দখিনা প্রেম,পর্ব ০৩,০৪

0
1532

দখিনা প্রেম,পর্ব ০৩,০৪
লাবিবা ওয়াহিদ
পর্ব ০৩

—“পাগল নাকি তুই? তোরে আমি নরকে তোরে পাঠামু তুই চিন্তা করলি কি কইরা? কোনোদিনও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না!” অত্যন্ত রেগে কথাগুলো বললো দাদীমা। সেহের দাদীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো।

—“দাদী! আমার বই-খাতা সব ওই বাড়িতে দয়া করে বোঝার চেষ্টা করো। আর রিমনটাও ভালো নেই গো, আমার যে ওর এই অবস্থা একদমই ভালো লাগছে না।”

—“তো আমি কি করমু? আর তোর বই-খাতা আমি আবিদরে দিয়া আইন্না নিমু তাও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না।”

—“ফুল দেখ বোঝার চেষ্টা কর। এবার তোর বাবা তোরে পাইলে সত্যি সত্যিই মেরে ফেলবে! তোর কী একটুও প্রাণের ভয় নেই?”

—“দুইদিনের দুনিয়ায় প্রাণের ভয় করে কী লাভ ভাইয়া? এরচেয়ে ভালো নয় কী উপর যিনি আছেন তার উপর ভরসা করে চলতে?”

আবিদ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সেহেরের দিকে তাকালো। সেহেরের চোখে মিনুতি। আজ অবধি কোনোদিন তারা সেহেরকে এই বাড়িতে রাখতে পারেনি এক অথবা দুইদিনের বেশি। কিসের টানে যে সেহের বারবার ওই বাড়িতে চলে যায় তা তাদের অজানা। কিন্তু কেউ-ই চায় না এই অসহায় মেয়েটাকে ওখানে রাখতে। সকলেই জানে সেহেরকে কতো অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আবিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেহেরের সামনে থেকে সরে আসলো। দাদীমা হাজার তর্ক, বকাবকি করেও সেহেরের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারলো না। তাই সেও আর কিছু বলতে পারলো না। সেহের রাতের খাবার খেয়েই চাচীর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে সেহের সেই বাড়িতে চলে গেলো। দরজায় নক করার মিনিটখানেক পর সৎমা দরজা খুলে দিলো। সেহেরকে দেখে সে কোনোরকম রিয়েকশন করলো না, সৎমা যেন আগেই জানতো সেহের আসবে। সেহের ম্লান হেসে ভেতরে প্রবেশ করে বললো,

—“রিমন কোথায় মা?”

—“ঘুমিয়েছে।”

—“কোনো কাজ আছে? আর বাবা আসেনি?”

—“না আসেনি। থালাবাসনগুলো আছে সেগুলো পরিষ্কার কর গিয়ে। আমি গেলাম শুতে।”

বলেই হাত পা টানতে টানতে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলো। সেহের কিছু না ভেবে উপরে রিমনের ঘরে চলে গেলো। গাঁয়ে কাঁথা জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে তার প্রিয় ভাই। সকালে উঠে বোনকে দেখতে পেয়ে রিমন কেমন রিয়েকশন করতে সেটাই ভাবছে সেহের। মুচকি হেসে ভাইয়ের রুমে গিয়ে ভাইয়ের মাথার পাশে বসলো। কিছুক্ষণ পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সৎমায়ের কথানুযায়ী চলে গেলো কাজ করতে৷ যদিও সেহের এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয় তবুও কিছু বলেনি। গ্রামের প্রায় সকলেই জানে সেহের কী পরিমাণ অত্যাচারিত হয়। কিন্তু সেহের মুখে স্বীকার করে না দেখে কেউ কিছু করতে পারে না। সেহের স্বীকার করলে হয়তো তার বাবা এবং সৎমায়ের সকল কাড়সাজি একদিনেই ঘুঁচে যেতো৷ থালাবাসন মেজে ধুয়ে উঠতেই কিছু ভাঙার শব্দ পেতেই সেহেরের টনক নড়লো। ওড়না দিয়ে ভেজা হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো তার বাবা মাতাল হয়ে এদিক সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। সে নিজের মাঝে নেই। সেহেরের দিকে চোখ যেতেই কবির বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,

—“কিরে ফইন্নির ঝি! এতদিন কোন নাগরের লগে ছিলি হ্যাঁ? তোর আবুল না কী জানি নাম, ও হ্যাঁ আবিদ। ওর তো তোর লেইজ্ঞা দরদ এক্কেবারে উতলায় পরে। তা আর কতো নাগর আছে রে? মা** বাসায় যে কাজ পইরা ছিলো হেইডি দেখসিলি! আমার বউডা কত্তো কষ্ট করসে দুইডাদিন! তোর এই আবুইল্লা কারণে আমার বউডা কতহানি পালসে আমার পুলারে। খবরদার যদি আমার পুলার গাঁয়ে একটা আঁচড়ও কাডোস তোরে আমি এবার ছাদ থেইক্কা লাত্থি মাইরা ফেইলা দিম!” এমন নানান বিলাপ বকছে কবির। সেহের চুপচাপ শুনছে কিছু বলছে না। বাবার এসব কথায় কষ্ট লাগলেও কেন জানি কান্না পায় না। কান্নারাও ক্লান্ত এইসব শুনতে শুনতে। একসময় এসব বকর বকর থেমে গেলো। কবির সেখানেই লুটিয়ে পরে ঘুমে কাত। সেহের লাইট বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে সে চেয়ারে বসে গেলো পড়তে। সারাদিন কাজ করে সেহের এই রাতেই নিজের পড়ালেখা শেষ করতে পারে। সৎমা কখনোই চায় না সেহের পড়ুক তাই সে সারাদিন নানা কাজে সেহেরকে ব্যস্ত রাখে কিন্তু সেহের যে রাতে পড়ে সেটা তার অজানা। পড়াশোনার জন্য সেহের অনেক কষ্ট ভোগ করেছে কিন্তু কেউ তার লেখাপড়া দমাতে পারেনি। জেঠু সেহেরের পড়াশোনার খরচ বহন করে তাই কবির এই বিষয়ে কিছু বলে না। বলা যায়, প্রয়োজনবোধ করে না। সৎমা নানানভাবে সেহেরের পড়াশোনা বন্ধ করতে বললে কবির সবসময় এক কথাই বলে,
—“ওর লেহাপড়া দিয়া আমার কোনো কাম নাই। আমি তো ওর পড়ার খরচ দিতাসি না ভাই দিতাসে! তো খাক স্যারগো জুতার বাড়ি!”

