দখিনা প্রেম,সূচনা পর্ব
লাবিবা ওয়াহিদ
গলা বেয়ে রক্ত পড়ছে। ফ্লোরের কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সারা শরীরের যন্ত্রণায় বিছানায় গুটিশুটি মেরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সেহের। তার সারা গাঁয়ে মারের চিহ্ন। কিছুক্ষণ আগেই সেহেরের বাবা আর তার সৎমা বিনা অপরাধে মারধোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সেহেরের মুখমন্ডলেও কাটা-ছেঁড়ার দাগ। সেহেরের চাচী তার গায়ে গরম পানির ছ্যাঁক দিয়ে যাচ্ছে আর সেহের বারংবার ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে।
সেহেরের থেকে দু-হাত দূরত্বে বসে আছে সেহেরের দাদীমা।
দাদী আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে। অসহায় মেয়েটাকে কী করে তার নিজ জম্মদাতা পিতা মারতে পারে তা-ই ভাবতে পারছে না।
এই অসহায় মেয়েটার বাবাই যে নিজের গর্ভের সন্তান ভাবতেই তার ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করছে।
কিছুটা দূরে আরামদায়ক চেয়ারে দুহাতের আঙুল একত্রিত করে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে সেহেরের বড় জেঠু আর দরজার দিকে দাঁড়িয়ে আছে সেহেরের চাচাতো ভাই আবিদ।
সকলেই চুপচাপ আছে কারো কোনো কথা নেই।
নিস্তব্ধ ঘরটাতে সেহেরের গোঙানি ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
চাচী যখন সেহেরের থুঁতনিতে মলম লাগানোর সময়ই দাদীমা বলে উঠলো,
—“কোন গজব জম্ম দিসিলাম আমার পেটে। মাইয়াডার সোনার মতো মা ডারে খাইলো এহন মাইয়াডারে মাইরা ফেলতাসে! পুঁতরে(সেহেরের বাবা) মাইয়া মানে একটা জান্নাত! আর তুই তোর বংশের উত্তরাধিকারের ল্যাইগা এক মাইয়ারে মারসোস এহন আবার নিজের মাইয়ার পিছে লাগসোছ! আমার আজ অব্দি একখান মাইয়া হইলো না, হেই দুক্ষে কতোরাইত কানসি আর আমার পেডের পুঁত!”
বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
দাদীমার কান্না যেন সেহেরের কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না।
সে একরকম ফোবিয়ায় আছে।
বারবার “মা” “মা” করছে।
দাদীর কান্নায় আবিদ এগিয়ে এসে দাদীকে সামলানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।
দাদীমা কাঁদতে কাঁদতে আবার বলা শুরু করলো,
—“মাইয়া ছিলো না হেই আফসোস আমার সুফিয়া(সেহেরের মা) ঘুঁচায় দিসিলো। আমার হেই পবিত্র ফুলটা দিনের পর দিন অত্যাচার মুখ চেপে সইয্য কইরাও হাসিমুখে কইতো “আমি ভালো আছি মা!” হেই ফুলের একটাই দোষ আছিলো হেয় পুঁত জম্ম দিতে পারে নাই দিসে এক মাইয়া। এতে আমারই বইনের মাইয়া আমার পুঁতের মাতা খাইয়া গিরিঙ্গি বাজের মতো আমার শান্তির সংসারে আগুন ধরায় দিয়া গেসে!”
—“আহ মা চুপ করবা! মান-সম্মান তো দেখছি সব খুইয়ে ছাড়বা।” বিরক্তির সুরে বললো জেঠু।
—“এই ছ্যাড়া চুপ কর তুই! গিরিঙ্গিবাজের চামচামি করতে আইবি না। এক গ্রাম কী আমি দশ গ্রামরে মাইকিং কইরা ওই গজবটার কুকীর্তি হুনামু! ভুইলা যাইস না ওই পোলায় তার মার গাঁয়ে হাত তুলতেও ভুলে নাই!”
জেঠু আর কোনো কথা না বলে আরামদায়ক সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
ওষুধ লাগানোর ঘন্টাখানেক অবধি সারা শরীরের জ্বালাতন না কমলেও আস্তে আস্তে কমে আসছে। এটাই হয়তো গ্রামের লতাপাতার চিকিৎসার ছোট নমুনা।
সেহের চোখদুটো ছোট ছোট করে আশেপাশে তাকালো। সে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করতে পেরেছে।
দাদীমা সেহেরকে জিজ্ঞেস করলো,
—“ফুল, তোর কী এহন ভালা লাগতাসে?”
সেহের মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ নিরব থেকে কাঁপা গলায় বলে,
—“দাদী, আমি মেয়ে বলে কী মানুষ না?”
সেহেরের এই নিষ্পার ভঙ্গির কথার শুনে দাদীর ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠলো কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। কী বলবে সে? আর কী বলেই বা সান্ত্বনা দিবে? আর কতোদিন এই অন্যায়-অবিচার চলবে?
