তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_৬,৭

0
800

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_৬,৭
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৬

‘ এখনো অনেক অপেক্ষার প্রহর বাকি!যেদিন এই যন্ত্রণাময় অপেক্ষা শেষ হবে সেদিনই ওকে আমার করে নিব।শত বাধা আসলেও আর মানব না।তখন তুই আমার বিয়েতে দুইহাতের কব্জি ডুবিয়ে খাস ইমন!দরকার পড়লে লোক ভাড়া করে রাখব তোর জন্য। ‘

ইমন ভাইয়া যখন পুনরায় বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিল তখন গম্ভীরমুখো মিস্টার দুর্জয় আমাদের তাক লাগিয়ে উক্ত কথাটি বলে ফেলল।উনার তাহলে মনের মানুষ আছে।আরে বাহ্! এতো সুখবর।কিন্তু এই লম্বু এলার্জিক ব্যক্তিটার গার্লফ্রেন্ড কে?

বিস্ময় ভাব কাটতে ইমন ভাইয়া জিজ্ঞেস করল,
‘ ইয়ার তুই তাহলে তলে তলে টেম্পু চালিয়ে পাক্কা ড্রাইভার হয়ে বসে আছিস।আর আমাকে দেখ্ কপালে একটা ঠেলাগাড়িও জোটে না।এই শহরে কি সুন্দরী মেয়েদের আকাল পড়েছে নাকি কে জানে।’

‘ আরে বলদা মেয়েদের কি মাথা নষ্ট নাকি তোর সাথে প্রেম করতে আসবে?নিজেকে ভাবিস কি তুই?’

সুহানা আপুর দিকে রাগী চোখে তাকাল ইমন ভাইয়া।আপু মুখ ভেঙচিয়ে আইসক্রিম খাওয়ায় মন দিল।আপু এসব বললেও আমরা জানি ভাইয়ার সাথে প্রেম করার জন্য অনেক মেয়েই প্রপোজ করেছে। বেশিরভাগ তাঁর অফিসের।কিন্তু সে প্রতিটা মেয়েকে প্রেমের অপকারিতা সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে বিদায় করে দিয়ে আমাদের সামনে দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

দুর্জয় ভাইয়া কার সাথে যেন ফোনে কথা বলতে বলতে আমাদের ইশারায় বলল সে গাড়ির কাছে যাচ্ছে।উনাদের অফিসের কেউ একজন এসেছে।কানে ফোন গুজে পকেটে একহাত ঢুকিয়ে চলে গেলেন উনি।

ফারাজ বায়না ধরল সে আবারো আইসক্রিম খাবে।এই ছেলেকে নিয়ে বাইরে বের হলেই আইসক্রিমের জন্য লাফালাফি করে।অথচ ওর ঠান্ডার দোষ।বছরের বেশিরভাগ সময় নাক টানতে টানতে কাটিয়ে দেয়।তাই চোখ পাকিয়ে ওকে শাসানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু আমাকে পাত্তা না দিয়ে সে ইমন ভাইয়াকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।আজ বাসায় যাই আম্মুর কাছে নালিশ করে এই ছেলের দফারফা করব আমি।

সুহানা আপু আর আমি বসে বসে টুকটাক কথা বলছি এটা সেটা নিয়ে।একটা প্রশ্ন মাথায় আসতে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ আপু তোমার বেস্টফ্রেন্ড জেরিন আপু অনেকদিন হলো আমাদের বাড়ি আসে না।গতমাসে লাস্ট দেখেছিলাম ভার্সিটি যাওয়ার পথে।’

‘ ও নাকি কিছুদিন অসুস্থ ছিল।এখন ঠিক আছে।’

‘ আপুকে আসতে বলো বাড়িতে।আমাকে অনেক….’

