দখিনা প্রেম,পর্ব ০৬
লাবিবা ওয়াহিদ
—“কারীব ওই বটগাছের নিচে কিসের মিটিং বসেছে?”
—“জানি না তবে শুনেছি চেয়ারম্যানের মেয়েকে নাকি ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। সেই অনুসারেই নাকি আজকে সভা বসেছে চেয়ারম্যানের সঙ্গে!”
—“বলছো কী! তাহলে তো অনেক সিরিয়াস বিষয়। আজ নির্ঘাত ওই রেপিষ্টের অবস্থা খারাপ হবে।”
—“স্যার আমার তো দেখতে মন চাইছে চলুন না প্লিজ চলুন!”
—“না কারীব আমাদের ফেরা লাগবে সেটে!”
—“স্যার প্লিজ চলুন না। ১ম শিডিউল তো বিকালে শুরু হবে। এখনো অনেক সময় আছে। প্লিজ চলুন! আমার অনেকদিনের ইচ্ছে গ্রামের মুরুব্বিদের এই ধরণের মিছিল-মিটিং দেখার।”
কারীবের জোরাজুরিতে সা’দ শেষ অবধি সেখানে যেতে রাজি হলো। এদিকে চেয়ারম্যান কবির মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। চুপচাপ বললেও ভুল হবে, সে চুপ করে নিজের রাগ দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওদিকে বাসায় স্ত্রী রাফসানের জন্য কান্নাকাটি লাগিয়ে রেখেছে আর এদিকে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা রাফসানকে শাস্তি দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। কবির বুঝতে পারছে না সে কোনটা করবে? ঘর সামলাবে নাকি বাহির সামলাবে? একপ্রকার কোটান মধ্যে পরে আছে সে। তবে এবার রাগ লাগছে তার সেহেরের প্রতি! সেহেরের জন্যই সব হচ্ছে। আপাতত সে ভাবছে বাসায় গিয়ে সেহেরকে ঠিক কী করবে। এদিকে আরেক মুরব্বির কথায় কবিরের ধ্যান ভাঙলো যার ফলে রাগ সামলাতে না পেতে উচ্চসরে বলে উঠলো,
—“তো আমি কি করতাম এহন? পুলারে একলা দোষ দিলে হইবো নাকি মাইয়াও সমানভাবে অপরাধী! আমি না দেইক্ষা প্রমাণ ছাড়া কেমনে ওই পুলার বিচার করুম!”
কবিরের কথায় বড় জেঠু অত্যন্ত রেগে গেলো। কবিরের কথা সা’দ আর কারীব দূর থেকেই শুনতে পারলো। তারা জলদি পা চালিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো এবং বোঝার চেষ্টা করলো আসল ঘটনাটা কী। বড় জেঠু হুংকারের সুরে বলে উঠলো,
—“কবির মুখ সামলে কথা বল! ওই মেয়েটা অসহায় হওয়ার আগে তোর রক্তেরই অংশ! আর আমরা এতক্ষণ কতোবার করে বললাম শুনিসনি? ওই রাফসান আমাদের মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করছিলো। আমরা যেই মুহূর্তে সেখানে পৌঁছিয়েছি সেই মুহূর্তে রাফসান দরজা ভাঙছিলো সাথে অকথ্য ভাষায় কথাও বলছিলো! তোর স্ত্রীর সাহস কী করে হলো এই মূর্খটার কাছে একা মেয়েটাকে ফেলে ঘুরতে যেতে? তোর নিজের স্ত্রী সমানভাবে দোষী, আমাদের ফুল নয়!”
—“ওই ভাই একদম আমার বউরে এইডিতে ঢুকাইবা না! ওই অপয়া মাইয়ারে নিয়া কী চৌদ্দগ্রাম ঘুরবো নাকি? বাসায় রাইখা গেছে, গেছে। এহন রাফসান আর ওই অপয়ায় কী করসে না করসে হেইডা আকরা কেমনে কমু? এহন যাইহোক রাফসান ধর্ষণ তো আর করে নাই! করলে এক কথা ছিলো, এই বিচারও ঠিক ছিলো কিন্তু মাইয়াটা তো জ্যান্তই আছে নাকি!”
