দিন_বদলের_হাওয়ায়-৬,০৭

0
494

#দিন_বদলের_হাওয়ায়-৬,০৭
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
০৬

রাতটা কোন রকমে কাটলো আমার। এ বাড়িতে আমার মন টিকছে না আর। এই বাড়ির স্মৃতি গুলো আমার কাছে এখন তি/ক্ত। মিষ্টি অতীতকে বর্জন করে সৃষ্টি হয়েছে তি/ক্ত কিছু অতীত। ভোর হতেই ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নিলাম। রাতে মাকে বলেছি চলে যাবো সকালে। মা কিছু বলেন নি। শুধু আমার দিকে চেয়ে দু ফোঁটা চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন। আমিও কোন কথা বলি নি। জানি তারা ক/ষ্ট পাচ্ছে কিন্তু আমি আর কিছু করতে পারবো না। এখানে থাকলে পায়রার কথা শুনে আমি ম/রে/ই যাবো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাবার কাছে গেলাম। কেমন যেন মনমরা হয়ে বসে আছেন বাবা‌। আমি বাবার কাছে গিয়ে বললাম, ‘বাবা আমরা যাচ্ছি।’

বাবা আমার দিকে তাকালেন। বললেন, সত্যি যাবি?

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। বাবা আবার বললেন, যাইলে আর আমি কি কইতে পারুম? যা তাইলে। আবার আইস। নিজের যত্ন নিছ।

তুমিও নিজের যত্ন নিয়ো। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবে।

এরপর মায়ের থেকে বিদায় নিলাম। মা হা,উ মা,উ করে কেঁদে দিলেন। আমি মাকে শান্তনা দিলাম। পায়রা নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মিষ্টি মুখটা দেখলে সব ভু/লে যাই। যত যাই হোক আমার ছোট বোন তো। আমি পায়রার কাছে গিয়ে বললাম, যাচ্ছি রে পায়রা। ঠিক মতো থাকিস। নিজের খেয়াল রাখবি। আর মাহবুব শোনো আমার বোনকে কিন্তু কখনো কোন ক/ষ্ট দিবে না।

পায়রা কিছু বললো না। শিউলি বললো, আমার ভাই ভাবিকে কোন ক/ষ্টই দেয় না। আপনারাই তো দেন। কথায় কথায় কথা শুনান। আবার দরদ দেখান।

ও মুখ ভে-ং-চে পায়রার হাত ধরে টেনে ভিতরে চলে গেলো। আমি আর কিছু বললাম না। আমি আর রেদোয়ান বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। কিছুদূর হাঁটতেই একটা রিক্সা পেলাম। রিক্সা করে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম।

দীর্ঘ তিন ঘন্টা জার্নি শেষে বাড়িতে পৌঁছালাম। দুই তিন বার কলিং বেল চাপ দেওয়ার পর আমার শাশুড়ি এসে দরজা খুলে দিলেন। শাশুড়ি দরজা খুলে আমাদের দেখে বোধহয় খুশি হলেন না। দরজাটা খুলে দিয়েই ভিতরে চলে গেলেন। আমি দরজাটা বন্ধ করে নিজের ঘরে গেলাম। আমার ঘরের অবস্থা দেখে চক্ষু চড়কগাছ। ঘরের অবস্থা না/জে/হা/ল। একটা কিছুও ঠিক নেই। ড্রয়ারের সব জামাকাপড় খাটের উপর ছড়ানো ছিটানো। ড্রেসিং টেবিলের জিনিসপত্র এলোমেলো করে রাখা কিছু আবার ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমার আলমারিটার আয়নার কাঁচটাও ভা/ঙা। ভীষণ আশ্চর্য হলাম। রেদোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, রেদোয়ান আমার ঘরের অবস্থা এমন কেন? আলমারির কাঁচ ভা/ঙ/লো কে?

রেদোয়ানও বিস্মিত হলো। বললো, আমি কি করে বলবো আয়ু?

আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। শাশুড়িকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা আমার ঘরের এই অবস্থা কেন?

শাশুড়ি আমার দিকে বি/র/ক্তি নিয়ে তাকালেন। বললেন, তো কেমন অবস্থা থাকবে তোমার ঘরের? আসমানে গিয়া বইসা থাকলে ঘরের অবস্থা তো এমন থাকবোই।

আমার আলমারির কাঁচ ভাঙলো কে?

