দরিয়া
পর্ব- ৪
আমিরাহ্ রিমঝিম
সামনে হাটছে আফিয়া আর মালতী, পেছনে তুরাগ। বাবা যখন ওদের দুজনের সাথে তুরাগকে পাঠিয়ে দিয়েছে তখনই আফিয়া বুঝে গেছে আজ তার সৈকতে বেড়ানোর আনন্দ শেষ। এই বিরক্তিকর লোকটাকে কেন যে ওর বাবা পাঠালো সাথে! ওরা দুইজন কি যেতে পারতো না?
সৈকতে এসে বালুর উপর বসে পরে তুরাগ। মালতী আর আফিয়ার উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ে,
“এই, তোমরা কিন্তু বেশি দূরে যেও না। আমি বসলাম এখানে।”
আফিয়ার ভ্রু কুচকে যায়। বাচ্চা নাকি ওরা দুজন? মনে হয় যেন আগে কখনো আসেনি ওরা সৈকতে, আজ তুরাগ ভাইয়া বেড়াতে নিয়ে এসেছে। ও তুরাগের দিকে ফিরে ঝাঁঝ মেশানো সুরে বলে,
“আমরা কি ছোট বাচ্চা নাকি যে আমাদের চোখে চোখে রাখতে হবে? আসতে বলেছে কে আপনাকে?”
তুরাগের মন মেজাজ বেশ ভালো ছিলো। আফিয়ার কথা সে গায়ে মাখলো না। সুন্দর করে উত্তর দিলো,“আপনার বাবা”
উত্তর শুনে দমে যায় আফিয়া। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর ভ্রু কুচকে গলার স্বর কিছুটা নামিয়ে প্রশ্ন করে, “ আসলেই কি শুধু বাবার কথায় আমাদের সাথে এসেছেন নাকি আমাকে ইমপ্রেস করতে?”
আফিয়ার কথা শুনে তুরাগ হো হো করে হেসে দেয়।হাসতে হাসতে বালির উপর গড়াগড়ি খায়। এতো হাসি সে এর আগে কবে হেসেছে মনে নেই। চোখে পানি চলে এসেছে হাসতে হাসতে। কিছুক্ষণ পর হাসি কিছুটা কমলে তুরাগ বলে,
“মানে…কি আর বলবো? তোমাকে ইমপ্রেস করার করার আমার কি দরকার? বিয়ে তো তোমার বাবা এমনিতেও ঠিক করে রেখেছেন আমার সাথে। তুমি বরং দেখো আমাকে ইমপ্রেস করতে পারো কিনা। বলা তো যায় না, নাইলে হয়তো দেখা গেলো তোমার বুদ্ধি দেখে কবে আবার বিয়েতে না বলে ফেলি। যেরকম গাধার বুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘুরো তুমি। কখনো কখনো তো মনে হয় তোমার চেয়ে গাধারই বুদ্ধি বেশি।”
আফিয়া রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, মালতী ওকে থামিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে গেলো।
“তুরাগ ভাইয়ার সাথে শুধু শুধু এরকম ঝগড়া কেন করছো আফিয়া?”
“ঝগড়া করবো না তো কি করবো? দেখলে না কিভাবে কথা বললো? বদমায়েশ লোক একটা!”
মালতী কিছুটা ধমকের সুরে বললো,“আফিয়া, উল্টাপাল্টা কথা বলো না।”
ধমক খেয়ে আফিয়ার মুখ চুপসে গেলো। ওর মন ভালো করার জন্য মালতী বললো,“চলো, পানির কাছে যাই।”
আফিয়াকে ধরে পানির কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো মালতী। ঢেউগুলো এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো পা। মুহূর্তেই আফিয়ার মন ভালো হয়ে গেলো। এভাবে ঢেউয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ওর খুব ভালো লাগে, সৈকতে এলে এটা ওর প্রিয় কাজ। একটু দূরে সুন্দর কিছু ঝিনুক দেখে মালতী গেলো সেগুলো কুড়াতে, আর আফিয়া ঢেউয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওভাবেই।
হঠাৎ ওর চোখ গেলো সৈকত দিয়ে হেটে যাওয়া কারো একজনের দিকে। মুগ্ধ চোখে সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ডাক দিলো, “হানিফ ভাইয়া?” কিন্তু হানিফ থামলো না। ওর ডাক শুনতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। এবার আরো জোরে ডাকলো, “হানিফ ভাইয়া?”