চারজন বখাটে টাইপের ছেলেকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে থেমে গেলাম আমি।এদের তো এতক্ষণ কোথাও দেখতে পাইনি।এখন কোন গুহা থেকে বেরিয়ে আসল।সুহানা আপু চিন্তিত হয়ে আমার দিকে তাকালেন।ছেলেগুলোর মুখে শয়তানি হাসির ঝিলিক দেখতে পাচ্ছি। আমি সামনে পেছনে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম ভাইয়ারা আছে কিনা।কিন্তু দুজনের একজনেরও ছায়া দেখা যাচ্ছে না।
ততক্ষণে চারজন আমাদের মুখোমুখি এসে বলল,

‘ এই সন্ধ্যাবেলায় আপনারা একা বসে আছেন তাই ভাবলাম একটু আপনাদের কম্পানি দিয়ে আসি।’

সুহানা আপু আতঙ্কিত হয়ে আমার হাত খামচে ধরল।আপু এমনিতেও কিছুটা ভীতু প্রকৃতির।পান থেকে চুন খসলেই চেহারার রঙ পাল্টে যায়।আমারও এই মুহূর্তে ভয় লাগছে কিন্তু ওদের বুঝতে দিলে চলবে না।

বিজ্ঞস্বরে বললাম,
‘ কোনো প্রয়োজন নেই ব্রাদার! আমাদের ভাইয়ারা আছে আশেপাশেই।ওরা এখনি এসে যাবে।’

ওদের মধ্যে লম্বামতন ছেলেটা বলে উঠল,
‘ মিথ্যা বলছো কেনো।আমরা তো দেখলাম তোমরা একা বসে আছো।’

এবার আমার মেজাজ খারাপ হতে লাগল।ছেলেগুলো আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসছে।অচেনা তাও আবার বখাটে কোনো ছেলের মুখ থেকে তুমি শব্দটা শুনলে এমনিতেই মাথা গরম হয়ে যায় আর এরা তো গায়ে পড়ে কথা বলতে চলে এসেছে।

‘ আচ্ছা লোক তো আপনারা! চেনা নেই জানা নেই কোত্থেকে এসে জেরা শুরু করে দিয়েছেন।একা বসে থাকি আর দোকা থাকি তাতে আপনাদের সমস্যা কোথায়?’

আপু আমার হাত আরো জোরে খামচে বুঝিয়ে দিচ্ছে যাতে চুপ থাকি।কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।মাথা বিগড়ে যাচ্ছে।আমার ঝাঁজালো মার্কা কথা শুনে ছেলেগুলোর শয়তানি হাসি মিলিয়ে থমথমে ভাব চলে এল।
পেছন থেকে একটা ছেলে বলল,
‘ দেখতে যেমন সুন্দর গলার জোর তার থেকেও বেশি ভালো দেখছি।আমার এমন মেয়ে খুব পছন্দ। ‘

মেজাজ খারাপের যতটুকু বাকি ছিল সেটা পরিপূর্ণ হয়ে গেল আমার।এসব রাস্তার ছেলেদের কথায় দমে যাওয়ার পাত্রী নই আমি।আপুর থেকে হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
‘ মেয়েদের সম্মান দিতে না জানলে কথা বলতে আসেন কেনো?আগে শিখে আসুন কিভাবে ভদ্রভাবে আচরণ করতে হয়।ডিজগাস্টিং লোকজন কোথাকার! ‘

যে ছেলেটা আমাকে বাজে কথা বলছিল সে এবার ফুঁসে উঠল।দুহাতে শার্টের কলার পেছনে নিয়ে বলল,
‘ দেখাচ্ছি তোমায় কোনটা ভদ্র আচরণ আর কে ডিজগাস্টিং! ‘

এই বলে ছেলেটা আমার দিকে দুপা এগিয়ে এসে হাত বাড়াল।কিন্তু থেমে গেল মুহূর্তেই।
আমি ভয় ভয় নিয়ে ওদের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই আমার পেছনে কাউকে দেখে অবাক হয়ে আছে।ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দুর্জয় ভাইয়া!উনি দাঁড়িয়ে আছেন শান্ত ভঙ্গিতে দুহাত পকেটে গুঁজে। উনাকে দেখে ঠিক লাগছে না।চোখের দৃষ্টি কেমন যেন কঠোর।

আমাকে চমকে দিয়ে বখাটে ছেলেগুলো একস্বরে বলে উঠল,
‘ দুর্জয় ভাই আপনি! আপনি দেশে কবে আসলেন!’

