তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২৮,২৯

0
828

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_২৮,২৯
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৮

পড়ন্ত বিকেলের রৌদ্রের তেজে উদ্ভট এক গরম এসে হানা দিচ্ছে। পরিবেশ কেমন যেন থম মেরে আছে।গাছের পাতারা সব নিজেদের স্থানে অনড় হয়ে নিদর্য়তার পরিচয় দিচ্ছে। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই।খোলা মাঠের মত ছোট একটা জায়গায় ছাউনির নিচে দুর্জয় ভাইয়ার সাথে বসে আছি আমি।চারপাশে আরো বেশ কয়েকটি ছাউনি রয়েছে।সেখানেও আমাদের মত গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে তাঁদের প্রিয় মানুষদের সাথে একাকী কিছুটা সময় কাটাতে এসেছে।জায়গাটা মূলত একটা রেস্তোরার সামনের অংশ।কয়েক গজ দূরে রেস্তোরাঁর মূল অংশ।সেখান থেকেই কাস্টমারদের অর্ডার কৃত খাবার এখানে এসে হাজির হয়।
গতকালের জেরিন আপু সম্পর্কিত ঘটনা কিছুই বলিনি দুর্জয় ভাইয়াকে।উনার ফুরফুরে চেহারা দেখে আর মুড নষ্ট করতে চাইনি।নিজ থেকেই কত কি রোমান্টিক কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন আর আমার ডানহাত নিয়ে তার উপর কিসব আঁকিবুঁকি করছেন।আমি যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছি স্বাভাবিক থাকার।কারণ এখনো চোখের সামনে জেরিন আপুর হিংস্র চাহনি ভেসে উঠছে।
কি করতেন যদি ওই কথাগুলো বলতাম?নিশ্চয়ই রেগে আগুন হয়ে এক্ষুনি গিয়ে জেরিন আপুকে জ্বালিয়ে ছাই করে দিতেন।
দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কোথায় যে হারিয়ে গেলাম।উনি আমার দিকে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলেন,
‘ তোর কি হয়েছে বলতো!কিছু লুকাতে চাইছিস আমার থেকে?’

দুর্জয় ভাইয়ার প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করেও চুপসে গেলাম কারণ উনি উনার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো দিয়ে আমাকে স্ক্যান করে ফেলছেন।আমি একপলক উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ কি লুকোবো আপনার থেকে।আমার লুকানোর মত কিছুই নেই।’

‘ একদম পাকা পাকা কথা বলবি না।কি চলছে তোর মনে তা আমি জানতে চাই সেটা এক্ষুনি। তুই কি ভাবছিস আমি এতক্ষণ তোকে খেয়াল করিনি?অপেক্ষা করছিলাম তুই নিজে বলিস কিনা।কিন্তু না তুই সোজা পথে হাঁটার মানুষ না।’

দুর্জয় ভাইয়া ধমক শুনে আমার কেঁদে দেবার উপক্রম হলো।মুখ কালো করে বললাম,
‘ বলব না আপনাকে।যখন তখন এভাবে ঝেড়ে দিবেন আর আমি চুপচাপ শুনব?’

দুর্জয় ভাইয়া কিছু না বলে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন।উনার জ্বলন্ত চাহনি দেখে মৃদু একটা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করলাম।তারপর দৃষ্টি নামিয়ে গতকালের জেরিন আপু সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনা একনাগাড়ে বলে ফেললাম।
দুর্জয় ভাইয়ার চেহারার প্রতিক্রিয়া এখন শূন্য। উনার মুঠোয় রাখা আমার হাত আগের মতই শক্ত করে আঁটা।এতকিছু শোনার পর উনি এমন নীরব আছেন কি করে।আমি হতাশ হলাম।মনের ভেতর জমানো ভয়গুলো আবারো উঁকি দিতে লাগল।
সাথে সাথেই খেয়াল করলাম দুর্জয় ভাইয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।উনার ফর্সা নাক ফুলে ফুলে উঠছে।আনমনে কি যেন চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ মুচকি হেসে তাকালেন আমার দিকে।আমি এতক্ষণ উৎসুক হয়ে উনাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম।দুর্জয় ভাইয়া হেসে বললেন,

‘ জেরিন কে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে।এই ঝামেলা আমি দেখছি।তুই প্যানিক হোস না।ঠিক আছে?’

