তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২৬,২৭

0
702

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২৬,২৭
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৬

সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে অহনা আপুর সাথে গল্প জুড়ে দিলাম।গতকাল পিকনিকের ঘুরাঘুরি নিয়েই আড্ডা চলছে।তবে সমুদ্রের পানিতে সেই দুর্ঘটনার কথাটা সতর্কতার সাথে চেপে গেলাম।গাড়িতে দুর্জয় ভাইয়া এবং আমার সেই খুনসুটির মুহূর্তগুলোও এড়িয়ে গেছি।কিছু কিছু আনন্দের মুহূর্ত অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে আলাদা সুখ পাওয়া যায় আবার কিছু আনন্দ মনের ভেতর সযত্নে পুষে রাখার মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পাই আমি। দুর্জয় ভাইয়ার সাথে কাটানো সময়গুলো থাক না মনের ভেতর বন্দী হয়ে!

খালামণি পাশের চেয়ারে বসে আমাদের গল্প শুনে যাচ্ছিল।একপর্যায়ে বলে উঠল,
‘ খাবার খেতে বসে এত কথা কিসের অহনা?পূর্ণী মা তুই আস্তে ধীরে খা তো।এরপর দুজন একসাথে ভার্সিটির জন্য বের হয়ে যাস।’

টেবিলের অপর প্রান্তে বসে খালু খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছিলেন।পেপার থেকে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কি ব্যাপার দুর্জয়ের আম্মু?তোমার ছেলে আজ নাস্তা করতে নিচে আসেনি?’

‘ রাতে বোধ হয় দেরি করে ঘুমিয়েছে।অন্যদিন তো আরো আগে উঠে যায়।আমিও আজ ইচ্ছে করেই ডাকিনি ওকে।’

খালামণির কথা শেষ হতে হতেই দুর্জয় ভাইয়ার আগমন ঘটল।দুহাতে চোখ কচলাতে কচলাতে সিড়ি দিয়ে নামছেন। উনার গায়ে সাধারণ জামাকাপড়। উনি কি আজ অফিস যাবেন না?চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ উনি কুম্ভকর্ণের মত নাক ডেকে সারাদিন ঘুমাবেন।ধুর কোথায় ভাবলাম আমাকে ভার্সিটি দিয়ে আসবে তা না।
দুর্জয় ভাইয়া চেয়ার টেনে বসে পড়লেন আমার পাশে।সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
‘ গুডমর্নিং আব্বু আম্মু,গুডমর্নিং সিস্টার।’

কিছুক্ষণ থেমে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন,
‘ গুডমর্নিং তেজপাতা।’

আমি মাত্রই পানির গ্লাস মুখের সামনে নিচ্ছিলাম আর এমন সময় তেজপাতা নামটা শুনে বড়সড় ধাক্কা খেলাম।কোনোরকমে পানির গ্লাস রেখে মুখ ফুলিয়ে তাকালাম উনার দিকে।খালামণি অহনা আপু খিকখিক করে হাসছে বারবার।এমনকি খালুও বাদ নেই।পেপার সামনে ধরে ওপাশে হাসছে।

‘ এই আপনি আমাকে তেজপাতা কেনো বললেন?’

‘ এছাড়া কি বলব?দিনদিন খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো না করার ফলে শরীরের কি অবস্থা করেছিস দেখ একবার।অনার্স পড়ুয়া মেয়ে অথচ খাওয়া দেখলে মনে হয় টু থ্রিতে পড়া বাচ্চা। ‘

‘ শুনুন আমার পেটে যতখানি জায়গা আছে ততটুকুই তো খাবো নাকি!আশ্চর্য। আপনি নিজের খাবার নিজে খান না।আমার পেছনে কেনো লেগেছেন?’

‘ তোর পিছনে কেনো লাগব?তুই সুপারগ্লু?এভাবে অল্প খেয়ে খেয়ে ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে ফেলছিস।শুকনা পাটকাঠির ট্যাগ লাগিয়ে কেউ তোকে বিয়েও করবে না।তখন কি হবে?’