এক কথা শুনতে শুনতে সেহেরের মা ক্লান্ত। তাই সে আর তার স্বামীকে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে না। নিজে আর তার মেয়ে মিলে দমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।

—“উফফ মা বলো না তোমার কী হয়েছে? এভাবে মাথায় আইসব্যাগ দিয়ে বসে আছো কেন?”। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে সা’দ। সা’দের কথা পাত্তা না দিয়ে মা চোখ বুজে আগের মতোই মাথায় আইসব্যাগ ধরে বসে আছেন। রুবাই হাতে ফাইল নিয়ে ক্যারিডোরে পায়চারি করছে আর ফাইল দেখে দেখে ফোনে কাউকে কিছু বলেই চলেছে। সা’দ ফোনে যখন শুনলো তার মার এই অবস্থা তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছে। এদিকে তার মাও কিছু বলছে না। আচ্ছা ফ্যাসাদে পরেছে সা’দ৷ সা’দ লম্বা শ্বাস ফেলে খুবই দৃঢ় গলায় বললো,

—“মা তুমি বলবে নাকি আমি যাবো? আমার শিডিউল আছে মা প্লিজ চুপ করে থেকো না।”

এবার উনি চোখ মেলে তাকালেন আর কড়া কন্ঠে বলে উঠলেন,

—“সারাদিন এত শিডিউল শিডিউল করে তো ফ্যামিলিকেই ভুলে যাস! মনে থাকে না ফ্যামিলিকেও তোর সময় দিতে হয়?”

—“দেখো মা! আমি যথেষ্ট সময় দেই তোমাদের। কিন্তু হঠাৎ এসব বলছো কেন তুমি? নিশ্চয়ই ঘাবলা আছে!” ভ্রু কুচকে প্রশ্নটা করলো সা’দ। মা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

—“সামনে কুরবানির ইদ। কতোদিন হলো গ্রামে যাই না, শাশুড়ীর সাথে আলাপ করতে পারি না। তোদের ব্যস্ততা কী এই জীবনে শেষ হবে না?”

—“আহ মা! ইদ আসতে আরও দেড় মাসের মতো বাকি। আর তুমি এই দেড় মাস আগে এসে বলছো ইদ করতে যাবে। এসব চিন্তা ছাড়া আর কিছু কী নেই?”

—“এই তুই চুপ কর। সারাদিন আজারে বসে থাকলে এসব চিন্তা আসবেই। এখন আমায় বল এবার গ্রামে ইদ করবি? বল!”

—” তুমি তাহলে জাস্ট এই কথাটা বলার জন্য আমায় ডেকে পাঠিয়েছো? পাক্কা ১ ঘন্টার জ্যাম সহ্য করে আমি এখানে আসছি তোমার এইসব কথা শোনার জন্য? হায় আল্লাহ!”

—“তাহলে তুই কী বলতে চাস? আমি তোকে ডিস্টার্ব করেছি? হায় আল্লাহ তুমি আমাকে এই দিন দেখালে! সন্তান তার মায়ের জন্য বিরক্ত!”

—“মা প্লিজ বাজে বকিও না। আমি অনেক টায়ার্ড রুমে যাচ্ছি।”

বলেই উঠে যেতে নিলো তখনই মা বলে উঠে,

—“খেয়েছিস?”

সা’দ থেমে পিছে ফিরে বলে,
—“নাহ খাইনি। তবে আপনার যদি এই অবলা পুত্রের উপর দয়া হয় তাহলে অতি দ্রুত আমার কক্ষে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমায় ক্ষুদামুক্ত করতে পারেন।”

সা’দের কথায় মা আইসব্যাগ নামিয়ে হুঁ হাঁ করে হেসে দিলো। সা’দও মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখলো সেন্টার টেবিলে খাবার এবং কফি রাখা। সা’দ আগে গিয়ে কফিটাই নিয়ে নিলো। কফিতে চুমুক দিতে দিতে কারীবকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ আর সে বেরোবে না। একেবারে কাল ১১টা নাগাদ যেন সে চলে আসে। সা’দের কথায় ওকে বলে কারীবও কল রেখে দিলো। সা’দ কাজের সময় বেশি কথা পছন্দ করে না তাই কারীব কিছু বলে নি। কারণ সে তার স্যারকে ভার্সিটি লাইফ থেকেই চিনে। সা’দের থেকে ৩ বছরের জুনিয়র সে। একবার সা’দের ব্যবহারে কারীব তাকে বেশ পছন্দ করেছিলো। তাই সে দিনরাত লেগে থাকতো সা’দের মন জয় করার জন্য। একবার সা’দ বেখেয়ালিভাবে ফোন চালাতে চালাতে হাঁটছিলো। সেদিন কারীবের জন্যই আরেকটুর জন্যই ট্রাকের নিচে যায়নি সে। সেই থেকে সা’দের আলাদা মমতাবোধ জম্মায় কারীবের প্রতি। সা’দ এবার লক্ষ করলো কারীব তার আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে তাই সা’দ কারীবের সাথেই মিশলো। সা’দের বন্ধু-বান্ধব ছিলো না বললেই চলে। যতো বন্ধু আছে কেউই তার ক্লোজ না। কিন্তু কারীব হয়ে উঠলো তার ভালো বন্ধু এবং ছোট ভাই। সা’দ তার প্রফেশনে কারীবকে নিয়েই শুরু করেছিলো। কেন জানি না সা’দ তাকে বড্ড ভালোবাসে, আর হয়তো এও জানে তার প্রফেশনে কারীবই তার প্রকৃত বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে।

প্রতিদিনের মতো সেহেরের আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ কচলাতে কচলাতে বাম হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সে বই হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলো। সেহের অসুস্থ বিধায় বেশিক্ষণ চেয়ারে বসে পড়তে পারেনি। তাই সে বইটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই পড়ছিলো। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার জানা নেই। নামাজ পড়ে সে নাস্তা বানাতে চলে গেলো। নাস্তা বানানোর আগে এক কাপ চা খেয়ে নিলো। এতে যেন তার মন ফুরফুরে এবং সতেজ হয়ে গেলো। শরীরের ম্যাজম্যাজ ভাবটাও কেটে গেলো। রুটি ভেজে বেরিয়ে এসে দেখলো কবির মেঝেতে নেই। নিশ্চয়ই উঠে গেছে সে। সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছুটলো তার প্রিয় ভাই রিমনের কাছে। এখন বাজে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট। রিমনকে হালকা ডাকতেই সে পিটপিট করে তাকালো। সেহেরের হাসিমুখটা দেখে রিমন লাফ দিয়ে উঠে বসলো। যখন দেখলো সত্যি সত্যিই সেহের বসে আছে তখন জাপটে ধরলো সেহেরকে। সেহেরও পরম সুখে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।

—“বুবু তুমি এসেছো! তুমি এসেছো আমার কাছে?”

