ আছে।’

হিমুর মুখ ঝুলে পড়ল।কিন্তু পরক্ষণেই আনন্দিত হয়ে বলতে লাগল,
‘ সামনের জন?উনাকে চিনিস তো?উনি তো সিংগেল নাকি?’

‘কে? দুর্জয় ভাইয়া?ওই লোক তো আরো একধাপ উপরে।দু’দুটো বিয়ে করে বসে আছে।শুনেছি আসছে বছর আরো একটা বিয়ে করার অপেক্ষায় আছে।’

‘ মাই গড! আজকালকার ছেলেরা এমন কেন বলতো!বাইরে দিয়ে তামিল মুভির হিরোদের লুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অথচ ভেতরের রেকর্ড জঘন্য! এসব ছেলেরা মেয়ে ভুলানোর ধান্দা নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়।এই তুই জানালাটা লাগিয়ে দে তো।আমার আর ইন্টারেস্ট নেই।’

হিমু মুখ ঘুরিয়ে গানের তালে অঙ্গভঙ্গি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।আমি আড়চোখে দুর্জয় ভাইয়াকে দেখতে চেষ্টা করলাম।উনি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকাননি।অথচ বাসের সাথে গতি ঠিক রেখে বাইক চালাচ্ছেন। এখন বুঝতে পারছি সেদিন মা কেনো উনার কথায় রাজি হয়েছিল।উনি আমার পেছন পেছন পাহারা দিতে চলে আসবেন এটা সম্পর্কে মাও অবগত।উফ্ এদের নিয়ে আর পারা যায় না।

চলবে…

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৩

গন্তব্যে পৌঁছাতে সবাই নেমে পড়লাম বাস থেকে।দুটো বাসের ছাত্র ছাত্রী একসাথে হওয়াতে একধরনের জটলার সৃষ্টি হয়ে গেছে।আমি সেই জটলার এক কোণায় দাঁড়িয়ে চারপাশে আমার পাহারাদার দের খুঁজে চলেছি।কোথায় গেল ওরা এবং ওদের বাইক।এখানেই তো আসার কথা কারণ আমি জানি দুর্জয় ভাইয়া আমাকে নজরে নজরে রাখতেই প্ল্যান সাজিয়েছেন।
টের পেলাম পিকনিকে আসার আনন্দটা আর তেমনভাবে মনে কাজ করছে না।আমার চোখ শুধু দুর্জয় ভাইয়াকে খুঁজে চলেছে।ভয় যদি উনি আমার বান্ধবীদের সামনে এসে কথাবার্তা বলা শুরু করে তখন তো সমস্যায় পড়তে হবে।আমার বান্ধবীদের তো চিনি আমি।ছেলেখোর সবগুলো।উনাদের মত সুদর্শন ছেলে দেখলেই হামলে পড়তে চাইবে।তারউপর যদি দেখে উনারা আমার পরিচিত তাহলে সব চোট যাবে আমার মত নিরীহ একটা মেয়ের উপর দিয়ে।এক্কেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা।
ক্ষণিকের মধ্যেই দুর্জয় ভাইয়া এবং তুষার ভাইয়ার দেখা মিলল।আমাদের বাস থেকে কিছুটা দূরে উনাদের বাইক থামানো।আমি পার্স থেকে ফোন বের করে দুর্জয় ভাইয়ার নাম্বারে ডায়াল করলাম।চোখ এখনো উানর উপরেই তাক করা।উনি ফোন হাতে নিয়ে দূর থেকে আমার দিকে তাকালেন।রিসিভ করার সাথে সাথে বলে উঠলাম,
‘ আপনারা এখানে কেনো?আমার পিছু পিছু কেনো এসেছেন?’

দুর্জয় ভাইয়া ধমকে উঠে বললেন,
‘ তুই কি রানী ভিক্টোরিয়া যে তোর পিছু পিছু চলে আসব?তুই তোর মত ঘুরতে এসেছিস আমি আমার মত।দুটো ঘটনা টেনে টেনে একসাথে করার চেষ্টা করছিস কেনো?’

সকাল সকাল এমন ধমক খেয়ে আমার মনটা বিষিয়ে উঠল।তার থেকেও বেশি রাগ উঠছে উনার কথা শুনে।আমাকে নজরে রাখার জন্যই এখানে এসেছে অথচ স্বীকার করতে চাইছে না।ভাঙবে তবু মচকাবে না। অসহ্য লোক একটা।উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করাই বৃথা।তারচেয়ে মূল কথাটা বলে কল কেটে দেই।

‘ শুনুন! আপনি যেহেতু আপনার মত ঘুরতে এসেছেন তাহলে আমার সাথে সামনাসামনি কোনোরকম কথাবার্তা বলবেন না।দূরে দূরে থাকবেন।আমার বান্ধবীরা দেখলে আমাকে ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউ দিতে হবে ওদের কাছে।তাই…’

‘ থাম।আমার তো বয়েই গেছে তোর সাথে কথা বলতে।ফোন রাখ।’

আমাকে ফোন রাখতে বলে নিজেই রেখে দিলেন।বাপরে আজ মনে হচ্ছে উনার মেজাজ বিগড়ানো। কেমন কাঠ কাঠ গলায় কথা বলছে।হাহ্ আমারও কি ঠেকা পড়েছে উনার ধমক শুনার?যা ইচ্ছা করুক শুধু আমার থেকে দূরে থাকলেই হলো।

.

