তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_৮,৯

0
814

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_৮,৯
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৮

ডাইনিং টেবিলে বসে আজকের তাজা খবরটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি।আমার জন্মদিন উপলক্ষে সন্ধ্যায় বাড়িতে হৈচৈ করে কেক কাটা হবে।সাথে মা এবং বড়মা’র হাতের মজাদার ডিশ তো আছেই।জন্মদিনের সেলিব্রেশন মানেই হলো সবার থেকে রঙিন কাগজে মুড়ানো গিফট পাওয়া।আহ্ ভাবতেই কি সুখ সুখ লাগছে।
খুশি ধরে রাখতে না পেরে হাসতে হাসতে ডাইনিং টেবিলের চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে মা বড়মা,আপু ভাইয়া সবাই অবাক হয়ে রইল।ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আব্বুর সামনে পড়ে গেলাম।লজ্জা বুঝি একেই বলে।আব্বু নিশ্চয়ই ভাববে তাঁর এত বড় মেয়ে কেমন বাচ্চাদের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আব্বু স্নেহময় কন্ঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ এভাবেই সবসময় হাসিখুশি থাক মা।’

নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ এত ভালেবাসে আমায় ভাবলেই ভাগ্যবতী মনে হয়।আমার প্রত্যেকটা খারাপ সময়ে সবাই পাশে থেকে সাপোর্ট করেছে আমায়।সেই দুর্ঘটনার পর বেশকিছু দিন আমি ডিপ্রেশড ছিলাম।কারো সাথে কথা বলতাম না,খাওয়াদাওয়া থেকেও মন উঠে গেছিল।ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে।তখন বাড়ির সকলে সর্বদা আমাকে চোখে চোখে রাখত।প্রতিটা মুহূর্ত চেষ্টা করে গেছে আমি যেন হতাশা থেকে বেরিয়ে এসে আবার নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারি।তাঁদের বহু পরিশ্রম এবং আমার ইচ্ছাশক্তির বদৌলতে আমি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।কিন্তু সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমি এদেরকে দিতে চাই।এরাই আমার সব।তাদের নিঃস্বার্থ আদরের সংস্পর্শ না পেলে আজ আমি এত খুশি থাকতাম না।জানি না তাদের ঋণ কিভাবে শোধ করব আমি।

.

সেলিব্রেশন নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে ভার্সিটি যেতে মন সায় দিল না।ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম এই বুঝি ভ্রু কুঁচকে ধমক দেবে।কিন্তু মা তো আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা হয়ে গেছে তাই শেষমেষ আর ভার্সিটি যাইনি।আমার দেখাদেখি আপুও ক্লাসে যাওয়া বাদ দিলেন।এদিকে ফারাজও বেঁকে বসেছে ওর বোনেরা কেউ যাচ্ছে না তাহলে সে ছোট হয়ে কেনো যাবে স্কুলে।ব্যস্ আমরা তিনজনই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা পাকা করে নিলাম।একমাত্র ইমন ভাইয়া রাগে গজরাতে গজরাতে অফিস গেলেন।ফাঁকিবাজ,পড়াচোর ইত্যাদি উপাধি দিতেও ছাড়েন নি আমাদের।আমি ভালো করেই জানি আমাদের দেখে ভাইয়ারও অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু কিছু করার নেই।

সারাদিন কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আমি আর আপু মিলে ড্রয়িংরুম সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।ফারাজও বাদ যায়নি কিন্তু সে বেলুনে হাওয়া দিতে গিয়ে চার পাঁচটা নিমিষেই ফাটিয়ে দিল।তাই আপু তাকে ধমকিয়ে সরিয়ে দিল এখান থেকে।
পুরো ড্রয়িংরুম সাজাতে প্রায় একঘন্টার মত সময় নিল।ততক্ষণে বাইরে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।ইমন ভাইয়া বলেছে আজ জলদি চলে আসবে অফিস থেকে।সকালে আমাকে আর আপুকে বলে গেছিল আমরা নাকি ডেকোরেশন করতে পারব না ভালোভাবে। ভাইয়া ফিরে আসা পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করি।কিন্তু আমরা দুবোন তো সব সাজিয়ে গুছিয়ে কামাল করে ফেলেছি।