—“হ্যাঁ ভাই আমার এসেছি। এখন উঠ দেখি ৮টায় স্কুল আছে তো। খাবে কে শুনি?”

স্কুলের কথা শুনে রিমন বিরক্তের সাথে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। তারপর নাক ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,

—“আমার খুশির সময় কেন স্কুলটা নামটা টেনে আনো বলো তো? যাও কথা নেই!”

সেহের হেসে দিলো রিমনের কথায়। এরপর রিমনের নাক টেনে মুচকি হেসে বলে,

—“ওরে আমার ভাইটা! বাস্তবজীবনে পড়াশোনা অনেক জরুরি সোনা, তাই এসব বলতে নেই। এখন উঠুন খেতে হবে তো নাকি?”

রিমন মাথা নেড়ে উঠে চলে গেলো ওয়াশরুমে। সেহের নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়তে থাকলো। কিছুক্ষণ পর রিমন স্কুলের ইউনিফর্ম পরে নিচে নামলো। রিমন চেয়ার টেনে বসতেই সেহের অতি যত্নে ভাইকে খাওয়াতে শুরু করলো। রিমনও মজার সাথে খাচ্ছে। রিমনের খাওয়ার মাঝেই সৎমা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ডাইনিং এ আসলো। জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে রিমনের দিকে না তাকিয়েই আবার ঘরে চলে গেলো। তার চোখে এখনো ঘুম আছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সেহেরকে বললো,

—“আমার ঘরের পানির জগটায় পানি নেই। পানি ভরে দিয়ে যাস তো!”

সেহের উত্তরে শুধু “আচ্ছা” বললো। কিন্তু সৎমা উত্তর শোনার আগেই রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। তার যেন প্রয়োজনবোধ নেই সেহেরের উত্তর শোনার।

চলবে!!

দখিনা_প্রেম
লাবিবা_ওয়াহিদ
পর্ব ০৪

সেহের নিশব্দে মরিচা ধরা গ্রিলটা ধরে আকাশের পানে তাকিয়ে রয়েছে৷ মনে তার কালো মেঘের গর্জন দিচ্ছে, মেঘের অশ্রু তার চোখজোড়া বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পরছে। কিছুক্ষণ আগেই তপা শুধু শুধু সৎমার হাতে চড় খাইয়েছে সাথে নিজের জম্ম পরিচয় নিয়েও অনেক বাজে কথা শুনেছে তাও নিজের জম্মদাতা বাবার সামনে যা সেহেরের সহ্যের সীমানার বাইরে। তপা কেন তাকে সহ্য করতে পারে না তা সেহের না। সেহের আকাশের পানে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো,

—“মা! ও মা। আমার কষ্ট দেখতে পাচ্ছো মা? কেন আমায় এই নরকে ফেলে চলে গেলে? কেন মৃত্যুর আগে ওয়াদা করিয়ে গেলে বাবা এবং সৎমায়ের খেয়াল রাখ নিয়ে? কেন রিমনের জন্য এ বাড়িতে থাকার ওয়াদা দিলে মা? তোমার ওয়াদার কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতেও যে পারি না মা। আমার অপরাধ কী মা? কেন সবাই আমার উপর এমন অত্যাচার করে?

মা তুমি বলেছিলে না আমি তোমার সুন্দর সকালের লাল টুকি ফুল। তাহলে তোমার এই ফুলটার কপালে সুখ কেন লেখা নাই মা? আর বাবা? আমার বাবা থাকতেও আমি এতিম, আমার জম্ম নিয়ে বাজে কথা শুনতে হয়!”
বলেই ডুঁকরে কেঁদে উঠলো সেহের। কিছুক্ষণ কেঁদে আপনমনে বলে উঠলো,

—“মা জানো আমার মাঝে মাঝে এই নরক ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা হয়, অনেক দূর! কিন্তু পারি না গো মা! তুমি যেমন আমার কাছে প্রয়োজন ঠিক তেমনই তোমার কথা। তাইতো যেদিন সৎমা এসে তোমার ওয়াদার কথা বললো সেদিন থেকে চাইলেও এই বাড়ি আর বাবা, রিমনকে ফেলে চলে যেতে পারিনি।”

সেহেরের কান্নার মাঝেই সে রিমনের কন্ঠ শুনতে পেলো। দরজার ওপারে রিমন ধাক্কাচ্ছে আর বারবার আপু আপু বলে ডাকছে।

—“আপু আপু! কী হলো দরজা লাগালে কেন আপু? খাবে না তুমি?”

—“আর খাওয়া! ভাইরে কবে পেট পুড়ে খেয়েছি আমার কনে পরে না রে। এই জীবনটা যে আমার বড্ড কঠিন।” আপনমনে বিড়বিড় করে বললো সেহের।
রিমনের আবার হাক শুনতে পেতেই সেহের নিজেকে স্বাভাবিল করে ভাঙ্গা গলায় বললো,

—“ভাই আমি খেয়ে নিবো। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড় ভাই কাল যে তোর স্কুল আছে!”

—“আচ্ছা আপু। তুমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেও আর মনে করে খেয়ে নিও। আসছি।”

বলেই রিমন দরজার সামনে থেকে সরে নিজের ঘরে চলে গেলো। দূর থেকে তপা সবটা দেখতে পেলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তপা আপনমনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

—“ঢং দেখলে বাঁচি না।”

—“কীরে তপা খাবি না মা?”

