দখিনা প্রেম,অতিরিক্ত অংশ
লাবিবা ওয়াহিদ
খুটখুট শব্দে সা’দের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পিটপিট করে তাকিয়ে মুখের সামনে থেকে কাঁথাটা অল্প সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে শব্দ করছে। কাঁথা সরিয়ে টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখলো একটা মেয়ে টেবিলে কী যেন করছে। মেয়েটার পিঠের অংশ দেখা যাচ্ছে সামনে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না। আচমকা একটা মেয়েকে দেখে সা’দ অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসলো। সেহের রিমনের ব্যাগ গুছাতে এসেছিলো, হঠাৎ ধুরুম আওয়াজ শুনে সেহের চোখ বড়ো বড়ো করে পিছে ফিরে তাকালো এবং দুজন দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। সেহের এবং সা’দ একে অপরকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তাদের মাঝে বিস্ময়ের শেষ নেই! সা’দ ঘুম থেকে উঠে সেহেরকে তারই ঘরে দেখবে তা সে কখনো কল্পনাও করেনি। মনের ভুল ভেবে চোখ কচলে সামনে তাকালো। নাহ সেহের নেই তো। শুধু সেহের কেন কোনো মেয়েই নেই। সা’দ কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলো? কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখলো আসলেই তার মনে ভুল। বিছানা থেকে নেমে হাই তুলতে তুলতে তাওয়াল নিয়ে সে ওয়াশরুম চলে গেলো। ওয়াশরুম ঢুকার আগে সময়টা দেখলো সা’দ। সকাল ৭ টা ১৩ মিনিট। সেহের ব্যাগ নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে কোনোরকমে তপার ঘরে চলে আসলো। রিমন তখন স্কুলের ইউনিফর্ম পরছিলো। সেহেরকে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকতে দেখে রিমন অবাক হলো৷ সেহের ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে অনবরত। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। সেহেরের এ অবস্থার কারণ সে বুঝতে পারলো না। রিমন নিজের ব্যাগ সেহেরের হাত থেকে নিতে নিতে বললো,
—“কী হয়েছে বুবু? এমন করছো কেন?”
সেহেরের সেদিকে খেয়াল নেই। তার চোখে বারবার সা’দের চেহারাটা ভাসছে। সে কী আসলেই সা’দকে দেখেছে? সা’দ কেন এবাড়িতে থাকবে? সা’দ তো সেদিনই চলে গেছে। নানান প্রশ্ন সেহেরকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। রিমন আরেকবার ডাকতেই সেহেরের ধ্যান ভাঙলো। সেহের অস্ফুট সুরে বলে,
—“তোর ঘরে কে ঘুমাচ্ছিলো ভাই?”
—“সা’দ ভাই। কেন গো বুবু?”
—“উনি দেখতে কী বিদেশিদের মতো?” শিওর হওয়ার জন্য রিমনকে প্রশ্নটা করলো সেহের।
—“হ্যাঁ কেন?”
সেহের যেন আকাশ থেকে পরলো। সে কিছুতেই তার হিসাব মেলাতে পারছে না। শেষ অবধি কি না সা’দ তারই চাচাতো ভাই? সেহের আবার প্রশ্ন করলো,
—“নাম কী যেন তার?”
—“আহা বুবু বললাম না সা’দ।”
সেহের ঠিক কেমন অভিব্যক্তি দেখাবে বুঝতে পারছে না। কেন বারংবার নিয়তি তাদের এভাবে মিলিয়ে দিচ্ছে তা সেহেরের জানা নেই। সেহের একটা শ্বাস ফেলে বললো,
—“চল ভাই খেতে বসবি!”