আপু আর আমি চটজলদি ড্রেস পাল্টে আজকের জন্য ঠিক করে রাখা জামা পড়ে নিলাম।আপু অবশ্য থ্রিপিস পড়েছে।আর আমারটা সাদা এবং গোলাপির কম্বিনেশনের অত্যন্ত ঝকমকে একটা গাউন।আয়নায় নিজেকে দেখে খারাপ লাগল না।সাজগোজের বাকি যা প্রয়োজন সব লাগিয়ে পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়ে নিলাম।আপু আমাকে দেখতেই চিল্লিয়ে বলে উঠল,

‘ ওহ্ মাই বিউটিফুল লেডি!তুম তো মুঝে দিওয়ানা বানা দোগি।’

আপুর মুখে হিন্দি শুনলে বরাবরই আমার হাসি পায়।আমিও তাল মিলিয়ে বললাম,
‘ অর তুম তো মুঝে মার ডালোগি।আজাও গালে লাগ যাও।’

ড্রয়িংরুমে আমাদের দুজনের অপরিপক্ক হিন্দি শুনে এবং কাজকারবার দেখে মা আর বড়মা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।কিন্তু এসব পাত্তা দেয় কে।আমাদের মাস্তি আরো একধাপ বাড়িয়ে দিতে ফারাজ এসে মিউজিক বক্সে একটা হিট গান চালিয়ে দিল-হায় গরমি!
আমাদের তিনজনকে আর পায় কে।হাত ধরাধরি করে উড়াধুরা নাচতে আরম্ভ করলাম।কেউ কারো থেকে কম নয়।গানের আওয়াজে অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলাম মা কিচেন থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বকাবকি করছে।করুক গে।আব্বুরা চলে আসলে তো এসব করা যাবে না তাই এখনই আশ মিটিয়ে লাফালাফি করে নেই।
নাচের একপর্যায়ে আপু হঠাৎ সটান দাঁড়িয়ে গেলেন।কাঁদকাঁদ চেহারা তাকাচ্ছেন ফারাজ এবং আমার দিকে।এইমাত্র তো ঠিক ছিল এখন কি হলো আবার।
নাচ থামিয়ে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কি সমস্যা? আসো নাচি। এখন বাড়ি ফাঁকা আছে।পরে কিন্তু সবাই চলে আসবে।’

আপু আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আগের ভঙ্গিতেই বোকার মত চেয়ে আছে আমার পানে।বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ এভাবেই থাকো তুমি।চল ফারাজ আমরা আমাদের উরাধুরা নাচ চালিয়ে যাই।’