ছেলেগুলো তাহলে উনার পরিচিত!
সুহানা আপু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমাকে টেনে দুর্জয় ভাইয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।আপু ঘেমে টেমে একাকার। আঠার মত আমার হাত ধরে আছে।
এদিকে দুর্জয় ভাইয়া নিশ্চুপভাবে হেঁটে ছেলেগুলোর সামনে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে গেলেন।কিছু বুঝে উঠার আগেই সশব্দে একটা চড় বসালেন সামনের ছেলেটার গালে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সুহানা আপুর চোখ বড়বড় হয়ে গেলেও আমি স্বাভাবিক। কেননা এই চড় ছেলেটার পাওনা ছিল।মেয়েদের হ্যারাস করার শাস্তি এটা।মনটা আরো নেচে উঠল যখন দুর্জয় ভাইয়া আরেকটা দশাসই চড় মারলেন পাশের ছেলেটার গালে।উনি চাপাস্বরে গজরাতে গজরাতে বললেন,
‘ হাউ ডেয়ার টু টাচ্ হার রাস্কেল!কোন হাত দিয়ে স্পর্শ করতে গেছিলি।এই হাত? তোর হাত আজ বডি থেকে আলাদা হয়ে যাবে দেখ্!’

ভাইয়ার কথা শুনে আমার চেহারা রক্তশূণ্য হয়ে গেল।উনি সত্যি সত্যিই ছেলেটার হাত মুচড়ে ধরেছে।ছেলেটা কাতরাতে কাতরাতে বলল,
‘ ছেড়ে দেন ভাই।ভুল হয়ে গেছে।আমি জানতাম না মেয়েটা আপনার পরিচিত।’

বাকি তিনটে ছেলেও একইভাবে অনুনয় বিনয় করতে লাগল।কিন্তু উনি যেন কিছুই কর্ণপাত করছেন না।দাঁত কটমট করে বলে উঠল,
‘ তোকে ছাড়ার তো প্রশ্নই আসে না।ভাগ্য খারাপ তোর যে আমার হাতে পড়েছিস।’
ছেলেটার হাত আরো মুচড়ে ধরতেই সে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল।আমার জান বেরিয়ে যেতে যেতেও আটছে পড়ছে।দুর্জয় ভাইয়ার এমন ভয়ঙ্কর রূপও আছে তা আমার জানা ছিল না।অবস্থা বেগতিক হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা না মরেই যায়।সামনে গিয়ে যে উনাকে থামতে বলব সেই সাহসও জোগাতে পারছি না।

এমন সময় ইমন ভাইয়া কোথা থেকে ছুটে আসলেন। সাথে আরো কিছু লোকজন।সবাই হতবাক হয়ে ঘটমান দৃশ্য দেখে চলেছে। ইমন ভাইয়া দিশাহারা হয়ে ছুটে এসে দুর্জয় ভাইয়ার বাহু টেনে বলতে লাগলেন,
‘ কি করছিস এসব? ছাড়! মরে যাবে ছেলেটা।লোকজন জমে যাচ্ছে চারপাশে ছেড়ে দে ওকে।’

ইমন ভাইয়া টানাটানি করে একচুলও নড়াতে পারছে না।দুর্জয় ভাইয়াকে দেখতে ক্ষুধার্ত বাঘের মত লাগছে যেন এক্ষুনি ছেলেটাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।

ইমন ভাইয়া হঠাৎ বলে উঠলেন,
‘ দুর্জয় সুহানা আর পূর্ণী ভয় পেয়ে যাচ্ছে এবার তো থাম!’

চকিতেই থেমে গেলেন দুর্জয় ভাইয়া।ছেলেটার হাত ছেড়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন আমাদের দুজনকে।উনার চেহারায় প্রচন্ড রাগের আভাস।রাগের বশে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরছেন বারবার।এই রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে ঢোক গিললাম আমি।আপুরও একই হাল।
ছেলেগুলো ছাড়া পেতে যে যার মত ছুটে পালাল।দুর্জয় ভাইয়াও চারপাশের লোকজনদের চোখ রাঙানি দিয়ে গেইটের দিকে হাঁটতে লাগল।
ইমন ভাইয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ এই ছেলে কি চিজ আল্লাহ্! আজ নির্ঘাত একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলত।তোরা দুজন আমাকে এ টু জেট বলতো কাহিনী কি!দুর্জয় এমন তান্ডব শুরু করেছিল কেনো?’