আমি বাচ্চাদের মত মাথা নাড়লাম।অদ্ভুত এই দুর্জয় ভাইয়ার হাবভাব কেমন যেন অন্যরকম লাগছে আমার।কি করতে চাইছেন উনি।এই মুহূর্তে উনার ফুরফুরে মেজাজ আমার ভালো লাগছে না।উনি যদি রেগে অস্থির হয়ে এখানে হৈচৈ করতেন অথবা টেবিল চেয়ার দুয়েকটা ভাঙতেন তাহলেও স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু এখন কিছুই স্বাভাবিক লাগছে না।

দুর্জয় ভাইয়া আমার হাত টেনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
‘ চল দেরি হয়ে গেছে অনেক।বাসায় যাওয়া যাক।’

‘ চলুন।’

সারারাস্তা দুর্জয় ভাইয়া এটা সেটা বলে দুষ্টুমি করে গেছেন।তবুও আমার মনে হয়েছে উনার ভেতর বড় কোনো প্ল্যান চলছে।যদিও আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।উনি যেহেতু বলেছে সব ঝামেলা উনি সামলাবেন তাহলে আমার এত ভেবে লাভ কি।

____________________________

ক্লাস শেষ করে আমরা বান্ধবীরা ঠিক করলাম আজ ভালো কোনো এক রেস্টুরেন্ট গিয়ে জমিয়ে লাঞ্চ করব।হিমু,ঈশিতার উৎসাহ বেশি।সুস্মিতার নাকি বাসায় জরুরি কাজ তাই সে আমাদের নিরাশ করে বাসার পথে হাঁটা দিল।অগত্যা আমরা তিনজন হেলেদুলে কলেজ থেকে কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম।যুতসই একটা টেবিলে বসে মেনু দেখে খাবার অর্ডার দিয়ে দিলাম।এরপর শুরু করে দিলাম গল্প গুজব।সুস্মিতা থাকলে আরো ভালো হত।বেচারি আজকের স্পেশাল লাঞ্চ করে গেল।এরজন্য ওকে পস্তাতে হবে সারাজীবন।
হঠাৎ আমাদের পাশের টেবিলে তিনজন অপরিচিত ছেলের আগমন আমাদের গল্পে ব্যাঘাত ঘটাল।চারদিকে আরো টেবিল ফাঁকা থাকা স্বত্ত্বেও ওরা এসে এখনেই কেনো বসল?প্রথমে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিলেও কিছুক্ষণের মধ্যে অস্বস্তি এসে ভর করল আমার মাঝে।
ওরা চেয়ারে বসার পর থেকেই কেমন কটু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে এবং ওদের দৃষ্টি যে আমার দিকেই তা নিমিষেই বুঝে গেলাম।হিমু ফিসফিস করে বলল,

‘ দেখেছিস বেকুব তিনটার কান্ড?ইচ্ছে করছে এই কাঁটাচামচ দিয়ে চোখ উপড়ে দিই।’

‘ হিমু!ওরা শুনতে পাবে।দেখ ওদের কিন্তু সুবিধার মনে হচ্ছে না।চল আমরা ওই টেবিলটায় গিয়ে বসি।’

আমার কথায় রাজি হয়ে ঈশিতা হিমু উঠে দাঁড়াল।এমন সময় আচমকা একটা ছেলে এসে পথ আটকে দাঁড়াল একদম আমার মুখোমুখি। হঠাৎ এমন হওয়ায় ভড়কে গেলাম আমি।হিমু ঈশিতা ভয় পেয়ে দুইপাশ থেকে আমাকে আগলে ধরল।ছেলেটা দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ একবারে শিক্ষা হয়নি?ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গেছিলি এবার যদি কিছু করি না একেবারে জানে মেরে দেব।ভালোয় ভালোয় দুর্জয় থেকে দূরে সরে যা।অন্য একজনের পছন্দের জিনিসের প্রতি তাক করে বসে আছিস কেনো?’