ফারাজ আমার কথায় সায় দিয়ে পা মেলাল। আমি ওর হাত ধরে স্টেপ নেওয়ার জন্য পেছনে মুড়তেই হাজার ভোল্ট কারেন্টের শক খেলাম।আমার চশমা কি আমার সাথে বেইমানি করছে নাকি সামনের দৃশ্যটা সত্যি!
খোলা মেইনডোরের সামনে দুর্জয় ভাইয়া চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছেন।উনি আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হাসলেন সামান্য।সুহানা আপু তাহলে উনাকে দেখেই এমন রোবট হয়ে গেছে।কিন্তু আমি তো অপ্রস্তুত হতে হতে মাটিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছি।
ফারাজ দুর্জয় ভাইয়া বলে লাফিয়ে উনার কোলে উঠতে গেল।কিন্তু উনার কৌতুকময় দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ।
আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে গাউন উঁচু করে ধরে দৌড়ে চলে এলাম নিজের ঘরে।লজ্জায় নাকি ভয়ে এভাবে চলে এসেছি জানি না।মন বলছে এখনি পালাতে তাই পালিয়ে এলাম।উনি আমার ঐতিহাসিক নাচ দেখে নিয়েছে ভাবতেই মাথা ঘুরে উঠছে।জন্মদিনে এমন এক লজ্জাকর অবস্থায় পড়ব তা ভাবিনি।ইস দরজাটা বন্ধ রাখলেই তো হত।কিন্তু লাফালাফির চক্করে একদম মনে ছিল না।এখন কিভাবে উনার সামনে যাব আমি।উনি নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে হাসিতে ফেটে পড়ছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচতলা থেকে ইমন ভাইয়ার হম্বিতম্বি করার আওয়াজ পেলাম।ভাইয়াই বোধ হয় ওই লোকটাকে নিয়ে এসেছে।এই ভাইয়াটাও যে কি!উফ।
রুমের মধ্যে এদিক সেদিক পায়চারি করছি এমন সময় দরজায় টোকা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।কারণ দুর্জয় ভাইয়া রুমের খোলা দরজার সামনে। উনার ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা।দরজায় টোকা দেওয়ার অর্থ উনি অনুমতি চাইছেন ভেতরে আসার।
উনাকে দেখতে পেয়ে একটু আগের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।মন চাইছে বলে দেই আপনার আসার দরকার নেই এই রুমে।চলে যান।আপনি অতি দীর্ঘকায় অদ্ভুত এক প্রাণী।
কিন্তু মনের কথা চেপে রেখে কোনোরকমে বললাম,
‘ আসুন! ‘

দুর্জয় ভাইয়াকে ভেতরে ঢুকতে দেখে আমি এককোনায় সটান দাঁড়িয়ে গেলাম।উনি দুহাত পকেটে গুঁজে আমার ছোটখাটো রুমটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।পড়ার টেবিলে এসে দুয়েকটা বই উল্টেপাল্টে দেখলেন।দেয়ালে লাগানো আমার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন একনজরে।উনার এমন জাসুসি করা দেখে নিজেকে আসামী মনে হচ্ছে। আর এটা যেন কোনো আসামীর ঘর যেখানে বিভিন্ন ভয়ানক অস্ত্র লুকিয়ে রাখা আছে আর সেই অস্ত্র উদ্ধার করার দায়িত্ব এনার উপর।
উনি পুনরায় আমার সামনে এসে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘ মেইন দরজা খোলা রেখে সেজেগুজে এভাবে লাফানোর কি মানে?আমার জায়গায় যদি বাইরের কেউ থাকত?’

এতক্ষণ এই প্রশ্নটার ভয় পাচ্ছিলাম আর সেই ভয় সত্যি হয়ে গেল।শেষমেষ উনি টেনে টেনে ওই ঘটনাটা সামনে নিয়ে এলেন।অসহ্য!
মাথা নিচু করে বিরবির করে বলে ফেললাম,
‘ আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ভালোই হত।এত লজ্জা পেতাম না।’

দুর্জয় ভাইয়া এবার দেয়ালে ঠেস দিয়ে দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে দাঁড়ালেন।উনার থেকে আমার দূরত্ব বেশখানিকটা।

‘ তাই?আমাকে দেখে এত লজ্জা কেনো?আমার জানামতে তো আমি বাইরের কেউ নই। আমাকে দেখামাত্রই তুই আড়ষ্ট হয়ে থাকিস,পালিয়ে বেড়াস কারণটা কি জানতে পারি?’

উনার প্রশ্নে আমার আড়ষ্টভাব আরো বেড়ে গেল।উনি বুঝি এরকম জেরা করার জন্যই আমার রুমে হাজির হয়েছে? উনার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারব না আমি।কারণ উত্তর তো আমার নিজেরও জানা নেই।

আমার চুপচাপ থাকাটা বোধ হয় উনার পছন্দ হলো না।মৃদু হেসে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে।উনি কি আজ আমার হার্ট অ্যাটাকের কারণ হবেন?বুক ধড়ফড় বাজেভাবে । এক্ষুনি হার্ট ছিটকে বেরিয়ে আসবে।
আমার কাছে এসে ঝুঁকতেই হঠাৎ,

‘ পূর্ণতা!কোথায় তুই?’

