দরিয়া
পর্ব – ৬
আমিরাহ্ রিমঝিম
চার দিন পেরিয়ে যায়। রোকসানা আর আফিয়ার কাছে পড়তে আসে না, সাগরপাড়েও যায় না। একদমই গুটিয়ে গেছে সে। মাঝে একবার কেয়ারটেকার ভাইকে দিয়ে খবর নিয়েছিলো আফিয়া, রোকসানা ঠিক আছে।
এই কয়দিনে আফিয়ার মনে তুরাগের উপর দৃঢ় সন্দেহ তৈরী হয়েছে। সেদিন রোকসানা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তুরাগও বেড়িয়ে যায়, আবার রাতের খাবারের আগে ফিরেও আসে। কোথায় গিয়েছিলো সে? তাছাড়া একদিন যে তাকিয়ে ছিলো রোকসানার দিকে।
আফিয়ার বার বার মনে হচ্ছে তুরাগই এই ঘটনার জন্য দায়ী। যদিও এই কথা ওর বাবাকে বলাতে ধমক খেতে হয়েছে। আর মালতী আপু একথা শুনে জানিয়েছে যে রোকসানা বলেছিলো ওই জঘন্য লোকটা অপরিচিত কেউ। আফিয়া তবু নিশ্চিত হতে পারছে না। রোকসানা হয়তো ভয়ে তুরাগের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। আর ওর বাবা তো ওর কথা বিশ্বাসই করছে না। তবে রোকসানার পরিবার নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না।
সকাল সকাল অনেক বায়না করে মালতী আর কেয়ারটেকার ভাইয়াকে রাজি করলো ওকে রোকসানাদের বাসায় নিয়ে যেতে। কেয়ারটেকার ওদের দুজনকে রোকসানাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে কোথাও একটা গেলো। বাইরে থেকে দেখতে সব ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।
— আফিয়া?
—হ্যাঁ আপু?
— রোকসানার ব্যাপারটা হয়তো ওর বাসা ছাড়া বাইরের কেউ জানে না, হতে পারে বাসার লোকজনও জানে না। তাই আগ বাড়িয়ে এ বিষয় নিয়ে কারো সাথে আলাপ করতে যেও না। বান্ধবীর খোঁজ নিতে এসেছো, অযথা ঝামেলা করো না কোনো।
মালতীর কথায় আফিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেও মনে মনে বিষয়টায় সম্মত হতে পারলো না।
বাড়ির উঠানে গিয়ে এক প্রতিবেশিকে দেখতে পেলো, আর একজন মহিলা বিশাল উড়না গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘরে কাজ করছে। প্রতিবেশিকে রোকসানার কথা জিজ্ঞাসা করতেই রান্নাঘরের ওই মহিলার দিকে দেখিয়ে দিলেন।
—ঠিক আছো রোকসানা?
রোকসানা ভাত বসানোর জন্য চাল ধুচ্ছিলো। মালতীর কথা শুনে ওদের দিকে তাকালো, অতি ক্ষীণ একটি হাসির রেখা মুখে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেলো। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মলিন কন্ঠে বসতে বললো দুজনকে, তারপর ভাত বসাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
প্রতিবেশি মহিলাটি রান্নাঘরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, “ দেখেছিস রোকসানা, তোর বান্ধবী দেখতে চলে এসেছে তোকে।”
মালতী আর আফিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “ আহারে, সেদিন না বলে আপনাদের বাসায় থাকাতে হানিফের মা মেয়েটাকে কি মারটাই না মারলো। মার খেয়ে অসুস্থই হয়ে গেলো মেয়েটা। আমরা কেউ তো দেখি নি মারতে, কিন্তু পরে গিয়ে দেখি হাতে মুখে দাগ হয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করাতে হানিফের মা বললো মার দিয়েছে মেয়েকে।”
আফিয়া প্রচন্ড চমকে গেলো। এমনিতেই মেয়েটার এই অবস্থা তার উপর ওর মা ওকে এভাবে মেরেছে? রোকসানার কি দোষ ছিলো? তবে মালতী ঠিকই বুঝতে পারলো মেয়ের হাত-মুখের ক্ষতের দাগের ঘটনা মা মারের কথা বলে চাপা দিয়েছেন।
রোকসানার মা এসে আফিয়া আর মালতীকে ঘরে নিয়ে গেলেন। রোকসানার এক চাচী ছিলো সেখানে। রোকসানার মা ওদের সাথে টুকটাক আলাপ করে কাজ করতে গেলেন। মালতীও গেলো উনাকে সাহায্য করতে।
আফিয়ার ভালো লাগছিলো না। একে তো রোকসানার এই অবস্থা, তার উপর ওর মা মেরেছে ওকে, আবার কাজও করাচ্ছে। এমন কেন করছেন ইনারা? রোকসানার এই ঘটনায় কোনো স্টেপও নেননি। এমনটা তো হতে দেয়া যায় না। বুঝাতে হবে উনাদের। রোকসানার ব্যাপার বাড়ির কেউ না জানলেও বাড়ির লোকদের তো জানার কথা। তাদের সাথে আলোচনা করতে তো সমস্যা নেই।
এসব ভেবে রোকসানার চাচীকে প্রশ্ন করলো,
“ আপনারা রোকসানার ঘটনায় কোনো স্টেপ নিচ্ছেন না কেন? পুলিশে কেন খবর দেননি? রোকসানা নয় শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছে, আপনারাও কি ভয় পাচ্ছেন?”