—“খেয়েছি মা তুমি গিয়ে ঘুমাও।”

বলেই একপ্রকার রাগ দেখিয়ে উপরে চলে গেলো। সৎমা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। বয়স যতো বাড়ছে তার আলসামো যেন সেই হারে বেড়েই চলেছে। ছেলে-মেয়ে, সংসার এসব সামলানোর সময় কই? সে নিজে বিশ্রাম নিতেই যে ব্যস্ত। স্বামী কি করছে না করছে সেটা নিয়েও চিন্তা করে না। সবটা সামলাতে আছে তো সেহের। এইজন্যই সৎমা কখনো সেহেরের বিয়ের কথা উঠায়নি। সেহের চলে গেলে যে সে রাজরানীর মতো শুয়ে-বসে কাটাতে পারবে না।

সা’দ একটা সুন্দর বাগানে বসে প্রকৃতি বিলাস করছে। কিছুক্ষণ আগেই শুটিং সেরে সবে বিশ্রাম করতে বসলো। নানান ফুলের সুঘ্রাণে চারিপাশটা মৌ মৌ করছে। কিছু কিছু ফুলের ওপর দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি উড়ছে নাহয় ফুলের উপর বসে খাদ্য পান করছে। নীল আকাশ তার মাঝে ভ্যালার মতো টুকরো টুকরো মেঘ। এ যেন বসন্তের সুখবর। হঠাৎ অদূরে সা’দ খেয়াল করলো এক অপরূপ হুরপরী আকাশ থেকে নামছে। চেহারা থেকে যেন রূপের ঝলকানি উপড়ে পরছে। সা’দ মুগ্ধ নয়নে সেই কন্যাটিকে দেখছে। কন্যাটির রূপের ঝলক যেন সা’দকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মেয়েটির দীঘল রেশমি কেশ অবাধ্য হয়ে বাতাসের তালে উড়ছে। মেয়েটি অতি যত্নে নিজের অবাধ্য কেশ সামলাচ্ছে। সা’দের দেখা যেন শেষই হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সা’দের ইচ্ছে করছে সময়টা থেমে যাক। এই মায়াবী আর স্নিগ্ধময়ী চেহারা দেখে প্রাণ জুড়াচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে সারাজীবন সে এই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার দেখার তৃষ্ণা মিটবে না। মেয়েটি মাটিতে পাড়া দিতেই সব ফুল উড়ে তার চারপাশটা ঘিরে সুঘ্রাণ ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সুঘ্রাণ সা’দের নাকেও এসেছে। হঠাৎ ফুলগুলো শুকনো পাতার মতো শুকিয়ে মাটিরে পড়ে গেলো। চারপাশে নীল আকাশ যেন অন্ধকারে ঢেকে গেলো আর বড়ো বড়ো বিজলি পরতে শুরু করলো। সাথে সাথে চারপাশের সকল ফুলগাছে মরে নেতিয়ে গেলো। বাজের বিকট শব্দে মেয়েটি কানে হাত দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। এবার সা’দ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। চোখের পলকে এসব হলো কী করে সেটাই ভেবে চলেছে সে। পায়ে তরল কিছু অনুভব হতেই সা’দ পায়ের দিকে তাকালো। একি! এ যে রক্ত! সা’দ ভীতদৃষ্টিতে চারপাশে তাকালো। পুরো মাটি রক্তের পুকুরে পরিণত হয়েছে আর এই রক্ত সব মেয়েটির থেকেই আসছে। এবার মেয়েটি মাথা উঁচু করে সা’দের দিকে তাকালো। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে চাপা গলায় বলে উঠলো,
—“আমায় এই নরক থেকে মুক্ত করুন সা’দ সাহেব! ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”
বলেই মেয়েটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।

সা’দ লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো। ভীষণ হাঁপাচ্ছে সা’দ। সা’দ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে তার ঘরে তারই বিছানায় শুয়ে। এসি চলছে তাও সা’দের খুব উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে। কপাল থেকে চুল সরাতে যেতেই খেয়াল করলো সা’দ ঘেমেও গেছে অনেক। সা’দ চটজলদি বালিশের পাশে থেকে এসির রিমোটটা হাতে নিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। রিমোটটা রেখে পাশের বেডবক্স থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে সবটা খেলো। সা’দের অস্থিরতা যেন কাটছে না। কে ছিলো সেই মেয়ে? সা’দ মেয়েটার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু সে ভুলে গেছে। সা’দ ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। আবছা আলোয় বেশ বোঝা গেলো ঘড়ির কাটাটা ৩টার মাঝেই আছে। সা’দ এসব চিন্তা সাইডে ফেলার চেষ্টা করে আবার শুয়ে পরলো কিন্তু তার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘুম সহজে ধরা দিলো না। ঘুম যেন স্বপ্নের সাথে পালিয়েছে। স্বপ্নের মেয়েটা কেন যেন সা’দকে বড্ড পোড়াচ্ছে। স্বপ্ন তো স্বপ্নই! তাও কেন তার এতো ছটফটানি? অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলো না। তাই সে উঠে বেলকনি গিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। তাও তার ঘুম আসছে না। অবশেষে আযান দিলো। সা’দ বেলকনি থেকে ওউ করতে চলে গেলো। নামাজ পড়ে, জগিং শেষ করে বাসায় আসতেই দেখলো তার মা সবে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে যাচ্ছে। সা’দ ক্লান্তি সুরে বললো,

—“মা কফি পাঠিয়ে দিও তো সাত টার মধ্যে বেরোতে হবে, কারীবও সাড়ে ছ’টা নাগাদ চলে আসবে!”