রিমন মাথা নাড়িয়ে সেহেরের সাথে নিচে নামলো। নিচে গিয়ে দেখলো দাদীমা সোফায় বসে পান চিবুচ্চে আর চাচী রান্নাঘরে রুটি বেলছে। তারা ফজরের নামাজের পরপরই চলে এসেছে। আজ রিমনের স্কুল হয়ে কাল থেকে ছুটি। রিমনকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সেহের রান্নাঘরে গেলো রিমনের জন্য নাস্তা নিতে। চাচী দুইটা রুটি আর ভাজি সেখানে আগেই রেখেছিলো রিমনের জন্য। সেহের সেটা নিয়ে আবার রিমনের কাছে চলে আসলো। সেহেরকে এভাবে ছুটতে দেখে দাদীমা মুখ ভেংচিয়ে বলে,
—“মায়ের ঘুমের ঠ্যালায় পোলার খবর নাই আর এই মাইয়া দিনরাইত এই পোলার লেইগা খাইট্টা মরে!”
সা’দ সেই মুহূর্তে ফোন ইউস করতে করতে নিচে নামছিলো তাই সে দাদীমার কথাগুলো শুনে ফেললো। এমন কথায় সা’দ ভ্রু কুচকে দাদীর দিকে তাকাতে তাকাতে নিচে নামলো। দাদীমা সা’দকে দেখে হাসিমুখে পান চিবুতে চিবুতেই বললো,
—“আরে নায়ক সাহেব এত্তো সকালে ঘুম ভাইঙ্গা গেছে নাকি?”
“নায়ক সাহেব” শুনে সেহের পিছে তাকালো চোখ বড়ো বড়ো করে। সা’দ পকেটে ফোন রেখে দাদীমার পাশে বসে মুচকি হেসে বলে,
—“আমার এইসময়ে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস আছে দাদী!”
বলেই সা’দ সামনে তাকালো। আবারও দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো৷ সেহের চোখ সরিয়ে রিমনকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। না এবার সা’দ ভুল দেখেনি। অবাক হয়ে সে সেহেরকে দেখছে। সেহের তাদের বাড়িতে আর রিমনকেই বা খাইয়ে দিচ্ছে কেন? তখন তাহলে তার রুমে সেহেরই ছিলো। সা’দ অস্ফুট সুরে দাদীমাকে বলে উঠলো,
—“ও কে দাদী?” সেহেরের দিকে ইশারা করলো।
—“আরে ও-ই তো আমার ফুল, আমার নাতনি! জানোস না ভাই আমার ফুলডা কতো কষ্ট সইয্য করসে।” বলেই নিজের আঁচল মুখে রাখলো। এদিকে সা’দ কিছুটা ঘাবড়ে গেলো এই ভেবে সেদিনের ঘটনা কী তারা জেনে গেছে? তার চেয়েও বড় কথা এই সেহেরই ফুল? সা’দের ছোট চাচার মেয়ে? সা’দ যেন বিষম খেলো৷ কিছুতেই হজন করতে পারছে না এসব! কী থেকে কী হয়ে গেলো! শেষ অবধি তার চাচাতো বোনের সাথেই সা’দের বিয়েটা হলো? এই মেয়েটাই তার মায়াবীনি! সা’দের ভাবতে ভাবতে অবস্থা খারাপ। ঘুম থেকে উঠে এতোগুলা শক একসাথে পাবে কে জানতো?
—“তাহলে একটু আগের কথাগুলো কাকে বলছিলে?”
—“আর কারে আমার ফুলরে! মাইয়াটা সারাজীবন এই সংসারের লেইজ্ঞা খাইট্টা গেলো আর ওই কালসাপ(জোহরা) মরার মতো ঘুমায় গেলো। মাইয়াটাও বলি হারি, আমার ফুলের ছোড হইয়াও কী অত্যাচারটাই না করসে। বাপটার কথা তো বাদই দিলাম, গজবটায় ফুলের মায়রে খাইসে আর এহন আমার ফুলরে!”
