#তোর_অপেক্ষায়
#পর্ব_৩০(শেষ পর্ব)
#সামান্তা_সিমি
কেটে গেছে বেশ কিছুদিন।এ কয়েকদিনে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।জেরিন আপুরও কোনো খবর জানি না।আমার এক্সাম চলার কারণে দুর্জয় ভাইয়ার সাথেও আগের মত দীর্ঘসময় ধরে কথা হয় না। কল করলে শুধু খেয়েছি কিনা মেডিসিন নিয়েছি কিনা সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কিনা জিজ্ঞেস করবে।প্রতিদিন এগুলোর জবাব দিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাই।উনার প্রশ্নের চক্করে আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারি না।
দেখতে দেখতে এক্সামও শেষ হয়ে এল।লাস্ট পরীক্ষা দিয়ে এসে সন্ধ্যায় আমি আর সুহানা আপু কিছু কেনাকাটা করতে বের হলাম।দুবোন অনেকদিন কোথায় বের হই না।ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।বাসার গাড়ি নিয়ে যাওয়াতে ফিরতে কোনো সমস্যা হয়নি।ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখা মিলল দুর্জয় ভাইয়ার পরিবারের।কি ব্যপার উনাদের কি আজকে বাসায় দাওয়াত দেওয়া হয়েছে নাকি!দরজা বরাবর সোফায় দুর্জয় ভাইয়া বসে আছেন।উনাকে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে ফেললাম আমি।সবার সামনে অজান্তে কেনো ভুলচুক করে ফেললে বিপদ।আমি হেসে সবাইকে সালাম দিয়ে উপর চলে এলাম।রুমে আসতেই সুহানা আপু উত্তেজিত হয়ে বলা শুরু করল,
‘ পূর্ণী উনারা সবাই কেনো এসেছে বুঝতে পারছিস? ও মাই গড!’
সুহানা আপুর খুশি হওয়ার কারণ আমি কিছুই বুঝলাম না।শপিং ব্যাগগুলো নেড়েচেড়ে বললাম,
‘ উনারা তো এই প্রথম এ বাসায় আসে নি আপু।তাহলে!’
‘ সবাই মিলে তো আসেনি কখনো।আরে গাধা মেয়ে আজকে তোর আর দুর্জয় ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে কথা হবে।আমার মন বলছে এটা। ‘
আমার হাত থেকে শপিং ব্যাগগুলো টপাটপ নিচে পড়ে গেল। সুহানা আপুর হাত খামচে ঊরে বললাম,
‘ কি বলছো এসব!বাড়ির সবাই কি সব জেনে ফেলেছে?
‘ না জানলে জানবে এখন।এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেনো?’
‘ উফ আপু মা আমাকে বকবে অনেক।মায়ের একটা চোখ রাঙানি দেখলেই সেই জায়গায়ই খতম আমি।’
‘ প্রেম করতে পারবি আর চোখ রাঙানি হজম করতে পারবি না?আর আমি জানি সবাই মেনে নেবে…..’
এমন সময় নিচ থেকে মায়ের ডাক পড়ল।মা আমাকে ডাকছে।কলিজা কামড় দিয়ে উঠল আমার।যা ভাবছি সেটাই কি হতে চলল।আমি আপুর উড়না ধরে বসে রইলাম।কিছুতেই যাব না নিচে।
সুহানা আপু টেনে হেঁচড়ে আমাকে পাঠাল সিড়ির কাছে। আমি কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে তাকাতেই আমাকে বেস্ট অফ লাক জানাল।
সিড়িতে পা রাখতেই সবার নজর আমার উপর পড়ল।নিজেকে কেমন আজব প্রাণী মনে হচ্ছে। এমন লাগছে যেন ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে যাচ্ছি। দুর্জয় ভাইয়ার উপর রাগ হচ্ছিলো প্রচন্ড। আমাকে একবারও বলল না যে উনি বাসার সবাইকে নিয়ে আসবে।একটা মেন্টালি প্রিপারেশন তো নিতে পারতাম অন্তত।
আমি গুটিগুটি পায়ে বড়মার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।তখনই আব্বু বলে উঠলেন,
‘ এখানে আয় তো মা।একটু কথা বলি তোর সাথে।’
আমি একপলক সকলের দিকে তাকিয়ে আব্বুর পাশে গিয়ে বসলাম।বুকের মাঝের ধকধক আওয়াজ সবাই শুনে ফেলছে কিনা তা ভেবে হাত পা অবশ হয়ে আসছে।আব্বু স্মিত হেসে বলল,
‘ তোমার খালা খালু একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। দুর্জয়ের সাথে তোমার বিয়ের।’
আব্বুর কথা শুনে ভয়ে লজ্জায় আমার কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হতে লাগল।আমি আড়চোখে একবার দুর্জয় ভাইয়াকে দেখে নিলাম।উনার ঠোঁটে মিষ্টি এক হাসি ঝুলছে।তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।এই হাসি দেখেই বুঝা যাচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক মতই এগুচ্ছে।
‘ আমাদের বাড়ির সবাই এই প্রস্তাবে রাজি এখন তোমার মতামত জানতে চাইছি। তুমি যা বলবে তাই হবে।’
আমি এবার দুর্জয় ভাইয়াকে ছেড়ে আম্মুর দিকে চোখ দিলাম।আম্মু রাজি আছে তো?