সুহানা আপু শ্বাস বন্ধ করে সমস্ত কিছু বর্ণনা করতে লাগল।আমি শুধু দুর্জয় ভাইয়ার কথা ভাবছি।ছেলেটা আমায় টাচ্ করতে গেছিল এইকারণে এভাবে মারল!হাত ভেঙে দিতেও চাইছিলো।অবিশ্বাস্য! একটা মানুষের বাইরের সুন্দর চেহারার আড়ালে এমন ভয়াবহ রুপ থাকে!
ইমন ভাইয়া সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন।অনুতপ্ত সুরে বললেন,
‘ তোদের একা ফেলে যাওয়া ঠিক হয়নি।আর এই ফারাজ ওকে আজ বাসায় নিয়ে আছাড় মারব আমি।বাইরে বের হলেই এটা খাব ওটা খাব বলে বলে জ্বালিয়ে মারে।’

ভাইয়া ফারাজের মাথায় বড়সড় একটা চাটি মেরে হাঁটা দিলেন।আমরাও আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলতে লাগলাম।ভেবেছিলাম আজ ঘুরাঘুরি শেষে একেবারে ডিনার করে বাড়ি ফিরব।কিন্তু তা আর হলো কই।আপু আর ভাইয়াকে জানিয়ে দিতে হবে বাড়িতে যেন সব গোপন রাখে নাহলে সবাই রেডিওর মত বকাবকি শুরু করে দেবে।একা ঘর থেকে বের হতে দেবে না।

গাড়ি চলতে লাগল বাড়ির উদ্দেশ্যে।ইমন ভাইয়া চুপচাপ বসে আছেন।দুর্জয় ভাইয়া নিঃশব্দে গাড়ি ড্রাইভ করছেন।তাঁর মুখের ভাবভঙ্গি এখন কেমন তা বোঝার উপায় নেই।কিছু যে জিজ্ঞেস করব সেই মনের জোরও পাচ্ছি না।
ফিসফিস করে সুহানা আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আপু তখনের ছেলেগুলো দুর্জয় ভাইয়ার পরিচিত ছিল।দেখলে না ওরা নাম ধরে ডাকছিল!’

‘ হ্যাঁ।আমিও শুনেছি।মনে হয় পলিটিক্সের ছেলেপুলে হবে।’

‘ পলিটিক্স মানে!দুর্জয় ভাইয়া কি পলিটিক্স করে?’

‘ একসময় করত। এখন করে না।’

বেশ অবাক হয়ে গেলাম। এজন্যই কি উনার এত রাগ!শুনেছি যারা পলিটিক্স করে ওরা ভীষণ রগচটা হয়।কিন্তু পলিটিক্সের মত এমন বাজে জিনিসে উনি কেন জড়াতে গেল!
গলা নিচু করে আবারো প্রশ্ন করলাম,

‘ উনি পলিটিক্স ছেড়ে দিলেন কেনো?’

আপু হতাশার সুরে বলল,
‘ একবার বিরোধী দলের ছেলেদের সঙ্গে কি নিয়ে যেন মারামারি করেছিল।ছেলেগুলো সেদিন জখম হয়েছিল অনেক।দুর্জয় ভাইয়াও রক্তাক্ত হয়েছিল।তবে এত নয়।উনার বাবা এই খবর জানতে পেরে ক্ষেপে যায় উনার উপর।তারপর আঙ্কেল অনেক জোরাজোরি করে ভাইয়াকে এসব থেকে ছাড়িয়ে আনে।এটা উনারা ইউএস যাওয়ার দুয়েকমাস আগের ঘটনা।আঙ্কেল ভাইয়াকে ইউএস নিয়ে গিয়ে পুরোপুরি অফিসের কাজে ঢুকিয়ে দেন।’

দুর্জয় ভাইয়ার জীবনবৃত্তান্ত শুনে শক খেয়ে গেলাম।উনি মারামারিও করেছেন!তারমানে কি উনার মধ্যে গুন্ডা স্বভাব আছে।মারামারি তো গুন্ডারাই করে।

