#তোর_অপেক্ষায়
#পর্ব_১
#সামান্তা_সিমি
ঘড়ির কাঁটা রাত বারোর ঘরে।সেকেন্ডের কাঁটার টিকটিক শব্দ এক তালে বেজে চলেছে।বাইরে ঝুম বৃষ্টির ধারা।আজ বোধ হয় কালো মেঘেদের দল এই শহরটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট সহ দমকা বাতাস প্রবেশ করছে আমার এই ছোট্ট রুমটিতে।বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে পড়ার টেবিলের উপর দন্ডায়মান জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা দপদপ করে উড়ছে।জানালার পর্দারা ঢেউ তুলে নেচে উঠতে চাইছে।এমন রোমাঞ্চকর একটা পরিবেশে কি পড়ায় মন বসে?মোটেও না।
বিগত একঘন্টা ধরে বৃষ্টি ঝড়ছে আকাশ ভেঙে।মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ কানে আসতেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল।দুদিন থেকে বাসার আইপিএস নষ্ট হওয়ার কারণে মোমবাতি জ্বালিয়ে রুমের অন্ধকার দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর ব্যর্থ হচ্ছি।বাতাসের তীব্র বেগের কারণে মোমবাতি নিভে যাচ্ছে। আর আমিও জেদ ধরে দিয়াশলাই দিয়ে মোমবাতিকে প্রজ্জ্বলিত করে চলেছি।
আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে মোমবাতিটা আবারো নিভে গেল।হতাশ হয়ে ফস করে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে মোমবাতি ধরালাম। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠা বিজলির আঁকাবাঁকা রেখা দেখতে পেলাম।কেউ কেউ এমন আবহাওয়াকে ভুতুড়ে নামে অভিহিত করে।কিন্তু আমার কাছে তা সম্পূর্ণ রোমান্টিক একটা ওয়েদার।খোলা বইয়ের পাতা বন্ধ করে হেডফোন হাতে নিলাম গান শোনার জন্য। এমন সময় বারান্দা থেকে খুট করে একটা শব্দ আসতেই চমকে উঠলাম আমি।কি ছিল এটা!এতক্ষণ তো কোনো শব্দ পেলাম না।এই নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দটা মনের ভেতর ভয় ধরিয়ে দিল।ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেল যখন মনে পড়ল যে আমার বারান্দায় কোনো গ্রিল নেই।কোমড় সমান রেলিং রয়েছে।
শব্দটা আবারো কানে আসতে আমি ঢোক গিললাম।কোনো চোর-টোর আসল নাকি আবার।বাড়ির সবাই তো এতক্ষণে ঘুমে কাদা হয়ে আছে।কাকে ডাকব এখন!অন্যদিন হলে আপুকে কল করে রুমে ডেকে আনা যেত কিন্তু আজ ঠান্ডা আবহাওয়া সে নিশ্চয়ই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে।কি করব ভাবতে ভাবতে পাঁচ মিনিট কেটে গেল।এখনো বারান্দা থেকে খুটখাট শব্দ ভেসে আসছে।নাহ্ এভাবে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না।এই শব্দের রহস্য উদঘাটন করতে হবেই হবে।এমনও তো হতে পারে প্রচন্ড বাতাসের কারণে বারান্দায় পাতা প্লাস্টিকের চেয়ারটা দেয়ালে বারি খাচ্ছে।
মনে সাহস জুগিয়ে বারান্দা এবং রুমের মধ্যকার থাই গ্লাসটা সরিয়ে দিলাম।হাতে নিয়েছি শলার চিকন ঝাড়ু যেটা দিয়ে প্রতিদিন আমি এলোমেলো বেডকভার ঝেড়ে পরিপাটি করার কাজ করি।যদি কোনো ছিঁচকে চোর হয় তাহলে এই ঝাড়ু দিয়ে ওই চোরের হালুয়া আমি টাইট করে ছাড়ব।আমার মন বলছে আজ এই ঝাড়ুর সাহায্যে কোনো বিস্ময়কর ঘটনা আমি ঘটিয়েই ফেলব।
বারান্দায় পা রেখে মোড় নিতেই আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসল।চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছি।হাতে থাকা ঝাড়ু নিচে পড়ে গেল।
রুম থেকে আসা মোমবাতির হালকা আলো এবং বিদুৎ চমকানোর আলোতে বারান্দার শেষ মাথায় কোনো পুরুষ মূর্তি নজরে আসছে আমার।গায়ে কালো লম্বা একটা কোট জড়ানো যা বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে আছে।চেহারা দেখার কোনো উপায় নেই।কোটের সাথে লাগোয়া টুপি দ্বারা পুরো মাথা ঢেকে রেখেছে।সেই মুর্তিটি আমার আগমন টের পেতে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার শরীর ঘেমে একাকার।এ কোনো ছিঁচকে চোর হতে পারে না।চোর হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই দৌড়ে পালিয়ে যেত।তাহলে দীর্ঘকায় এই পুরুষটি কে?