হানিফ প্রথমবারে ডাক শুনেও না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছিলো, আফিয়া সেটা বুঝতে পারেনি। পরের বার এতো জোরে ডেকেছে যে আশেপাশের মানুষ পর্যন্ত তাকিয়ে আছে এদিকে। মনে মনে আফিয়ার উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলেও মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখেই আফিয়ার সামনে গেলো। আফিয়া ভীষণ খুশি হয়ে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম হানিফ ভাইয়া, ভালো আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুসসালাম।”
“আমাকে চিনেছেন ভাইয়া? আমি আফিয়া, রোকসানার বান্ধবী।”
“হ্যাঁ”
“রোকসানা কি বাসায়?”
“হ্যাঁ”
“আপনাদের বাসায় যে গিয়েছিলাম….”
“ওই রবিন, দাড়া”
আফিয়ার কথার মাঝখানেই হানিফ কারো দিকে তাকিয়ে গলা উচু করে তাকে ডাক দিয়ে দাড়াতে বলে। তারপর আফিয়ার দিকে ফিরে বলে,“আমার কাজ আছে, যাই আমি।” তারপর চলে যায় আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে।
আফিয়া খুবই বিব্রতবোধ করে। তুরাগের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পায় সে ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে।
ড্রয়িং রুমে বসে অংক করছে রোকসানা, আফিয়া কাছে বসে অংক করা দেখছে। আফিয়া আজ সেই নীল জামাটা পড়েছে যেটা রোকসানাকে দিয়েছিলো। বাবার কথামতো নতুন কেনা জামা রোকসানাকে দিয়ে পুরনো জামাটা ফেরত নিয়েছিলো আগেই।
আজ সপ্তাহখানেক হয় রোকসানা পড়তে আসছে। আর পড়াতে গিয়ে আফিয়া বুঝতে পারছে ব্যাপারটা ও যতটা সহজ ভেবেছিলো ততটাও সহজ নয়। বেশ কয়েকবারই নিজেই আটকে গিয়েছে পড়া বুঝাতে গিয়ে। তখন মালতী আপু এমনকি ওই তুরাগ ভাইয়ার সাহায্যও নিতে হয়েছে ওকে।
অংক থেকে চোখ সরিয়ে ডাইনিংয়ে তাকালে মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আফিয়ার। ছোটখাটো হুংকার ছেড়ে বললো, “তুরাগ ভাইয়া, আপনি রোকসানার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?”
ব্যাবসায়ে ছোটখাটো একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আনমনে এক দিকে তাকিয়ে সেটার ব্যাপারেই ভাবছিলো তুরাগ, দৃষ্টির সামনে কি রোকসানাই রয়েছে নাকি কলাগাছ রয়েছে তা খেয়াল করেনি।
আফিয়া হুংকারে কিছুটা চমকে ওঠে তুরাগ। ব্যাপারটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগে তার। এরপর ভ্রু কুচকে বলে, “ আমি মোটেও ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম না। আনমনে একদিকে তাকিয়েছিলাম, সামনে কে ছিলো তা দেখিনি।”
“ধরা খেয়ে মিথ্যা কথা বলছেন কেন এখন?”
“তোমাকে সত্য বলেই কি লাভ আর মিথ্যা বলেই কি? বিশ্বাস তো তুমি করবেনা আমার কথা। পারো শুধু আমাকে কথা শোনাতে।”
কথাটা বলেই সেখান থেকে উঠে চলে গেলো তুরাগ। তর্ক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার এখন। পেছন থেকে আফিয়া চেঁচাতে লাগলো,“হ্যাঁ, যান, পালান। পালাবেনই তো এখন। নিজের বদমায়েশি ধরা পড়েছে না?”
পুরো ঘটনায় রোকসানা বেশ বিব্রত হয়েছে। আফিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “একটু বেশি হয়ে গেলো না আফিয়া? উনি হয়তো সত্যি কথাই বলছিলেন?”
( চলবে ইনশাআল্লাহ )