সমুদ্র সৈকতের এলোমেলো ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে শায়িত খন্ড খন্ড চারকোনা পাথরগুলোর উপর।তীর ঘেঁষে মানুষজন সমুদ্র বিলাস করছে।কেউ আবার পানিতে নেমে ঢেউয়ের স্পর্শ নিচ্ছে। সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট বড় জাহাজ এবং পর্যটকদের বিনোদনের জন্য স্পিডবোট।
এই মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তীরে বিছানো প্রস্তর খন্ডগুলোর পাশে।আমার বন্ধু মহলের বেশিরভাগই ব্যস্ত হয়ে গেছে ছবি তোলা নিয়ে।এসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই।প্রকৃতির সব সৌন্দর্য আমি চোখ দিয়ে,মন দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি।বরাবরই আমার সমুদ্র ভালো লাগে।পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে নজর দিলে যেন হারিয়ে যাই কোথাও।তখন সমুদ্রটাকে মনে হয় পৃথিবীর বুকে বিছানো কোনো পাতলা স্বচ্ছ পর্দা যা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে।জানান দিচ্ছে তাঁর কম্পিত ছোট বড় ঢেউয়ের স্পন্দন!

দলের অনেক ছেলেমেয়েই উদ্যোগ নিল স্পিডবোটে উঠার।পতেঙ্গা এসে স্পিডবোটে না চড়লে নাকি কোনো আনন্দই পাওয়া যায় না।এইক্ষেত্রে আমি আবার একটু ভীতু।হাস্যকরও বটে।সমুদ্র ভালোবাসি অথচ সমুদ্রের বুকে চড়ে বেড়াতে ভয় পাই।আমার দেখাদেখি হিমু,ইশিতা এবং সুস্মিতা ওরাও উঠল না।চারজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম স্পিডবোট গুলো কিভাবে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটে যাচ্ছে।
হঠাৎ ঈশিতা বলে উঠল,
‘ এই চল ওরা আসার আগে আমরা কিছুক্ষণ সমুদ্র স্নান করে নেই।চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে আর আমরা একটুও পানি গায়ে মাখব না তা কি করে হয়!চল সবাই।’

হিমু সুস্মিতা সায় দিল।ওরা ঝটপট জিন্স মুড়ে কিছুটা উপরে তুলে ফেলল।আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ যাবি না?’

‘ অফকোর্স! ‘

ওদেরকে ডিঙিয়ে আমি পানিতে হাটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে দিলাম।হঠাৎ দুর্জয় ভাইয়ার কথা মনে হতে চারদিকে নজর বুলালাম। উনাদের টিকিও দেখা যাচ্ছে না।অগুনতি মানুষের ভীড়ে উনাদের খোঁজা আর খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজা একই ব্যাপার।তাই এসব বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম।এবার প্রায় কোমর সমান পানি।মৃদু মৃদু ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে গায়ে।ঢেউয়ের সাথে আমরাও দুলছি।ঈশিতা পাশ থেকে মুঠোভরা পানি ছুড়ে মারল আমার দিকে।রাগী চোখে তাকাতেই হিমু এবং সুস্মিতাও একই কাজ করে বসল।ওরা হাসছে কিটকিট করে।আমি দুহাত কোমড়ে রেখে বললাম,

‘ ঠিক আছে আমিও দেখাচ্ছি মজা।’