হঠাৎ ভীষণ আওয়াজ তুলে দূরে কোথাও বাজ পরার শব্দ হলো।আতঙ্কে এবং ভয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে কেঁপে উঠলাম আমি।তখনই দেখলাম সেই পুরুষ মূর্তিটি নড়েচড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।আমি বোধ হয় বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।শরীর থরথর করে কাঁপছে।দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি যেন উবে গেছে।অবশেষে আমি কি কোনো অশরীরীর খপ্পরে পরেছি?আমাকে কি মেরে ফেলবে এখন?চিৎকার দেওয়ার জন্য ঠোঁট আলগা করতে বুঝতে পারলাম গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছে না।
এক পা দুপা করে এগুতে এগুতে কোট পরিহিত সেই মানব আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।লম্বায় আমি তাঁর বুক সমান।মাথা তুলে লোকটির চেহারার দিকে তাকানোর হিম্মত নেই আমার।ভয়ের কারণে দাঁতে দাঁত ঘষা লাগছে।
দ্বিতীয়বারের মত বুকে সাহস তৈরি করে কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম,
‘ কে আ..আপনি!’
সেই ব্যক্তিটি কোনো উত্তর দিল না।ধীরে ধীরে আমার কোমড়ে একজোড়া ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম।মুহূর্তেই জমে গেলাম আমি।এটা কোনো মানুষ হতেই পারে না।মানুষের হাত কি এমন বরফ শীতল হয়?
বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিতে লাগল আমাকে।কিন্তু সেদিকে আমার কোনো ধ্যান নেই।
আচমকা এক ঝটকায় সেই লোকটি আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল।আমার ছোট্ট প্রাণটা বের হতে গিয়েও হলো না।আমি আবার কিছু বলার চেষ্টা করতে লোকটি আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দ্বারা স্পর্শ করে বলল,
‘ চুপ! কোনো কথা নয়।’
তাঁর ঠান্ডায় শীতল হওয়া আঙ্গুলের স্পর্শ এবং ফিসফিসিয়ে বলা বাক্যটা শুনে কেঁপে উঠলাম আমি।চোখ দুটো আপনাতেই বন্ধ হয়ে আসল।শ্বাস-প্রশ্বাস উঠানামা করছে তীব্র গতিতে।এবার সেই ফিসফিসিয়ে বলা পুরুষালি কন্ঠটি আরো কাছ থেকে শুনতে পেলাম।
‘ আমার পেছনে পুলিশ লেগেছে।ওরা আশেপাশেই কোথাও খুঁজছে আমায়।কোনো আওয়াজ করার চেষ্টাও করবে না। নাহলে এই ছুড়ি দিয়ে তোমার গলা দুফাঁক করে দিব।’
লোকটার গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার ভীত শঙ্কিত চেহারায়।হুমকি শুনে আরো দুর্বল হয়ে গেলাম আমি।এখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছি কারণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি এবং তাঁর হাতে বিদ্যমান ছুড়ির ফলা কোনোটাই দেখার ইচ্ছে নেই আমার।
শুষ্ক হয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বললাম,
‘ না না…আমি ক..কোনো আওয়াজ করব না।প্লিজ ম..মারবেন না আমায়।’
‘ আহ্..দ্যাটস্ লাইক অ্যা গুড গার্ল।’
বলে লোকটি মৃদু হাসল। সেই হাসি কেনো যেন আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। মাথাটা কেমন চিনচিন করে উঠল।সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা টের পাচ্ছি।
হঠাৎ অনুভব করলাম সেই মানুষটির উপস্থিতি আর নেই। আগের মত আমার শরীরে আবার বৃষ্টির ঠান্ডা ফোঁটা স্পর্শ করছে।লোকটি এতক্ষণ আমাকে আড়াল করে রেখেছিল তাই বৃষ্টি ছুঁতে পারেনি আমায়।কিন্তু এখন ঠান্ডায় কেঁপে উঠছি আমি।
আস্তে করে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম।মন বলছে এখনি চোখের সামনে বিভৎস কোনো আকৃতি দেখব।নয়তো বিদঘুটে কোনো চেহারা।
দাঁতে দাঁত চেপে চোখ খুলতেই অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে আসলো না।সেই মানুষটিও সামনে নেই।রুমের মোমবাতি কখন নিভে গেছে কে জানে।বৃষ্টির ধারাও কিছুটা কমে এসেছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।এটা ভেবে শান্তি লাগছে যে লোকটি কোনো অশরীরী ছিল না।জেল থেকে পালিয়ে আসা কোনো ক্রিমিনাল হবে হয়তো।নাহলে পুলিশ কেনো তাড়া করে বেড়াবে।আর এই হতভাগা খুঁজে খুঁজে আমার বারান্দাতেই উঠে এসেছে।
বারান্দা থেকে রুমে আসতে নিব এমন সময় বিজলির ঝলকানিতে দেখলাম আমার থেকে হাত তিনেক দূরে সেই অবয়বটি দাঁড়িয়ে আছে।প্রচন্ড ভয়ে আবারো আঁতকে উঠলাম আমি।লোকটি তাহলে এখনো যায় নি।ও মাই গড! এবার নিশ্চয়ই আমাকে খুন করার মতলবে আছে।শ্বাস বন্ধ করে স্ট্যাচু হয়ে রইলাম।
‘ সি ইউ অ্যাগেইন মিস পূর্ণতা!’