আমাদের ঝগড়া যখন তুঙ্গে উঠার পালা ততক্ষণে সবাই নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। আমার সেদিকে খেয়াল নেই।ক্ষুব্ধ হয়ে পরোটার টুকরা হাতে নিয়ে পিষে ফেলার চেষ্টা করছি।
খালামণি হাসি থামিয়ে কপট ধমকের সুরে বলে উঠল,

‘ আহ্ বাবু।মেয়েটাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস কেনো?ওর স্বাস্থ্য ঠিকই আছে।হ্যাংলা পাতলা শরীরই ভালো।পূর্ণী তুই চুপচাপ খা তো।ফাজিলটার কথায় কান দিস না।’

আমি দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি দিলাম।তালগাছের মত লম্বা এক হাতি সে নাকি আবার বাবু।কালে কালে কত কি শুনব।আসছে আমাকে তেজপাতা বলতে।আমি একটা ছোট মানুষ হয়ে হাতির মত খাবার খেতে পারি নাকি?নিজে তো খায় হাতির মতো।আমি এখনো একটা পরোটা উল্টেপাল্টে দেখছি আর উনি চেয়ারে বসতে না বসতে দুটো পরোটা গোগ্রাসে খেয়ে আরেকটা ছিড়তে বসেছে।সকাল সকাল উঠেই আমার সাথে ঝগড়া করতে শুরু করেছে।শয়তান লোক!

নাস্তা শেষ করে দুর্জয় ভাইয়া উঠতে যাবেন এমন সময় খালু উনাকে হাত তুলে বসতে বললেন।খালামণির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন।কিন্তু খালামণি নাকচ করে দিয়ে বলল,

‘ তুমিই আগে শুরু করো না!এরপর আমি বলছি।’

দুর্জয় ভাইয়াসহ আমি এবং অহনা আপু কৌতুহল নিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি কিছু শোনার জন্য। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে কোনো সিরিয়াস বিষয় ঘোষণা করতে চলেছেন।খালু তাঁর হাতের পেপার ভাঁজ করে রেখে স্বচ্ছন্দ্যে জিজ্ঞেস করল,

‘ বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছো দুর্জয়?’

এমন এক প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলাম আমি।হঠাৎ একটা অজানা ভয় এসে ঘিরে ধরছে আমায়।খালামণিরা দুর্জয় ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছে তারমানে আমাদের সম্পর্কটা সামনে আসতে চলেছে?
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে আমার।অহনা আপু টেবিলের নিচে আমার হাত ধরে ভয় না পেতে বারণ করলেন।কিন্তু দুর্জয় ভাইয়া?
আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখি উনার মুখ প্রতিক্রিয়া শূন্য। বেশ আয়েশ করে বাটি থেকে প্লেটে সবজি তুলে নিচ্ছেন। আল্লাহ এই লোক প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না কেনো।খালামণি হেসে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করল,

‘ চুপ করে থাকলে হবে?বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিতে হবে না?তোর বিয়ের পরেই না মেয়েটাকে পার করব।’

‘ উফ মা। আমি আগেই বলেছি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করব না।শুধু শুধু আমাকে নিয়ে হৈচৈ করবে না তো।’

অহনা আপু বিরক্তি নিয়ে জবাব দিল।কিন্তু আমি দুর্জয় ভাইয়ার জবাব শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।উনার এমন নিশ্চুপ থাকার অর্থ কি বুঝতে পারছি না।উনি কি ভয় পাচ্ছেন নাকি দ্বিধায় ভুগছেন?
খালামণি এবার বেশ জোর দিয়ে বলে উঠল,

‘ ওমা ছেলে তো দেখি একদম চুপ।কিছু একটা বল।আমরা কিন্তু একটা মেয়ে দেখেছি।দেখতে শুনতে ভালো।আচার-আচরণ মার্জিত।তোর সাথে মানাবে।এখন তুই যদি হ্যাঁ বলিস তাহলে আমরা আগাবো।’

দুর্জয় ভাইয়া নীরব।
খালু তাঁর মোটা চশমার ফাঁক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ দুর্জয়ের আম্মু, মনে হচ্ছে তোমার ছেলের পছন্দের কেউ আছে।মুখে তো কুলুপ এঁটে রেখেছে।’

আমার অবস্থা এবার করুণ।অস্থির হয়ে ডানে-বামে তাকাতে লাগলাম।আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে। কেউ আমাকে হসপিটাল নিয়ে যাও।
হঠাৎ দুর্জয় ভাইয়া মৌনতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন,

‘ আব্বু একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?একবার দেখো আমার পাশের জনকে।এমন কাঁপা-কাঁপি করছে যেন কেউ কারেন্টের শক দিচ্ছে ওকে।আর এই যে তুই বলতে পারছিস না আমি বিয়ে করব তোমাদের ছেলেকে।অলরেডি বউ হয়েই আছি।ইদানীং তো আমার সাথে খুব মেজাজ দেখাস এখন কি হলো হুম?চোখের সামনে আমাকে আরেকটা মেয়ের সাথে বেঁধে দিচ্ছে তাও চুপ করে আছিস!’

দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনে আমি হতভম্ব। খালামণি এবং খালু শব্দ করে হেসে উঠলেন।আমি অদ্ভুত ভাবে তাঁদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় দুর্জয় ভাইয়ার দিকে ফিরলাম।এগুলো কি হচ্ছে আমার সাথে?কিছু না করেও আমি যেন অনেক কিছু করে ফেলেছি।সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে!
পরক্ষণেই মাথা নিষ্ক্রিয় থেকে সক্রিয় হয়ে উঠতেই লজ্জায় মর্মর হয়ে উঠলাম।এরা সবাই সবকিছু জানতো। জেনেশুনেই আমার সামনে এত নাটক করে গেল।হায় খোদা! মাটি ফাঁক হোক আমি ভেতরে ঢুকে যাই।টের পাচ্ছি আমার গালদুটো গরম হয়ে উঠছে।চোখ তুলে সামনে তাকাতেও পারছি না কিন্তু বুঝতে পারছি আমার অবস্থা দেখো সবাই মুখ টিপে হাসছে।

‘ হয়েছে অনেক।মেয়েটাকে আর লজ্জা দিস না তো।অহনা খাওয়া শেষ হলে পূর্ণীকে নিয়ে ভার্সিটি যা।বিয়ে টিয়ে নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে।’

অবশেষে খালামণি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন।আমি ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দুর্জয় ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তে উনি বাঁকা হাসলেন।ইস এত লজ্জা লাগছে কেনো?

চলবে…

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৭

ক্লাস শেষে ভার্সিটির গেইটে এসে দাঁড়ালাম।বিগত একঘন্টা ধরে ভেবে যাচ্ছি এখন খালামণিদের বাসায় ফিরে যাওয়া উচিত নাকি নিজের বাসায়!ভার্সিটি আসার সময় খালামণি বলে দিয়েছে আমি যেন অন্যদিকে না তাকিয়ে সোজা ওখানে চলে যাই।কথা ছিল কয়েকদিন থাকব তাঁদের বাসায়।কিন্তু তা তো হচ্ছে না।খালামণিরা সবকিছু জানে। ওদের সামনে কি করে যাব আমি?লজ্জা লাগে যে ভীষণ।আচ্ছা উনারা কি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠাবে আমাদের বাড়ি?এ কথাটা মনে আসতেই মনের ভেতর উত্তেজনার ঢেউ বইতে লাগল।
এমন সময় দুর্জয় ভাইয়াদের ড্রাইভার হাজির হলো গাড়ি নিয়ে। আমাকে দেখতে পেয়ে হেসে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিল।আমি সহাস্যে বললাম,

‘ চাচা আপনি আমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে চলুন।দুর্জয় ভাইয়াদের বাড়ি যাব না এখন।’

আমার কথায় ড্রাইভার চাচা কিছুক্ষণ চিন্তিত হয়ে বলল,
‘ কিন্তু দুর্জয় বাবা তো ফোন করে বলেছিল তোমাকে যেন তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিই।’

‘ সমস্যা নেই চাচা।আমি ভাইয়াকে জানিয়ে দিব যে আমি নিজের বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। চলুন এখন।’

ড্রাইভার চাচা আর কিছু বলল না।কিন্তু উনার মুখ দেখে বুঝা গেল আমার কথাটা পছন্দ হয়নি।অবশ্য এরও কারণ আছে।অহনা আপু থেকে শুনেছিলাম বাড়ির হাউজ হেল্পার থেকে শুরু করে ড্রাইভার, দাড়োয়ান সবার সাথেই নাকি দুর্জয় ভাইয়ার আন্তরিক সম্পর্ক।উনারাও ভাইয়াকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।ভাইয়ার একেকটা কথা উনাদের কাছে শিরোধার্য।
অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই জানালা দিয়ে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে চাচাকে তাড়া দিলাম গাড়ি থামানোর জন্য। গাড়ি থেকে নেমে পেছনে ছুটে গেলাম মানুষটির সামনে।

‘ জেরিন আপু! কেমন আছো?কতদিন পর দেখা।’

আমার ডাকে আপু হঠাৎ যেন চমকে উঠল।কারণ সে ফোনে কারো সাথে মুখ গম্ভীর করে কথা বলছিল।আমাকে দেখতে পেয়ে কল কেটে কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

‘ আরে পূর্ণী যে।কোথায় যাচ্ছো তুমি?’