ছেলেটার এমন দুর্ব্যবহার আর কথার ধরণ শুনে আমি আরেকদফায় চমকে গেলাম।এই ছেলে আমাকে থ্রেট দিচ্ছে! আর প্রথম কথাগুলো কি বলল এসব?কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না।কিন্তু এটা ভালোই বুঝতে পারছি ওরা তিনজনই জেরিন আপুর ফ্রেন্ড। আমি যেন স্তব্ধ হয়ে রইলাম।আপু শেষ পর্যন্ত এসব ফালতু ছেলেদের পাঠিয়েছে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য! ছিঃ! আপু এটা কিভাবে পারল। একটা মেয়ে হয়ে আপু এমন ডেঞ্জারাস কিভাবে হতে পারে।দিনদিন জেরিন আপুর আসল রূপ যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।
সামনের ছেলেটা এবার চাপা ধমকে উঠে বলল,
‘ এবার শুধু মুখে বলে গেলাম।যদি তুই দুর্জয়কে না ছাড়িস তাহলে মুখের কথা কাজের মাধ্যমে দেখাব।’

আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।কান্না পাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরের মানুষগুলো উৎসুক হয়ে আমার অবস্থা দেখছে অথচ কেউ এসে কিছুই জিজ্ঞাসা করছে না।চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছি।আমি সবার সামনে কাঁদতে পারব না।তখনই ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দিয়ে দেখতে পেলাম সেই পরিচিত মুখ। দুর্জয় ভাইয়া।মুহূর্তেই যেন আমার ছন্নছাড়া মস্তিষ্কে চিন্তা-চেতনা ফিরে আসল।কোনোদিকে না তাকিয়ে একছুটে হাজির হলাম উনার সামনে।আমাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে দুর্জয় ভাইয়ার চেহারায় বিস্ময় খেলে গেল।উনার পেছনে ফরমাল ড্রেস পড়া আরো কিছু লোকজন।
দুর্জয় ভাইয়া বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ কাঁদছিস কেনো?আর এখানে এলি কিভাবে?’

চলবে….

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৯

আমাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে দুর্জয় ভাইয়ার চেহারায় বিস্ময় খেলে গেল।উনার পেছনে ফরমাল ড্রেস পড়া আরো কিছু লোকজন।
দুর্জয় ভাইয়া বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ কাঁদছিস কেনো?আর এখানে এলি কিভাবে?’

দুর্জয় ভাইয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি সহসা দিতে পারলাম না।পেছনের মানুষগুলোকে দেখে চুপসে গেলাম।দেখে মনে হচ্ছে উনার অফিসের লোকজন। ততক্ষণে হিমু,ঈশিতাও আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমার নীরবতা সহ্য করতে না পেরে দুর্জয় ভাইয়া এবার ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ কি বলছি কানে যাচ্ছে না?কি হয়েছে বল!’

কেঁপে উঠলাম আমি।সাথে লজ্জা আর জড়তা এসে গ্রাস করে ফেলল।এতগুলো মানুষের সামনে এমনিতেই অনেক ছোট হয়ে গেছি আর এখন শুরু হলো উনার ধমক।
হিমু আমাকে পেছনে ফেলে দুর্জয় ভাইয়ার মুখোমুখি হয়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা সব গড়গড় করে বলে দিল।সবকিছু শুনে উনার অস্থির চেহারা যেন হঠাৎ অসম্ভব শান্ত হয়ে গেল।একটু দূরে দাঁড়ানো সেই ছেলেগুলোর দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টি দিলেন।
তৎক্ষণাৎ পেছনে ফেরে হাসিমুখে উনার সাথের লোকগুলোকে বললেন,
‘ প্লিজ আপনারা বসুন।আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছি।’

