দলিল -৩

0
242

দলিল -৩

স্পটে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে। পুলিশ এসেছে। পুলিশের ভ্যান গাড়িও সাথে। ট্রাক ভেঙেচুরে শেষ। সেই দৃশ্য দেখার জন্য উৎসুক মানুষজন মাথার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মোবাইলে ছবি তোলা ভিডিও সব চলছে । বিষয়টা এমন যেন খুব মজার কিছু ঘটেছে।
শুভ দাঁড়িয়ে আছে। খুব হতাশ তার চেহারা। শাকিলের ফোন এসেছে তিনবার। শুভ ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও উদ্বেগ কাটাতে পারছে না। দশটা বেজে গেছে। এখনও যদি রওনা হওয়া যায় তবুও দুইটার আগে যাওয়া সম্ভব। কিন্ত জ্যাম না ছাড়লে সেটাও দুরাশা। বিকল্প পথ হলো গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলা। শুভ একবার ভাবল উত্তরা দিয়ে চলে যাবে কিন্ত সেখানেও যদি একই অবস্থা হয় তবে ঝামেলা আরো বাড়বে।
মানে ডাবল সময় নষ্ট হবে।

অযথা বাজে চিন্তা মাথায় এসে ভর করছে। সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এই মুহুর্তে পরিস্থিতি মেনে কুল থাকা উত্তম। শুভ রিলাক্স মুডে হাঁটতে থাকে। দিয়াবাড়ি জায়গাটা খুব সুন্দর। বিকেল হলেই লোকজন ঘুরতে আসে। আড্ডা দেয়। খায় বেড়ায়। সুন্দর সময় কাটায়।
ছোট ছোট কটেজ আছে। চমৎকার সময় কাটানোর জন্য।
পার্কও রয়েছে।
তবে সন্ধ্যের পর বেশ রিস্ক এখানে। নানা ঘটনা ঘটে।
ফাঁকা আর নিরিবলির জন্য চুরি ছিনতাই নিয়মিত ঘটনা।
মাঝে মাঝে বেডবডিও ফেলে রাখা হয়।

শুভ উচু ঢাল বেয়ে একটা টি স্টলে গিয়ে বসল। মাথা ধরেছে তার। চা খেতে হবে। দুই কাপ লিকার চায়ের অর্ডার করেছে।
সবখানে লোকের সমাগম।
শুভ যেখানে বসেছে সেখান থেকে তিথিকে দেখা যাচ্ছে।
মেয়েটা ঝিমঝাম বসা। কোন অস্থিরতা নাই। যতটা অস্থির শুভ নিজে। সে।জানালার গ্লাস নামিয়ে একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। শুভকে খেয়াল করেনি।
শুভর মনে হলো তিথিকে ডেকে আনা উচিত। ব্রেকফাস্টের পর কিছু খায়নি। ক্ষিধে পেয়েছে হয়তো।
কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে কিছু খাবে কিনা।
ফোনে হাত দিতেই দেখে জামান ছুটে আসছে। তার আনন্দিত চেহারা নিয়ে।
কাছে এসে হাঁপাতে লাগল।

: স্যার সব কিলিয়ার।

শুভ চা খাচ্ছে।
: কি বলো?

: হ স্যার, টেরাকওয়ালা তে পলাইছে।
পুলিশ হেলপার বেডারে চিপা থিকা বাইর করছে।
এহন টেরাক লইয়া যত কাহিনী। সরাইতে সময় লাগব।
হেইডার লাইগা লোকের ব্যবস্থা অইয়া গেছেগা। তাই পুলিশ জ্যাম ছুটানির ব্যবস্থা করতাছে।

শুভ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষনে বুকের উপর থেকে ভারী পাথরটা সরে গেছে।

চায়ের বিল মিটিয়ে শুভ বের হয়ে আসে। জামানও সাথে সাথে আসছে। নানা কথা তার মুখে। সেসব শুনতে শুভর খারাপ লাগছে না। কারন তার মন এখন খুব ভালো।

গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে । তিথির বিমর্ষ ভাব নেই। বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে।
শুভ আড়চোখে তাকিয়ে দেখল। কেমন মায়া লাগছে মেয়েটার জন্য হঠাৎ করে। তার মনে হলো তিথিকে সে ইদানীং বেশ অবহেলা করে। যেটা তার প্রাপ্য নয়। আসলেই সংসার করতে এসে বেশীরভাগ মেয়েরা অবহেলা পায়। আর সবচাইতে আশ্বর্য হলো তারা সেসব মেনেও নেয়। কেন মেনে নেয়। সেটা কি অনিশ্চিত জীবন নাকি সমাজের নিয়মের জন্য।।
এমন অবহেলা হলে একটা মেয়ের তো সংসার ফেলে চলে যাওয়া উচিত। শুভ আস্তে করে তিথির হাতটা টেনে ধরল। বিয়ের আগেও তিথির হাত ধরেছে। তখন ভালবাসা কেমন উথাল পাথাল ছিল। ধরার সাথে সাথে শরীর কাপুনি দিত। কিন্ত আজ শুভর অন্যরকম লাগছে। তাহলে কি সংসার জীবনে প্রেম ভালবাসাগুলো আস্তে আস্তে মায়ায় পড়ে যায়।
শুভ বেশ শক্ত করেই হাতটা ধরল।।
তিথি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে শুভর দিকে।

: কি হয়েছে তোমার?

: নাহ, কিছু না।

গাড়ি টঙ্গী ছাড়িয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় চলে আসছে। শুভ অবাক হল। এখানে কোন জ্যামই নাই। চৌরাস্তার বিখ্যাত জ্যাম সে ফেলে এসেছে। এতো মহাভাগ্যের বিষয়।
খুব খুশী মনে সে কানে ইয়ারফোন গুঁজে দেয়।
গাজীপুরের রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। দুপাশে দারুন দৃশ্য। এসি বন্ধ করে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে রাখা হয়েছে। তিথি মুগ্ধ হয়ে সেসব দৃশ্য দেখছে। সবুজ গাছ দুরের পথ। মাটির জীবন। তার চোখ ভালো লাগায় ডুবে গেছে।
গাজীপুর রাজেন্দ্রপুর এসে আবার স্লো গতি। সামান্য জ্যাম। জামান চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে।
জ্যাম ছাড়ার পর গাড়ির স্পিড বেড়ে যায়। বাতাসের সাথে উড়ে যাবার মত অবস্থা।

শুভ মিররে জামানকে লক্ষ্য করে। লোকটা বেশ চৌকস ড্রাইভার। ভালো চালায় গাড়ি কিন্ত সুযোগ পেলে বেপরোয়াও হয়ে উঠে।

: আস্তে চালাও।

: স্যার সময়ডা ব্যবহার করলাম। একটু উইরা না গেলে কেমুন জানি লাগে।
শরীর চাঙ্গা অয় না।
তিথি একবারেই কথা বলছে না। শুভ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। অত মুডে থাকলে গ্রামে গিয়ে তিথিকে ম্যানেজ করতে পারবে তো?

দুই ঘন্টা পর গাড়ি মাওনা পার হয়ে ভালুকা সিডস্টোরেএসে থামল। এটুকু বিরতি শুভ চাইছিল না। এতে দেরী হবে পৌঁছতে। কিন্ত ফ্রেশ হওয়া দরকার। ওয়াশরুমেও যেতে হবে। হাইওয়ের একপাশে গাড়ি রাখল জামান।তিথি উশখুশ করছে। শুভ ডাকল।

: নামবে এখানে?

: চলো।

: জামান আসুক। গাড়ি লক না করে কেমন করে যাই।

তিথি নেমে পড়ল। অনেকটা সময় পর তার ভালো লাগছে।
শুভও নামল।
বারোটা বাজে মাত্র। ক্ষিধে পেয়েছে যদিও কিন্ত এখনো লাঞ্চের সময় হয়নি। কিন্ত তিথি নাশতার পর কিছু খায়নি।
শুভ বলল।

: তিথি লাঞ্চ করে ফেলি কি বলো?

