দখিনা প্রেম,পর্ব ১০
লাবিবা ওয়াহিদ
সা’দ দূর থেকে সেই ১ তলা বাড়িটার ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে তার মায়াবীনি রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে ভূবন ভুলানো হাসি দিয়েই চলেছে অনবরত। সমস্ত সুখ যেন এই হাসিটায় বিদ্যমান! মায়াবীনির ভূবন ভুলানো হাসিতে সা’দের মনে হচ্ছে তার মতো সুখী এই পৃথিবীতে কেউ নেই। সা’দের মনে হচ্ছে মায়াবীনির হাসিটা ধারালো ছুঁড়ির মতো তার বুকে গিয়ে বিঁধছে। এই হাসিটা দেখার সুযোগ দ্বিতীয়বার পাবে তো? ভাবতেই সা’দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই দুরত্ব যে তাকে হিম শীতল হাওয়ার মতো জমিয়ে দিচ্ছে। কে জানতো এই এক সপ্তাহের সফরে এমন এক মায়াবতীর মায়ায় পড়ে যাবে? ৭টা দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেলো তার। নির্ঘুম রাত পার করলো মায়াবীনির কল্পনায় আর সারাদিন পার করলো নিজের কাজের ব্যস্ততায়, তবুও এক মুহূর্তের জন্য সে মায়াবীনিকে ভুলতে পারছে না। মাঝেমধ্যে মায়াবীনি শুটিং দেখতে আসতো সেটা তার ক্যামেরার ফুটেজেই বুঝেছে কিন্তু কাজের চাপে তার অন্যদিকে তাকানোর সময় ছিলো না। সা’দ সেহেরকে দেখার জন্য প্রতিটা ফুটেজ কালেক্ট করেছে পেনড্রাইভে। হয়তো এগুলো স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন! আজ দুপুরেই শুটিংয়ের কাজ শেষ হয়, আগামী পরশু নাটক রিলিজ দেয়া হবে তাই আজ রাতেই সকলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। অভিনয়শিল্পীরা শুটিং করার ঘন্টাখানেক পরেই নিজেদের পার্সোনাল কারে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে কিন্তু সা’দ এবং তার পুরো টিম রাতে রওনা হবে। আজ চলে যাবে দেখে শেষ বিকালে সা’দ গ্রাম ঘুরে দেখিতে বেরিয়েছে। কারীব কাজে ব্যস্ত ছিলো বিধায় কারীবকে ফেলেই সে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অট্টহাসির শব্দ পেতেই সা’দ সামনে তাকালো এবং দেখলো তার থেকে কিছুটা দূরত্বে একটা ১তলা বাড়ি। সেই হাসির মালিককে দেখে সা’দ এতক্ষণ আনমনেই সবটা ভাবছিলো। হঠাৎ সা’দের মনে হলো, আচ্ছা এই মায়াবীনির নাম কী? তার নাম কী তার মায়ার মতোই বিষাক্ত? কিন্তু আমার কাছে যে এই “মায়াবিনী” নাম ছাড়া কোনো নামেই তাকে মানায় না। নাহ থাক, নাম জেনে কাজ নেই, সে শুধুই “মায়াবীনি”। আমার “মায়াবীনি”!
সা’দ নিজের ভাবনায় নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কী ভাবছে সে এসব? এই মেয়েটি তার মায়াবীনি কেন হতে যাবে? অদ্ভুত! সা’দ তো প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসী নয়, তাহলে সে এরকম কেন বললো? সে যে সা’দের কেউ-ই না। সা’দ আরেক পলক সেহেরকে দেখে সড়াইখানায় ফিরে গেলো, সূর্য অলরেডি অস্ত নেমেছে!
এদিকে সেহের মানজু আর আবিদের ঝগড়া দেখছে আর সমানতালে হেসেই চলেছে। দুটোর মধ্যে সাপে নেউলেরর মতো সম্পর্ক। ওদের ঝগড়াগুলো এমন,
—“এই আবুল একদম আমাকে মগজের বেলপাতা বলবেন না আমার সুন্দর একটা নাম আছে!”
—“তাহলে তুমিও আমাকে আবুল বলা বন্ধ করো! নিজের ঢক দেখসো যে আমার এতো সুন্দর নামটার সম্মান ফালুদা বানিয়ে দাও!”
—“আবুল বলেছি বেশ করেছি! আপনি তো পুরাই আবুল! সারাদিন বখাটেগিরি করে এখন আমার সাথে লাগতে আসছেন!”
—“তাহলে আমিও বেশ করেছি তোমায় মগজের বেলপাতা নাম দিয়ে! সারাদিন হাঁসের কতো প্যাক প্যাক ছাড়া আর কী পারো?”
দুজনের ঝগড়াঝাঁটি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তখন সেহের গিয়ে ওদের থামিয়ে অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললো,
—“হয়েছে আমার বাপ-মা গণ! এবার অন্তত চুপ যাও, তোমাদের ঝগড়ায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।”
সেহেরের কথায় মানজু আর আবিদ আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময়ই দাদীমা এসে হাজির হলো এবং হুংকারের সুরে বললো,
—“এই তোগো আর কোনো কাইজ কাম নাই? এতো চিল্লাস কেমতে হুনি? নামাজ পইড়া বিছানায় যাইয়া একটা শুইসিলাম কিন্তু তোদের মাইকের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ হুনতে হুনতে আমার কান দুইটা ঝালাপালা হইয়া গেলো! বলি তোগো কী মাথা নষ্ট?”
দাদীমার ধমকে দুজনই চুপ হয়ে গেলো। সেহের কথা ঘুরিয়ে বললো,
—“আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে এখন চলো নিচে, গরম গরম আলুর পাকোড়া খাবো!”
—“চাচী বানিয়েছে নাকি?”
—“সে তো জানি না। তবে আমি ঠিক করেছি আমি নিজেই বানাবো! জানিস ওই বাড়িতে রিমনের জন্য রোজ পাকোড়া বানাতাম। প্রিয় ভাইটা খুব পছন্দ করে খেতে আর তপাও….!”
—“এই হারামী মাইয়া চুপ! ওই কালসাপটার নাম এই বাড়িতে ভুল কইরাও নিবি না! তোর পুন্দে কী লজ্জা-শরম নাই? ওই মা-বেটি মিলে তোরে এতো অইত্যাচার করলো তাও তুই এই কালসাপগুলার নাম নিতাসোস! খবরদার এই বাড়িতে ওদের নিয়ে কথা বলছিস তো! এখিন চল নিচে নামাজ পড়বি! মাগরিবের আযানের সময় হইয়া গেছে!”
বলেই দাদীমা হনহন করে চলে গেলো। সেহের দাদীমার যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মানজুর চোখের দিকে তাকাতেই দেখলো মানজু অসম্ভব রেগে আছে! সেহের একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
—“চল নিচে এই সময় ছাদে থাকা ঠিক হবে না!”
—“তুই এমন কেন রে ফুল? ওই তপা মেয়েটা তো ওর বাপটার মতোই শয়তান হইসে তা কী তুই বুঝিস না? তুই বুঝিস না ওরা তোর মাকে মেরে ফেলেছে? তোর বাবাকে প্রভূলন দিয়ে এমন অমানুষ করেছে? ওই জোহরা ঠিক কেমন মহিলা তা তুই এখন অবধি বুঝতে পারলি না! এই মহিলা পারে না এমন কিছু নাই! হয়তো তার প্রথম স্বামী আর তার পরিবার সবটা জানতে পেরেছিলো তাইতো ওরে লাথি-উষ্টা মেরে ভাগিয়ে দিসে! এতো সহজ হস না রে বোন! এই পৃথিবীতে কাউকে সহজ হতে নেই, দুনিয়ার মানুষ যে তাকে কখনোই ভালো থাকতে দেয় না রে!”
