দখিনা প্রেম,পর্ব ১৮ + ১৯
লাবিবা ওয়াহিদ
প্রতিদিনের মতো সেহের ফজরের সময় উঠে পরে। ওযু করে ঘরে ঢুকতে নেয়, তখন কী মনে করে সে রিমনের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ধীরে ধীরে রিমনের ঘরের দিকে এগিয়ে দরজায় হাত দিতেই দেখলো দরজা ভেঁজানো। সেহেরের কী যেন হলো। সে ভেতরে ঢুকে পা টিপে টিপে বিছানার পাশে চলে গেলো। সা’দ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ডানপাশে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে সে। সিলিংফ্যানের বাতাসে সা’দের কপালের চুলগুলো মৃদ্যু নড়ছে। ঘুমন্ত চেহারায় সা’দকে বড্ড নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। একদম বাচ্চা বাচ্চা! কে বলবে এই ছেলেটাই গতকাল সারাটাদিন সেহেরকে জ্বালিয়ে মেরেছে? সেহেরের সা’দকে ডাকতে ইচ্ছা করলো না কিন্তু ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে বিধায় সেহেরের সা’দকে তুলতে হবে। ডাকতে গেলে সেহেরের অস্বস্তিও লাগছে। নিজের মনের সাথে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে অতি নম্র স্বরে সা’দকে ডাকলো,
—“এইযে শুনুন!”
সা’দের কোনো হুঁশ নেই, সে যে ঘুমে বেঁহুশ। সেহের আবার ডাকলো কিন্তু তাতেও সা’দের হেলদোল নেই৷ সেহের এবার সা’দের কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকালো। এখানেই ঝামেলা হলো৷ সা’দ সেহেরের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলো। সেহেরের সা’দ জড়ানোর সময় সেহের কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলো যার ফলে সে গিয়ে পরলো সা’দের উপর, সেহের মাথাটা সরুয়ে ফেলার কারণে সা’দের মাথার সাথে বারি খায়নি। সেহের চোখ বড় বড় করে সা’দের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
“কী শক্তি এই বিদেশির, ঘুমের মাঝে এতো শক্তি আসে কোথা থেকে? কী এমন খায় যে হাতির মতো শক্তি তার, আল্লাহ মালুম!”
হঠাৎ কী মনে হতেই সেহের নিজের হাত মোচড়াতে থাকে সা’দের থেকে ছাড়ানোর জন্য। কেউ এভাবে দুজনকে দেখে ফেললে মিহা কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। সা’দের উপকার করতে গিয়ে সে নিজে ফ্যাসাদে বেশ ভালোভাবেই পরেছে। এজন্যই বলে কারো ভালো করতে নেই নয়তো নিজেই মারা পরবে। সেহেরের হাত মোচড়া-মুচড়িতে সা’দের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় তার ভ্রুজোড়া কুচকে গেলো। সা’দের চেহারা দেখে যে কেউই ধরতে পারবে সা’দ এখন অত্যন্ত বিরক্ত। সেহেরও সা’দের অভিব্যক্তি বুঝতে পারলো। সা’দ পিটপিটি করে চেয়ে দেখলো এক নারীমূর্তি কেমন ছটফট করছে। তার ঘরে মেয়ে ভাবতেই সা’দ লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আবছা আলোয় সেহেরকে দেখে ভ্রু কুচকে বললো,
—“তুমি আমার ঘরে কি করছো?”
সেহের লজ্জায় মাথানত করে ফেললো আর উঠে দাঁড়ালো। সেহেরের লজ্জার কারণ বুঝতে পারলো না সা’দ, তাই একই প্রশ্ন আবারও করলো। সেহের আমতা আমতা করে বললো,
—“নামাজের জন্য ডাকতে এসেছিলাম আপনাকে কিন্তু আপনি…”
আরও কিছু বলতে গিয়ে সেহের মুখে হাত দিলো। সা’দ আবারও ভ্রু কুচকে বললো,
—“আমি কী? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম আমার আবার অপরাধ কী?”