কবিবের এমন নিচ বিচার-বিবেচনা দেখে উপস্থিত সকলের ঘৃণায় তারে থু থু মারতে ইচ্ছা করলো। মানুষ এতোটা পাষাণ এবং নির্দয় কী করে হতে পারে? কী করে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে এসব বলছে? সা’দ এতক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী লোকের থেকে সমস্ত ঘটনা শুনলো। কবিরের কথাগুলো তাকেও অত্যন্ত রাগিয়ে তুললো। সে সকলের মতো রাগ দমাতে পারলো না, ঘৃণিত কন্ঠে খুবই কড়া এবং শান্ত গলায় বলে উঠলো,
—“হয়তো ওই ছেলেটা কিছু করেনি তাই বলে ভবিষ্যতে অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করবে না তার গ্যারান্টি কী? এসব পুরুষ মানুষদের উচিত শিক্ষা না দিলে এরা কখনোই শোধরায় না। আর বর্তমানে যেকোনো মেয়ের বাবাই এসব বিষয় নিয়ে অনেক সিরিয়াসভাবে সবটা হ্যান্ডেল করে আর আপনার তো সেদিকে কোনো হেলদোলই নেই! উল্টো তখন থেকে নিজের মেয়েরই দোষ ঘাটছেন! বলি আপনি বাবা নাকি অন্যকিছু? আপনার দ্বারা যদি বিচারটাই ঠিকমতো না হয় তাহলে আপনি কোন কাজের চেয়ারম্যান যেখানে নিজের মেয়ের বিষয়েই এমন হেলাফেলা? এই ধরণের ফিউচার রেপিষ্টদের সুযোগ না দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরুন তাহলে এই সমাজে মেয়েদের সেফটি থাকবে!”
সা’দের বক্তব্যগুলো সকলের বেশ মনে ধরেছে কিন্তু কবির সাহেব সবসময়ই সত্যের ব্যতিক্রম! তিনি হুংকার ছেড়ে বললো,
—“শহরের পোলাপাইন শহরের পোলাপাইনের মতো থাকো। তুমারে কেউ আমাগো বিচারে নাক গলাইতে কয় নাই! আর তুমার এতো সাহস আমার বিচার নিয়া এসব বলো? তুমি গ্রাম চালাও নাকি আমি চালাই?”
—“গ্রাম আপনি চালান বা অন্যকেউ সেটা আমার দেখার বিষয় না। একজন চেয়ারম্যানের বড় কাজ হচ্ছে গ্রামের মানুষকে সুরক্ষা দেয়া, তাদের বিপদে-আপদে সঠিক পরামর্শ এবং বিচার করা। সেখানে আপনি গ্রাম তো দূর নিজের পরিবারের মেয়েকেই তো সুরক্ষা দিতে পারেন না। তাহলে আপনার এই চেয়ারম্যান পদের দরকার কী?”
—“এইসব জ্ঞান তুমার প্যান্টের পকেটে রাখোম আজাইরা কথা না কইয়া এইহান থেইকা বিদায় হও নয়তো পুলিশ দিয়া এমন ডান্ডাপিডান খাওয়ামু জম্মেও ভুলতে পারবা না।”
—“সেটা নাহয় ওই রেপিষ্টকে দিন শুধু শুধু আমার মতো নির্দোষ ছেলেকে এসব বলার মানেই হয় না!”
—“এইবার আইসো লাইনে এহন বিদায় হও!”
—“জ্বী না হবো না। তবে শুনুন আপনার এইসব ছোটখাটো হুমকিতে আমাকে দমাতে পারবেন না। হয় সঠিক বিচার করুন নয়তো উপরমহলের সাথে যোগাযোগ করে আপনার ব্যবস্থা করবো!”