‘ বাসায়।তুমি এখন আমাদের বাড়ি যাও না কেনো আপু?সেই যে নানু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার পর আর দেখা পেলাম না।’

‘ ইদানীং কোথাও যেতে মন চায় না।তাই..’

‘ এখন কোথায় যাচ্ছো?চলো আমাদের বাড়িতে।মা তো সেদিনও তোমার কথা বলল।প্লিজ মানা করো না।’

জেরিন আপু কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে রাজি হল।কিন্তু গাড়ির সামনে এসেই হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ এই গাড়িটা তো তোমাদের নয় পূর্ণী?এটা দুর্জয় ভাইয়ার গাড়ি?তোমার নানুবাড়ি থেকে আসার সময় দেখেছিলাম।

‘ ঠিক ধরেছো আপু।আসলে আমি কালরাতে খালামণিদের বাড়িতেই ছিলাম।সুহানা আপু নিশ্চয়ই আমাদের ভার্সিটির পিকনিকের ব্যাপারে বলেছিল তোমাকে!কাল আর বাসায় যাইনি।দুর্জয় ভাইয়ার সাথে একেবারে উনাদের বাড়ি চলে গেছি।’

আমার কথার উত্তরে জেরিন আপু আর তেমন কিছু বলল না।গাড়িতে বসার পরও কেমন শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকল।তবুও আমি নিজে থেকে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে গেছি কিন্তু আপু তাঁর জায়গায় অটল থেকে নীরব হয়েই থাকল।
বাড়ি পৌঁছে ভেতরে পা রাখতেই মনে হলো না জানি কতযুগ এখানে এসেছি।ড্রয়িংরুমে মা সোফার কুশন ঠিক করছিল।আমাদের দেখতে পেয়ে বিস্তৃত হাসল।আমি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম মাকে।গত কয়েক ঘন্টায় মায়ের আদরগুলো ভীষণ মিস করেছি।ততক্ষণে বড়মা এবং সুহানা আপুও চলে আসলো।আমাকে ছেড়ে এবার সবাই জেরিন আপুর আদর আপ্যায়ন শুরু করল।
আমি একপলক সকলের হাসিমুখ গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।দরজা খুলে ঢুকতেই মনটা সতেজ হয়ে উঠল।কি সুন্দর সাজানো গোছানো প্রত্যেকটা আসবাবপত্র। উফ্ আমার মায়ের জবাব নেই! হাত-পা মেলে তুলতুলে বিছানায় শুতে গেলাম তখনি মোবাইল বেজে উঠল।হাতে নিয়ে দেখি দুর্জয় ভাইয়ার কল।মাই গড এতক্ষণে বোধহয় উনার কানে খবর চলে গেছে যে আমি এখানে চলে এসেছি।এখন কল রিসিভ করলেই ইয়া বড় বড় ঝারি খেতে হবে।শয়তানি হাসি দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট মুডে দিয়ে বালিশের নিচে ফেলে রাখলাম।বিরক্ত হয়ে একটু পর আপনাতেই কল করা বন্ধ করে দেবে।
প্রায় আধাঘন্টার মত সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর বের হলাম ওয়াশরুম থেকে।ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে বালিশের নিচ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এতটুকু সময়ে ৫০+ কল দেওয়া হয়ে গেছে।উনি কি পাগল! নাকি আমায় ধমকানোর জন্য পাগল হয়ে আছেন।আমাকে অবাক করে দিয়ে ফোনটা আবারো বেজে উঠল।শ্বাস বন্ধ করে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম।আজ তো মনে হয় আমার জীবনের শেষ সময় উপস্থিত।
দুর্জয় ভাইয়া সত্যি সত্যি মস্ত এক ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ বেয়াদপ মেয়ে কোথাকার! আমি বলা সত্ত্বেও তুই কোন সাহসে বাড়ি চলে গেলি?একবার তোকে আমি সামনে পাই তখন শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবি তোর কি হাল করি আমি।ফোন ধরছিলি না কেনো?স্মার্টনেস দেখাচ্ছিস?আমার সাথে?’