এতো জবাব তোমারে দিমু কেন? তোমার ঘর যে ঠিক আছে সেই শুকরিয়া করো। গেছিলাই তো আইলা কেন? মাইনষের ঘাড়ে খাওয়ার অভ্যাস হইয়া গেছে?

আমি আর কিছু বললাম না। অযথা কথা না বাড়ানোই ভালো। আমি নিশ্চুপ ভাবে ঘরে চলে গেলাম। কিন্তু শাশুড়ি থামলেন না। তিনি আমাকে আরো নানান কথা শুনাতে থাকলেন। আমি ঘরে এসে চুপচাপ সব গুছিয়ে নিলাম। ঘরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমার ঘরে তল্লাশি হয়েছে। কিছু খুঁজতে গিয়ে ঘরের সব জিনিসপত্র একাকার করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পারছি। নিশ্চয়ই কাজটা আমার শাশুড়ির। তিনি ছাড়া এই কাজ আর কেউ করতে পারেন না। নিশ্চয়ই তিনি আমার ঘরে আলমারির চাবি খুঁজেছেন। হতাশ হলাম প্রচুর। আমি প্রথমে ড্রয়ারটা গুছিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করে ড্রেসিং টেবিল গুছালাম। ড্রেসিং টেবিল গোছাতে গিয়ে মনে পড়লো আমার নূপুর জোরা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ছিলো। কিন্তু এখন নেই। গোছানো ড্রেসিং টেবিলের সব এলোমেলো করে আবার নূপুর জোরা খুঁজতে লাগলাম। নূপুর জোরা আমার খুব প্রিয়। রেদোয়ানের থেকে দিয়েছিলো সেগুলো। আমার বাসর রাতের উপহার ছিলো ওগুলো। সারাটা ঘর তন্ন তন্ন করে ওগুলো খুঁজলেও পেলাম না। রেদোয়ানকে বললাম, আমার নূপুর জোরা পাচ্ছি না রেদোয়ান। ড্রেসিং টেবিলে রেখে গিয়েছিলাম।

ভালো করে দেখো। সেখানে রাখলে আর কোথায় যাবে? খুঁজে দেখো।

আমি চিৎকার করে বললাম, আমি গোছানো জিনিস এলোমেলো করে খুঁজলাম পেলাম না। আর কত খুঁজবো?

রেদোয়ান কিছু বললো না। উঠে আমার শাশুড়ির কাছে গেলো। শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো, মা আয়রার নূপুর জোরা পাচ্ছে না। ড্রেসিং টেবিলের মধ্যে রেখে গিয়েছিল। এখন আর পাচ্ছে না। এগুলো কোথায়?

আমার শাশুড়ি তে/জ দেখিয়ে বললেন, তোর বউয়ের নূপুরের খবর আমি কেমনে জানবো?

বাড়িতে তো আর আমরা ছিলাম না যে আমরা জানবো। তুমি ছিলা তাই তোমারই জানার কথা। জুলি আর শান্তি ও তো বাড়িতে নেই।

আমার শাশুড়ি রেদোয়ানের কথা শুনে হায় হুতাশ করতে লাগলেন। বললেন, তার মানে তুই কইতে চাইতাছোছ আমি তোর বউয়ের নূপুর জোরা চু/রি করছি? আমার এই দিনও দেখতে হইলো? নিজের পোলায়ই আমারে চো/র বানায়া দিলো। মা বাপের আর কোনো কদর রইলো না। পোলা পাইল্লা বড় করলাম পোলায় চো/র বানায়া দিলো। আল্লাহ গো তুমি কই বইসা দেখো গো..!