—“আমারে ডর দেহাও তুমি?” কপট রেগে বললো কবির। কবিরের কথায় সা’দ হালকা হাসলো! এরপর হাসতে হাসতেই বললো,
—“জ্বী না। এই সাদ বিন সাবরান হুমকি বা ভয় দেখায় না। যা বলে সোজা তা-ই করে। এখন আপনার যদি আপত্তি না থাকে আমি যোগাযোগ করতে পারি। তাদের বলবো তো, দেখে যান কীভাবে এই চেয়ারম্যান পদের মানুষটা তাদের গ্রামের উন্নতি করার বদলে উল্টো বিপদে ঠেলছে। এর বিচারব্যবস্থার ঠিক নেই। যেখানে নিজের ঘরকেই সামলাতে পারে না পুরো গ্রামকে কী করে সামলাবে?”
কবির প্রথমে দমে গেলেও পরমুহূর্তে নিজের রাগকে দমাতে না পেরে সেই সবার সামনেই গালিগালাজ শুরু করলো। মুরব্বিরা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আর তারা চুপ থাকলেন না। সকলে মিলে সা’দকে বললো যেন এক্ষুনি উপরমহলের সাথে যোগাযোগ করে। এতদিন অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে তারা এখন আর সম্ভব না। চুপ থাকা মানেই অপরাধীকে আরও উষ্কে দেয়া। সা’দও তাদের কথা ফেললো না। সা’দ নিজেও বিরক্ত হয়েছে এই লোকের প্রতি। আর এই লোকের ভাষার যা ছিঁড়ি এরে চেয়ারম্যান পদ থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। সা’দ ফোন করলো তার মামা ইকবালকে। ইকবাল মামা একজন বড় পলিটিশিয়ান তাই এইসব বিষয় তাদের জন্য বা হাতের কাজ। ইকবাল মামাকে সবটা বুঝিয়ে বলতেই সে জানালো অতি দ্রুত সে জেলা প্রশাসকদের পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। এদিকে কবিরকে এক ঘরে বন্দি করে রাখা হলো, যতক্ষণ না জেলা প্রশাসক আসছে ততক্ষণ অবধি তাকে বন্দিই রাখতে হবে। কারণ, কবিরকে খোলামেলা রাখা মানেই নিজের বিপদ ডেকে আনা।
★
সেহের চুপ করে উঠোনে মোড়া দিয়ে বসে আছে। গতকালের ঘটনা যেন তাকে পুড়িয়ে মারছে। গতকাল দাদীমা ওদের ইচ্ছেমতো অপমান করে সেহেরকে সাথে নিয়ে চাচীর বাসায় চলে এসেছে। স্বহের আসতে না চাইলে সেহেরকে তার কসম দেয়। তাই সেহের জীবন্ত মানুষটার জন্য মৃত মানুষটার ওয়াদা ভাঙতে বাধ্য হয়েছিলো। একবারের জন্যেই সে এখানে চলে আসে। তবে একা নয় সাথে রিমনও চলে এসেছে। রিমন নিজেও ওই নরকে থাকতে চায় না। ওয়াদা ভঙ্গের জন্য অপরাধবোধ সেহেরকে ক্ষণে ক্ষণে আঘাত করে ক্ষত করে দিচ্ছে। সেহেরের মন ভালো করার জন্য রিমন সেহেরের সামনে এসে দাঁড়ালো!
—“বুবু?”
—“হু?” রিমনের কথায় সেহেরের ধ্যান ভাঙতেই উত্তর দিলো।
—“বরই পারবো চলো না!”
—“কি এই ভরদুপুরে? আর চাচী যদি জানে তাহলে তো দুটোরই অবস্থা খারাও করবে!”