আবিদের কথায় সেহের কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে ম্লান হেসে বলে,
—“কথায় আছে না,”যার জীবন সে-ই বুঝে।” আমিও আমার জীবনের প্রতিটা বিষয়ই বুঝি, জানি। কিন্তু আমার হাতে যে কিছুই নেই। আপনজন বলতে তুমি, মানজু, চাচী-জেঠু, রিমন আছে ভাইয়া। আমার আর কী লাগবে বলো তো? আমার ভেতর কী চলে সেটা আমি এবং আমার আল্লাহ জানি! তাইতো ওদের ভুলে থাকতে পারি না। আমি এমন পরিস্থিতির মাঝে আছি যেখান থেকে না সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি আর না আশেপাশে তাকানোর ভরসা পাচ্ছি! আমার লড়াই যে আমার একার! জানি না আমার এই জীবন যুদ্ধের শেষ পরিণতি কী হবে, তবে একটা কথাকে আজীবন ভরসা করে এসেছি যে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা যা করেন তা মঙ্গল এবং কল্যাণের জন্যই করেন। হয়তো তিনি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন!”
বলেই সেহের বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। সেহেরের কথাগুলো দুজনের মধ্য থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
সা’দ গাড়িতে উঠার আগে একবার আঁধারে আচ্ছন্ন মায়াবীনির গ্রামটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো। এক সপ্তাহর স্মৃতি তাকে এভাবে ঝেঁকে ধরবে সেটা সা’দ কল্পনাও করতে পারেনি। এর মূল কারণটা হয়তো তার মায়াবীনি! এই মায়াবীনির মায়ায় যে সে গভীরভাবে পড়েছে, এখন দূরে চলে যাবে ভাবতেই তার বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। কয়েকবার লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো সা’দ কিন্তু কিছুতেই নিজের এই অস্থিরতা কাটাতে পারছে না। এ কেমন মোহ বা অদ্ভুত অনুভূতি যেটা সা’দকে এভাবে পুড়িয়ে মারছে?
—“স্যার কী হলো গাড়িতে আসুন হাইস তো রওনা দিয়ে ফেলেছে।”
কারীবের কথায় সা’দ ধ্যান ভাঙ্গলো। সা’দ আরেকবার অন্ধকারে গ্রামের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,
—“বিদায় মায়াবীনি!”
বলেই সা’দ গাড়িতে উঠে বসলো এবং কারীবকে গাড়ি স্টার্ট দেয়ার নির্দেশ দিলো। নির্দেশ পেতেই কারীব গাড়ি চালানো শুরু করলো। মেইনরোডে গিয়ে উঠতেই অন্ধকার কেটে গিয়ে কৃত্রিম সোডিয়াম আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে যায়। সা’দ আনমনে মুখে হাত হেলিয়ে বাইরের পানে তাকিয়ে রয়। কারীব কিছুক্ষণ পর পর লুকিং গ্লাসে তার স্যারের বিষন্ন চেহারাটা লক্ষ্য করছে কিন্তু কিছু বলছে না। কারণ, সে জানে তার স্যার এতো সহজে মুখ খুলবে না। তবে কারীব যে সা’দের মুখ খোলানোর ব্যবস্থাই করে এসেছে। ভাবতেই কারীবের ঠোঁটদুটি প্রসস্থ হয়ে যায়।
প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার সফরে সা’দ বাড়িতে পৌঁছালো রাত সাড়ে বারোটায়। বাড়িতে ঢুকে সা’দ তার বোন এবং মাকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখলো। রুবাই মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু মা এখনো জেগে আছে। সা’দের বাবা প্রতিদিন রাত ১১টায় কড়া ঘুমের মেডিসিন নিয়ে ঘুম দেয়। নাহলে সেও এখানে উপস্থিত থাকতো। কিন্তু এখন যে তার ঘুমে হুঁশ নেই!
চলবে!!!