তিথি সায় দেয়।

: এখনই, তাছাড়া এখানে ভালো কিছু পাবো?

: যা আছে এতেই চলবে। কারন ময়মনসিংহ গিয়ে আর কোথাও নামব না। সোজা বাড়িতে।

জামান এসে গাড়ি ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টর সামনে রাখল।

তিথি চারপাশটা দেখছে। কি চমৎকার গ্রাম্য পরিবেশ। মন ভালো হয়ে যায়। শুভ এলো পিছু পিছু।
ভালো একটা রেস্টুরেন্ট দেখে ভিতরে গিয়ে বসল।

: তুমি ফ্রেশ হবা?

: এখানে? দেখছো কি অবস্থা?

শুভ দেখল কিছু করার নাই। আপাতত এটাই ভরসা।
: ঠিক আছে তুমি বসো আমি আসছি।

তিথি উঠে গিয়ে খাবারের মেনু দেখছে। সামনে সারি সারি করে খাবার সাজানো। সকল পদ আছে। মাছ গোশত ভর্তা। কয়েক রকম ভর্তা।
তিথি খাবার অর্ডার করে ফেলে।
ভর্তা ডাল টক আর ছোট মাছের চচ্চড়ি।
শুভ চলে এসেছে।
ফ্রেশ হওয়াতে তাকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে। মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে।
তিথি এক নজর দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।
শুভ মুচকি হাসি দিয়ে তিথির পাশে বসল।

: কি দেখছিলে ওমন করে?

তিথি লাজুক ভঙিতে না করল।

খাবার চলে এসেছে। ধোঁয়া উঠা গরম খাবার। শুভ খেতে আরম্ভ করে।

: জামান কই?

: ঐতো বাইরে।

শুভ জামানকে ডাক দেয়।

: তোমার পছন্দমত অর্ডার করো।
জামান একগাল হেসে বলল।

: জ্বি স্যার।

জামান গোশত ডাল আর সবজি নিয়েছে। ভাত নিলো দুইবার।
তিথি খাবার খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। সে কফি খুজঁছে।
তিনটা দোকানের পর একটা কফির দোকান পেলো।
দুটো কফি অর্ডার করে।
শুভ কফি খেতে চায়নি। কিন্ত বিল দিতে এসে দেখে দুটো নেয়া হয়ে গেছে।

কফি শেষ হলেও জামানের খেতে সময় লাগছে।

শুভ তাগিদ দেয়। সব শেষ করে ওরা বের হতে হতে পৌনে একটা বেজে গেছে।

ভালুকা থেকে গাড়ি ছুটছে। খুব নিরিবিলি পরিবেশ
। যতদুর চোখ যায় কেবল গাছ আর গাছ। খোলা প্রান্তর। ফসলী।জমি।।
তিথির ঘুম ঘুম ভাব চলে আস।

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ওরা ময়মনসিংহে ঢুকে।যায়। শুভ ভীষন মুড নিয়ে আছে। এখান থেকে মুক্তাগাছায় যেতে মাত্র চল্লিশ মিনিট লাগবে।

শাকিল আর লিটন কল দিয়েছে। কাগজপত্র নিয়ে ওরা রেজিস্ট্রি অফিসে চলে গেছে।
সিএনজি স্টেশনে গ্যাস নেয়া হলো। এখানেও সময় লাগল।
গ্যাস নেয়ার পর গাড়ি মুক্তাগাছার দিকে রওনা হয়। এর মাঝে বারেকের ফোন আসে।

: কাকা আমনে মময়মনসিংহ আইয়া পড়ছেন?

: হুম। কেন?

: একটা প্যাচ অইয়া গেছে।

শুভ চমকে যায়।

: কি হয়েছে?

: সাব রেজিস্টার নাকি দুইটার পরে চইলা যাইবো।

শুভ কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল।

: সমস্যা নেই। আমি প্রায় চলে এসেছি। তুমি অফিসের সামনে থেকো।

শুভ ফোনটা রাখল।

তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here