—“আয়হায় সে কী বলিস? আমি তো এখনো রান্নাই করলাম না। আর এখন তো ছ’টা বাজছে।”

—“আরে মা এতো উতলা হওয়া লাগবে না। সার্ভেন্টকে দিয়ে রাঁধিয়ে নিয়েছি। এখন জলদি কফি পাঠাও।”

বলেই সা’দ উপরে চলে গেলো। রাতে না ঘুমানোর ফলে সা’দের মাথা ধরে আছে সাথে রয়েছে চোখের অসম্ভব জ্বালা। ঠিক সাড়ে ছ’টায় কারীব এসে হাজির হলো। সা’দ আর কারীব একসাথে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে গেলো। মা জেগে থাকলেও বাকিরা এখন ঘুম। রুবাই আর সা’দের বাবা ৮-৯ টায় উঠে। তাদের অফিস ১০ টায়। রুবাই অর্ধেক রাত নিজের হাসবেন্ডের সাথেই কথা বলে কাটিয়ে ফেলে। রুবাইয়ের বিয়ে হয়েছে আরও ৪ বছর আগে। রুবাইয়ের হাসবেন্ড তানজীল ইতালিতে বিজনেসে আছে আর সেখানেই তানজীল থাকে। সা’দের বাবার বিজনেস পার্টনার ছিলো তানজীল। একবার বাংলাদেশের এক পার্টিতে রুবাইকে দেখে পছন্দ করে বসে। এর কয়েকদিনের মাঝেই সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। তানজীলের বাবা-মা নেই তবুও তানজীলের ব্যবহার খুবই ভালো ছিলো। তাই পরিবার থেকে সকলে রাজি হয়ে যায়। রুবাই তখন কোনো অমত করেনি কারণ তার পছন্দের মানুষ ছিলো। তাদের বিবাহিত জীবন ভালোই চলছিলো, তানজীল রুবাইকে ইতালিতে নিয়ে সেটেল হয়। এর কয়েকমাস পরেই জানতে পারে রুবাই কনসিভ। এই সুখবর শুনে সেদিনই সা’দের বাবা-মা ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয় কিন্তু সা’দের শুটিংয়ের প্রেশার থাকায় যেতে পারেনি। তখন সা’দ একদমই নতুন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাই নিজেকে প্রমাণ করতে তখন তার উপর দিয়ে বেশ চাপ যেতো। তবে বিপত্তি ঘটে আরেক জায়গায়।
রুবাইয়ের প্র‍্যাগন্যান্সির ৫ মাসে একটা এক্সিডেন্টে সে তার বাচ্চাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। সাথে হারিয়ে ফেলে নিজের মা হওয়ার আনন্দ। সেদিন ডক্টর বলেছিলো রুবাই আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। একজন নারীর জন্য এর চেয়ে বড় জঘন্য যন্ত্রণা কী-ই বা হতে পারে? রুবাই তখনো ধৈর্য ধরে চুপ করে ছিলো। বিদেশের মাটিতে তানজীল নামক আপনজন ছাড়া যে তার আর কেউ নেই। সারাদিন রুবাই একা রুমে পরে থাকতো। তানজীল প্রথম কিছুদিন রুবাইকে সময় দিতে পারলেও পরে অফিসের কাজের জন্য তাকে রাত করে ফিরতে হয়। এই একাকিত্ব জীবনে তার দুঃখ যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। তাই রুবাই সিদ্ধান্ত নেয় সে বাংলাদেশ নিজের বাসায় থাকবে। আপনজন ছাড়া তার পক্ষে এখানে থাকা একদমই অসম্ভব। তানজীলও অমত করেনি। তানজীল এমন একটা মানুষ সে রুবাইকে বুঝে ফেলে। ১ সপ্তাহর মাঝেই রুবাই বাংলাদেশ আসে। আর তানজীল রুবাইকে কথা দেয় সে বাংলাদেশে সেটেল হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সেদিন থেকে তানজীল দিনরাত চেষ্টা করে গেছে নিজের অফিস এখান থেকে বাংলাদেশে ট্রান্সফার করার জন্য। কিন্তু ইতালির নানান ঝামেলা শেষ করতে করতেই তানজীলের চার বছর পেরিয়ে গেছে। অবশেষে সে ছ’মাস পরেই বাংলাদেশে সেটেল হতে পারবে। তবে মাঝেমধ্যেই প্রিয়তমার সাথে সময় কাটাতে তানজীল দেশে আসতো। রুবাই দেশে আসার পর থেকে বাবার সাথেই সে আবার তাদের বিজনেসের হাল ধরে। আর সা’দ! সে তো কোনোকালেই এমুখো হয়নি। সে সবসময় তার ইচ্ছাকেই প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে। ৩টা বছর এতো বুঝোনোর পরেও সা’দ রাজি হয়নি। সে নিজের কথা থেকে ১ ইঞ্চিও এদিক সেদিক হয়নি।

—“আর কতোদিন এসব অন্যায়-অবিচার সহ্য করবি তুই? তোর মাঝে কী রাগ নেই প্রতিবাদ করার মতো? কী করে পারিস কথায় কথায় ওইসব অমানুষগুলোকে ক্ষমা করে দিতে?” কপট রেগে কথাগুলো বললো মানজু। সেহের নিজের মুখের মুখোশ ঠিক করতে করতে ম্লান হেসে বলে,

—“চেরি কার্টার-স্কট কী বলে জানিস? উনি বলেছেন ‘রাগ আপনাকে আরও ছোট করে তোলে, এবং ক্ষমা, আপনি যা তার থেকেও বড় করে।’

—“হইসে তোর এইসব ভংচং উক্তি আমাকে শোনাতে আসবি না। ক্ষমা মহৎ গুণ সেটা সবাই জানে! কিন্তু সকলকে বারবার ক্ষমা করতে নেই। ক্ষমা তাকেই কর যে তোর ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য।”

—“উফ কী শুরু করলি বল তো? এমনিতেই গরমের তাপে অনবরত ঘামছি আর তুই বাবা আর মাকে বকছিস!!”

—“এই মেয়ে আমি কী শুধু শুধু চেঁচাই? তোর ওই মাতাল বাপরে তো আমার মাগুর মাছে খানা বানাইতে ইচ্ছা করে! ওই অমানুষটার জন্যই তো তোর মুখোশ বাঁধতে হইসে। গরম খুন্তির কালচে দাগ তো এখনো তোর মুখ, থুতনি আর ঠোঁটের চারপাশে রইসে। বিশ্বাস কর একবার সামনে পাই। এক্কেবারে স্যান্ডেল ফিক্কা মারমু!”

—“তোর বকবকানি হলে এখন আসতে পারিস আমার যেতে হবে!”

—“যাবি মানে কই যাবি?”

—“দাদীর কাছে। সেদিনের পর তো বাসা থেকে বের হতে পারি নাই, আজ কলেজ আসছি এই একটা সুযোগ!”