সেহের কিছু না বলে চলে যেতে নিলো কিন্তু সা’দ পেছন থেকে সেহেরের হাত ধরে সেহেরকে আটকালো। তারপর দুষ্টু হেসে বললো,
—“ও বুঝতে পেরেছি! বিয়ে হয়েছে কিন্তু আমরা আলাদা সেটাই বলতে এসেছো তাইতো? সমস্যা না চলো একসাথে ঘু….”
—“এই চুপ! মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলবেন! এগুলো কী ধরণের অসভ্যতামি! বলেছি না আপনাকে নামাজের জন্য ডাকতে এসেছি, কিন্তু আপনি-ই তো আমার হাতকে কোলবালিশ বানিয়ে রেখেছিলেন।”
—“ও আচ্ছা এই ব্যাপার, আমি হাতকে কেন কোলবালিশ করলাম! তোমাকে করলে তো…”
—“আবার!” চোখ গরম করে কথা বললো সেহের। সেহেরের তেজ দেখে সা’দ হুঁ হাঁ করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতেই বললো,
—“জানো আজ অবধি মা ছাড়া কারো সাহস হয়নি আমাকে এভাবে চোখ গরম দেখানোর। কিন্তু দেখো আজ তুমি করলে যেখানে সবাই তোমাকে নিষ্পাপ বলে অত্যাচার করে। তাই তো বলি তুমি আমার বউ হলা কীভাবে, নিশ্চয়ই তুমি আমার উপরে যাওয়ার মতো মেয়ে!”
বলেই আবার হাসতে থাকলো। এবার সেহের লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সা’দের মুখে বারবার ‘বউ’ ডাকটা সেহেরকে অস্থির করে দেয়। সেহের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে বলে,
—“ছাড়ুন, আমার যেতে হবে।”
—“উম… আচ্ছা ছাড়বো, তবে এক শর্তে!”
—“কী?” চোখ বড় করে বললো সেহের।
—“দু’জন একসাথে নামাজ আদায় করবো, জানো আমার খুব ইচ্ছা বউয়ের সাথে নামাজ পড়ার!”
সেহেরের গাল জ্বলে উঠলো। না চাইতেও সা’দের শর্তে সেহের রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু বাসার মানুষকে নিয়ে সেহের খুব ভয়। সেহের আমতা আমতা করে বলে,
—“কেউ যদি রুমে চলে আসে তখন কী হবে?”
—“আরে কিচ্ছু হবে না, দাদীমা আর জেঠুরা তো ওই বাড়িতে আর এই বাড়ির কেউ-ই তো ফজরে উঠে না। চিন্তা করিও না কেউ কিছু বুঝবে না। আচ্ছা তুমি জায়নামাজের ব্যবস্থা করো আমি চট করে ওযুটা করে আসছি।”
বলেই সা’দ ওয়াশরুমের চলে গেলো। সা’দ যেতেই সেহের যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সেহের এখনো জানে না সে বিয়েটাকে মানতে পেরেছে কি না, কিন্তু সা’দকে সে অত্যন্ত ভরসা করে কিন্তু কেন তা সে জানে না। সা’দের মাঝেই যেন তার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান যেখানে তার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। সেহের তাদের বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই তপার ঘরে গিয়ে দুইটা জায়নামাজ নিয়ে আসলো। জায়নামাজ দুইটা বিছিয়ে দিতেই সা’দ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তাওয়াল দিয়ে হাত আর মুখ মুছে, মাথায় টুপি দিয়ে সে সেহেরের পাশে জায়নামাজে দাঁড়ালো। দুইজন একসাথে নামাজ আদায় করলো। সেহের মোনাজাতে আল্লাহ তায়ালার কাছে বললো,