আম্মু আমার চোখের ভাষা নিমিষেই বুঝে নিয়ে প্রশান্তির হাসি দিল।এতেই আমার মনের সকল ধোঁয়াশা দূর হলো।
‘ তোমরা যা বলবে তাই হবে আব্বু।’
চোখ বন্ধ করে উত্তর দিয়ে দিলাম আমি।ইস! কি লজ্জা লাগছে।এমন সময় বড় আব্বু হেসে বলে উঠলেন,
‘ মেয়ে তাহলে বিয়ের জন্য প্রস্তুত।তাই আমাদেরও কোনো আপত্তি রইল না।’
সবাই এবার মেতে উঠল হাসি ঠাট্টায়।আমি সুযোগ পেয়ে চলে এলাম নিজের রুমে।সুহানা আপু সেখানে পায়চারি করছিল।আমি আপুকে ঝাপটে ধরে অনবরত চরকির মত ঘুরতে লাগলাম।এত খুশি কোথায় রাখব জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না।
আপু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ কি করছিস মেরে ফেলবি নাকি।মাথা ঘুরছে আমার।তোর বিয়ে না খেয়ে মরতে চাইছি না আপাদত।’
আমি লম্বা একটা দম নিয়ে বললাম,
‘ সবাই কিভাবে এত সুন্দর ভাবে মেনে নিল আপু! আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তো!’
‘ না মানার কি আছে? দুর্জয় ভাইয়ার মত ছেলেকে রিজেক্ট করার সাহস কারো নেই বুঝলি?’
‘ কিন্তু আপু…তোমার আগে আমার কেনো বিয়ে হবে!এটা কেমন যেন গড়মিল লাগছে।তুমি বড় আমার থেকে!’
‘ তাতে কি!তোর বিয়েটা হোক একবার এরপর আমিও মাকে বলব পূর্ণীর বিয়ে হয়ে গেল এবার আমাকেও দাও বিয়ে।’
দুবোন হেসে গড়াগড়ি দিতে লাগলাম।এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।দুর্জয় ভাইয়া সেখানে দাঁড়িয়ে। আমি আমার হাস্যরত মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম।নাহলে উনি দেখলে ভাববে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছি আমি।সো এত হাসা চলবে না।
সুহানা আপু হালকা কেশে বলল,
‘ নে পূর্ণী এসে গেছে তোর হিরো।এখন তো আমাকে বিদায় নিতেই হয়।’
দুর্জয় ভাইয়া আপুর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
‘ গুড গার্ল।মাথায় বুদ্ধি আছে।’
আপু বের হতেই দুর্জয় ভাইয়া দরজা আটকে চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন।যেন পুলিশের সামনে আসামির জেরা হবে এখন।আর হলোও তাই।
‘ এত রাত করে বাড়ি ফেরা হচ্ছে? আমাকে বলেছিলি বাইরে যাচ্ছিস?’