কথাটি বলে লোকটি বারান্দা থেকে নেমে গেল তরতর করে।লাফিয়ে নামল নাকি পাইপ বেয়ে নামল সেটা দেখার আগ্রহ নেই আমার।
লোকটির মুখে আমার নাম শুনে বিশাল এক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছি আমি।আবার বলেছে সি ইউ অ্যাগেইন।এসবের মানে কি!লোকটি কি আমাকে আগে থেকে চেনে?কিন্তু এমন কাউকে তো আমি চিনি না যে একজন ক্রিমিনাল।যার পিছনে পুলিশ হন্যে হয়ে ঘুরছে।এই ব্যক্তি আমার নাম জানলো কিভাবে!
ধাঁধার অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে চোখে পানি এসে ভীড় করল।মনের কোণে অজানা ভয়েরা উঁকি মারছে।আমি কি কোনো বিপদে পড়তে চলেছি?
বিধ্বস্ত মন নিয়ে রুমে ঢুকে থাই গ্লাস টানলাম।অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের প্রান্তে পৌঁছে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলাম।
তখনই নজর পড়ল দেয়ালে টাঙানো লাল নীল কাগজের অক্ষর গুলোর দিকে।
‘ Happy Birthday Purnota ‘
অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের মাথায় নিজেই চাটি মারলাম।শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম এতক্ষণ। ক্রিমিনালটা নিশ্চয়ই জানালা দিয়ে দেয়ালের এই লেখাগুলো পড়েছিল।আর এ থেকেই আমার নাম জেনেছে।হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।কত কিছুই না ভেবে ফেলেছিলাম আমি।
গতবছর আমার বার্থডেতে ফ্রেন্ডসরা আমার রুমের ভেতরই সেলিব্রেশন করেছিল।মূলত এটা সারপ্রাইজ ছিল। আগে থেকে কিছুই জানতাম না আমি।ওরাই বেলুন দিয়ে সাজিয়ে এই অক্ষর গুলো লাগিয়েছে। অবশ্য আমার নাম পূর্ণতা হলেও সবাই পূর্ণী বলে ডাকে।
বই-খাতা গুছিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে চলে এলাম বিছানায়।তখনের ঘটনাটা মনে পড়তেই ভয় লাগছে খুব।লোকটার কথা এবং হাসি দুটোই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি না কেনো মনে হচ্ছে এগুলো আমার পূর্ব পরিচিত।আগে অনেকবার এই হাসির আওয়াজের সম্মুখীন হয়েছি আমি।কিন্তু কবে কোথায়?শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না।সি ইউ এগেইন এই বাক্যটা মনে আসতেই আবারো ঘাবড়ে গেলাম।সে কি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এটা বলেছে নাকি অন্য কারণে।
নাহ্ আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না।মাথাব্যথাটা আবার চিনচিন করে বেড়ে উঠছে।এখন শান্তিতে একটা ঘুম দেওয়া যাক।চুলোয় যাক ওই হাসি,হাসির আওয়াজ।এমন ঠান্ডা আবহাওয়ায় উটকো বিষয় নিয়ে ভেবে ঘুম নষ্ট করার মানে হয় না।
চোখ বন্ধ করতে ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
চলবে…