—“তোর বইন তপায় যদি তোর নামে বিচার দেয়?”

—“তপা আপু তো আজ কলেজ যায়-ই নি। সে তো মনে হয় এখনো ঘুমাচ্ছে।”

—“এক সেকেন্ড তুই ওরে আপু ডাকিস কেন? তুই না ওর বড়?তুই তো সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী আর ওই তপা তো সবে ম্যাট্রিক দিয়া ইন্টারে উঠসে।”

—“ওসব কিছু না। সে বলে দিয়েছে তাকে যেন আপু ডাকি। আর ডাকলেই বা সমস্যা কী? ছোট বড় সকলকেই আপু ডাকা যায়!”

সেহেরের কথায় মানজু যেন আরও রেগে বোম হয়ে গেলো। সে রেগে উচ্চসরে বলে উঠে,

—“তোর আপুর গুল্লি মারি! চ্যাঙ্গা মাইয়ারে আপু ডাকে! এই দুনিয়ার তোর মতো বলদ এই এক পিসই আছে। কেমন পারিস তুই ফুল? যেখানে তোরে কেউ রেসপেক্ট করে না সেখানে কি না তুই মরতে যাস! যা ইচ্ছা কর আমি তোর সাথে আর নাই? যা গিয়ে আরও ঝাটার বাড়ি খা।”

বলেই মানজু সেহেরকে রেখেই উল্টোদিকে হাঁটা ধরলো। সেহের নিশ্চুপ হয়ে মানজুর যাওয়া দেখছে। মানজু আগেও এমন রাগ দেখিয়ে কথা বলেছিলো তবে তার রাগ বরফের মতোই খুব জলদি-ই গলে যায়। রাগ যেতেই মানজু সেহেরের কাছে এসে তার গলা জড়িয়ে বসে কাঁদো কাঁদো গলায় কথা বলতে শুরু করে দেয়। সেহের আপাতত সেই মুহূর্তেরই অপেক্ষায় আছে। ভাবতেই সেহের মুখোশের আড়ালেই মিষ্টি হাসি দিলো। এই একজন সখী সেহের বেশ ভাগ্য করে পেয়েছে। এই একটা মানুষই তার সুখ দুঃখের ভাগীদার হয়। কিন্তু সবাইকে কী তার ভেতরের কষ্টটা বলা যায়? সেহের একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেঠুর বাসার দিকে চলে গেলো।

দাদী সেহেরকে অনেক সময় নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো আর চাপাস্বরে কাঁদছিলো। সেহেরকে সে একবারের জন্যেও ছাড়েনি। এতো করে সেহের সামলানোর চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই সফল হলো না। দাদীমা বিলাপ করতে করতে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলেন। আবারও সেহেরের সুখাবারের দেখা মিললো। কারেন্ট না থাকায় চাচী সেহেরকে বাতাস করছিলো আর সেহের তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিলো। হাঁসের মাংস, মিনি চিংড়ি মাছের ভর্তা, লাল শাক সাথে শশা, পেঁয়াজ, টমেটোর সালাদ। জম্পেশ খাওয়া হলো সেহেরের। খাওয়া শেষ হতেই সুখের ঢেকর তুললো সে। নাতনীর মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে দাদীমার প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেলো। হাত ধুঁয়ে বসে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো দেরী হয়ে গেছে। সেহের তৎক্ষনাৎ গামছা দিয়ে হাত মুখ মুছে সকলকে বিদায় দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরলো। সেহের থাকাকালীন আবিদকে দেখতে পায়নি। হয়তো কোনো কাজে বাসার বাইরে ছিলো। সেহেরদের বাসা জেঠুর বাসা থেকে বেশি দূরে নয় জাস্ট ১৫ ধাপের পথ। তবে সেহের বাড়িতে না গিয়ে আগে পুকুরপাড়ে গেলো। পুকুরপাড় থেকে নরম কাঁদামাটি নিয়ে কোনোরকম নিজের জামার কিছু অংশে লাগিয়ে নিলো। লাগানো শেষ হতেই পুকুরের পানিতে হাত ধুঁয়ে আল্লাহর নাম নিতে নিতে বাসার দিকে গেলো।
বাসায় গিয়ে দেখে বাঁশের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে টেলিভিশন দেখতে ব্যস্ত তার সৎমা। সেহের একটা শুকনো ঢেঁকুর তুলে বিড়বিড় করে “বিসমিল্লাহ” বলে বাসায় প্রবেশ করলো।

সৎমা কোণা চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আবার টেলিভিশিনের দিকে তাকালো। হঠাৎ কী মনে করে টিভি বন্ধ করে রিমোটটা রেখে সেহেরের দিকে ফিরলো। সেহের চুপচাপ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আজ আবার বোম ফাটবে যা সেহের বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে।

—“কীরে নবাবের ঝিঁ! ভরদুপুরে কই গেছিলি? ঘরে যে কতোডি কাম আছে সেইগুলা দেখছিলি? ছাগলের বাচ্চা! আমার খাস আমার পড়োস আবার আমার টাকায় আনন্দ ফূর্তি করতে গেছিল! হারামজাদী!”

—“মা! বাবা ডেকে পাঠিয়েছিলো খালের দিকে। জালে পাথর বাঁধানোর জন্য। দেখো আমার জামাতেও কাঁদা লেগে আছে!” সৎমার কথা শেষ করতে না দিয়ে সেহের বললো। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে জামার কাঁদা লাগা অংশটুকু দেখালো সৎমাকে।
কাঁদা দেখে উনি কিছুটা নরম হলেন। তাও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

—“আচ্ছা বুঝলাম। এহন যা থালাবাসন আর জামা-কাপড় ধুঁয়ে দে। এগুলা শেষ হইলে উপর তলা মুছবি! আজ আমার ভাগনে আইতাসে! তার আপ্যায়নে যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে।”

বলেই উঠে চলে গেলো। এদিকে ভাগনের শুনে সেহের কেঁপে উঠলো। সৎমায়ের ভাগনের নাম রাফসান। লুচ্চামিতে মাস্টার সে। সেহেরকে সে নানানভাবে উত্ত্যক্ত করার ধান্দায় থাকে আর সবার সামনে নিষ্পাপ বান্দার মতো থাকে। রাফসানকে সেহেরের দু’চোখে সহ্য হয় না। সৎমা যাওয়ার আগে বলে গেলো,
—“আর হ্যাঁ৷ বেসিনের ধারে পান্তাভাত রাখসি, কালকের বাঁশি তরকারির আলু পটল ছিলো সেগুলা দিয়া খাইয়া নিস!”