আমি মুখ বাঁকা করে বললাম,
‘ আপনাকে বলতে হবে কেনো!পরীক্ষা শেষ হলো তাই একটু বের হলাম।’
‘ আমাকে জানাতে হবে না?তের বর হই আমি।’
‘ হাহ্ আগে হোন তারপর।’
দুর্জয় ভাইয়া হাসলেন।উনার হাসিমুখ দেখতে আমার বরাবরই ভালো লাগে।উনি আমার গালে দুহাত রেখে বললেন,
‘ বলেছিলাম না কোনো চাপ নিবি না।সব ঠিকঠাক ভাবেই এগুবে।আমি সবসময় আছি তোর পাশে।তুই শুধু সময়গুলো ইনজয় কর।কোনো বিপদ আসতে দিব না তোর উপর।যখন যা প্রয়োজন হবে অথবা যখনই কোনো সমস্যায় পড়বি আমাকে জাস্ট একটা কল দিবি। তোর জন্য আমি সবসময় ফ্রি।’
উনার কথা শুনে অসম্ভব এক ভালোলাগায় মোহিত হয়ে গেলাম আমি।কেউ আমাকে এত ভাবে।সবাই আমাকে এত ভালোবাসে!সত্যিই ভাগ্যবতী আমি।
_____________________________________
সমস্ত বাড়ি জুড়ে প্রাণচাঞ্চল্য রূপ।এমনিতে আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে বার্থডে,এনিভারসারী এসব অনুষ্ঠান ঘরোয়া ভাবেই সেলিব্রেট করা হয়।তাই অনেকদিন পর বড় কোনো অনুষ্ঠান আসাতে সবাই খুব আনন্দিত। আজ আমার আর দুর্জয় ভাইয়ার এঙ্গেজমেন্ট!
সেই উপলক্ষে আমাদের ছোটখাটো ডুপ্লেক্স বাড়িটা এক অন্যরূপে সেজে উঠেছে।সেইসাথে বাড়ির মানুষগুলোও।আমি এই মুহূর্তে রুমে আয়নার সামনে অবস্থান করছি এবং পাশেই সুহানা আপু আমায় সাজাতে ব্যস্ত।আপু এই কাজে ভীষণ পারদর্শী। কিন্তু একটু পর পর আমি অস্থির হয়ে বলে উঠছি,
‘আর কতক্ষণ আপু।’
সুহানা আপু বিরক্তি নিয়ে তাকাল আমার দিকে,
‘ আশ্চর্য পূর্ণী! এমন ছটফট করছিস কেনো!দুর্জয় ভাইয়া কিন্তু নিচেই আছে।ডাকব তাকে?’
আমি মুখ ছোট করে বসে রইলাম।দেখতে দেখতে একসময় সাজানো কমপ্লিট।আপুর জবাব নেই।পার্লারের থেকে কম কিসে!
সাজ সম্পূর্ণ হতে আমাকে নিচে নিয়ে আসা হলো।আমার গায়ে গাড় নীল রঙের শাড়ি জড়ানো।দুর্জয় ভাইয়ার শার্টের কালারও এক।উনি আমাকে দেখতেই মুচকি হাসি ছুড়ে দিলেন।তা দেখে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলাম।এতদিন ধরে উনার সাথে আমার কথা হয় দেখা হয় অথচ এখনো উনার সামনে গেলে আমার সেই পুরনো অস্থিরতা ঘিরে ধরে। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না।কি আছে ওই চোখে কে জানে!
সুহানা আপু আমাকে সোফায় বসিয়ে দিল।কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্জয় ভাইয়া এসে আমার পাশের সোফাটা দখল করে নিলেন।আমি দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইলাম। উনি ফিসফিস করে বললেন,
‘ আমার পছন্দ করা শাড়ি পড়েছিস। তাই তো এত সুন্দর লাগছে।একটা থ্যাংক ইউ দিবি না? ‘
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
‘দিব না।এখন এখান থেকে উঠুন।বড়রা কেউ দেখলে কি ভাববে।ওই দেখুন ওখান বড় আব্বু।’
‘ তাতে কি হয়েছে?একটু পর আমার বাগদত্তা বানিয়ে ফেলব তোকে।এরপর বিয়ে এরপর বাসর….’