আমি পুরো বেকুব বনে গেলাম।এই লোক কিভাবে এত ধমকাতে পারে।আবার কিভাবে এত এত রোমান্টিক হতে পারে!
আমি প্রাণপন চেষ্টা করে গলার স্বর মধুর করে বললাম,
‘ কি যে বলেন!আপনার সাথে স্মার্টনেস দেখানোর মত কলিজা আমার আছে নাকি!আসলে বাড়ির সবাইকে খুব মিস করছিলাম তো তাই…’

‘ চুপ! তোর এসব অজুহাত কোনো কাজে আসবে না।কেনো চলে গেছিস সত্যি করে বল।কোনো সমস্যা হয়েছে?’

‘ আরে নারে বাবা।কেনো চলে এসেছি বুঝতে পারছেন না! আজ সকালে আপনারা সবাই কি করেছিলেন আমার সাথে তা কিন্তু ভুলিনি।কতটা লজ্জা পেয়েছি জানেন! আপনি তো আর এটা জানবেন না।পারবেন শুধু গলা কাঁপিয়ে ধমকাতে।’

দুর্জয় ভাইয়া কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ হেসে উঠলেন।আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।যাক উনার রাগ তাহলে পড়েছে।জিও পূর্ণী জিও।

‘ লজ্জা তো সবে শুরু।চুপচাপ শুধু দেখে যা কি কি হয়। যতদিন পারিস মজামাস্তি করে নে ওই বাড়ি।হাতে সময় কম।খুব তাড়াতাড়ি তোকে বউ বানিয়ে নিয়ে আসব।’

‘ যান তো।বয়ে গেছে আপনার বউ হতে।হাহ্!’

এটা বলে মুচকি হেসে ফোন রেখে দিলাম।বউ শব্দটা শুনে হঠাৎ মনের কোণে খুশির জোয়ার বইতে লাগল।কিছু স্বপ্ন, কিছু আশা,প্রিয়জনের হাত ধরে সামনে এগিয়ে চলা এমন হাজারো জল্পনা কল্পনা এসে ভীড় করছে মনে।এই মুহূর্তে কেউ আমার চেহারা দেখলে নিশ্চিত মুখ বাকিয়ে বলবে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য মেয়ের তর সইছে না।কিন্তু সত্যিই আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।দুর্জয় ভাইয়ার বউ হতে ইচ্ছে করছে।মুঝে সাজান কি ঘর যানা হ্যায়!

হঠাৎ রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে পেছনে ফিরলাম।আমার থেকে কয়েক হাত দূরে জেরিন আপু দাঁড়িয়ে আছে। নিমিষেই আমার উৎফুল্ল মেজাজ ঠান্ডা হয়ে চুপসে গেল।অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি জেরিন আপুর রাগে লাল হয়ে যাওয়া চেহারার দিকে।কেমন যেন একটা হিংস্রতা ফুটে উঠছে।চোখ দিয়েই আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।সবমিলিয়ে আপুকে স্বাভাবিক লাগছে না।
তবুও আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ কি হয়েছে আপু?’

জেরিন আপু হঠাৎ আমার দিকে তেড়ে এসে বলা শুরু করল,
‘ কি হয়েছে বুঝতে পারছিস না তাই না?শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিলি তো আমার দুর্জয়কে।নিজের ন্যাকামো দিয়ে,অসুস্থতার ভান করে দুর্জয়ের মনে সিমপ্যাথি জাগিয়ে ওকে রূপের জালে ফাঁসিয়ে নিয়েছিস।’

আপুর হুংকার শুনে স্তব্ধ আমি।আমার ছোট রুমটাতে আপুর চিল্লানোর আওয়াজ গুলো ধাক্কা খেয়ে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।যে মেয়েটাকে কখনো গলা উঁচু করে কথা বলতে দেখিনি সেই মেয়েটা এসব কি জঘন্য কথা বলছে!আমাকে বিশ্রীভাবে তুই তোকারি করছে।আমি দুর্জয় ভাইয়াকে কেড়ে নিয়েছি মানে?দুর্জয় ভাইয়া কোনকালে জেরিন আপুর ছিল যে আমি কেড়ে নিব?

নিজেকে সামলে মাথা ঠান্ডা করে আপুকে শান্ত হয়ে বললাম,
‘ আস্তে কথা বলো আপু।এটা আমার বাড়ি।তুমি কি বলছো নিজে বুঝতে পারছো?’