সেহের কিছুক্ষণ আনমনে থেকে হালকা হাতে চোখ মুছে দাদীকে বললো,
—“দাদী আমাকে ওই বাসায় যেতে হবে। কাল রিমনের স্কুল আছে আর রান্নাটাও তো বাকি!”
—“এই চুপ কর! যারা তোরে এই আধারাইতে মাইরা উঠানে ফালায় রাখসে তাদের লেইগা এতো দরদ একদম দেখাবি না!” দাদী পরমুহূর্তে আবার হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে বলে,
—“এতো নরম ক্যান হস রে ফুল? তোর মারে তোর ওই বাপ মাইরা লাইসে এহন তোরেও মারতে উইঠা পইরা লাগসে। তোরে কতো কইরা কইলাম ওই বাড়িত থেইকা আইয়া পর আমাগো কাছে নয়তো ঢাকায় আমার মেজো পুঁতের কাছে চইলা না। হুনোস না তুই আমার কথা!!”
—“মাকে ফেলে আমি কোথাও যাবো না দাদী। আমার মায়ের স্মৃতি যে ওই বাসার আনাচে কানাচে লেপ্টে আছে। চাইলেও ওই বাড়ির মায়া কাটাইতে পারি না। তাইতো এই অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নেই।”
তখনই চাচী পাশ থেকে বলে উঠলো,
—“ওইডা তোর স্বামীর বাড়ি না ফুল যে সব মুখ বুইজা সহ্য করবি। সবকিছুর সীমা আছে সেই সীমা তোর বাপ আর সৎমা অনেক আগেই পার কইরা ফেলসে।”
—“একটা মেয়ে যদি শশুড়বাড়িতে মুখ বুজে সব সহ্য করতে পারে তাহলে বাবার বাসায় কেন পারবে না? এ কেমন নিয়ম গো চাচী?”
—“দেখ ফুল তোর বুঝার বয়স হইসে, তাও ক্যান সব বুইঝাও না বুঝার ভান ধরে থাকোস? পড়ালেখাও তো তুই করোস তাও বুঝোস না?”
—“চাচী। তাদের প্রতি আমি ঋনি। আমাকে এতো বছর লালনপালন করেছে খাইয়েছে এই অবধি মানুষ করেছে, কী করে সব ভুলে যাই?”
চাচী আর দাদী এবার চটে গেলো সেহেরের কথায়। সেহের মেয়েটা অনেকটা বোকা এবং সৎ। কে বলে তাকে এতো সৎ হতে?
—“আর ছোট থেকে যেই অত্যাচারটা করতাসে সেটা? তোর বাপে তোর মায়ের খুনি জাইনাও কুত্তার মতো ওদিকে দৌড়াইতে লজ্জা করে না? আমি কোনো কথাই হুনুম না। তুই আমার বাড়িতেই থাকবি ব্যাস!”
বলেই দাদীমা কক্ষ ত্যাগ করলেন। চাচীও খাবার আনতে বেরিয়ে গেলো। সেহের একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। সেহেরের বাবা কবির এলাকার চেয়ারম্যান। দো’তলা বাড়ি তার। তবে সেই বাড়িটা দাদাজানই তৈরি করে গিয়েছিলো, কিন্তু সেহেরের বাবা নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয়। দাদীমা আগে সেই বাড়িতেই থাকতো কিন্তু সেহেরের সৎমা বাড়িতে আসার পর তাকে বের করে দেয়।
ওদের বাড়ি থেকে ১৫-১৭ হাত দূরেই সেহেরের বড় জেঠুর বাড়ি। একতলা বিশিষ্ট এই বাড়ি। বড় জেঠু তার কয়েক বিঘা জমির পর্যালোচনা ছাড়াও মাছ চাষ করেন, আলাদা সম্মান আছে তার গ্রামে কারণ সে কখনো লোক ঠকায়নি। কবিরের কাড়সাজি সম্পর্কে সকলেই অবগত। লোকটি যেমন অশিক্ষিত তেমনই ভয়ংকর লোভী এবং স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য সে সব করতে প্রস্তুত।।
কবিরের এমন রূপের জন্য গ্রামের সকলে তাকে ভয় পায়। প্রতিবারই কীভাবে কীভাবে যেন কবিরই চেয়ারম্যানের পদ পায়, হয়তো দুই নম্বরি করে।
সেহেরের চকির পাশেই একটা জানালা। সে কষ্ট করেছে আলতো লেসড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো। আজ পূর্ণ গোলাকার চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে চারপাশটা আলোকিত হয়ে আছে। ঝি ঝি পোকার ডাক খুব ভালোভাবেই শোনা যাচ্ছে। সেহের একমনে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে। আনমনেই সে একটা জগল ধরলো,
“আমি চাঁদকে বলি, তুমি সুন্দর নও
আমার মায়ের মতো!