কারো চিৎকারে চমকে উঠলাম আমি। দুর্জয় ভাইয়া ঝটপট কয়েক কদম পেছনে চলে গেলেন দ্রুত পায়ে। ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকালেন।
জেরিন আপু দাঁড়িয়ে আছে।তাঁর হাতে বড় একটা গিফটের বাক্স।আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম আপুকে।

‘ অনেকদিন পর দেখা হলো আপু।সুহানা আপু থেকে শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ ছিলে।এখন ঠিক আছো তো?’

আপু কোনো উত্তর দিচ্ছে না।এর আবার কি হলো।এক্ষুনি তো আমার নাম ধরে চিল্লিয়ে কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল।
আপুকে ছেড়ে সামনে এসে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম।আপু গোলগাল চোখে সরাসরি তাকিয়ে আছে দুর্জয় ভাইয়ার দিকে যেন দুর্জয় ভাইয়া কোনো মানুষ নয়।
এদিকে দুর্জয় ভাইয়ার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।উনার চোখের চাহনি কঠিন।একটু আগে উনার ঠোঁটে যেমন মিষ্টি হাসি খেলা করছিল সেটা আর নেই।তার বদলে স্থান করে নিয়েছে চাপা এক রাগ।যেন এক্ষুণি সামনের মানুষটাকে ছিলে খাবেন।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এরা এভাবে একে অপরকে দেখে যাচ্ছে কেনো?

আপু আমতাআমতা করে বলল,
‘ ক..কেমন আছো দুর্জয় ভাইয়া?’

স্পষ্ট দেখলাম দুর্জয় ভাইয়ার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।চোখে এখনো অজস্র রাগ।উনারা কি একে অপরকে আগে থেকে চেনে?দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।

‘ ভালো।’

এটা বলেই দুর্জয় ভাইয়া হনহনিয়ে বের হয়ে গেলেন।আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।জেরিন আপু উনার সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলতে চাইল আর উনি কেমন অভদ্রের মত চলে গেলেন!কিভাবে পারলেন এটা করতে?
জেরিন আপুর দিকে তাকিয়ে বেশ মায়া লাগল আমার।মেয়েটা সুহানা আপুর সাথে একই ক্লাসে পড়ে।ওর নাকি ছোটবেলায় বাবা-মা দুজন কোনো এক এক্সিডেন্টে মারা যায়।এরপর থেকেই নিজের চাচীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করে।একদিক দিয়ে ভালো যে জেরিন আপুর চাচী তাঁকে মেয়ের মত ভালোবাসে।
সুহানা আপুর ফ্রেন্ড হওয়ার দরুণ এ বাড়িতে তাঁর আসা-যাওয়া লেগেই থাকে।আমাদের বাড়ির সবাই আপুকে খুব আদর করে।বাবা-মা মরা মেয়ে।
দুর্জয় ভাইয়ার ব্যবহার দেখে খুব রাগ হলো আমার।আপুকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললাম,
‘ তুমি দুর্জয় ভাইয়াকে চিনো?’

আপু জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
‘ চিনি।খুব ভালো করেই চিনি ওকে। ‘

‘ আর বলো না উনার মত এমন রগচটা মানুষ কখনো দেখিনি আমি।খালামণিদের পরিবারে সবাই ভালো একমাত্র উনি বাদে।বদমেজাজি লোক একটা।’

আমার কথায় আপুর কোনো হেলদুল হলো না।উদাসভাবে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। ইস না জানি কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।