সুহানা আপু আমার কনুইয়ে খোঁচা মেরে বললেন,
‘ সেদিন হসপিটাল থেকে ভাইয়া আমাদের বাড়িতে এসেছিল।আই মিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। পলিটিক্স ছেড়ে দেওয়ার জন্য সেদিন তুইও অনেক রাগারাগি করেছিলি।যখন তোর রুমে ভাইয়া এসেছিল তুই তো রাগে ফুঁসে যা নয় তাই বলে ধমকিয়েছিস!আমি তখন তোর রুমে ছিলাম।তোকে এত পরিমাণ রাগতে ওইদিনই প্রথম দেখেছি।’

‘ মানে?আমি? উনার পার্সোনাল বিষয় নিয়ে আমি কেনো এমন রিয়্যাক্ট করেছিলাম!’

‘ সেটা তো আমারও প্রশ্ন ছিল।তোকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তুই এড়িয়ে গেছিস আমায়।আচ্ছা পূর্ণী ডক্টর বলেছিল তোর কিছু কিছু স্মৃতি মনে থাকবে বেশিরভাগই ভুলে যাবি।তোর কি এসব কথা একটুও মনে পড়ছে না?দুর্জয় ভাইয়া কত আসতো আমাদের বাড়িতে।আমরা সবাই অনেক মজা মাস্তি করতাম।’

আপুর কথা শোনে মাথায় আবার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল আমার।দুর্জয় ভাইয়ার ব্যপার নিয়ে আমি কেনো সেদিন রেগে গেছিলাম! উনি ইনজুরড্ হয়েছিল শুধু এই কারণেই?
সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে পুরনো দৃশ্য গুলো মাথায় সাজানোর চেষ্টা করলাম।এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সমস্ত দৃশ্যরা আমার মাথার ভেতর টুকরো টুকরো হয়ে এলোমেলো অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।শুধু আমি ওদের একত্র করে সাজাতে ব্যর্থ হচ্ছি বারংবার। মনে পড়তে গিয়েও পড়ছে না।হঠাৎ করেই খুব অস্বস্তি হতে লাগল।একসময় ক্লান্ত হয়ে আপুকে বললাম,
‘ দুর্জয় ভাইয়া সম্পর্কিত কোনো কিছুই আমার মনে নেই আপু।’

চলবে…

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৭

বাড়ি পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল।দেরি কেনো হলো তার কারণ আমার অজানা।সারা রাস্তায় আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।হয়তোবা রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে লেট হয়েছে। খেয়াল করিনি।
গাড়ি থামতেই দুর্জয় ভাইয়া বাদে আমরা তিনজন নেমে গেলাম।সুহানা আপু ঘুমন্ত ফারাজকে কোলে নিয়ে গেইট পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। আমি দাঁড়িয়ে আছি ইমন ভাইয়ার সাথে।কেনো দাঁড়িয়ে আছি তাও জানি না।
ইমন ভাইয়া বলল,
‘ দুর্জয় ভেতরে আয়।ডিনার করে যা।চাচী বোধ হয় তোর জন্য রান্না করে রেখেছে।’

ইমন ভাইয়ার কথায় না বোধক উত্তর দিলেন উনি।বুঝতে পারছি আমারও বলা উচিত উনাকে যেন খাওয়াদাওয়া করে যায়।কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।উনি গুডনাইট বলে ধুলো উড়িয়ে শাঁ করে চলে গেলেন।তাকিয়ে রইলাম কালো চকচকে গাড়িটার দিকে।ধীরে ধীরে এটা আমার চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে। এত অদ্ভুত কেনো এই লোকটা?নিজের চারপাশে কেমন একটা বেড়াজাল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।সত্যিই অদ্ভুত নাকি আমিই উনাকে নিয়ে ভেবে ভেবে অদ্ভুতের কাতারে ফেলে দিচ্ছি।

.

রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। পড়ার টেবিলে বসে বসে ঘুমের তাড়নায় ঝিমচ্ছি। ডিনার শেষে পড়তে বসা আমার বাধ্যগত কাজ।ঘুমাতে যাওয়ার আগে আম্মু এসে চেক দিয়ে যায় আমি পড়ার টেবিলে আছি কি না।অনেকটা জোর করেই বসে থাকি।
ঘুমের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বইখাতা গুছিয়ে উঠে এলাম বিছানায়।এমন সময় মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল মিষ্টি একটা সুর তোলে।স্ক্রিনে দুর্জয় নামটা দেখে চোখ থেমে ঘুম উধাও হয়ে গেল।উনি এতরাতে কল দিচ্ছেন কি কারণে।আবার কিছু হয়েছে নাকি।তখন যেভাবে রেগে ছিলেন!কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি তাহলে ভয় কিসের।
বেশ সময় নিয়ে কল রিসিভ করলাম।হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে ভরাট গলার আওয়াজ আসলো,

‘ বারান্দায় আয়।’

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম।উনি রাত বারোটার সময় এখানে কি করছে।উনাকে তো আর শুধু শুধু অদ্ভুত বলি না।ভাবলাম নাকচ করে দিই কিন্তু উনার কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা আমাকে বাধ্য করল বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছতে।
মনটা খুঁতখুঁত করছে।সত্যিই উনি এসেছে নাকি…
ওইতো দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছেন।উনার গায়ে কালো ফুলহাতার শার্ট কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করা।সন্ধ্যায় যে পোশাকে দেখেছিলাম এখনো তেমনি।তারমানে উনি তখন বাসায় যাননি?

ফোন কানে গুঁজে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এখানে কি করছেন?আপনি বাড়ি যাননি?’

‘ না।অফিসে গিয়েছিলাম।কাজ ছিল অনেক।ওখান থেকে ডিরেক্ট এখানে এসেছি।’

‘ কিন্তু কেনো?কিছু বলবেন?’

দুর্জয় ভাইয়া এবার চুপ করে গেলেন।এতক্ষণের কথোপকথনে একবারের জন্যও উনার দৃষ্টি আমার থেকে সরে যায়নি।
হঠাৎই বলে উঠলেন,
‘ পূর্ণতা!’

উনার এমন মাদকতা জড়ানো কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলাম আমি।রাস্তা থেকে আমার বারান্দার দূরত্ব বেশি না হওয়ায় উনাকে বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু রাস্তার স্ট্রিট লাইটের নিয়ন আলোয় উনার মুখে হলদে আভা খেলে যাচ্ছে। রাতের এমন অন্ধকারাচ্ছন্নতায় উনি কি আরো সুদর্শন হয়ে উঠেন?নাকি আমার চোখের ভ্রম!ইস্ কি মায়া জড়ানো ওই চেহারায়। কিন্তু এর পেছনেই বাস করে ভয়ানক এক রূপ।

‘ তোকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে পূর্ণতা!কিন্তু পারি না।একটা জায়গায় এসে আটকে যাই আমি। চেয়েও কিছু করার নেই আমার।নিরুপায় হয়ে আছি। খুব কষ্ট হয় আমার।আর কত অপেক্ষা করতে হবে জানি না!অপেক্ষা খুবই যন্ত্রণা দেয় প্রতিটা সেকেন্ড। ‘

দুর্জয় ভাইয়ার এমন আকুলতা মাখা কথা শুনে কেমন মিইয়ে গেলাম আমি।বুকের ভেতর ধকধক শব্দটা যেন হৃৎপিণ্ডটাকে অধিক অশান্ত করে তুলছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

‘ কি বলতে চান বলে ফেলুন।’

কথাটা বলে নিজেকে বেকুব মনে হচ্ছে। উনি তো বলেছে উনি বলতে চেয়েও পারছেন না। কিন্তু কি এমন কথা যা উনার এবং আমার মধ্যে থাকতে পারে!আমি তো কিছুই বুজে উঠতে পারছি না।হতে পারে এক্সিডেন্টের আগের কোনো ঘটনা।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে উনি বললেন,
‘ সময় হলে বলব সব।এখন যা ঘুমাতে।এত রাতে বারান্দায় থাকার দরকার নেই।’

‘ আরেহ্ আপনি তো চরম ধাপ্পাবাজ! আপনি ডেকেছেন বলেই তো আমি এসেছি। নাহলে রাতে আমি বারান্দায় কেনো থাকব?’

