দলিল-১

0
580

দলিল-১

বিছানায় আড়মোড়া দিয়েই শুভ মোবাইলটা অফ করে দিয়েছে। তারপর পাশ ফিরেই কোলবালিশটা টেনে নেয়।

সে এখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাত এগারটায় তার ঘুম আসার কথা না। কিন্ত ঘুম ঘুম ভাব আনার জন্য হলেও চোখ বন্ধ করতে হবে।
শুভ চোখ বন্ধ করল।

: তিথি শুয়ে পড়ো।

: এখন না, তুমি ঘুমাও।

তিথি আয়নার সামনে বসা। এটা তার দৈনিক রুটিন । রাত এগারটায় কম হলেও আধঘন্টা নিজের কেয়ার করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখে। শরীরে লোশন মাখে হাত পায়ে তেল দেয়। নিজের প্রতি খুব যত্নবান সে । শুভ চোখ বন্ধ অবস্থায় কথা বলছে। তিথির কথা শুনে সে বিছানায় উঠে বসে।

: কালকের ট্যুরের কথা ভুলে গেছো?

: ট্যুর নয় বলো এডভেঞ্চার।

তিথির ওমন কথায় শুভ একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়।

: সবকিছুতে ফান করো না।

তিথি মুখ টিপে হাসে। মেয়েটার হাসিটা মারাত্নক সুন্দর। কি দারুন একটা টোল পড়ে গালে। তখন দেখতেই ভালো লাগে।

: ফান নয়, সত্যি আমার কাছে এটা।এডভেঞ্চারের মত লাগছে।

শুভ কিছুটা সেটিয়ে যায়।
তিথি ইদানীং খুব রহস্য করে কথা বলে। অথচ বিয়ের পর পর কেমন বোকা বোকা ভাব ছিল। অল্পতেই শুভর জন্য ভালবাসা উথলে পড়ত। শুভ যাই বলত তাতে সায় দিত।
এখন হয়েছে উল্টো। সব ঘাটিয়ে দেখে। সত্য অসত্য যাচাই করে। এটা শুভর জন্য ভালো খবর নয়। শুভকে আরো সতর্ক হতে হবে।

: তাই?

: হুম। জানো পুরো বিষয়টা আমার কাছে রহস্য রহস্য লাগছে।

: কি রকম?

: এই যে আমি যাচ্ছি তোমার গ্রামের বাড়িতে অথচ সেখানে আমার কাজটা কি সেটা জানা হলো না। কেবল বললে জমির একটা সুরাহা হবে। কিন্ত জমি সংক্রান্ত কাজে আমাকে কেন লাগবে এটা বললে না। ওসব তোমার সম্পত্তি। আমার তো কিছু না।

: তুমি ওমন পর পর হয়ে কথা বলছো কেন?

: এমনি।

তিথির কথায় শুভ রিএ্যক্ট করেনি। মেয়েটা দিন দিন ভার হয়ে যাচ্ছে। সহজ কথাকে জটিল করে। নিজের মত যুক্তি দেখায়। শুভ এসব মানতে পারে না।

তিথির চুল বাঁধা শেষ। সে এখন গুনগুন গান গাইছে। আনন্দিত ভাবসাব নিয়ে। তার এই উচ্ছাস আগামীকালের ট্যুর নিয়ে। অনেকদিন পর কোথাও যাওয়া হচ্ছে। তিথি চোখ বন্ধ করে আরেকবার ফিল করল। লং জার্নি। ঢাকা টু মুক্তাগাছা। ময়মনসিংহ হয়ে যেতে হবে। দারুন একটা সময় কাটবে। হাইওয়ের দুপাশের সবুজ গাছ দুরের গ্রাম আঁকাবাঁকা পথ।

উফ! কি দারুন একটা ব্যাপার।

মুক্তাগাছা শুভর দাদা বাড়ি। শুভর বাবা চাচারা তিন ভাই। শুভর বাবা সবার ছোট। সবার বড় রহমত চাচা। আর মেঝো চাচা সালাম। মেঝো চাচা পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কুয়েতে থাকেন । দেশে আসেন না।

শুভর বাবা নেই। গত এক বছর আগে মারা গেছেন। আর রহমত চাচাও মারা গেছেন তিন বছর হয়। তিনি চিরকুমার ছিলেন। কিন্ত তার সহায় সম্পদ অনেক। কিন্ত জীবিত অবস্থায় সেসবের কোনকিছু উইল হয়নি। তাই তার মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে বিরাট ক্যাচাল লাগে। চাচাতো ভাই ফুপুর ছেলেরা এসব নিয়ে দেন দরবার করেই চলেছে । শেষ পর্যন্ত সব মিটেছে। তার ভাই আর বোনের ছেলেমেয়ের মাঝে বেশ কিছু জমি বন্টন হয়। এরই অংশ হিসাবে শুভ পেয়েছে পঁয়ত্রিশ শতাংশ জমি। কিন্ত তার আরেক চাচাতো ভাই শাকিল লিটন এই জমিটা নেবার জন্য শুভকে চাপ দিচ্ছিল । শুভ ঢাকায় থাকে। গ্রামে তার যাওয়া আসাও। কম। তাই জমি নিয়ে সেও খুব মাথা ঘামায় না। সে উল্টো চিন্তা করল জমিটা ছেড়ে দিলে ভালো কিছু টাকা আসবে যেটা তার কাজে লাগবে।