এটা বলেই দুর্জয় ভাইয়া আমাকে চোখের ইশারায় উনার পিছু পিছু আসতে বললেন।সমস্ত ঘটনা আমার কেনো জানি সিনেমার দৃশ্য মনে হচ্ছে আর আমি হলাম নীরব দর্শক।দুর্জয় ভাইয়া বড় বড় কদম ফেলে হাজির হলেন সেই ছেলেগুলোর সম্মুখে। একটানে আমাকে সামনে এনে নিজের সাথে মিশিয়ে বলে উঠলেন,
‘ এই মেয়েটা আমার ছিল,আমার আছে এবং ভবিষ্যতেও আমার থাকবে।গট ইট?যে অমানুষ তোদের ওর পেছনে লাগিয়েছে তাঁকে বলে দিবি এই কথাটা।তোদের ভাগ্য ভালো আজ আমার সাথে অফিসের লোকজন ছিল নাহলে সবকটার হাল বেহাল করে দিতাম।কিন্তু তোদের সাথে এই হিসাব পাওনা রইল।আবার দেখা হবে।’

দুর্জয় ভাইয়া আমার হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেলেন।উনার ক্ষিপ্র গতির সাথে আমি পাল্লা দিয়ে পারছি না।হিমু,ঈশিতাও বাইরে চলে গেল।দুর্জয় ভাইয়া দুটো রিকশা ডেকে আমাদের উঠিয়ে দিলেন।আমার গালে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
‘ এভাবে কাঁদতে হয়?খুব তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে দেব আমি।বাসায় গিয়ে আমাকে একটা টেক্সট দিবি কেমন?’

উনার কথায় মাথা দোলালাম।এই প্রথম একটা জিনিস খুব অনুভব করছি যে উনি যতক্ষণ আমার সাথে থাকে তখন নিজেকে সবদিক দিয়ে সিকিউর মনে হয়।একটা ভরসার আশ্রয়স্থল খুঁজে পাই আমি।
রিকশা চলতে শুরু করলে আমি আবার পিছন ফিরে তাকালাম।দুর্জয় ভাইয়া এখনো এদিকে পানে তাকিয়ে আছেন।আমি জানি উনি এই মুহূর্তে অনেক ব্যস্ত নাহলে নিজে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতেন।

______________________________

বাসায় এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।আমাকে আর দুর্জয় ভাইয়াকে ঘিরে কি হচ্ছে এগুলো।মনের ভেতর থেকে ভয় উঁকি মারছে।সব ঠিক থাকবে তো?দুনিয়া উল্টে যাক দুর্জয় ভাইয়াকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব।আমি আপাদমস্তক উনার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি।আল্লাহ্ তুমি আমার দুর্জয় ভাইয়াকে আমার করে দাও।
ফোন হাতে নিয়ে উনাকে ছোট একটা মেসেজ দিয়ে দিলাম যে আমি চলে এসেছি বাসায়।

রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। ফোনের ভাইব্রেশনে চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল।হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে কল কেটে উঠে বসলাম।হঠাৎ ঘুম থেকে উঠলে চারদিক কেমন অচেনা মনে হয়।এই মুহূর্তে চোখ ডলতে ডলতে মনে করার চেষ্টা করছি কোথায় আছি আমি।দৃষ্টি স্পষ্ট হতে দেখি বারান্দার দরজা হা করে খোলা।কি আশ্চর্য এত কেয়ারলেস কেনো আমি!ঝটপট উঠে দরজা বন্ধ করতে যাব এমন সময় দেখি নিচে দুর্জয় ভাইয়া দাঁড়িয়ে। উনি হাত উঁচিয়ে ইশারা করছেন আমায়।ঘুমের ঘোরে ভুলভাল দেখছি নাতো!আজকাল যে হারে দুর্জয় নামক রোগে আক্রান্ত হয়েছি আমি এসব হেলুসিনেশন দেখা অস্বাভাবিক কিছু না। সাত পাঁচ না ভেবে আস্তে করে দরজা টেনে দিলাম।মস্ত এক হাই তুলে ফোন হাতে বিছানায় বসতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। একি একটু আগে দুর্জয় ভাইয়ার কল ছিল।আমি ঘুমের জন্য কিছুই ভালোমত খেয়াল করিনি।কিছু একটা মনে হতেই বারান্দার দরজা খুলে ছুটে গেলাম।সত্যিই উনি দাঁড়িয়ে। ফোনে কল বাজতে তাড়াতাড়ি রিসিভ করে কানে লাগালাম।