‘ এখন থেকে যখনই ডাকি তখনই সাড়া দিতে হবে তোকে।এটা ঢুকিয়ে নে মাথায়।কল কাট।’

উনার কথা শুনে মুখ থমথমে হয়ে গেল আমার।এমন ব্যবহার করছে মনে হয় যেন আমি উনাকে কল করে এখানে ডেকেছি।কত বড় সাহস আবার অর্ডার দিচ্ছে আমায়।রাগে কানদুটো গরম হয়ে উঠছে।অন্যদের লজ্জায় কান লাল হয় আর আমার রাগে।

‘ আমি কেনো কাটব? কল কাটার অপশন আপনার ফোনেও তো আছে আপনি কল কাটুন!’

‘ আমিও কাটব না তুইও কাটবি না তাহলে সারারাত এভাবেই চলতে থাকুক।’

বেশ বুঝতে পারছি উনি মজা নিচ্ছেন।আড়চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি হাসছেন মিটমিট করে।কি আশ্চর্য আমার রাগকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।

নাক ফুলিয়ে কল কাটতে গেলাম তখনই উনি আবার বললেন,
‘ শোন পূর্ণতা!’

‘ বলুন।’

‘ হ্যাপি বার্থডে।’

‘ মানে!’

‘ তোকে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি মানে বুঝাবো? আমাকে পাগল মনে হয় তোর?যা ঘুমাতে যা।’

আমাকে একঝাঁক বিস্ময়ে ডুবিয়ে রেখে চলে গেলেন উনি।যেমন আচমকা এসেছেন তেমনি করে হাওয়া!তাড়াতাড়ি ফোনের তারিখ এবং সময় চেক করলাম।বারোটা বেজে একমিনিট! ও মাই আল্লাহ্ আজ আমার বার্থডে এটা উনি জানেন আর এইমাত্র আমাকে উইশ করে গেলেন।খুশি হব না দুঃখী হব বুঝতে পারছি না।কেউ কাউকে এভাবে উইশ করে জানা ছিল না।
প্রথমে কিছু রহস্যময় কথা এরপর আমাকে রাগিয়ে দিয়ে উইশ করে আস্ত একটা ধমক দিয়ে বিদায় নিলেন।মানে কিভাবে সম্ভব! হাহ্ আমি তো ভুলেই যাই উনি স্বাভাবিক মানুষের দলে নেই।কাউকে হুটহাট চমকে দিয়ে ভড়কে দেওয়া উনার ক্যারেক্টারেই থাকতে পারে।

দরজায় নকের শব্দে হুঁশ ফিরল আমার।এইসময় আবার কে আসতে পারে! কারো কোনো সমস্যা হলো নাকি!বারান্দার থাই বন্ধ করে দরজা খুলে দিলাম।
ইমন ভাইয়া, সুহানা আপু এবং ফারাজ হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ল।হঠাৎ এমন হওয়ায় আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবার মত অবস্থা।

চোখ বড়বড় করে বললাম,
‘ তোমরা রাতবিরেতে ডাকাত দলের মত আমার রুমে হামলা দিলে কেনো?আরেকটুর জন্য আমার জান বেরিয়ে যায়নি।’

ততক্ষণে আমার নজরে পড়ে গেছে আপুর হাতে ছোট সাইজের একটা ভ্যানিলা কেক উঁকি মারছে।আমি কিছু বলার আগেই ওরা তিনজন সমস্বরে চিৎকার করে উঠল,

‘ হ্যাপি বার্থডে পূর্ণী!মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে।’

দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরলাম আমি।এমন চিৎকারে বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই ভূমিকম্প ভেবে জেগে উঠেছে।ওদের সাথে রাগ দেখাতে গিয়েও পারলাম না।কত ভালোবেসে রাতের বেলা উইশ করতে চলে এসেছে আমায়।
হেসে বললাম,
‘ থ্যাংক ইউ অল।খুব খুশি হয়েছি আমি।এই কেক টা কি আপু বানিয়েছো?’