“হে মাবুদ আমি জানি না আপনি কী করতে চান, আমার ভাগ্যে কী লেখা আছে। তবে আমি আমার সুসময়ের অপেক্ষায় রইলাম। বিয়ে নিয়ে আপনি আমার মনের সকল দ্বিধাবোধ দূর করে দিন, আমার পাশের মানুষটাকে আপনি হেফাজতে রাখুন। তার মতো ভালো মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে আমি সত্যি-ই ভাগ্যবতি। আপনি বিদেশিকে ফেরেশতা হিসেবে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, আমি ইনশাল্লাহ তার যত্ন করবো। আমার মাকে আপনি জান্নাতবাসী করুন, আমিন!” বলেই মোনাজাত শেষ করলো সেহের। এদিকে সা’দ মোনাজাতে আল্লাহ’র দরবারে লাখ লাখ শুকুরিয়া আদায় করছে,
“আপনার দরবারে লাখো লাখো শুকুরিয়া, জানি না আমি আমার জীবনে কোন মহাকাজ করেছিলাম যার জন্য আপনি আমার জন্য এমন উত্তম জীবনসঙ্গিনী দিয়েছেন। তাকে আমি ভালোবেসে ভুল করিনি, সে সত্যি-ই আমার স্ত্রী হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা রাখে। আপনি আমায় তৌফিক দান করুন মাবুদ যাতে আমি আমার স্ত্রীকে সুখে এবং সুরক্ষিত রাখতে পারি এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারি, আপনিই যে সকল কিছুর উর্ধ্বে। আমার জীবনসঙ্গিনীর হেফাজত করুন। আমি তার কল্যাণ কামনা করি, আমিন।” সা’দও তার মোনাজাত শেষ করলো।
দুজনের নামাজ শেষ হতেই সেহের জায়নামাজ দুটো গুছিয়ে নিলো। সা’দ মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে আছে। সারারাতে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে, প্রচুর মাথা ব্যথা হচ্ছে তার। সেহের জায়নামাজ নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিবে তখনই সা’দ তাকে ডাকলো এবং মৃদ্যু সুরে বললো,
—“আমাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে পারবে?”
—“কফি তো নেই। চা আছে খাবেন।”
—“না থাক লাগবে না, তুমি যাও।” বলেই মাথা ধরে চোখ বুজে বসে রইলো। সা’দের ভাবভঙ্গি সেহেরের ভালো লাগলো না। সেহের কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলে,
—“মাথা ব্যথা করছে আপনার?”
—“হু, ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারণে ব্যথা করছে।”
—“তাহলে এখন ঘুমিয়ে পড়ুন, দেখবেন মাথা ব্যথাটা আর থাকবে না।”
—“তো জগিং কে যাবে?”
—“জগিং যেকোনো সময়ই যাওয়া যায়, শেষ বিকালেও জগিং করা যায়। আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন, মাথা ব্যথা নিয়ে জগিং যাওয়াটা মোটেও ঠিক হবে না।”
সেহেরের কথায় সা’দ সম্মতি জানালো। সে একটা বালিশ কোলে নিয়ে শুয়ে পরলো চখ বুজে। সেহের কিছুক্ষণ সা’দের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো এবং অতি সাবধানে দরজাটা ভিজিয়ে তপার ঘরের দিকে চলে গেলো৷ রিমন এখনো ঘুমোচ্ছে দেখে সেহের একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভাগ্যিস বাড়ির কেউ ঘুম থেকে জাগেনি। সেহের জায়নামাজ দুইটা ওয়ারড্রপে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেলো। আধো আধো আলো ফুটেছে। পাখিদের কিঁচিরমিঁচির শব্দে জানান দিচ্ছে তাদের আনন্দের অনুভূতি। একটা মানুষ যেমন ফুরফুরে মেজাজে থাকলে গান ধরে তেমনই পাখিরাও তাদের