গোলাপকে বলি, তুমি মিষ্টি নও
আমার মায়েরই মতো!”
এই জগলটা সে তার সখি মাঞ্জুর মোবাইলে শুনেছিলো। যদিও সেহের তার সৎবোন তোপার সঙ্গে এখনো মিশতে পারেনি। বলা চলে তার সৎবোনের জন্যই সে বেশি মার খায়। কিন্তু কথা হলো, তোপাকে কবির সেহেরের মতো মারে না আদর করে আগলে রাখে। এ নিয়ে সেহের কখনোই কোনোরকম অভিযোগ করে না। তার সৎভাইও আছে তবে বেশি বড় না ৮-৯ বছরের। তাও তার বিচার-বিবেচনা বিচক্ষণ। সে একদমই তার বোন বা মায়ের মতো নয়। রিমন সেহেরকে অনেক পছন্দ করে। কেনই বা করবে না, সেহের যে নিজ হাতে তাকে লালনপালন করেছে, সৎবোন হয়েও মাতৃস্নেহ দিয়েছে। আর সেহেরের সৎমা? সে তো কখনোই নিজের ছেলের খবর রাখতো না, তবুও যখন কবির সাহেব আসতো তখন ছেলেকে নিয়ে তার কতো দরদ! এমন ভাব করে যেন সে ছেলেকে সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত। এমন নানান ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে সেহের।
সেহেরের সৎমার ১ম বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু সে কিছু সামলাতে পারেনি দেখে শশুড়বাড়ি থেকে বের করে দেয় তার ২ মাসের মেয়ে তোপাকে নিয়ে। কবিরের সম্পত্তির প্রতি তার আগেভাগেই লোভ ছিলো বিধায় সে নানানভাবে সেহেরের মাকে নিয়ে কবিরের মনে হাজাররকম বিষ ঢেলেছে। এও বলেছে ছেলেসন্তান হচ্ছে বংশের বাতি।
সেহেরের চাচী খাবার দিয়ে গেলেও সেহেরের খেতে মন চাইলো না। সে একইভাবে এখনো চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে।
★
—“স্যার ফাইভ হান্ড্রেড পুশ আপ অলরেডি ডান তাও কেন আপনি কন্টিনিউ করেই চলেছেন!”
কারীবের কথায় সাদ থামলো। হাত টান দিয়ে বসে উঠে দাঁড়ালো হাত ঝাড়তে ঝাড়তে।
সাদের চেহারা এবং গলা বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝড়ছে।
সাদ হাতের রুমালটা খুলতে খুলতে কয়েকধাপ এগিয়ে গিয়ে পানির বোতলটা নিলো। বোতলের মুখ খুলে মুখের মধ্যে ঢেলে মুখ মুছতে মুছতে কারীবকে বললো,
—“আই থিংক আমার গণনায় কোনোরকম গোরবর হয়েছিলো।”
—“ইট’স ওকে স্যার। বাট স্যার নেক্সট শুটিং শিডিউলের সময় তো হয়ে আসছে আপনি জলদি চেঞ্জ করে হালকা খাবার খেয়ে নিন।”
সাদ নিজের গলা এবং হাতের ঘাম তোয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে আবারও বললো,
—“শাওয়ার নিতে হবে তুমি আপাতত নিচে গিয়ে ওয়েট করো।”
বলেই হাতে থাকা তোয়ালটা গলায় ঝুলালো। এমন সময়ই সাদের বড় বোন রুবাই জিম কর্ণারে এসে হাজির হলো,
—“সাদ তুই আবারও কোথাও বের হবি নাকি?”
—“হ্যাঁ! সন্ধ্যার পর শুটিং আছে যেতে হবে।”
—“উফ! এই তোর এই শুটিং ফুটিং আর কতোদিন চলবে বলতো? আর কতো এই অফিস আমি আর বাবা সামলাবো? তোর অফিস তুই না সামলিয়ে আমি কেন সামলাচ্ছি হ্যাঁ?”
—“ভুল বললি। এই অফিস আমার কোনোদিনও ছিলো না। আর আমি একদমই অফিসের কাজে ইন্টারেস্টেড না আপু! তুই তো জানিসই এই সা’দ বিন সাবরান সবসময় নিজের ইচ্ছাকে প্রায়োরিটি দেয়। সো তুই সামলা আর নিজের ক্যারিয়ার গড়!”
বলেই তোয়াল দিয়ে চুলের ঘাম মুছতে মুছতে রুবাইয়ের পাশ কেটে বেরিয়ে গেলো। আর কারীব তো আহাম্মকের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারীবকে এভাবে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুবাই বললো,
—“হোয়াট! তোমার স্যার কী অর্ডার দিয়েছে তা গিয়ে পূরণ করো স্টুপিড!”
বলেই রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুবাই।
চলবে!!!