শাশুড়ি ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলেন। রেদোয়ান তাকে আর কিছুই বললো না। চুপচাপ ঘরে এসে পড়লো। আমিও আর কথা বললাম না। নূপুর জোরা আর আমার নেই সেটা অন্য কারো হয়ে গেছে বুঝতে পারলাম। কথা না বাড়িয়ে ঘরটা আবার গুছিয়ে ময়লা কাপড়চোপড় ধুয়ে নিলাম। কাপড় মেলে এসে দেখলাম আমার শাশুড়ি ঘুমাচ্ছে। দুপুর হয়ে এসেছে। রান্নাঘরে গিয়ে হাঁড়ি পাতিল ধুয়ে রান্নার জন্য চালের ড্রাম খুলতেই দেখলাম কিছু নেই। নেই চাল, নেই ডাল। ভীষণ আশ্চর্য হলাম। এরকম এ বাড়িতে কখনো আমি দেখি নি। আমার জা য়েরাও বাড়ি নেই। তারা বাপের বাড়ি গেছে। তারা মাকে এভাবে বাজার না করে দিয়ে চলে যাবে ব্যাপারটা কেমন জানি লাগছে। এখন রান্না করবো কি? শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করবো? কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করলে তো সে আরো দশ রকমের কথা শুনিয়ে দিবে। তার উপর ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে সজাগ করলে ল/ঙ্কা/কা/ণ্ড বাঁধাবে। তাই আর তাকে ডাক দিলাম না। চুপচাপ ঘরে চলে গেলাম। রেদোয়ান নামায পড়তে গেছে। এদিকে আমার খিদে পেয়েছে প্রচুর। গতরাতেও খাই নি। সকালেও তেমন কিছু খাই নি। কাজ করে এখন খুব খারাপ লাগবে। কিছু না খেয়েই কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম। চোখ লেগে এলো। কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো। রেদোয়ান এসেছে। ও এসেই বললো, খেতে দাও।

কি খেতে দেবো?

রান্না হয় নি এখনো?

কি রান্না করবো? ঘরে রান্নার জন্য কিছু আছে নাকি?

নেই কিছু?

না।

রেদোয়ান কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পর আমার শাশুড়ির ঘুম ভাঙলো। আমি শাশুড়িকে বললাম, আম্মা ঘরে তো রান্না করার মতো কিছুই নেই।

নেই যখন এনে নাও। কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করো না
তো।

আমি চুপসে গেলাম। ঘরে এসে রেদোয়ানকে বললাম, তোমার কাছে টাকা নেই? কয় টাকা আছে?

চারশ সত্তর টাকা আছে। কি করবে?

চাল, ডাল, আর আলু নিয়ে আসো। খাবে কি?

তাহলে তো আমার কাছে আর টাকা থাকবে না। হাতে কিছু টাকা….

তুমি হাতে টাকা রাখবে আর আমি না খেয়ে ম/র/বো? যা আছে তা দিয়েই নিয়ে আসো। হাতে টাকা রাখা লাগবে না।

রেদোয়ান কিছু বললো না। বেরিয়ে গেলো। আমি ঘরের মধ্যে চুপটি করে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমার বড় ননদ রুশা এলো। তাকে দেখলাম হাতে করে টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি নিয়ে এসেছে। এসেই ডানে বামে না চেয়ে আমার শাশুড়ির ঘরে চলে গেলো। বুঝলাম শাশুড়ির জন্য কিছু নিয়ে এসেছে। আমি আর কিছু বললাম না। চুপটি করে আমার ঘরেই বসে থাকলাম।
আমি ঘর থেকে বের হলাম রেদোয়ানের আসার পর। ও আমার কথা মতো চাল ডাল নিয়ে এসেছে। চাল ডাল ধুয়ে চুলায় বসিয়ে ঘরে গেলাম। ভাত ফুটার ঘ্রাণ পেয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই দেখলাম শাশুড়ি রুশা আপার ব্যাগে পিঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদের বাটা থেকে পলিথিন ভরে হলুদ দিচ্ছেন। আমি হা করে তাকিয়ে শুধু দেখেই গেলাম। এবার বুঝলাম বাড়িতে এসে কেন চাল ডাল পাই নি। দেখেও না দেখার ভান ধরে ঘরে চলে এলাম।

রুশা আপার বড় মেয়েটার বয়স দশ বছর। ও আসার পর থেকেই ঘরে লাফালাফি শুরু করেছে। ও লাফাতে লাফাতে আমার ঘরে এলো। নূপুরের ঝংকারে ওর পায়ের দিকে তাকালাম। আমি আবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছালাম। কারণ ওর পায়েই আমার সেই নূপুর জোরা…!!

চলবে……..