আনন্দটাকে গান দিয়ে প্রকাশ করে৷ সেহেরের বড্ড ভালো লাগছে প্রকৃতির বন্ধুত্বপূর্ণ সকালটা। একেই তো সুন্দর স্নিগ্ধময়ী সকাল। শহরের মতো এখানে নেই কোনো দূষণভরা বায়ু, সবটাই প্রকৃত। সেহের ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। হঠাৎ তার মনে পরে গেলো কিছু কথা। সে কীভাবে সা’দের সাথে এতোটা স্বাভাবিক হয়ে যায় সেহের নিজেও জানে না। যেখানে বড়দের সাথে চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায় না সেখানে সা’দের সাথে কীভাবে কী? কেন ভয় পায় না সে সা’দকে? এই প্রশ্নগুলো তার অজানাই রয়ে গেলো। সূর্য অনেকটা উঠতেই সেহের নিচে নেমে পরলো।
সকাল সকাল তিন ভাই মিলে গিয়েছে গরুর হাটে। আগামীকাল ইদ, তাই তারা আর দেরী করেনি। তিন ভাই মিলে বিরাট আয়োজন করবে। এদিকে বৃষ্টির দিন বিধায় চাচী আজ সকলের জন্য খিঁচুড়ী রাঁধছে। বৃষ্টির দিনে খিঁচুড়ি আর আঁচার পুরোই জমে খিড়! বাড়ির বড় ছেলেরা বের হতেই সকলেই টুকটাক কাজ করতে লেগে পরে। এদিকে সা’দ ঘুম থেকে উঠলো ১০ টা বাজে। প্রায় ৫ ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখে রুবাই, তানজীল, সেহেরসহ আরেকটি মেয়ে আড্ডা বসিয়েছে। তাদের আড্ডায় আবিদও উপস্থিত। কিন্তু সেহেরের পাশে বসা মেয়েটিকে সা’দ চিনতে পারলো না। সেসব বিষয় না ভেবে সা’দ সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসলো। দাদীমা দূর থেকে সা’দকে দেখতেই বলে উঠলো, “আমার নায়কের ঘুম ভাঙসেনি?”
দাদীমার কথায় সকলেই সিঁড়ির দিকে তাকালো। সা’দকে দেখে মানজু হা হয়ে গেলো আর সেহেরকে খুঁচিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—“এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা কে রে? কোন মুভীর হিরো?”
সেহের উত্তর দিলো না। কেন জানি না সা’দকে দেখলেই সেহেরের কথাগুলো গলায় এলোমেলো হয়ে আটকে যায়। সা’দ দাদীমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে তাদের আড্ডার দিকে গিয়ে বসলো। রুবাইয়ের পাশে সা’দ বসতেই সা’দকে কনুই দিয়ে গুতা মেরে বললো,
—“বউয়ের পাশে না বসে আমার পাশে বসলি কেন হু?”
—“তুমি কী ভুলে যাও আমাদের বিয়েটা গোপন?”
রুবাই জিবহায় কামড় দিয়ে বললো,”আসলেই তো। সরি!” পরমুহূর্তে দাদী চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “কই গেলা মেজো বউ আমার নায়করে না খাওইয়া রাখবা নাকি?”
আসিয়া রান্নাঘর থেকে মৃদ্যু জোরে বলে উঠলো,
—“আনছি মা। আপনি আপনার নায়ককে ডাইনিং এ বসতে বলুন।”
সা’দ তার মায়ের কথা শুনে কোন কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে উঠে ডাইনিং এ চলে গেলো। এদিকে মানজু মুখটা ছোট করে ফেললো সা’দ চলে যাওয়াতে। সেহের মানজুর এরূপ অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকে বলে,
—“কী হলো, মুখটাকে ওমন প্যাঁচার মতো করে রেখেছিস কেন?”
—“উনি চলে গেলো কেন? আর দাদী কী নায়ক নায়ক লাগিয়ে রেখেছে নামটা বললে কী হতো?”
—“কেন নাম জেনে কী করবি?”