‘মেরে তক্তা বানিয়ে দিব তোকে পূর্ণতা।তুই জানিস আমি কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি।জলদি মেইনডোর খোল।ভেতরে আসব আমি।’

দুর্জয় ভাইয়ার ধমক শুনে দৌড়ে গেলাম মেইনডোর খুলতে।নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজের কপাল ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে।নিঃশব্দে নিচে নেমে দরজা খুলে দিলাম।বাড়ির সবাই এখন গভীর ঘুমে তাই কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা উপরে চলে এলাম।
দুর্জয় ভাইয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বেডে বসে আমার দিকে ভ্রুকুটি নিয়ে তাকালেন।আমি মেকি হেসে বললাম,

‘ আ..আসলে ঘুমিয়ে ছিলাম।আপনি আসবেন জানলে তো জেগে থাকতাম।’

উনি আর কিছু বললেন না।দুজনেই চুপচাপ। আমি মাথা নিচু করে উনার থেকে একটু দূরে চেয়ারে বসে আছি।আমি জানি উনি আমারই দিকে তাকিয়ে।কি আশ্চর্য উনি কোনো কথা বলছেন না কেনো?এভাবে বসে থাকার জন্য এসেছে!এত কষ্ট করে মেইনডোর খুলে উনাকে চোরের মত নিয়ে আসলাম।
দুয়েক মিনিট কাটার পর আমিই মুখ খুললাম।

‘ খেয়েছেন?’

উনি আমার কথা পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ কাছে আয়।’

আমি চমকে উনার দিকে তাকালাম।উনার কথার স্বর এমন লাগছে কেনো?উনি কি অসুস্থ? কেমন যেনো জড়ানো গলায় কথা বলছেন।

‘ কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না?কাছে আয়।’

আমি ধীরে ধীরে উনার পাশে দাঁড়িয়ে কপালে হাত রাখলাম।

‘ কই জ্বর তো নেই।আপনার কি হয়েছে?’

কথা শেষ না হতেই দুর্জয় ভাইয়া উঠে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন।আচমকা এমন হওয়ায় আমি দু কদম পিছিয়ে গেলাম।উনি হাত দিয়ে সামলে নিলেন আমাকে।আমি উনার পিঠে হাত রাখতেই বললেন,

‘ ড্রিংকস করে এসেছি।আমি অসুস্থ না।একদম ফিট।’

আমি হতভম্ব।উনি ছাইপাঁশ গিলে এসেছেন আর আমি ভাবছি উনি অসুস্থ। দরদ দেখাতে গেছি উনাকে।মেজাজটাই বিগড়ে গেল আমার।দুহাতে উনাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম,

‘ ছাড়ুন!আগে জানলে আমি আপনাকে বাড়িতেই ঢুকতেই দিতাম না।বের হোন আমার রুম থেকে।আমার রুমের পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছেন। ‘

‘ পূর্ণতা! এমন লাফালাফি করছিস কেনো!একটু জড়িয়ে ধরতে দে না।সারাদিন তোকে কত মিস করেছি জানিস!’

‘ আমার জানার দরকারও নেই।আবর্জনা খেয়ে এসেছে আবার বলছে জড়িয়ে ধরতে দে।ছাড়ুন!বাজে লোক একটা।’

দুর্জয় ভাইয়ার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে চলে এলাম বারান্দায়। সিগারেট খাওয়া ড্রিংকস করা আমার একদমই পছন্দ না।আর উনি আজ এসব খেয়ে এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে।
হঠাৎ উনি পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। আমি কোনো রেসপন্স না করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম।উনি আস্তে করে বললেন,
‘ আজ কাজের চাপ এত বেশি হয়ে গেছিল।আর রাস্তায় এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা সে টেনে নিয়ে গেল ওর বাসায়।সেখানেই দু পেগ মেরে দিয়েছি।প্লিজ রাগ করিস না।আমি তো এগুলো ছুই না কখনো।’

আমি থমথমে মুখে উনাকে ছেড়ে দূরে দাঁড়ালাম।কি সুন্দর কথা! কখনো ছুন না কিন্তু দু পেগ মেরে এসেছে।মশকরা হচ্ছে আমার সাথে?উনি আবার এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে।আস্তে করে বললেন,
‘ কিছু কথা বলতে চাই শুনবি?বলতে ইচ্ছে করছে এখন।’
আমি নীরব রইলাম।

‘ আমাদের সম্পর্কটা কবে শুরু হয়েছে বলতে পারবি?’