‘ বুঝতে পারছি।একটু আগে দুর্জয়ের সাথে কথা বলছিলি তাই না?দুর্জয়ের বউ হবি তুই?কোনোদিনও না।দুর্জয় শুধু আমার।কেনো পড়ে আছিস দুর্জয়ের পেছনে?ওর টাকা পয়সা বেশি এজন্য? ওর বাড়ি গাড়ির নমুনা দেখে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিস তাই না?’

এবার আমার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসলো।এমন নোংরা কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে উঠছে।ছিঃ এটাই কি জেরিন আপুর আসল রূপ ছিল?
এমন সময় কোথা থেকে সুহানা আপু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে লক লাগিয়ে দিল।এক ঝটকায় জেরিন আপুকে সামনে ফিরিয়ে বলে উঠল,

‘ বাইরে থেকে তোদের সব কথাবার্তা শুনতে পেয়েছি আমি।তুই এত নিচ জেরিন!আমি তোকে একটা নম্র ভদ্র মেয়ে হিসেবে জানতাম।এই বাড়ির সবাই তাই জানে আর তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে।শোন জেরিন!দুর্জয় ভাইয়াদের বাড়ি গাড়ি যেমন আছে তেমন আমাদেরও কিছু কম নয় যে পূর্ণী সেসবের লোভে পড়ে ভালোবাসতে যাবে।আমার তো মনে হচ্ছে তুই নিজেই বাড়ি গাড়ি দেখে ভাইয়ার জন্য পাগল হয়ে আছিস। কেনো বুঝতে পারছিস না যে ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। তুই এখানে তৃতীয় ব্যক্তি।’

জেরিন আপু এতক্ষণ শক্ত মুখে কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল।হঠাৎ ফুঁসে উঠে আমার দিকে হিংস্র চাহনি দিয়ে বলল,

‘ তৃতীয় ব্যক্তি এই মেয়েটা!আমি দুর্জয়কে ভালোবাসি অনেক আগে থেকে।আজ হোক কাল হোক দুর্জয়কে আমি ঠিক মানিয়ে নিতাম। মাঝখান থেকে এই মেয়েটা এসে দুর্জয়কে টেনে নিয়েছে।আমি ওকে ছাড়ব না সুহানা।’

‘ থাম তুই।আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার বোনকে হুমকি দিচ্ছিস? আর দুর্জয় ভাইয়া কি রোবট যে যেদিকে টানবে উনি সেদিকেই ছুটে যাবে!দুর্জয় ভাইয়া পূর্ণীকে ভালোবাসে।এটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নিতে পারবি ততই মঙ্গল। নাহলে ভাইয়ার রাগের তোপে পড়তে হবে তোকে।তার আগে তুই এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা।আমার কেনো জানি তোকে সহ্য হচ্ছে না।আমার কথাগুলো মনে থাকলে আর কখনো আমাদের বাড়িতে পা রাখবি না প্লিজ।’

জেরিন আপু উদভ্রান্তের মতো কোনোরকমে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।আমি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম।জেরিন আপুর বলা কথাগুলো কানে তীরের মত এসে বিঁধছে।না চাইতেও অজানা একটা ভয় এসে উঁকি মারছে।কি হচ্ছে এসব?একটু আগেও তো মনে হয়েছে সব ঠিকঠাক আছে।
সুহানা আপু আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে থেকে বলল,

‘ কাঁদিস না বোন।সব ঠিক হয়ে যাবে।দেখি তাকা আমার দিকে।’

আমি নির্বিকার হয়ে বললাম,
‘ তুমি কি জানতে জেরিন আপু যে দুর্জয় ভাইয়াকে পছন্দ করে?’

‘ নারে বোন।এতদিন ওর সাথে চলাফেরা করেও ওর মনের খবর জানতে পারিনি।তুই কি ভয় পাচ্ছিস পূর্ণী?’

আমি ভেজা চোখ নিয়ে আপুর দিকে তাকালাম।আপু সহজেই আমার চোখের ভাষা পড়ে ফেলতে পারল।কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ জেরিনকে নিয়ে ভাবিস না।তুই ভাব যে দুর্জয় ভাইয়া শুধুমাত্র তোকে ভালোবাসে।জোর করে কখনো ভালোবাসা পাওয়া যায় না।এটা আশা করি জেরিন খুব জলদি বুঝতে পারবে।’

আমার মনের ভয় কাটল না পুরোপুরি। জেরিন আপু বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়েছিল।এই তাকানোর অর্থ আমি বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করেছি।আপু সহজে হার মানবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here