চলবে…

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৯

কেক কাটার পর্ব শেষ হতে হতে প্রায় দশটা বেজে গেল।এখন খাওয়াদাওয়ার পালা।পুরো ড্রয়িংরুম ডাইনিংরুম জুড়ে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।বড়মা এবং আম্মু টেবিলে খাওয়াদাওয়ার তদারকি করছেন। আমি সোফায় বসে আছি অহনা আপুর সাথে। আমাদের পাশে জেরিন আপু এবং সুহানা আপু।আম্মু যে কখন খালামণিদের ইনভাইট করেছিল তা আমি জানতামই না।ওদের সবাইকে দেখে খুব ভালো লেগেছে।অনেকদিন পর বাড়িতে এমন উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর ভিড়ে একটা জিনিস খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করছিলাম।জেরিন আপু কেমন যেন মুখ গোমড়া করে বসেছিল সারাক্ষণ। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু সে প্রত্যক্ষভাবে আমাকে এড়িয়ে গেছে।আর কেউ না জানুক আমি তো জানি যবে থেকে জেরিন আপু দুর্জয় ভাইয়ার মুখোমুখি হয়েছে তখন থেকেই এমন আচরণ করছে।কিছু তো একটা গন্ডগোল আছে যা আমি টের পেলেও বুঝে উঠতে পারছি না।

অন্যদিকে দুর্জয় ভাইয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না।উনি মাস্তি মুডে ইমন ভাইয়ার সাথে কথা বলে যাচ্ছেন।এই যে এখনো খাওয়ার টেবিলে আব্বুর সাথে কি নিয়ে যেন আলোচনা করছেন আর হেসে উঠছেন মাঝেমধ্যে।তবে মানতেই হবে যে উনার মুখের হাসি দেখতে খারাপ লাগছে না।সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকা মানুষরা যখন হঠাৎ হেসে উঠে তখন চারপাশ ঝলমল করে।

খালামণিরা খাওয়া শেষ করেই বেরিয়ে পড়তে চাইলেন।আমি অনেক করে বললাম আজ রাতে থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ব্যর্থ হলাম।আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ তোর জন্য খুব সুন্দর একটা গিফট এনেছি।খুলে দেখে নিস।আর ক্লাস বন্ধ পড়লেই সুহানাকে নিয়ে চলে যাবি আমাদের বাড়ি।’

আপু এমনভাবে কথা শেষ করে দিল যে আমি আর আটকানোর সুযোগও পেলাম না।
ওদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য গেট পর্যন্ত এলাম।সবসময়ের মত দুর্জয় ভাইয়া গিয়ে বসলেন ড্রাইভিং সিটে।কিন্তু বাড়ির ভেতর উনাকে স্বাভাবিক দেখালেও এখন কেমন যেন লাগলো।কারণ উনি আমার দিকে একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকাননি।অথচ অন্যসময় যতক্ষণ সামনে থাকি আমাকে তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে স্ক্যান করে নেন।
গাড়িটা চলে যাওয়ার পর আমি আরো মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে রইলাম গেইট ধরে।অসহ্য লাগছে কেনো জানি।উনি আমার দিকে তাকায়নি এতে সমস্যা কোথায়!এসব কি উল্টাপাল্টা চিন্তা করছি আমি।ধ্যত্!

______________________________

মাথার উপর গনগনে সূর্য। দুপুরের নিস্তব্ধ রাস্তার কিনারা ধরে হাঁটছি আমি।ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার এই সময়টায় বেশ ক্লান্ত বোধ করি।এতগুলো ক্লাস করতে করতে হাঁপিয়ে যাই আমি।আজ তো আবার সূর্যের তাপ প্রখর।গায়ের জামা ঘামে ভিজে জবজব করছে।বিরক্ত ভাবটাকে দূর করার জন্য গুনগুন করে প্রিয় গানের সুর তুললাম গলায়।এমন সময় খুব স্পিডে একটা গাড়ি ছুটে গেল আমার পাশ দিয়ে।আমার জান বেরিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে গেছে প্রায়। ভয়ের কারণে চোখ বড়বড় হয়ে গেল।থমথমে চেহারায় দেখতে পেলাম কিছুদূর গিয়ে সেই দৈত্যের মত গাড়িটা থেমে গেল।মন চাইছে ছুটে গিয়ে ভেঙে দেই গাড়ির গ্লাস।দিনদুপুরে এই গাড়ির মালিক রাস্তায় খুন করতে বেরিয়েছে নাকি। হাহ্!