শেষ পর্যন্ত জমিটা শাকিল আর লিটন কিনে নিয়েছে। দুই লাখ টাকায় ।কাগজপত্র সব ঠিকঠাক। বারেক সব দেখে ফাইনাল করে ফেলেছে। বারেক শুভদের বর্গাদার। তার বাপ দাদারা সবাই শুভর দাদাবাড়িতে কাজ করেছে। মনপ্রান দিয়ে। তাই শুভও সব কাজে বারেকের সাহায্য নেয়।

কাল সেই কাগজ রেজিস্ট্রি অফিসে জমা পড়বে। সাব রেজিস্টার যাচাই বাছাই করে সই দেবে। কাগজে। ব্যস।
এটুকু কাজ বিরাট চাপ হয়ে মাথার উপর বসে আছে।
এটাই শুভর জন্য টেনশান।

: তোমার কিছু না কে বললো। তুমি ওখানে গেলেই বুঝবা।
এখন তুমি দয়া করে সাজগোজ বন্ধ করো। আমায় ঘুমুতে দাও।

তিথি ঠোঁট উল্টিয়ে বলল।

কই সাজগোজ দেখলা। চুল আচঁড়াতে বসলেই তোমার বিরক্ত লাগে না?

তিথির শ্যামলা মুখ কালো হয়ে যায়।

: বিরক্ত না। বলছিলাম কাল সকাল বেলা বেরিয়ে পড়তে হবে তাই অত রাত জাগার দরকার কি।

: শুভ আমার না কেমন জ্বর জ্বর লাগছে।

: একটা নাপা খেয়ে নাও।

: আচ্ছা।

তিথি উঠে গিয়ে নাপা খেলো। ঔষধের বক্সে দুনিয়ার ঔষধ। নাপা খুঁজতে গিয়ে সব এলোমেলো হয়ে গেছে।

নাপা খেয়ে তিথি ব্যাগটা আবার চেক করল।
ছোট একটা ব্যাগ নিয়েছে। ওতে টুকিটাকি সব গুছিয়েছে।
আয়না লোশন রুমাল টুথব্রাশ পেস্ট। গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ পানি বিস্কিট চকলেট।
একসেট সালোয়ার কামিজ নিয়েছে। যদি প্রয়োজন হয় চেঞ্জ করার।
লং জার্নিতে কখন কি লাগে বলা মুশকিল। হঠাৎ মনে হলো বমির ট্যাবলেট নেয়া হয়নি।
লাগবেও না। কারন তিথির জার্নি সিকনেস নাই।

আলো নিভিয়ে দিয়ে তিথি হাঁটতে থাকে। মাথাটা ভার হয়ে আছে।
আধো অন্ধকারে আস্ত একটা মানুষ পায়চারি করলে ভৌতিক একটা আবহ আসে।
তিথিকেও অন্ধকারে রহস্যময় লাগছে।
শুভ একটু থমকে যায় তিথির দিকে লক্ষ্য করে।
হঠাৎ করে হাঁটা থামিয়ে তিথি শুভর খুব কাছে চলে আসে।

: শুভ তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো?

: নাহ, কেন?
শুভ বেশ তাড়াহুড়োয় কথা বলছে। সে খেয়াল করল তিথি অন্ধকারেও অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকে অবজার্ভ করছে।
অনেকটা গোয়েন্দার নজরের মতন।

: তোমাকে কেমন জানি অস্থির লাগছে।

শুভ হেসে ফেলল। কিন্ত হাসিটা মেকী মেকী হয়ে গেছে।
সে কথা ঘুরিয়ে ফেলো।

: একটা কাঁথা দাও। আমার শীত শীত লাগছে।
তিথি ওয়ারড্রব থেকে কাঁথা বের করল। শুভ কাঁথা মুড়ে শুয়েছে। এখন অক্টোবর চলে। এই সময় ঢাকা শহরে কোন ঠাণ্ডা থাকে না।
অথচ শুভর শীত লাগছে। কি অদ্ভুত।

তিথি খেয়াল করল শুভ তাকে এড়িয়ে চলছে। কিছুটা সময় তা লক্ষ্য করে সে আস্তে করে ব্যলকনিতে চলে আসে।
বেতের চেয়ারটায় এসে চুপচাপ বসল। এখন বারোটা বাজে। খুব বেশী রাত নয়। তবুও বিষন্ন এক পরিবেশ রাতের শহরে।

এই বাড়িটা সাততলা । তিথিরা থাকে পাচঁতলায়। পাচঁতলা বাড়ির এই ব্যলকনিতে একটা প্রকট শূন্যতা।
তিথি রাত হলেই টের পায়। শুভর ব্যস্ততা তিথির একা থাকা সব মিলিয়ে একটা শূন্যতা।
এত শূন্যতার মাঝে তিথির কেন জানি হঠাৎ খুব ভালো লাগা চলে এলো।
তিথি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। আলতো করে গ্রিল ছুঁয়ে দেয়। কি ঠাণ্ডা। শীতল একটা অনুভুতি রাত্রির বাতাসে।
তিথির ভালো লাগাটা বাড়ছে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
কাল খুব সকালে বেরিয়ে পড়তে হবে। অনেকটা পথ। তিথি তড়িঘড়ি করে রুমে চলে আসে।
রুমে এসে দেখে শুভ ঘুমিয়ে পড়েছে। তিথি আস্তে করে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

…. তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here