#দিন_বদলের_হাওয়ায় [৭]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)

সন্ধ্যার দিকে রুশা আপা চলে গেলেন। নিশি আর নিহাল পুরো ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো করে ফেলেছে। আপা যাওয়ার পর আমি ঘর গুছিয়ে নিলাম। আমার শাশুড়ি আজকে আর তার ঘর থেকে বের হলেন না। আমিও আর সেদিকে এগোলাম না। তার প্রতি প্রচন্ড ক্ষো/ভ জন্মেছে মনে। এতো দিন আমার সাথে যাই করুক যাই বলুক আমি তাকে কিছুই বলি নি। মনে হতো সে আমাকে বলছে না বলছে তার নিজের ছেলেকে। তার ছেলের চাকরি নেই দেখেই তো এতো বলাবলি। আর সেটা তার তো কোন অপরাধ নয়। সে মা যা ইচ্ছে বলতে পারে। আমার তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু এবার তিনি তো মাত্রা অতিক্রম করলেন। আমার জিনিস নিয়ে দিলেন নিজের নাতনীকে! ভাবতেই অবাক লাগছে। এই শাশুড়ি কি আমার সেই শাশুড়ি যে কিনা আগে কথায় কথায় আয়রা আয়রা বলে মুখ ব্যথা করে ফেলতো। যে আমি কি করলাম, কি খেলাম তা মুহূর্তে মুহূর্তে জিজ্ঞেস করতো সে এখন আমার প্রতি বি/র/ক্ত। এখন আমাকে দেখলে তার মুখে বি/র/ক্তি/র ছায়া ব্যতীত মমতার স্পর্শ দেখা মুশকিল। যাই হোক মেনে নিয়েছি। কিন্তু বাড়াবাড়ি তো আর মানতে পারি না। আজ এক জিনিস নিয়েছে কাল আরেক জিনিস নিবে পরশু আরেক! এভাবে তাকে আমি প্রশ্রয় দিবো না। তবে এখন এসব বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করবো না কিছুই। বললেই সৃষ্টি হবে আরো নানান কথা।

আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। আপাতত অন্য কোন কাজ নেই। বাড়িতে কোন মানুষও নেই। জা রা থাকলে বসে থাকার সুযোগ হয়তো পেতাম না। একজনের এই কাজ করো তো আরেক জনের সেই কাজ। একজনের কাজ শেষ হওয়ার আগেই আরেকজনের তাড়া। তাছাড়া ছোট জা এর ছোট বোন তো বারো মাসই বলতে গেলে এখানে পড়ে থাকে। তার আছে যত ফরমায়েশ। সারাক্ষণই চলে তার ভুরিভোজ। রান্নাঘরেই পড়ে থাকা লাগে তখন। আগে কাজের লোক ছিলো। ওর চাকরি যাওয়ার পর তাকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। তারা আমাদের টেনে বাড়তি কাজের লোক টানতে পারবে না। যাক আমাদের টানতে পারবে এটাই অনেক। এসব মনে পড়লে হতাশ লাগে প্রচুর।

এসব ভাবনা বাদ দিয়ে আপাতত জামা কাপড় ভাজ করায় মন দিলাম। কাপড় ভাজ করতে গিয়ে দেখলাম রেদোয়ানের একটা শার্টের কলারের দিকের অনেকটা অংশই ছিঁড়ে গেছে। খারাপ লাগলো ভীষণ। এবার সুঁই সুতা নিয়ে বসে গেলাম সেটা সেলাই করতে। কিছুক্ষণ পর পাশের বাসার নতুন ভাবি এলেন। তারা এ বাসায় এসেছে গত মাসে। তার সাথে ততটা পরিচিত নই আমি। সে হঠাৎ আমাদের বাসায় কেন এলো ঠাওর করতে পারছি না। তবুও কথাবার্তা স্বাভাবিক ভাবেই বলছি। ওনার নাম স্বর্ণা। বেশ ভালো লাগলো তার সাথে কথা বলে। ভাবি বেশ মিশুক। তার সাথে অনেক কথা হলো সুখ দুঃখের। তিনিও আমার জন্য আফসোস করতে থাকলেন। আফসোস করলেই কি কিছু আর হবে? হঠাৎই ভাবি বললেন, ভাবি ভাইয়া কি টিউশনি করবে? আমার বান্ধবীর দুইটা ছেলে আছে। ওদের পড়ানোর জন্য ও টিচার খোঁজাখুঁজি করতেছে। আপনি যদি বলেন তবে আমি ভাইয়ার কথা ওকে বলতে পারি।

তার কথায় চমকে গেলাম অনেক। বললাম, ঠিক আছে। আপনার ভাইয়া বাড়ি আসুক আমি বলে দেখি। সকালেই আপনাকে জানাবো এই বিষয়ে।