সেহের উত্তরে শুধু মাথা নেড়েছিলো। ব্যাগটা রুমে গিয়ে রেখে একটা লম্বা গোসল দিলো। গোসল শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে সৎমায়ের রুমের দিকে গেলো। রুমে গিয়ে দেখে সৎমা ঘুমে কুপোকাত। সেহের আস্তে করে দরজা ভিঁজিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। তার তো পেট পুরো ভরা এসব খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার এই পান্তাভাত পরে থাকলে আরও খারাপ কথা শোনা লাগবে। সেহের ভেবে পাচ্ছে না সে এখন কী করবে। পরমুহূর্তে কিছু একটা মনে হতেই একটা কড়াইয়ে পান্তাভাত নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেলো৷ দূরে একটা কুকুর দেখতে পেতেই কিছুটা ঝোঁপে গিয়ে পান্তাভাত ফেলে দিলো। পান্তাভাত ফেলা দেখে কুকুরটা দৌড়ে ঝোঁপের কাছে চলে আসলো। খাবার পেয়ে চটজলদি খাওয়া শুরু করলো। সেহের হাঁটু গেড়ে বসে কুকুরটার খাওয়া দেখছে। কুকুরটা তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে জিহবা দিয়ে ফাস ফাস করে কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সেহেরও নাটিটা নিয়ে ভেতরে চলে এলো। থালাবাসন ধুঁয়ে উঠে দাঁড়াতেই রিমন এসে হাজির হলো,

—“বুবু বুবু একটা লোক কুলফির আইসক্রিম এনেছে?”

—“মানে?” অনেকটা অবাক হয়ে বললো সেহের।

—“আরেহ! মানে হলো ওইযে স্কুলের সামনে যে কুলফিওয়ালা কুলফি আইসক্রিম বিক্রি করতো উনি আমাদের বাসার এদিকে আসছে। চলো না কুলফি কিনে দাও ”

—“টাকা কই পাবো ভাই?”

—“আমার কাছে জমানো কিছু টাকা আছে তুমি চলো।”

—“না আরে ভাই তুই একা গিয়ে কিনে আন। মা একবার টের পেলে আমাকে আস্ত রাখবে না!”

—“আরে ধুর কিছু হবে না আসো!”

বলেই সেহেরের হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলো। সেহের এতো বলেও রিমনকে থামাতে পারেনি। শেষে সেহেরকেই কিনে আনতে হলো রিমনের জন্য দুইটা কুলফির আইসক্রিম। রিমন একটা নিয়ে অপরটা নিলো না। সেহের ভ্রুজোড়া কুচকে বললো,

—“একটা নিলি কেন ভাই এটাও নে আর জলদি খা। যা কাঠফাটা রোদ গলে যাবে তো।”

—“ওটা তোমার জন্য আপু তুমি খাও!”

—“আমার জন্য মানে?”

—“আহ বুবু! এতো মানে মানে করো কেন? তুমি আর আমি মিলে খাবো দেখেই তো দুটো কিনেছি।”

সেহের আর কী বলবে। গরমে তারও আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছিলো তাই সে নিজেও খেলো। খাওয়া শেষ করে পানির মটর ছেড়ে জামা-কাপড় ধোঁয়ার জন্য ছাদে গেলো। ছাদের এক কর্ণারে কল আর সাথে জামা+কাপড় ধোঁয়ার জায়গা করা আছে। সকালে অনেকটাই ধুঁয়ে ফেলেছিলো সে তাই এখন ২-৪টা জামার বেশি নেই। সেহের আধোঁয়া জামা-কাপড়সহ জরুরি সাবান বালতি মগ নিয়ে ছাদে চলে আসলো। ছাদের কর্ণারে বসে জামা-কাপড় কাচাকাচি করে শুকোতে দিয়ে দিলো। কাজ করতে করতে সেহের ক্লান্ত হয়ে বসে পরে। রোদের তাপ এখনো কমেনি। গরমে সেহের ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো।

—“স্যার আপনার কফি!”

সা’দ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মাথা উঁচু করে কর্মচারীর দিকে তাকালো। কর্মচারীর হাতে কফি দেখে সা’দ ভ্রু কুচকে বললো,

—“আমি তো কফি চাইনি! তাহলে হঠাৎ?”

—“কারীব স্যারই তো পাঠালো।”

—“ওহ আচ্ছা। তাহলে সেন্টার টেবিলে রেখে চলে যাও।”

কর্মচারী মাথা নাড়িয়ে কফির মগটা রেখে নিজের কাজে চলে গেলো৷ সা’দ না চাইতেও কফিটা নিয়ে মুখে দিতে যেতেই তার হঠাৎ চোখ গেলো অদূরে দাঁড়ানো অভিনেত্রী সিনথিয়ার দিকে। সিনথিয়া রহস্যময় হাসি দিয়ে সা’দের দিকে তাকালো। সা’দ তার দিকে তাকাতেই সিনথিয়া জলদি হাসি থামিয়ে অন্যদিকে তাকালো আর এমন ভাব ধরলো যে সে খুব ব্যস্ত। সা’দের সন্দেহ হলো তাই সে সিনকথিয়ার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সেন্টার টেবিলে একটা প্লেটে থাকা চামচ হাতে নিয়ে কফিতে ঢুকালো। কিছুক্ষণ আলতোভাবে নেড়ে চামচ উঠিয়ে দেখলো চামচে সাদা সাদা কিছু ছোট কণা। সা’দ ভ্রু কুচকে শব্দহীন হাসি দিলো। তখনই কারীব দৌড়ে এসে বললো,

—“স্যার কাল না আমাদের নরসিংদী শুটিং আছে! আজ রাতেই তো রওনা হতে হবে।”

কারীবের একটা কথাও সা’দের কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। কারীবের আর কিছু বলার আগেই সা’দ এক কর্মচারীকে ডেকে কী যেন বললো। কর্মচারী মাথা নাড়িয়ে কফির মগটা নিয়ে চলে গেলো।

সিনথিয়া মেকাপ ঠিক করছিলো তখনই এক কর্মচারী তার সামনেই পা মচকে যায় যার ফলে সব কফি সিনথিয়ার ড্রেসে গিয়ে পরে। ভাগ্যিস কফিটা ঠান্ডা ছিলো। এই দৃশ্য দেখে সা’দ নিশব্দে হাসলো। সিনথিয়া সাংঘাতিক রেগে উঠে দাঁড়ালো। কর্মচারী তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বারবার সরি বলতে লাগলো। অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়া পূর্বেই সা’দ সেদিকে গিয়ে সিনথিয়া আর কর্মচারীর মাঝে ঢুকে বললো,

—“মিস সিনথিয়া আপনার নেক্সট শিডিউলে তো ড্রেস চেঞ্জ করার কথা আপনি তা না করে এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন?”