আমি ঝটপট উত্তর দিলাম,

‘ বেশিদিন তো হয়নি।’

‘ উহু।রং আনসার।প্রায় তিনবছর হতে চলল।’

‘মানে?’

অবাক হয়ে দুর্জয় ভাইয়ার চোখে চোখ রাখলাম।এত আগে থেকে সম্পর্ক আমার তো কিছুই মনে আসছে না।
দুর্জয় ভাইয়া রেলিঙে হেলান দিয়ে বললেন,
‘ আমি আমার পরিবার সহ যেদিন দেশের বাইরে চলে গেছিলাম সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কি পরিমানে কেঁদেছিস মনে পড়ে?কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।বাবা আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল।এখানে রাজনীতি নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে গেছিলাম সেজন্য। আর ভাগ্য দেখ!আমি যাওয়ার পরই তোর সাথে শুরু হল নির্মম কাহিনী।’

এটুকু বলে থামলেন দুর্জয় ভাইয়া।নির্মম কাহিনী বলতে আমার এক্সিডেন্টের কথাই ইঙ্গিত করছেন তা ভালোই বুঝতে পারলাম।

‘ তোর এক্সিডেন্টের খবর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম।দিশেহারা অবস্থা যাকে বলে।মাকে বারবার বলছিলাম দেশে ব্যাক করার জন্য। কিন্তু হয়ে উঠল না বিভিন্ন ঝামেলার কারণে।প্রতিটা মুহূর্ত তোকে ভেবে আমি পাগল হয়ে থাকতাম।একটা বার কথা বলার জন্য ছটফট করতাম।কিন্তু আমার জন্য এতবড় ধামাকা অপেক্ষা করছে সেটা তো বুঝতে পারিনি।’

‘ কিসের ধামাকা!’

‘ তোর যখন জ্ঞান ফিরল তখন তুই কাউকেই চিনতে পারছিস না। এই খবর শুনে চোখে অন্ধকার দেখলাম আমি।মনে অজানা ভয় উঁকি মারছিল যে তুই তাহলে আমার কথাও ভুলে যাবি।আর হলোও তাই।আমাদের সম্পর্ক,আমাদের ভালোবাসা সবই যেন এক নিমিষে চুরমার হয়ে গেল।নিরুপায় হয়ে বসে থাকা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না জানিস।না পারছিলাম তোর কাছে যেতে না পারছিলাম সব কিছু মেনে নিতে।দিনে দিনে আমার আফসোসের পাল্লা ভারী হতে লাগল যে কেনো তোকে আমি একা ছেড়ে আসলাম।সময়ের সাথে তুই একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছিলি আর আমি প্রহর গুণছিলাম তোকে একনজর দেখার।অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি ব্যাক করলাম।বাসায় পৌঁছাতে সেদিন বেশ রাত হয়ে গেছিল।কিন্তু আমি কোনোমতে নিজের ব্যাগ রুমে ফেলে তোর কাছে ছুটে এসেছিলাম।বৃষ্টি বেগ ছিল প্রচন্ড।কোনো উপায় না পেয়ে এই বারান্দার মাধ্যমে উঠে এসেছিলাম।মনে পড়ে সেই রাতের কথা?’

এতক্ষণ ধরে আমি মন দিয়ে দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনছিলাম।উনার সাথে এত আগে থেকে সম্পর্ক এজন্যই বুঝি উনাকে দেখলে আমার কেমন অস্থির লাগত।
আমার হাত দুর্জয় ভাইয়ার মুঠোয়।সেই আবদ্ধ হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম,

‘ ওইদিনের ঘটনা কি ভুলা যায়!আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা!’

দুর্জয় ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,

‘ কিহ্!প্রথম দেখা?’