কিন্তু গাড়ি থেকে দুর্জয় ভাইয়াকে নামতে দেখে আমার চেহারার নকশা পাল্টে গেল।পূর্বে জমা হওয়া রাগের জায়গায় আরো এক ছটাক রাগ এসে ভিড় করল।আগেই বুঝা উচিত ছিল এই দৈত্যাকৃতির গাড়ির মালিক একজন দৈত্যই হবে।দুর্জয় দৈত্য!

উনি দ্রুত পায়ে আমার সামনে এসে ধমকিয়ে উঠলেন।
‘ চোখের মাথা খেয়েছিস?রাস্তায় হাঁটার সময় খেয়াল কোথায় থাকে তোর ইডিয়ট? ‘

উনার এমন ব্যবহার দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল।নিজেই তো তুফানের মত গাড়ি চালিয়ে আমাকে মারতে এসেছিল আর এখন ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে ধমকানো হচ্ছে! যখন তখন আমাকে মেজাজ দেখানো উনার স্বভাব।আজ বুঝাবো বিনা কারণে কাউকে ধমকালে বিনিময়ে কি কি সভ্য গালি শুনতে হয়।
চোখ রাঙিয়ে কিছু বলতে যাব তখনই নজর গেল আমি ফুটপাথ ডিঙিয়ে রাস্তার উপর উঠে এসেছি।বোধ হয় হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই এসে পড়েছি যার জন্য গাড়িটা আমার গায়ে ধাক্কা লাগতে গিয়েও লাগেনিতারমানে এখন সব দোষ আমার।আমার ভুলের কারণেই এখন একটা এক্সিডেন্ট হতে পারত। কোথায় ভাবলাম উনাকে দুটো কড়া কথা শুনানোর সুযোগ পেয়েছি কিন্তু তা আর হলো না।

উনার রাগান্বিত চোখে চোখ মেলানোর চেষ্টা করে বলতে লাগলাম,
‘ ও আ..আচ্ছা… কখন যে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় উঠে এসেছি… যাই হোক আপনি এই রোডে কি করছেন?আমাদের বাড়িতে যাচ্ছিলেন বুঝি?’

উনি আমার কথা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ গাড়িতে গিয়ে বোস।আমি পৌঁছে দিচ্ছি। ‘

উনার অর্ডার শোনে প্রতিবাদ করার মত কোনো বাক্য খুঁজে পেলাম না।তাঁর ওই বাদামী স্থির চোখজোড়ায় এমন এক তীক্ষ্ণতা খেলা করছে যা বুঝে উঠার সাধ্য আমার নেই।মন চাইছে উনার আদেশ নাকোচ করে চলে যাই কিন্তু পারলাম না।অদৃশ্য কিছু টেনে নিয়ে আমাকে বসিয়ে দিল উনার গাড়িতে।

সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ হেঁটে আসা যাওয়া করার কারণ কি?বাসা থেকে গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় না?’

‘ জ্বি।আব্বু তো ডেইলি ভাড়া দেয়।কিন্তু আমি তা খরচ করি না।জমিয়ে রাখি।’

‘ এত টাকা দিয়ে করবিটা কি?বাড়ি কিনবি?নাকি গাড়ি?’

উনার ঠাট্টা শুনে আড়চোখে তাকালাম।কিছুক্ষণ আগেই তো আমাকে বকেছেন এখন আবার..