‘ এই এই থামুন তো!একি অবস্থা! মুখে লাগাম দিন দয়া করে। ‘
‘ আচ্ছা দিলাম।চল একটা সেলফি নেই।পরে আর সুযোগই হবে না।’
এটা বলেই ফোন বের করে সেলফি নিয়ে নিলেন।আমি ক্যামেরাতে তাকানের সুযোগও পেলাম না।উনার মুখের দিকে তাকানো অবস্থাতেই ছবি তুলে নিলেন।
‘ বাহ্! একটা অন্যরকম পোজ হয়েছে।চল আরো কয়েকটা নিই।’
আমি চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম উনাকে।অনেকদিন পর উনাকে ফ্রেস মুডে দেখতে পাচ্ছি।
হঠাৎ এমন সময় মেইনডোর দিয়ে জেরিন আপুর আগমনে সব কিছু থেমে গেল।দুর্জয় ভাইয়া সেলফি তোলা থামিয়ে তাকালেন সেদিকে।আমি সব ভুলে উনার হাত খামচে ধরলাম।কারণ জেরিন আপু ভয়ংকর চোখে দেখছেন আমাদের। আপুকে আগেও রাগান্বিত অবস্থায় দেখেছি আমি কিন্তু আজকের চেহারা অন্য কিছু জানান দিচ্ছে।
জেরিন আপু হাতের পার্স ফ্লোরে ছুড়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
‘ কি পেয়েছো তুমি এই মেয়েটার মধ্যে দুর্জয়?আমার ভালোবাসা চোখে পড়ে না তোমার!ওর আগে থেকেই তোমার প্রতি দুর্বল আমি।আমার দিকে একবার তাকানোর ইচ্ছা হয়নি তোমার? ‘
আপুর চিৎকারের আওয়াজে পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল।দূরেই বড়আব্বু দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলেন।উনি কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে এলেন এখানে।বাড়ির ভেতর যারা ছিল সবাই হাজির।ভয়ে আমার শরীর ঘেমে একাকার।এঙ্গেজমেন্ট উপলক্ষে বাড়ির আমেজ মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে গেল।দুর্জয় ভাইয়া শান্ত গলায় বললেন,
‘ এখানে কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট করবে না জেরিন।তোমাকে যা বলার আমি সেদিন বলিনি?তারপরও কেনো এসেছো এখানে?’
এতে যেন জেরিন আপু আরো জ্বলে উঠল।
‘সিনক্রিয়েট মনে হচ্ছে তোমার?কি ভেবেছো লুকিয়ে লুকিয়ে এঙ্গেজমেন্ট করবে আর আমি জানতেও পারবো না!তুমি আমাকে বিয়ে করবে।এই মেয়েটাকে নয়।সেকি এখনো ভালোবাসে তোমায়?কিভাবে বাসবে সে তো তোমাকে চিনতোই না। ‘
আম্মু দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন।সবাই প্রশ্ন চোখে নিয়ে তাকিয়ে আছে। জেরিন আপুর এমন ব্যবহার কেউই আশা করেনি।আম্মু বলল,
‘ কি হয়েছে জেরিন।এসব কি বলছো তুমি?দুর্জয় কি চলছে এসব?জেরিন ভালোবাসে তোকে?’
মায়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না উনি।দাঁত কটমট করে বলে উঠলেন,
‘ আমি খারাপ ব্যবহার করার আগে এখনা থলকে চুপচাপ বেরিয়ে যাও জেরিন এতদিনেও আমার রাগ সম্পর্কে তোমার ধারণা হয় নি?’
‘ তোমার সবকিছু আমি মেনে নিব দুর্জয় শুধু এই মেয়েটাকে ভুলে যাও।তুমি যা বলবে আমি তাই করব।শুধু ভালোবাসো আমাকে।’
বলতে বলতে জেরিন আপু কেঁদে দিলেন।উনার কথায় একরাশ আকুতি।তা দেখে বুকে ধক করে উঠল আমার।গলা শুকিয়ে উঠছে বার বার। জানি না কিসের ভয় গ্রাস করছে আমায়।বাড়ির কেউ কোনো কথা বলছে না এখন।তাঁরা নিশ্চয়ই ঘটনার সূত্রপাত বুঝার চেষ্টা করছে।
‘ পূর্ণতাকে ভুলে যেতে বলছো?হাস্যকর না কথাটা?একটু আগে কি বললে যে পূর্ণতা এখন ভালোবাসে কিনা, সে আমাকে চিনে না। লিসেন সে ভালেবাসে আমায়।আগের দুর্জয়কে ভুলে গেছে ঠিকই কিন্তু আবার নতুনরূপে নতুনভাবে আমায় ভালেবেসেছে।এতদিনেও বুঝো নি তুমি যতই চেষ্টা করো আমাদের মাঝে আসতে পারবে না!’