হলেই বিলাপ করতে লাগলেন উনি। সেহের চুপ থাকতে ইশারা করলো কিন্তু দাদীমা ভাঙ্গা রেডিওর মতো বলেই গেলো। সেহের অসহায় দৃষ্টিতে একবার সা’দ তো আরেকবার দাদীমার দিকে তাকিয়ে রিমনকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রিমনকে উঠোন অবধি এগিয়ে দিয়ে ফিরবে সে। সা’দ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো আর নিজেই আহত হলো। এতোটা কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা! সা’দের মুহূর্তেই রাগ লাগলো, যাদের গতকাল এতো শ্রদ্ধা দিয়েছে তারাই তার মায়াবীনি, তার বউয়ের উপর এমন জুলুম করেছে! শাস্তি দেয়ার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে সা’দের গাঁয়ে। দাদীমা না বললে তো জানতেই পারতো না। সা’দ এবার দাদীকে জিজ্ঞেস করলো,
—“সুফিয়া চাচীকে কীভাবে মেরেছে চাচা?”
দাদীমা বলতে যাবে তখনই বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে সোফার রুমে চলে আসে। সকলের সামনে দাদীমা বললো না আর সা’দও জিজ্ঞেস করলো না। তপা এসে তার পাশে বসতে নিতেই সা’দ উঠে আসিয়ার কাছে গিয়ে বললো সে আর তানজীল হাঁটতে বের হবে। বলেই তানজীলকে নিয়ে সে বেরিয়ে গেলো। হনহন করে বের হওয়ার জন্য সা’দ সেহেরের সাথে ধাক্কা খেলো। আর এই দৃশ্য উপস্থিত সকলের চোখেই পরেছে। তপা এবং জোহরা তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। জোহরা হুংকার ছেড়ে বললো,
—“সেহের বাহিরে কই গিয়েছিলি? যা রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর!”
জোহরা কন্ঠ শুনে সেহের সা’দের সামনে থেকে সরে মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। সা’দ পিছে ফিরে জোহরার দিকে একপলক তাকালো। জোহরার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। সা’দ কী যেন ভেবে রুবাইকে ডাকলো। রুবাই সা’দের সামনে গেলে রুবাইকে সা’দ ফুসুরফুসুর করে কিছু একটা বুঝিয়ে দিতেই রুবাই “ওকে ডান” বলে মাথা নাড়ালো। সা’দ আরেকবার সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাইরে চলে গেলো। সা’দ যেতেই জোহরা এবং তপা গেলো সেহেরের কাছে। সেহের তখন নিজের ঘরে কাঁথা ভাঁজ করে বিছানা ঝেড়ে নিচ্ছে। জোহরা পেছন থেকে কেশে উঠলেই সেহের কাজ ছেড়ে পিছে ফিরলো।
—“মা, আপু তুমি?”
—“ভালোই রঙলিলা করতাছিস তুই তাই না? বড়লোক ছেলে পাইলি ওমনি নিজের রূপ দেখানো শুরু করলি তাই না?” অনেকটা রেগে কথাগুলো বললো তপা। তপার কথাগুলোর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি সেহের। সেহের কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
—“কী বলছো তুমি আপু আমি ঠিক বুঝলাম না!”
—“হাহ ন্যাকা! এমন ভাব ধরসে যে সে নিষ্পাপ। দেখ সেহের একদম ন্যাকামি করবি না, সা’দরে আমি আমার তপার জন্য ঠিক করে রাখসি! তুই যদি আবার ওদের মাঝে গন্ডগোল পাকাস তাহলে তোরে আমি মেরে তোর লাশ নদীতে ভাসায় দিবো! দুইদিন ভালো ব্যবহার করেছি বলে মাথায় চড়ে বসবি নাকি!”
—“মা তোমরা ভুল বুঝছো আমি তো ওনাকে….”
—“ওই চুপ! কিসের ওনা-ওনি? আরেকবার যদি তোরে আমার সা’দের আশেপাশে দেখি তাহলে আমাএ চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না! মনে রাখিস।”
বলেই ওরা বেরিয়ে গেলো। ওরা বের হওয়ার আগেই দরজার সামনে আড়ি পাতা মানুষটা সরে গেলো।
—“ছিঃ এরা এতো নিচে কী করে নামতে পারে? এরা কী ভুলে যায় উপরেও একজন আছে তাদের এসব কর্মের হিসাব চুকানোর জন্য! জাস্ট ঘেন্না ধরে গেলো এদের প্রতি!” বলেই নাক সিটকালো রুবাই।
চলবে!!!