‘ আমার কি বাড়ি গাড়ি নেই?আমাকে কি ভিখিরি মনে হয়?টাকা জমানোর অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে খাঁচাসহ দুটো পাখি পুষব।মাকে কত করে বলেছি কিন্তু রাজি করাতে পারিনি।বাড়ির সবাই মেনে নিয়েছে শুধু মা ছাড়া।বলে যে বাড়িতে পাখি নিয়ে আমি নাকি দিনরাত এসবের পিছনের পেছনেই সময় ব্যয় করব।আমার পড়াশোনা নাকি লাটে উঠে যাবে।কিন্তু পাখি তো আমি কিনেই ছাড়ব।যেভাবেই হোক।’

শুকনো মুখ করে বললাম কথাগুলো।কিন্তু আমার কষ্ট দুর্জয় ভাইয়াকে ছুঁতে পারেনি।কেমন স্বাভাবিক ভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন।মুখে কোনো রা নেই যেন আমাকে লক্ষ্যই করছেন না।
মনে মনে মুখ ভেংচি দিলাম।আরে দুটো সান্ত্বনামূলক কথাও তো বলতে পারতেন!শুধু কি ধমক দেওয়া আর ভাব দেখানো ছাড়া কিছুই জানেন না।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিলাম।নামতে যাব তখন উনি বললেন,
‘ একটু দাঁড়া।’

ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই পেছনের সিট থেকে একটা ছোট ব্যাগ টেনে আনলেন।উনি আসলে কি করতে চাইছেন তা চুপচাপ বসে থেকে বুঝার চেষ্টা করছি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ব্যাগের ভেতর চকচকে একটা বাক্স থেকে বের করে আনলেন ঝকঝকে সাদা পাথরের অতি সুন্দর একটি ব্রেসলেট! এটা এতই আকর্ষণীয় যে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না।মনের বিস্ময়তা চেপে রেখে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ বাহ্! দারুণ তো!আপনার পছন্দ আছে।’

দুর্জয় ভাইয়া স্মিত হেসে বললেন,
‘ হাতটা দে।’

আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম উনার দিকে।এই ব্রেসলেট কি তাহলে আমার জন্য? উনি কি আমাকে এটা গিফট্ করছেন?ও মাই গড!দুর্জয় দৈত্য আমাকে গিফট দিচ্ছে।
মনে মনে খুশির হাওয়া বইলেও উনার সামনে গম্ভীরভাবে বললাম,
‘ হাত পাতব কেনো?এটা কার জিনিস আমাকে পরাতে চাইছেন?’

‘ সময় নষ্ট না করে হাতটা দে গবেট।অন্যকারোর ব্রেসলেট নিশ্চয়ই আমি তোকে পরাতে আসব না।তোর বার্থডে’র গিফট্ এটা।নিতে চাইলে নে নাহলে ফেলে দে জানালা দিয়ে।’

এমন স্ট্রেইট কথা শুনে বুঝতে পারলাম আর ভাব দেখিয়ে কাজ নেই।খুশিতে গদগদ হয়ে বাড়িয়ে দিলাম আমার হাতখানি।উনি খুব যত্ন করে পরিয়ে দিলেন।আমি হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম কেমন মানিয়েছে।সুহানা আপু দেখলে সিউর পাগল হয়ে যাবে।সামনের সপ্তাহে আপুর ভার্সিটিতে কি যেন একটা ফাংশন আছে।আমি জানি এই ব্রেসলেট দেখার পর বলবে অনুষ্ঠানের দিন ওকে এটা ধার দিতে হবে।আপুকে তো চিনি।আমিও দিয়ে দেব খুশিমনে।আপু আর আমার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।আপু যেমন আমার জিনিস ব্যবহার করে তেমনি আমিও প্রায়ই আপুর জামা জুতা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করি।

হঠাৎ গাড়ির ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনে হুঁশ ফিরল আমার।যখন বুঝতে পারলাম দুর্জয় ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে তখনই চিল্লাতে লাগলাম,

‘ আরে আরে কি করছেন!আমি বাড়ি যাব না?থামান গাড়ি।’

উনি শান্ত কন্ঠে জবাব দিলেন,
‘ বাড়ি যদি যাবি তাহলে এখানে বসে ধ্যান করছিস কেনো?আমার হাজার কাজ পরে আছে অফিসে।এখানে তোর জন্য টাইম ওয়েস্ট করতে পারব না আমি।’