জেরিন আপু চোখ পাকিয়ে তাকালেন দুর্জয় ভাইয়ার দিকে।দ্রুত পায়ে সামনে এসে বলল,
এই মেয়েটা আমার ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে এসেছে।’এঙ্গেজমেন্টের বারোটা বাজিয়ে দেব আমি।কোথায় রিং দেখি!*
এটা বলে জেরিন আপু আমার হাতের আঙুল দেখতে লাগলেন।আপুর কথায় ব্যবহারে এমনিতেই আতঙ্কিত হয়েছিলাম।কিন্তু এখন যেন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব।
আচমকা দুর্জয় ভাইয়া জেরিন আপু থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।গর্জে উঠে বললেন,
‘ পূর্ণতাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করবে না তুমি।যা ইচ্ছা বলো কিন্তু ওর থেকে দূরে থাকবে।তোমার জন্য ওর উপর আর কোনো বিপদ আসতে দেব না আমি।তুমি মেয়ে বলে বার বার ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু পূর্ণতার উপর আর একটাও আঁচ আসলে আমি ভুলে যাব তুমি মেয়ে।’
পুরো বাড়ি শান্ত হয়ে উঠল।আমার মনে হচ্ছে দুর্জয় ভাইয়ার ধমকে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠেছে।জেরিন আপু যেন থমকে গেল।অসহায় চোখে বার বার তাকাচ্ছে সবার দিকে।চেহারায় কাউকে নিজের করে না পাওয়ার তীব্র কষ্ট। আপুর এই অবস্থা দেখতে আমার আর ইচ্ছা করছে না।এতদিন পর্যন্ত জেরিন আপুর যে রাগ ছিল তা হঠাৎ কেথায় যেন উবে গেল।উনার কান্নামাখা অসহায় মুখ আমার সহ্য হচ্ছে না।আল্লাহ্ কি করব আমি এখন! এমন কেনো হলো!
তখন জেরিন আপুর চাচীর আগমন ঘটল।এই প্রথম উনি আমাদের বাড়িতে আসলেন।দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছেন। উনি এসেই জেরিন আপুর হাত ধরে বলতে লাগলেন,
‘ আবারো সেই পাগলামো শুরু করেছিস জেরিন!কত বুঝিয়েছি তোকে যে ভালেবাসা জোর করে হয় না।কেনো ওদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিস।বুঝার চেষ্টা কর এবং মানার চেষ্টা কর যে দুর্জয় পূর্ণতা দুজন দুজনকে ভালেবাসে।ওরা বিয়ে করে ভালো থাকতে চায়।তুই ওদের ভালো থাকার মাঝে একটা আতঙ্ক হয়ে হাজির হচ্ছিস।যদি সত্যিই দুর্জয়কে ভালোবাসিস তাহলে দূরে চলে আয় এবং এটা প্রার্থনা কর যে দুর্জয় যেন সবসময় ভালো থাকে। আর দুর্জয় সবসময় পূর্ণতার সাথেই ভালো থাকবে।’
জেরিন আপু এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল।আপুর চাচী মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ কাঁদিস না মা।আমার কথা শোন।বাসায় ফিরে চল।’
জেরিন আপু আমাদের দিকে তাকালেন।উনার চোখ পানিতে টলমল করছে।এতক্ষণ যেমন হিংস্র ছিলেন সেটা এখন আর নেই।সকলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ ক্ষমা চাইছি আমার এরকম কাজের জন্য। আজকের পরিবেশটা নষ্ট হয়ে গেল।এতক্ষণে সবাই বোধ হয় জেনেও গেছেন আসল ঘটনা কি ছিল।আসলে আজকে ওদের এঙ্গেজমেন্ট এই খবরটা পেয়ে মাথাটা গরম হয়ে গেছিল।’
আপুর কথায় কেউ কোনো শব্দ করল না।কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলতে লাগল,
‘ তোমার কাছেও মাফ চাইছি পূর্ণী।আমি আর কখনো আসব না তোমাদের মাঝে।কেনো যে এতবছর পর আমার বুদ্ধির উদয় হয়েছে।আরো আগে হলে এতকিছু হত না।আমার প্রতি কোনো রাগ রেখো না প্লিজ।’
আমি নির্বাক হয়ে রইলাম।কি বলা উচিত আমার!হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন পরিবর্তন হয়ে গেল।