ভীষণ ভালো লাগছে। যদি দুই একটা টিউশনি করে তবেও হাত খরচের পয়সাটা হবে। কিছুক্ষণ পরই আমার শাশুড়ি আমার ঘরে আসলেন। তিনি এসেই মুখটা কালো করে নিলেন। বললেন, সারাদিন গল্প করলেই কি হবে? বাড়িতে কি কোন কাজ নেই? সেই কখন থেকে দেখছি গল্প করেই যাচ্ছো। এতো কিসের কথা শুনি? কথার বেলায় তো ভালোই পাকা বুড়ি হয়েছো আর কাজের বেলায় তো ঠনঠন।

নানান কথা বলতে লাগলেন তিনি। আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম। এসবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। স্বর্ণা ভাবি চলে গেলো।

রাত দশটায় রেদোয়ান বাসায় আসলো। তার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে মন ভীষণ খারাপ। আসার পর থেকে মনমরা হয়ে আছে। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?

ও কিছু বললো না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কথা বলছো না কেন? তোমার মন খারাপ কেন?

কি বলবো? ভালো লাগছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও তো।

রেদোয়ান কিছুটা ধ/ম/কে/ই কথাটা বললো। অবাক হলাম। ও আমার সাথে এভাবে কথা বলে না সচরাচর। তাই বললাম, তুমি এভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে? কি হয়েছে তোমার?

রেদোয়ান বি/র/ক্তি নিয়ে বললো, কি হওয়ার বাকি রেখেছো তুমি বলো? তোমাদের ওখানে চাকরিটা করলে কি এমন ক্ষ/তি হয়ে যেতো? নিজের পয়সায় দু মুঠো খেতে পারতাম তো। আমি আমার অ/ভি/শা/প/টা থেকে তো মুক্তি হতাম। কিন্তু দিলে না তো! তোমার আবার লোকের কথার ভ/য়। যেই লোকের কথার ভ/য়ে চাকরি করতে দিলে না তারা কি তোমায় দেখছে? তুমি তো আমায় খুব বলো ভাইদের বিদেশ পাঠিয়েছি নিজের অর্থ ব্যয় করে। তারা আমায় দেখছে না। তুমিও তো লোকের কথায় আমাকে চাকরি করতে দিলে না। তারা তোমায় দেখছে? তুমি জানো আমার অবস্থাটা? আজ এক পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা হলো। দুজনে একসাথে বসে দু কাপ চা খেলাম। তার ইমার্জেন্সি কল আসায় সে চলে গেলো। আমি চায়ের বিলটা মিটাতে পারি নি। জানো এটা আমার জন্য কতটা লজ্জাজনক ছিলো? এরপরও বলবে কিছু হওয়ার বাকি রেখেছো তুমি?

আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বলতে পারলাম না। আমার প্রতি তার যত অভিযোগ আছে করুক সে। মিথ্যে অভিযোগ তো আর করে নি। সত্যি কথা বলেছে। রেদোয়ান কথা বলা শেষ করে আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো। আমি কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর ভাত বাড়তে গেলাম। কিন্তু রেদোয়ান আর রাতে খেলো না। আমিও খেলাম না। শাশুড়িকে খাবার দিয়ে সব গুছিয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছে না। বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভালো লাগছে না কিছু। জোছনা রাত। সবসময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশটা কিছুটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে এখন। এই আকাশের আবছায়া উজ্জ্বলতার মতো কি আমার জীবনে একটু উজ্জ্বলতা আসতে পারে না? একটু কি পরিবর্তন হতে পারে না আমার চলার পথ? দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছুক্ষণ সেখানেই অতিবাহিত হলো। আমার ধ্যান ভাঙলো রেদোয়ানের ডাকে।

আয়ু ঘুমাবে না?

পাশ ফিরে তাকালাম। কিন্তু সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। নিজেকে কেমন জানি অপরাধী লাগছে। মাথা নিচু করে বললাম, ঘুম আসছে না।

কেন?

জানি না।

আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছো তাই না?