‘ তো কি!আপনি জড়িত সব স্মৃতি তো মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল।তাহলে ওইদিন রাতের দেখাই তো আমার প্রথম দেখা তাই না।’

দুর্জয় ভাইয়া স্মিত হেসে আমার মাথায় চাটি মারলেন।কিন্তু হঠাৎই উদাস চোখে বলতে লাগলেন,

‘ দেশে ফেরার পর মনে ভয় ছিল আমি আবার আমার সেই পূর্ণতাকে ফিরে পাব কিনা।আবার আমার ভালোবাসা দিয়ে তোকে কাছে আনতে পারব কিনা।মনে ভয় ছিল সেই সাথে প্রচন্ড বিশ্বাস। অবশেষে আমি সফল।’

আমি মুচকি হেসে মাথা নিচু করলাম।এত ঝড় ঝাপটার পর যখন ফলাফল মিষ্টি হয় তখন সবকিছুই সহজ মনে হয়।আমি নিঃসঙ্কোচে উনার চোখের দিকে তাকালাম।ঘুম জড়ানো দুটো চোখ।চেহারায় অদ্ভুত এক সৌন্দর্য!
একবার তাকালে নজর সেখানেই আটকে যায়।

হঠাৎ দুর্জয় ভাইয়া কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন,
‘ একটা কথা না বলে পারছি না পূর্ণতা।আজ হোক কাল হোক কথাটা তোর জানা দরকার তাই বলছি।তোর এক্সিডেন্টের পুরো ঘটনাটার পেছনে জেরিনের হাত।মোটকথা সে তোকে জানে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।’

আতঙ্কে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।একি শুনছি আমি!জেরিন আপুকে আমি খুবই ডেঞ্জারাস একটা মেয়ে মনে করেছিলাম তাই বলে এতটা?দুর্জয় ভাইয়া হাসিল করার জন্য সে আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছি।এতটা হিংস্র জেরিন আপু?
হঠাৎ খুব ভেঙে পড়লাম আমি।নিজের অজান্তেই চোখে পানি জমে গেল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ খবরটা জানার পর আপনি কিছু বলেননি উনাকে?’

দুর্জয় ভাইয়া আমার চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে বললেন,
‘ মেয়েদের গায়ে আমি কখনো হাত তুলি না।কিন্তু সেদিন জেরিনকে কষে দু গালে দুটা থাপ্পড় মেরেছি।প্রমাণের অভাবে আমি ওকে পুলিশে দিতে পারিনি।আর যে ছেলেগুলো জড়িত ছিল ঘটনায় ওরাও তখন হাত থেকে বেঁচে গেছিল।কিন্তু আজ খুব কায়দা করে ওদের জেলে পাঠিয়েছি।এখন বাকি শুধু জেরিন।’

দুর্জয় ভাইয়াকে কিছু বলতে নিব এমন সময় মাথায় খুব ব্যথা অনুভূত হলো।উপায় না পেয়ে উনার টি শার্টের হাতা খামচে ধরলাম।

‘ পূর্ণতা! কি হয়েছে? মাথা ব্যথা করছে?এই!’

দুর্জয় ভাইয়ার অস্থির কন্ঠের জবাব দিতে ইচ্ছা করল না।আমার এই মুহূর্তে খুব একা থাকতে ইচ্ছা করছে।তাই বললাম,

‘ অনেক রাত হয়েছে।আপনি বাসায় যান।ঘুমাতে হবে আমার নাহলে মাথা ব্যথা কমবে না।’

‘ যাচ্ছি। তার আগে তুই ঘুমা।চল রুমে চল।’

উনি আমার হাত ঝাপটে ধরে রুমে নিয়ে আসলেন।আমিও বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়লাম।উনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ এত চাপ নিতে হবে না তোর।আমি আছি তো।একটু সময় দে আমায় দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি থাকতে তোকে কেনো কিছু নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না।শুধু নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখ। ‘

আমি হালকা নাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করলাম।সত্যিই আর চাপ নিতে পারছি না।আজ থেকে সবকিছু উনার উপর ছেড়ে দিলাম।কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করব না আমি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here