‘ আমি যাচ্ছি চাচী।গাড়িতে অপেক্ষা করব।আসো তুমি।’
জেরিন আপু বের হয়ে গেল।দুর্জয় ভাইয়ার সামনে এসে চাচী অনুতপ্ত স্বরে বলল,
‘ আসলে জেরিনের বাবা মা মারা যাওয়ার পর ও এতটা একা হয়ে গেছিল। আমরা ওকে এতবছর ধরে আমাদের সাথে রেখেছি কখনো কিছু নিয়ে এমন জিদ করেনি যতটা তোমাকে নিয়ে করেছে।তোমাকে পাওয়ার জন্য ওর মধ্যে আমি এক ধরনের হিংস্রতা দেখেছি।কিন্তু ভালোবাসা তো হিংস্রতা দিয়ে হাসিল করা যায় না।ও এখন সেটা বুঝতে পেরেছে।এতেই আমি খুশি।এখন ও আবার আগের মত হাসিখুশি হয়ে যাবে আশা করি।আসছি কেমন!দোয়া করি তোমরা দুজন ভালো থেকো।’
সবাই উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল।আম্মু এসে নীরবতা ভাঙলেন।
‘ যা হওয়ার হয়েছে।এখন যে কাজ বাকি আছে সেটা সম্পূর্ণ হোক।’
কেউ আর কোনো কথা বলল না।আমি এটা নিয়েও ভয়ে ছিলাম যে আম্মু হয়তো চেঁচামেচি করতে পারে।এতক্ষণের যেসব ঘটেছে সেজন্য আমি এক ঘোরের মধ্যে চলে গেছি।দুর্জয় ভাইয়াও কেমন চুপ হয়ে আছেন।এঙ্গেজমেন্টের অনুষ্ঠান একরকম নীরবতার মাঝেই শেষ হয়ে গেল।
__________________
আকাশে চাঁদের একাংশ উঁকি মারছে।তাই চারিদিকে অন্ধকার গাঢ়।এমন পরিবেশে পরিবেশ উপভোগা করার মত না।তবুও আমি আর দুর্জয় ভাইয়া একে অপরের হাত ধরে ছাদে বসে আছি।ছাদের লাইট সবগুলো নেভানো।উনার নাকি এভাবে অন্ধকারে বসে থাকতেই ভালো লাগছে।
‘ পূর্ণতা, বললি না তো আমার দেওয়া আংটি পড়ে কেমন লাগছে তোর?আমার বউ হয়ে আমার বাড়িতে ঢোকার প্রিপারেশন নিচ্ছিস তো!’
আমি মুচকি হাসলাম।উনি অন্ধকারে তা দেখলেন না।পুনরায় বললেন,
‘ আমাদের প্রেম কাহিনীটা কি জোস দেখলি।কত টুইস্ট।কত ঝামেলাও গেল।কিন্তু গল্পের শেষে আমি তোকে পেয়েছি। আর কিছু চাওয়ার নেই।আমার তুই থাকলেই হবে।তুই যখন আমার স্মৃতি, আমাদের ভালোবাসা ভুলে আমার সামনে ঘুরে বেড়াতি কি পরিমাণ কষ্ট লাগত ভাবতে পারিস।তোর কাছে যেতে পারতাম না,তোকে ছুঁতে পারতাম না।তোর অপেক্ষা আমাকে খুব বেশিই পুড়িয়েছে।’
আমি দুর্জয় ভাইয়ার কাঁধে মাথা রেখে বললাম,
‘ভুলে যান সেসব।কিন্তু জেরিন আপু….’
‘ পূর্ণতা জেরিনকে নিয়ে এখন কেনো কথা উঠাচ্ছিস।ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এটাই বড় কথা।আমিও চাই ভালো থাকুক সে।’
‘ এখনো রেগে আছেন উনার উপর।’
‘ সে নিজের ভুল বুঝেছে এটাতে আমি খুশি।কিন্তু এটাও ভুলে যাইনি সে তোর উপর আঘাত করেছে।আমার ভালোবাসা উল্টেপাল্টে দিয়েছে।’
‘ ঠিক আছে। থামুন।আর কথা বাড়াতে হবে না।কালকে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন।অনেকদিন ধরে কোথাও যাওয়া হয় না।এখন কিন্তু বলতে পারবেন না আপনার দুইটা চারটা মিটিং আছে অফিসে।’
‘ এরকম কখনো বলেছি আমি?যতই অফিস থাকুক তোর জন্য আলাদা টাইম আমার কাছে সবসময়ই থাকবে।বল কোথায় যাবি!’
আঁধারে বসে চলতে লাগল আমাদের গল্পগুজব।উনার সাথের প্রত্যেকটা মুহূর্তই আমার জন্য স্পেশাল।তেমন ভাবে এখনের সময়টাও।জোছনা হোক অন্ধকার হোক উনি পাশে থাকলে আমার আর কিছুই লাগবে না।
ভালোবাসা সুন্দর যখন তা নিজ নিয়মে চলে।আবার সেই ভালেবাসা বিষাক্ত হয়ে যায় যখন সেখানে প্রতিহিংসা এবং জোর জবরদস্তি ঢুকে পড়ে।তাই ভালোবাসা একতরফা হোক অথবা উভয়ের হোক তা যেন মুক্ত থাকে সবসময়।
(সমাপ্ত)