—“মিস্টার সা’দ দেখুন আপনার কর্মচারী কীভাবে আমার ড্রেসটা নষ্ট করলো! এদের তো ম্যানারলেস বলতে কিছুই নেই! আপনি কী এমন ভেবে এই মূর্খগুলোকে কাজে রেখেছেন!”

—“ড্রেসে কফি ফেলেছে সো হোয়াট? আপনিও যেমন মানুষ ওরাও তেমন মানুষ! আপনি যদি শুটিং এ গিয়ে মিস্টেক করেন তো ওরা এখানে ছুটাছুটি করতে গিয়ে মিস্টেক হতেই পারে সিম্পল। মানুষ মাত্রই ভুল! আর আপনি সেখানে ভালোভাবে ইটস ওকে না বলে লেইম ওয়ার্ড ইউস করে চলেছেন। আপনার অভিনয় যেমন পেশা তেমনই ওদের পেশা আছে। সো সব পেশাকে উঁচু নিচু না দেখে সমানভাবে রেসপেক্ট দিন। আপনাদের দৃষ্টির ছোটখাটো কর্মচারীর জন্যই আপনারা এতো উঁচুতে গিয়ে পৌঁছতে পারেন সো রেসপেক্ট দেম! নাও নো মোর ওয়ার্ড গো ফাস্ট এন্ড লিভ দিস টপিক!”

কর্মচারীসহ সকলে যে যার কাজে গেলো। সিনথিয়া নিজের ড্রেস ঝাড়তে ঝাড়তে সা’দের পাশ কেটেই যাচ্ছিলো তখনই সা’দ হালকা সুরে বলে উঠলো,

—“কফিতে আরও ভালো করে স্লিপিং পিলটা মেশানো দরকার ছিলো আপনার!” বলেই বাঁকা হাসল্প সা’দ। সিনথিয়া থেমে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সা’দের দিকে তাকালো! পরে সা’দের কথার মানে বুঝতে পেরে মন খারাপ করে বলে,

—“একটাবার বেডপার্টনার করলে কী হয় সা’দ? জাস্ট ওয়ান নাইট!”

আবারও হাসলো সা’দ। হাসতে হাসতেই বললো,

—“আপনাদের মতো নিচ মানুষদের বেড পার্টনার বানাবো? হা হা নো ওয়ে! আমার বেড পার্ট অনলি আমার ফিউচার ওয়াইফ হবে।”

—“আমাকে কী সুযোগ দেয়া যায় না?”

—“একদমই না। আপনার মতো লুজার আর চিফ মাইন্ডেড মেয়েদের না কোনোদিন পাত্তা দিয়েছি আর না কোনোদিন দিবো। মাই জার্নি ফর অনলি ওয়ান পার্সন যার পুরোটা মন জুড়ে থাকবো আমি শুধু আমি! যার মনে থাকবে না কোনো নোংরামির চিহ্ন! আন্ডার্স্ট্যান্ড?”
সিনথিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চেঞ্জিং রুমের দিকে হনহনিয়ে চলে গেলো।

রাফসান এসেছে মিনিট পাঁচেক হবে। সেহের কিচেনে হাতে চা আর বিস্কুটের ট্রে নিয়ে থরথর করে কাঁপছে। রাফসানের লালসার দৃষ্টি সেহেরের একদম পছন্দ নয়। রাফসান বারবার তাকে বিভিন্নভাবে বাজেভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সেহের বারবার তাকে এড়িয়ে চলে। সোফার ঘর থেকে সৎমার হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তখনই বিকট চিৎকার দিয়ে সৎমা বলে উঠে,

—“কীরে সেহের এতক্ষণ লাগে নাকি চা-বিস্কুট নিয়া আইতে?”
সেহের একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আল্লাহকে ডেকে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসলো। সামনের রুমে এসে দেখে তপা মা এবং রাফসান বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। সেহেরের দিকে চোখ যেতেই কেমন বিশ্রীভাবে সেহেরকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখতে লাগলো। সেহের না তাকিয়ে বুঝতে পারছে রাফসান তার দিকেই তাকিয়ে। সেহেরের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তাই সে ট্রে-টা টি-টেবিলে রেখে চলে আসতে নিতেই রাফসান বলে উঠলো,

—“লেবুর শরবত হবে সুন্দরী?”

রাফসানের এমন কথায় সেহের থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। সেহেরকে সুন্দরী বলায় তপা মুখ বাঁকা করে বিরক্তির সুরে বললো,

—“ওকেই তোমার সুন্দরী লাগে ভাইয়া। কই আমাকে তো কখনো সুন্দরী বললে না?”

রাফসান হেসে তপার গাল টেনে বললো,

—“তুই তো সুন্দরী বটেই তবে অল্প।”

—“কীরে সেহের এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ছেলেটা মুখ ফুটে শরবতের কথা বললো আর তুই দাঁড়িয়ে আছিস? যা গিয়ে শরবত বানা!”

—“জ্বী মা!”

বলেই দ্রুত সেই ঘর ত্যাগ করলো সেহের। ঘৃণায় সব কেমন তা গুলিয়ে যাচ্ছে। তার মন বারবার বলছে আজ খারাপ কিছু ঘটবে। সেহের মাথা উঁচু করে চোখ বুজে মনে মনে দোয়া করতে লাগলো,

—“হে মাবুদ আপনি আমার আগমন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করুন। এই রাফসান ছেলেটার হাত থেকে আমায় বাঁচাও!”

চলবে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here