কষ্ট পাবো কেন? ঠিকই তো বলেছো তুমি। মিথ্যে তো আর বলো নি।

মন খারাপ করো না। আজকে এক বন্ধুর সাথে চাকরির বিষয় নিয়ে কথা হলো। ও কাল জানাবে বলেছে।

ওর কথা শুনে আমার স্বর্ণা ভাবির কথা মনে হলো। আমি ফট করে বললাম, পাশের বাসার নতুন ভাড়াটিয়া আছে না ওইযে স্বর্ণা ভাবি। তার স্বামীর নাম আমি জানি না।

হুম চিনেছি বলো।

তিনি আজকে বাসায় এসেছিলেন। অনেকক্ষণ কথা বলেছি তার সাথে। তার বান্ধবীর ছেলেদের পড়ানোর জন্য নাকি তার বান্ধবী টিচার খোঁজাখুঁজি করছে। তুমি পড়াবে কিনা তাই জিজ্ঞেস করে গেলেন তিনি।

বেশ তো। পড়তে চাইলে পড়াবো না কেন? আমার অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যেই কাজ পাবো সেই কাজ করতেই আমি রাজি আছি। যদি কেউ এখন রিক্সা চালাতেও বলে তবে তাই করবো আমি। আমার আর এই অ/ভি/শ/প্ত জীবন ভালো লাগছে না আয়ু! ক্লান্ত আমি!

ভীষণ কষ্ট হলো। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সেই চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে হাজারো কষ্ট, হাজারো হতাশা। কিছু বলতে পারলাম না আমি। রেদোয়ান নিজেই আবার বললো, চলো ঘুমাতে চলো। অনেক রাত হয়েছে। আর জাগতে হবে না।

দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

আজ সকাল সকালই আমার ছোট জা চলে এসেছে। শান্তি আসাতে আমার শাশুড়ি বোধহয় বেশ চমকে গেছেন। কথা ছিলো শান্তি এক সপ্তাহ পর আসবে। কিন্তু দুদিনের মাথায়ই চলে এসেছে। শাশুড়ির ভয় পাওয়ার কারণ তো আমি জানি। তবুও চুপ আছি। সকাল থেকে এখনো চুলায় আগুন ধরে নি। চুলায় আগুন ধরালেই বা রাঁধবো কি? আমি চুপচাপ ঘরে বসে আছি। কিছুক্ষণ পরই শান্তি আমার কাছে এসে বললো, ভাবি এখনো রান্না বসাচ্ছো না যে? খাবো কি? তুমি কি পেনশনি পেয়ে গেছো?

আমি অবাক হলাম। বললাম, রাঁধবো কি? ঘরে কিছু থাকলে না রাঁধবো!

কি বলছো? থাকলে রাঁধবে মানে?

বলছি ঘরে তো চাল, ডাল, মাছ টাছ কিছুই নেই। তবে রাঁধবোটা কি?

শান্তি আশ্চর্য হলো। ওর চেহারা দেখেই বুঝেছি। বললো, কি বলছো তুমি? দুইদিনে এতো বাজার শেষ? ঘরে কিছুই নেই?

আমি সহজ ভাবেই বললাম, না নেই। যেয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করো কিছু আছে কিনা।

শান্তি শাশুড়ির কাছে গেলো। আমিও পেছন পেছন গেলাম। শান্তি শাশুড়ির কাছে গিয়েই বললো, আম্মা ঘরে নাকি চাল, ডাল কিছুই নেই? আপনাকে একা থাকার জন্য না বাজার করে দিয়ে গেলাম কোথায় সেগুলো? দুদিনে আপনি এতো বাজার একা কি করে শেষ করলেন?

শাশুড়ি আমতা আমতা করে বললো, শেষ হয়ে গেছে আমি কি করমু কও বউ মা। রেদোয়ান আসলো ওর বউ আসলো। এতো গুলো মানুষের খাওয়া দাওয়া। এখনো কি বাজার থাকে?

ভীষণ আশ্চর্য হলাম। কি সুন্দর করে মিথ্যে বলে আমাদের ঘাড়ে সব চাপিয়ে দিচ্ছেন উনি! এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। শাশুড়ির কাছে গিয়ে বললাম, মিথ্যে কথা বলতেছেন কেন আম্মা? আমরা তো কাল দুপুরে বাড়ি আসলাম। আর বাড়ি এসে তো কিছুই পাই নি। রেদোয়ানই তো কাল চাল, ডাল আর আলু আনলো। তাহলে আমরা বাজার শেষ করলাম কি করে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here