—“মানুষ নাম জেনে কী করে? এই ছেলেটা এতো সুদর্শন আমার তো জান-প্রাণ হার্ট অ্যাটাক করে ফেলেছে রে সখি!”
—“তাহলে ওইযে তোর সিনেমার নায়ক, কী যেন নাম ও হ্যাঁ তুষার! সে তোরে হার্ট অ্যাটাক দেয়নি?”
—“আরে ধুর, ওর কথা বাদ। ওইদিন খবরে দেখলাম সে নাকি বেআইনিভাবে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে, আবার পুলিশ তাকে ধরাতে সে মাতাল হয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালও করেছে। ইয়াক ছিঃ কী পরিমাণ ঘাউড়া আর বজ্জাত ওই তুষার, আমার তো ঘিন ধরে গেছে। সেদিন থেকে সে আমার মন থেকে উঠে গেছে বইন, ওই অপদার্থটাকে নিয়ে ভাবার সময় নাই!”
সেহের মুচকি মুচকি হাসলো। তার ধারণাই ঠিক, ওই ছেলেকে দেখেই তার কেমন মাতাল মাতাল মনে হয়েছিলো। ঠিক হয়েছে পুলিশ ধরেছে ওই অসভ্যকে। সেহের মনে মনে দোয়া করলো আল্লাহ যেন তুষারকে ভালো বোঝার তৌফিক দান করে। মানজু সা’দের বিষয়ে আরও কিছু বলে খোঁচাতেই সেহের বলে উঠলো,
—“তুই তো দেখছি দুই নৌকায় পা দিয়ে আছিস। তার তথ্য দিলে আমার বেচারা আবিদ ভাইটার কী হবে শুনি?”
মানজু যেন চমকে উঠলো৷ সে কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,
—“মানে কী ববলতে চাচাচাইছিস?”
সেহের হেসে ফেললো। মানজু অনেকদিন পর সেহেরের কৃত্রিম হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা হাসিটা দেখলো। এই হাসিতে কৃত্রিমতা নেই, আজ সেহের প্রাণখুলে হাসছে। সেহের হাসতে হাসতেই বললো,
—“তুই কি মনে করিস আমি কিছুই বুঝি না? আবিদ ভাই আর তুই যতোই ঝগড়া করিস না কেন দিনশেষে ঠিকই একে অপরকে চিঠি আদান-প্রদান করিস। তুই কী ভেবেছিস আমি কিছু জানবো না? তোর দুটো চিঠি আমার হাতে কিন্তু পরেছে সখি!”
এবার মানজু লজ্জায় পরে গেলো। কিছুক্ষণ লজ্জায় লাল হয়ে মানজু আবার বললো,
—“প্লিজ বইন কাউকে কিছু বলিস না, মা একবার জানতে পারলে আমাকে মেরেই ফেলবে!”
—“ঠিক আছে জানাবো না। তুইও লুচুগিরি কম কর নয়তো আবিদ ভাই তোকে মেরে ভূত বানিয়ে দিবে!”
মানজু ভেঙচি কাটলো। সা’দ খেয়ে আসতেই সকলেএ আড্ডা আবার শুরু হলো। রিমন কিছুটা দূরে বসে আবিদের ফোনে মনোযোগ দিয়ে গেমস খেলছে। এদিকে তপা সকাল থেকেই বাড়িতে নেই। জোহরাকে বলে গেছে তপা তার এক বান্ধুবির বাসায় যাচ্ছে। সেই যে গেছে এখনো তার খবর নেই। হয়তো বিকালের দিকে ফিরবে। সাড়ে বারোটা নাগাদ গরু নিয়ে তিনভাই বাড়িতে ফিরলো। গরু দেখতে সকলেই বের হলো, সেহের যেতে চায়নি কিন্তু রুবাই তাকে জোর করে বাহিয়ে নিয়ে গেছে। উঠোনের একপাশের কলপাড়ে কবির, জেঠু এবং জোবায়ের হাত, মুখ ধুচ্ছেন। গ্রামের একটা ছোট ছেলে ক্লাস এইট পড়ুয়া বাচ্চা গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছে। বাড়ির সকলে গরুর আশেপাশে দাঁড়ালো। সেহের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছে, কিছুক্ষণ পর কবিরের দুই-তিনজন বন্ধু এসেছে যাদের কেউই চিনতে পারেনি। তাদের মধ্যে একজনের চোখ সেহেরের দিকে পরলো। সেহেরের সেদিকে খেয়াল নেই, সেহের তো এদিক সেদিক বারবার তাকাচ্ছে। লোকটা চোখ দিয়ে সেহেরকে যেন গিলে খাচ্ছে। লোকটার সাথে দাঁড়ানো তার ছেলে মোতালেব বলে উঠলো,
—“আব্বা কবির কাকার সাথে দেখা না করে এখানে দাঁড়ায় রইসো কেন?”