এটা বলেই সমস্ত শক্তি দিয়ে ওদের তিনজনের দিকে পানি ছুড়তে লাগলাম।ওরাও কম যায় না।একে অপরের দিকে পানি ছুড়ে চারজন মেতে উঠলাম জলকেলি খেলায়।একপর্যায়ে পিছন থেকে আচমকা কারো ধাক্কা লেগে আমার পা ফসকে গেল।পাশে ঈশিতার হাত ধরতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম।ক্ষণিকের মধ্যে অনুভব করলাম আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছি পানির ভেতর।ভয়ে এবং আতঙ্কে আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম।ওদের সাথে পানি নিয়ে দুষ্টুমি করতে করতে আগের চেয়েও সামনে চলে গেছিলাম যেখানে পানি কোমড় ছাড়িয়ে আরো উপড়ে উঠে গেছিল।সাথে ঢেউ মৃদু থেকে হচ্ছিল গাঢ়।তাই পা পিছলে পড়ে যাওয়াতে আর শরীরের ব্যালেন্স রাখা সম্ভব হচ্ছে না।শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে আমার।মনে হচ্ছে ঢেউয়ের ধাক্কায় আরো গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি।হাত-পা ঝাপটিয়ে উপরে দিকে উঠার চেষ্টা করছি কিন্তু শরীরের সব শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে।হাত বাড়িয়ে কোনোকিছু আকড়ে ধরতে চাইছি বাঁচার জন্য কিন্ত সবকিছু অসাড় হয়ে আসছে আমার।একটু অক্সিজেন পাওয়ার আশায় বুক চিড়ে ফুসফুস বেরিয়ে আসতে চাইছে।নিজের মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি আমি।একমুহূর্তের জন্য চোখের সামনে দুর্জয় ভাইয়ার হাসিমাখা চেহারাটা ভেসে উঠল।উনাকে তো বলাই হলো না আমার ভালোবাসার কথা!

হঠাৎ টের পেলাম বলিষ্ঠ কোনো হাত শক্ত করে আমার বাহু চেপে ধরেছে। পরক্ষণেই সূর্যের আলো এসে হানা দিল আমার চোখেমুখে। পিটপিট করে তাকাতে দেখলাম আমি পানির উপরে অবস্থান করছি।আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন দুর্জয় ভাইয়া।উনাকে দেখতে পেয়ে আমার কান্না উপচে আসল।কিছু বলতে যেয়েও পারলাম না কারণ আমার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রচন্ড গতিতে উঠানামা করছে।পৃথিবীর সব অক্সিজেন যেন শরীর টেনে নিতে চাইছে।আমি নিশ্চিত আর কিছুক্ষণ পানির নিচে থাকলে এক অসহনীয় যন্ত্রণার মৃত্যুকে বরণ করতে হত।দুর্জয় ভাইয়া শক্ত করে আগলে আমাকে তীরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন।তখনই বুঝতে পারলাম ঢেউয়ের ধাক্কায় আমি কতটা দূরে চলে এসেছি।দুর্জয় ভাইয়া কিভাবে খুঁজে পেলেন আমায়?

উপরে এসে একটা পাথরের সাথে হেলান দিয়ে বসলাম।এবার যেন শরীরে কিছুটা বল পাচ্ছি। পূর্ণদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম।আমাকে ঘিরে হিমু,ঈশিতা, সুস্মিতা এবং তুষার ভাইয়া।সাথে আরো অচেনা কিছু মানুষজন।দুর্জয় ভাইয়া আমার বরাবর হাঁটু মুড়ে বসে আছেন।উনার দুচোখ ভীষণ লাল হয়ে আছে।সমস্ত শরীর ভিজে একাকার।এত হট্টগোলের মাঝেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি উনার চোখ টলমল করছে। উনি কি কান্না করেছেন নাকি দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকার দরুন এ অবস্থা হয়েছে।উনি নিষ্পলক ভাবে করুণ চেহারা নিয়ে দেখছেন আমায়।
তুষার ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তুমি ঠিক আছো পূর্ণতা?কষ্ট হচ্ছে? হসপিটাল নিতে হবে?’

আমি ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলাম,
‘ হসপিটালে যেতে হবে না ভাইয়া।’

আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুর্জয় ভাইয়া হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।আমি ভীত চোখে তাকালাম উনার দিকে।উনার মুখের করুণ ভাব বদলে সেখানে স্থান করে নিয়েছে অজস্র রাগ।
হিমু,ঈশিতা এবং সুস্মিতার দিকে রক্তাক্ত চাহনি দিয়ে ধমকে উঠলেন,
‘ চারজনের মধ্যে একজন চোখের সামনে পানির নিচে হারিয়ে যাচ্ছিল আর তোমরা হা করে দেখলে সবটা!ইডিয়টস! আজ যদি এই মেয়েটার কিছু হয়ে যেত তাহলে আমি শেষ হয়ে যেতাম। ছারখার হয়ে যেতাম। ওর সাথে সাথে আমার চিহ্নও বিলীন হয়ে যেত।’

দুর্জয় ভাইয়া রাগে ফুঁসছেন।আমি কিছু বলতে যেয়েও আটকে যাচ্ছি। শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে।
হিমু নাক টেনে কান্না করতে করতে বলল,
‘ বিশ্বাস করুন ভাইয়া আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওকে টেনে তোলার কিন্তু ঢেউয়ের ধাক্কায় টাল সামলাতে পারিনি।মুহূর্তের মধ্যেই পূর্ণী যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেল।এরপর…’

‘ স্টপ! আর কাউকে কিছু বলতে হবে না।’

দুর্জয় ভাইয়ার ধমক শুনে ওরা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।আমার খুব খারাপ লাগছে। উনি কেনো ওদের বকছেন!ওদের তো কোনো দোষ নেই।ওদের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা ভয় পেয়ে গেছিল।
এমন সময় ভীড় ঠেলে একজন যুবক এসে দাঁড়াল।ছেলেটার চোখে-মুখে কৌতুহল। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চারপাশের অবস্থা পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে এখানে?এই মেয়েটা এভাবে বসে আছে কেনো?আর ওরাই বা কাঁদছে কেনো?’