‘ অফকোর্স আমি।চল এবার কেক কাটবি।’

কেক কাটতেই ফারাজ ফটাফট মোবাইলে ছবি তুলে নিল।আমি কেক নিয়ে ওদের সবাইকে খাইয়ে দিলাম।ইমন ভাইয়া আস্ত একটা পিস মুখে ঢুকিয়ে বলল,

‘ জন্মদিনে কি উপহার চাস বল্ পূর্ণী।জুতা হতে জামাই সব দেওয়ার চেষ্টা করব।আফটার অল আমার প্রিয় ছোটবোন তুই।’

আমি মুখ ভার করে বললাম,
‘ প্রিয় যেহেতু তাহলে এত তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছো কেনো ভাইয়া!’

‘ তাড়াতাড়ি কই দেখলি।তোর আগে সু যাবে শ্বশুরবাড়ি। কিরে সু যাবি না?’

ভাইয়া সুহানা আপুর মাথায় গাট্টা মেরে কথাটা বলল।আমি আর ফারাজ একপাশে দাঁড়িয়ে হাসছি মুখ চেপে।কারণ আপু রাগে সাপের মত ফুসফুস করছে শুধু।বিকট এক যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি ওদের দুজনের মধ্যে। কারণ বিয়ের কথা শুনলে আপু এমনিতেই রেগে বোম্ব হয়ে থাকে।
আমার ভাবনাকে সত্যি করে আপু আমার হাত থেকে ছুড়ি নিয়ে তেড়ে গেলেন ভাইয়ার কাছে।
‘ আমার বিয়ে নিয়ে আর কখনো টু শব্দ করলে তোকে আমি গুম করে দেব ইমইন্না।’

এমন সময়,
‘ কি হচ্ছে এখানে?’

বড়আব্বুর গলা পেতেই আমরা সবাই তটস্থ হয়ে গেলাম।এতক্ষণ এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি।ওরা যেভাবে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিল তাতে মনে হয়ে এলাকার অর্ধেক লেকের ঘুম ভেঙে গেছে।

বড়আব্বু ঘরে ঢুকে সবকিছু দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেক মোমবাতি এসব কেনো?কি করছিলে এতরাতে?’

ইমন ভাইয়া এখনো কেক খেয়ে চলেছে।হাসতে হাসতে বলল,
‘ আমাদের পূর্ণীর আজ বার্থডে। আমরা সেটারই সেলিব্রেশন করছিলাম।আসো তুমিও কেক খেয়ে যাও।কেক কিন্তু সু বানিয়েছে।’

বড়আব্বু ভারী চশমার ফাঁক দিয়ে সকলকে একবার দেখে নিয়ে এগিয়ে আসলেন।ভাইয়ার কথামতো সত্যি সত্যি একটুকরো কেক নিয়ে খাইয়ে দিলেন আমায়।মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ শুভ জন্মদিন মা।তোমার জন্য কাল গিফট থাকবে আমার তরফ থেকে।’

আনন্দে আমার চোখ চিকচিক করে উঠল।আমিও একটুকরো কেক খাইয়ে দিলাম।
যাওয়ার সময় বড়আব্বু ইমন ভাইয়া এবং আপুকে গম্ভীর গলায় বলে গেলেন,

‘ ঝগড়া করার জন্য দিনের বেলাটা ভালো ছিল না?রাতে মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে ঝগড়া ভালো দেখায় না।যে যার যার রুমে চলে যাও এখন।গুডনাইট বাচ্চারা।’

বড়আব্বু চলে যেতে আমরা কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম নিজেদের জায়গায়।এরপর হঠাৎই সবাই মিলে রুম কাঁপিয়ে হেসে উঠলাম।

__________________________

সকালে ঘুৃম থেকে উঠেই টের পারলাম আজ আমার মনটা ভীষণ ভালো।বাইরের আবহাওয়াটাও চমৎকার! আমার মনের সাথে মিল রেখে প্রকৃতিও সামিল হয়েছে।মোবাইলে সময় দেখতে গিয়ে কাল রাতে দুর্জয় ভাইয়ার কথা মনে পড়ল।নিজের অজান্তেই হেসে ফেললাম।পারেও বটে মানুষটা।উইশ করার জন্যই তাহলে এসেছিল কিন্তু এটা কেমন উইশ ছিল তা একমাত্র উনিই ভালো বলতে পারবেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here