—“কিশু না তুই বাড়ি যা বিকালে আসিছ আমার লগে।”
—“আইচ্ছা তুমি থাকো আমি তইলে গেলাম।”
বলেই মোতালেব চলে গেলো। মোতালেবের বাবা কামাল দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে সেহেরের দিকে এগোতে নিলেই সা’দ কামালের সাথে এসে দাঁড়ালো। সা’দ তার পথ আটকানোতে কামাল অনেকটা বিরক্ত হলো। বিরক্তির সাথে বলে উঠলো,
—“কী সমস্যা রাস্তা আটকাইসোস ক্যা? কেডা তুই, এইহানে কী করোস?”
সা’দ কামালের মাথা থেকে পা অবধি দেখে বলে,
—“বয়স তো মনে হয় পঞ্চাশের কাছাকাছি, তাও এই বুড়ো বয়সে মেয়েবাজি ছাড়েন না। ছেলেমেয়েও তো মনে হয় আছে, তা আপনার বাসায় কী বউ নেই? আপনার বউ জানলে তো আপনাকে ঝাটা দিয়ে পিটাবে!”
—“এই বিয়াদপ পোলা, মুখ সামলায় কথা বলো, কে কইসে তুমারে আমি মেয়েবাজি করি!”
—“সেটা আপনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপনার ভেতর কী চলছে। যাইহোক, ঝামেলা এখানেই মিটিয়ে ফেলুন। উল্টোপাল্টা দেখলে আমি নিজে আপনার ঝাটা পেটা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিবো, আল্লাহ হাফেজ।”
বলেই সা’দ সেহেরকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো যা একমাত্র কামালই দেখলো। কামাল রাগে ফুঁসতে থাকলো সা’দের কথা শুনে। কবির হাত মুছতে মুছতে কামালের দিকে এগিয়ে আসতেই কামাল হুংকার ছেড়ে বললো,
—“শু*র জাত! তোরে কইসি না আমি সেহেররে আমি বিয়া করুম, তুই আবার কোন বালের কাছে বিক্রি করছোস! চিটারি করোছ আমার লগে, তোর এক লাখ আমি তোর পাছা দিয়া ভইরা দিমু। আমার ফ্রেশ মাল চাই মানে ফ্রেশ মালই চাই। যদি কোনোরকম চিটারি করার চেষ্টা করোস তো তোরে মাটিতে হোতায় দিমু!”
কবিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কালাম হনহন করে চলে গেলো। এদিকে কবির কালামের কোনো কথাই বুঝলো না তবে কালামের অপমান সে নিতে পারে না। কালামের ঝাল গিয়ে পরলো জোহরার উপর। জোহরাকে রুমে নিয়ে গিয়ে বেল্ট দিয়ে অনেক মারলো কবির। বাড়ির সকলে বাহিরে থাকায় জোহরার আর্তনাদ কেউ শুনতে পেলো না। তখন সা’দ সেহেরকে নিয়ে ছাদের গাছগুলো দেখছিলো।
চলবে!!!