‘ তাই বলে আপনি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেবেন! আজব লোক তো আপনি।আপনার টাইম লস হলে কেনো আমাকে নিয়ে আসলেন!আমি কি বলেছি একবারো? বলিনি তো।তাহলে আমাকে এখন কথা শোনাচ্ছেন কেনো?ভেবেছিলাম গিফটের জন্য মিষ্টি করে ধন্যবাদ দেব কিন্তু আপনি সেই সুযোগ হারালেন।যান যান আপনি আপনার ভাঙাচোরা গাড়ি নিয়ে চলে যান।’

যা মনে আসছে তা বলে বকতে বকতে নামলাম উনার গাড়ি থেকে।ধপধপ পা ফেলে চলে এলাম গেইট পেরিয়ে।পেছন থেকে গাড়ির শব্দ পেতে বুঝলাম উনি বিদেয় হয়েছেন।উনার মত বাজে লোক আর একটাও নেই এই শহরে।এই ভাল এই খারাপ এরকম কোনো মানুষ হয় বুঝি?উনার মতিগতি আজও বুঝতে পারলাম না আমি।মাঝেমধ্যে মনে হয় পাবনার পাগলাগারদ থেকে আমদানি হয়েছেন উনি।
এমন হাজারো বাক্য বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম।

.

পরদিন সকালে ঘটল একটি আচানক ঘটনা।এই ঘটনার পেছনে মূল ব্যক্তিটি যে কে ছিল তা আমি তৎক্ষনাৎ বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকি বুঝেছিলাম। কিন্তু কিছু করার ছিল না আমার।সবটা যে ওই ব্যক্তির সাজানো প্ল্যান।উনার সাপও মরল না আর লাঠিও ভাঙলো না।মাঝখান থেকে আমি হলাম বলির পাঠা।

সকালে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বের হব এমন সময় মেইনডোরের সামনে হাজির হলেন প্রবীণ একজন লোক।লোকটার পরনে ধুলো মাখা লুঙ্গি এবং গায়ে অগোছালো শার্ট।গলায় গামছা ঝুলানো।সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো লোকটার হাতে মাঝারি সাইজের একটা পাখির খাঁচা।খাঁচার ভেতর লম্ফঝম্প করছে দু’দুটো টিয়া পাখি।
আমাকে দেখে লোকটির মুখে বিশাল এক হাসি ফুটে উঠল যেন এ বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য একমাত্র আমি।
এবার আমাকে হতবাক করে দিয়ে প্রবীণ লোকটি বলে বসল,

‘ নাও মামনি তোমার পাখি।তোমার বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে অনেক হয়রানি হলো।’

এমন কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি।ড্রয়িংরুম থেকে মা তেড়ে এসে বললেন,

‘ কি ব্যাপার পূর্ণী?ইনি তোমাকে পাখি দিচ্ছেন কেনো?’

‘ বুঝতে পারছি না মা।এই চাচা বোধ হয় ভুল ঠিকানায় চলে এসেছে।’

প্রবীণ লোকটি এবার প্রতিবাদ করে বলল,
‘ আমি তো সঠিক বাড়িতেই এসেছি আম্মা।তুমি কি ভুলে গেছো গতকাল আমার থেকে পাখি কিনতে চাইলে।কিন্তু একটাও তোমার পছন্দ হচ্ছিল না।তখন আমাকে টাকা দিয়ে বললে পরেরদিন এই ঠিকানায় পাখিসহ খাঁচা পৌঁছে দিতে।এজন্যই তো নিয়ে এলাম।’

আমি যেন অনেক উঁচু কোনো গাছ থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়লাম।কিসব ভুলভাল বলছেন এই লোক।আমি কাল কখন পাখি কিনতে গেলাম আর এই লোকটাকে তো জীবনে প্রথম দেখছি।
চোরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি রাগী ভাবে দেখছেন আমাকে।যাহ্ মা নিশ্চয়ই ওই লোকের কথা সত্যি ভেবে নিয়েছে।এখন সব রাগ ঝাড়বে আমার মত মাসুম বাচ্চার উপর।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here