—“আরে জানবে না চলো তো। আমি গাছে উঠে ঢিল মারবো আর তুমি টোকিয়ে তোমার ওড়নাতে বাঁধবে। চলো না বুবু প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”
—“ভাই এভাবে চুরি করে খাওয়া ঠিক হবে না প্লিজ জোর করিস না! এমনিতেই এই গাছে আগে বরই ধরেনি এই প্রথম বরই আসছে। প্রথম প্রথম চাচীর কন ভাঙ্গা কী ঠিক হবে?”
—“ক্যান হইবো না আইজ আমিও তোগো লগে বরই চুরি কইরা খামু!”
দাদীমার কথায় সেহের চোখ বড় বড় করে পিছে ফিরলো। অবাক হয়ে বললো,
—“কী বলো কী তুমি দাদী? মাথা ঠিকাছে? এই বুড়ো বয়সে বরই চুরি করবা?”
—“ওই মাইয়া চুপ! সারাক্ষণ বুড়ি বুড়ি বইল্লা চিল্লাইবি না। আমরা শহরের বুড়ি না যে আমাগো গাঁয়ে জোর থাকবো না। এহনো মনে মনে ৩০ বছরের জুয়ান ছোঁকড়ি। এহন বেশি প্যাঁচাল না পাইরা চল। বউমা এহন ইকটু হুইসে এ-ই সুযোগ!”
—“ইয়ে!! দাদী তুমি থাকলে তো নাচত্ব নাচতে গাছে উঠবো। বুবু চলো দাদী ঠিকই বলেছে এখনই সুযোগ।”
বলেই রিমন সেহেরকে টেনে উঠালো। এদিকে সেহের হাজার মানা করেও দাদী আর ভাইয়ের সাথে পারলো না। সেহের দাদীমার সাথে নিজের ওড়না হাতে বিছিয়ে সামনে দাঁড়ালো। আর দাদীমা নিজের সাদা সুতির আঁচলটা হাতে বিছিয়ে সামনে বাড়িয়ে রাখলো। এদিকে রিমন খুব সহজে গাছে উঠে গাছ কয়েকবার ঝাঁকি মারতেই বৃষ্টির বেগে বরই পরতে লাগলো। দাদীমা আঁচল বাড়িয়ে বাড়িয়ে নিচ্ছে আর সেহের টুকিয়ে তো আবার ওড়না বাড়িয়ে নিচ্ছে। ঝাঁকি দেয়া শেষে এবার রিমন ঢিল ছুঁড়া শুরু করলো। এতে বরই ঠুসঠাস করে মাটিতে পরতে শুরু করলো। একড়া বরই তো দাদীমার ডান চোখ গিয়ে লাগলো। দাদীমার হাতে থাকা বরই ফেলে চোখে দুইহাত দিয়ে “ওমাগো” “আল্লাহ গো” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। দাদীমার চিৎকারে বাসার ভেতর থেকে শব্দ আসতেই রিমন জলদি করে গাছ থেকে নেমে সেহেরের সাহায্য নিয়ে বরইগুলো লুকিয়ে ফেললো। এদিকে দাদীমার চিৎকার চেঁচামেচিতে চাচীমা দৌড়ে আসলো দাদীর কাছে। চাচী অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,
—“কী হয়েছে মা চিৎকার করছেন কেন? আর চোখে কী হয়েছে?”
দাদীমা চাচীর কথার উত্তর না দিয়ে রিমনকে ধমকানোর সুরে বলে উঠলো,
—“ওই হতভাগা, চোর! চোখ মেইল্লা দেহোস না ঢিল কই মারোস! এখন আমার হারাইয়া যাওয়া চোখ কী তুই ফিরায় দিবি?”
চাচীমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো দাদীমার কথায়। অবাক হয়ে বলে,
—“এসব আপনি কী বলছেন মা? কে আপনার চোখে ঢিল মারলো?”
এবার দাদীমা এতক্ষণে বুঝলো সে ঠিক কী বলে ফেলেছে। জিবহায় সামান্য কামড় দিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
—“আরে ওই বেয়াদব কাউয়ারে কইসি। বরই পারতে যাইয়া আমার চোখে ফেলাইয়া পালাইসে।”
চলবে!!!