ছেলেটার কথায় এমন কিছু ছিল যে সবাই আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর দিকে তাকাল।এবার ঘটল আরেকটা অঘটন।কোনো বলা-কওয়া ছাড়া দুর্জয় ভাইয়া তড়িৎ গতিতে ছেলেটার কলার দুহাতে চেপে ধরলেন।বিস্ময়ে এবং আকস্মিকতায় আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল।বাকিদেরও একই অবস্থা। দুর্জয় ভাইয়া কি পাগল হয়ে গেছেন?এত মানুষের সামনে এসব কি সিনক্রিয়েট শুরু করেছেন?

দুর্জয় ভাইয়া চোয়াল শক্ত করে ছেলেটাকে টেনে এনে বললেন,
‘ হাঁটার সময় চোখ কি পকেটে ফেলে রাখিস?রাস্কেল কোথাকার!তোর ধাক্কা লেগে কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়ে মরতে বসেছিল আর তুই এখন জোকারের মত এসে জিজ্ঞেস করছিস কি হয়েছে এখানে!’

দুর্জয় ভাইয়ার ধমক শুনে ছেলেটার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন ভাইয়ার দিকে।কিন্তু সাথে সাথেই দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল,

‘ আশ্চর্য আপনি এভাবে কলার ধরে রেখেছেন কেনো?ছাড়ুন!আমি কি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছি?যত্তসব! লিভ মি!’

ছেলেটার বিরক্তিমাখা কথা যেন দুর্জয় ভাইয়াকে আরো ক্ষেপিয়ে তুলল।উনি এবার ছেলেটাকে মারতে উদ্যত হলে তুষার ভাইয়া এসে পেছন থেকে আটকালেন।দুর্জয় ভাইয়াকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন,

‘ এনাফ দুর্জয়!বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। পরে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেললে ঝামেলায় ফেঁসে যাবি।’

দুর্জয় ভাইয়া দাঁতে দাঁত চিপে বলে উঠলেন,
‘ ছাড় তুষার।এই রাস্কেলটাকে একটা থাপ্পড় অন্তত মারা উচিত।ওর জন্য পূর্ণতার আজকে কিছু একটা হয়ে যেতে পারত!ছাড় আমাকে।’

তুষার ভাইয়া কোনোরকমে দুর্জয় ভাইয়াকে শান্ত করে ভীড় পরিষ্কার করে ফেললেন।আমি এখনো পাথরের উপর চুপচাপ বসে সব দেখছি।পাশ ফিরে দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না।কারণ রাগের কারণে উনার শ্বাস উঠানামার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ উনি আমার হাত চেপে ধরে বলে উঠলেন,

‘ মেইন কালপ্রিট তো তুই।আমি না করেছিলাম না যে পিকনিকে আসার দরকার নেই?বল!কিন্তু তুই কি করলি!আমার কথা অমান্য করে নিজের ইচ্ছেমত চলে আসলি।এখানে এসে যখন আমাকে দেখলি তখন কি যেন বলেছিলি!আমি যেন তোর সামনে না আসি।দূরে দূরে থাকি।তুই মরে ভুত হয়ে যা আর আমি সেটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখি এটাই তো?তোকে থাপ্পড় দিয়ে আবার ওই পানিতে ছুড়ে ফেললে শান্তি লাগত আমার।যা পানিতে ডুবে চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে।উঠ!’

এমন বিশাল ধমক শুনে আমার কলিজা কেঁপে উঠল।ভয়ে একদম সিটিয়ে গেছি। এখন মনে হচ্ছে পানিতে ডুবে মরে যাওয়াই ভালো ছিল।অন্তত উনার এই বিষাক্ত ধমকগুলো শুনা লাগত না।চারদিকের মানুষগুলো কিভাবে যেন দেখছে আমায়।বোধ হয় ভাবছে এতবড় মেয়েটার কোনো প্রেস্টিজ নেই।এতবড় হওয়ার পরেও অনবরত ধমক খেয়ে চলেছে।এসব ভাবতে ভাবতে সবকিছু ভুলে হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here