রোকসানার চাচী ভ্রু কুচকে পালটা প্রশ্ন করলো, “ পুলিশে কেন খবর দিবো?”
“আশ্চর্য, আপনাদের মেয়ের উপর যে এরকম জঘন্য অত্যাচার করলো তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবেন?”
প্রশ্নটা করেই আফিয়ার মনে হলো উনি হয়তো কিছু জানেন না এ ব্যাপারে। এদিকে রোকসানার চাচী রহস্যের গন্ধ পেলেন আফিয়ার কথায়। ঘুরিয়ে পেচিয়ে উনি ঠিকই আফিয়ার পেট থেকে সব কথা বের করে নিলেন। তারপর উঠে চলে গেলেন কিছু না বলে।
আফিয়া আর মালতী চলে আসার আগেই চারিদিক থেকে নানান বাক্যবাণ এসে ঘিরে ধরলো রোকসানা আর তার পরিবারকে।
একা একাই সাগরপাড়ে চলে এসেছে আফিয়া। দুচোখে বইছে নোনাজলের ধারা। ও ভুলটা করলো কোথায়? ও কি জানতো সবার ক্ষেত্রে যে চাচা-চাচী মানে নিজের আপনজন হয়না? সে তো নিজের চাচীর কাছে মায়ের মতোই স্নেহ পেয়েছে। আর ও তো রোকসানার ভালোর জন্যই ওদের বাসার কারো সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। ও কি জানতো এর ফলে রোকসানাকে এরকম বিশ্রী অবস্থায় পড়তে হবে?
এই ঘটনা জানার পর বাসায় সবাই বিস্তর রেগে আছে আফিয়ার উপর। সবচেয়ে বেশি রেগে আছে মালতী। আফিয়ার কিছু ভালো লাগছেনা। সমুদ্রের পাড়ে এসেও মন খারাপ কাটাতে পারছেনা।
একটু দূরে দুইটা বড় মাছ ধরার নৌকা রাখা। তার এক নৌকায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে কেউ। আফিয়া কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সেদিকে এগিয়ে গেল।
বালুর উপর ক্রাচ নিয়ে হাটা বেশ কষ্টকর। আফিয়া তবু অনেকক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে নৌকাগুলোর কাছে দাড়ালো।
“হানিফ ভাইয়া?”
হানিফ ঘাড় ঘুরিয়ে আফিয়াকে দেখতে পেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
“ভাইয়া আপনারা পুলিশে খবর দিন। এই কাজ যেই করে থাকুক তার শাস্তি পাওয়া উচিত।”
“চলে যান।”
“আরে আমিতো ভালোর জন্যই….”
“অনেক ভালো করে ফেলেছেন, আর করবেন না”
কথাটা বলে আর একটা মুহূর্ত বিলম্ব না করে হানিফ চলে গেল সেখান থেকে।
একা একা সৈকতে যাওয়ার জন্য বাসায় ফেরার পর আরেক দফা বকা খায় আফিয়া। তবে ওর মাথায় তখন অন্যকিছু চলছে। কেউই রোকসানাকে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারটায় স্টেপ নিচ্ছে না যখন, তাহলে সে নিজেই পুলিশে খবর দেবে। ওর ধারণা এই ঘটনার পেছনে তুরাগই দায়ী। এর তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
পরেরদিন সকালে খাবার টেবিলে বসে আফিয়া খবর পায় রোকসানার পুরো পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারছে না।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )