দু’মুঠো প্রেম,৬,৭
ফারজানা আফরোজ
৬
সকালের মিষ্টি বাতাস এসে পড়ল ফয়সালের গায়ে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো পাঁচটা চল্লিশের বেশী বাজতে চলেছে। হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিল বাহিরের দিকে। রাতে বৃষ্টি হওয়াতে এখনও বেশ থমথমে আছে পরিবেশ। সারারাত জেগে আদিবার ধ্যানে মগ্ন ছিল সে। কিভাবে যে রাত পেরিয়ে সকালের আলো ফুটতে চলেছে সে দিকে কোনো খেয়াল ছিল না তার। এই প্রথম সারারাত ধরে সে সাতটা সিগারেট শেষ করেছে যেখানে দুই ঘণ্টায় এক প্যাকেট শেষ করে সে। মনে মনে শান্তি শান্তি ভাব নিয়ে জানালা অফ করে দিয়ে ওয়াশ রুমের দিকে হাঁটা দিল। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরেই নিজের রুম থেকে বের হয়ে গেলো। তার উদ্দেশ্য এখন আদিবার বাসায় যাওয়া। কলেজ থেকে সব ইনফরমেশন নিয়েছে সে। বাইক চালিয়ে এসে দাঁড়ালো আদিবার বাসার সামনে।
ফজরের নামাজ আদায় করে সকালের শান্তিময় ছোঁয়া গায়ে মাখার জন্য ছাদে দাঁড়িয়েছিল আদিবা। ছাদের এক কোণে পানি জমে থাকায় তার দুষ্টু মন নাচতে শুরু করলো, ফিসফিস করে বলল,
– আদু দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা বৃষ্টির পানিতে নেমে পড়। রাতে বৃষ্টি বিলাস করিসনি তো কি হয়েছে বৃষ্টির পানি তো তোর পায়ের নিচে ঠিকই আছে। লাফালাফি করতে তো বারণ নেই।
আদিবা পানির নিচে দাঁড়িয়ে লাফাতে লাগলো। তার শরীর অর্ধেক ভিজে একাকার হয়ে গেছে। দূর থেকে আদিবার দুষ্টুমি দেখে হাসছে ফয়সাল। তার বড্ড ইচ্ছা করছে আদিবাকে ছুঁয়ে দিতে। গোলাপের মত ঠোঁট দুটি একবার স্পর্শ করতে। হঠাৎ একজন মাঝ বয়সী লোক এসে দাঁড়ালো ফয়সালের সামনে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি ফয়সালকে দেখে ভীষণ বিরক্ত।
– কি চাই?
– তেমন কিছু না আংকেল।
ধমকের সুরে বলল লোকটি,
– তাহলে আমার বাসার সামনে এসে আমার মেয়ের দিকে কু-নজরে তাকাচ্ছ কেন? রাজনীতি করো বলে আমার বাসায় এসে আমার মেয়েকে বিরক্ত করবে আর আমি চোখ বুজে সেসব সহ্য করবো ভাবলে কিভাবে?
ফয়সালের বুঝতে বাকি নেই লোকটি কে। আদিবার বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
– এইজন্যই তো বলি দুই বোন এত সুন্দর, কিউট হওয়া সত্বেও ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথা কেন বলে। সব সময় ঠোঁটের কোণায় ঝগড়া লাগার জন্য স্পেশাল কথাবার্তা ঠোঁটে লেগেই বা কেন থাকে? আজ বুঝলাম যাদের বাবা এমন তারা কি করে আর ভালো হবে। শশুর মশাইকে দেখেই বুঝে যাচ্ছে মেয়েগুলোর আচার আচরণ উনার মত তবে দেখতে মনে হয় শাশুড়ি মায়ের মত হয়েছে। আমার শাশুড়ি মা মে বি অনেক সুন্দর।
ফয়সালের বিড়বিড় বুঝতে না পেরে আবারো জোরে ধমক দিয়ে বলল আদিবার বাবা,
– কি হলো কথা বলছো না কেন? বিড়বিড় করে কি বলছো? এক্ষুনি আমার বাসার সামনে থেকে চলে যাও তা-নাহলে তোমার খবর আছে।
রাগে গজগজ করতে করতে বাসায় চলে গেলেন আদিবার বাবা। শশুর মশাইয়ের যাবার পানে তাকিয়ে থেকে শব্দ করেই বলল ফয়সাল,
– জন্মের সময় আমার দাদী শাশুড়ি উনার মুখে মধু দেননি এই কারণেই এমন রগচটা হয়েছেন সাথে করে আমার ভবিষ্যত্ বউ আর শালীকেও বানিয়েছেন। আমার সুন্দরী শাশুড়ি মা কোন দুঃখে যে এই লোকটাকে বিয়ে করলো কে জানে? অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমার কি ভালো একটা শশুর হতো। দুঃখে ইচ্ছা করছে মেয়াদ উত্তীর্ণ বিষ খেয়ে হয় নিজে মরি নয় উনাকে মারি।
বাইক স্টার্ট করে একবার ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ফ্লাই কিস দিয়ে চলে গেলো ফয়সাল। আদিবা এইসবের কিছুই জানে না সে তার মতো লাফালাফি করতে ব্যাস্ত।
আদিবার বাবা বাসায় এসেই ঝগড়া করতে শুরু করে দিলেন উনার স্ত্রীর সাথে।
– বাসার নিচে আজকাল রাজাকারের বাচ্চারা ঘুরাঘুরি শুরু করে দিয়েছে। কবে না জানি আমার বাসায় আঘাত হানে। আজকের পর থেকে আমার মেয়ে দুটোকে বলবে তারা যেন ছাদে উঠে নাচানাচি না করে। তুমি যেমন আগে লাফালাফি করে আমার মনকে নাচিয়েছ এখন তোমার মেয়েও লাফালাফি করে রাজাকারের বাচ্চাদের নাচাচ্ছে। সকাল হতে না হতেই বাসায় এসে বদ নজর দেওয়া শুরু করেছে।
– বুড়ো বয়সে বিমরতি হলে যা হয় আর কি। ওই ক্ষুধা লাগছে তোমার? পেটে বেশি টান পড়লেই বাজে বকো তুমি। কেন যে তোমার মত পেটুক বদমেজাজি লোকের সাথে প্রেম করেছিলাম। এখন দেখি ছেলে মেয়ে প্রেম করলে কত জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়, শপিং করায়, গিফট দেয় আর তুমি কি দিয়েছো আমায়? ঘুরাঘুরির কথা উঠলেই বলো , তোমার বাবার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে এনেছি ঘুরাঘুরি হয়নি তোমার? যাও তাহলে বাবার বাড়ি ঘুড়ে আসো। শপিংয়ের কথা বললে বলো, শপিং করে করে তো আমাকে ফকির বানিয়ে ফেলছ। গিফটের কথা বললে বলো, দুইটা বাচ্চা গিফট করেনি? আরো চাও। এই তোমার মত আনরোমান্টিক লোকের সাথে প্রেম করে আমার জীবন তেজপাতা বানিয়ে ফেলছি।
শুরু হয়ে গেলো আদিবার মার ঘ্যানঘ্যান। সোফায় বসে চুপচাপ স্ত্রীর বকবক শুনছেন আর খবরের কাগজ পড়ছেন। মনে মনে বড্ড আফসোস করছেন কেন এই মহিলার প্রেমে পড়লেন আর কেনই বা আজকে কথা বলতে এলেন। এক সপ্তাহ ধরে এখন শুনতে হবে স্ত্রীর চেঁচামেচি। বাঘ হতে এসে বিড়াল হয়ে পড়লেন এখন।
______________________
দুই বান্ধবী হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল কলেজের উদ্দেশ্য। পার্কের কাছে আসতেই বাইকে হেলান দিয়ে আধশোয়া ফয়সালকে দেখে অরিনের হাত চেপে ধরলো আদিবা। এই লোকটাকে দেখলেই তার ভয় হয়, ঘৃনা হয়, রাগ হয়। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই ফয়সাল আদিবার হাত চেপে ধরলো। আদিবার পুরো শরীর এইবার কাঁপতে লাগলো। তোতলিয়ে বলতে লাগলো,
– হা হাত ধ ধরেছেন কেন?
– কিছু কথা বলব।
– অপমান করবেন আবারো?
– একটু সাইডে চলো কিছু কথা আছে।
আদিবা পার্কের চারপাশটা দেখে শিউরে উঠলো। এমন পরিবেশে কোনো ছেলের সাথে পার্কে জায়গা মানেই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। সাহস জুগিয়ে বলে ফেলল,
– যাবো না কোথাও? যা বলার এইখানেই বলেন।
– প্রেমময় মুডে আছি। দয়া করে রাজনীতিবিদ ফয়সালের মুড ধারণ করতে বলো না। চুপচাপ চলো জাস্ট কিছু কথা বলব ।
আদিবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ফয়সাল। পিছন পিছন অরিন আসতে নিলেই ফয়সাল বলে উঠলো,
– তোমাকে কেউ আসতে বলেছে? দেখতেই পাচ্ছো আমরা রোমান্স করতে যাচ্ছি কাবাব মে হাড্ডি হতে এসো না।
অরিন দাঁড়িয়ে পড়লো। এত্ত বড় অপমান কিছুতেই সে মানতে পারছে না। কিন্তু ফয়সালকে কিছু বলার সাহস তার নেই সেইজন্য চুপচাপ পার্কের এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলো।
গাছের আড়ালে দাঁড়ালো ফয়সাল ও আদিবা। ফয়সালের দৃষ্টি আদিবার গালের সেই তিলের উপর।
– কি বলবেন?
– সরি।
আদিবা যেন আকাশ থেকে টপকে মাটিতে পড়ল মনে হয়। ফয়সাল তাকে সরি বলছে তার যেন বিশ্বাসেই হচ্ছে না। আবারো নিজের কাননে বিশ্বাস করানোর জন্য বলল,
– কি বললেন?
– সরি। সেদিন তোমাকে ঐভাবে না বললেই হতো।
– অপমান করেছেন একশো লোকের সামনে আর সরি বলছেন চুপিচুপি। করবো না ক্ষমা আপনাকে।
– সমস্যা নেই। বাই দা ওয়ে তোমার গালের তিলটা কি আসল নাকি আসল?
– যত্তসব। তিল নকল হতে যাবে কেন? চোখে কি দেখেন না এখন। দেখবেন বা কি করে বয়স তো আর কম হয়নি। বিয়ে করলে দশ বাচ্চার বাপ হয়ে যেতেন এতদিন।
– তুমি বললে দশটা কেন একশো বাচ্চার বাপ হতে পারবো। সামলাতে পারবে এতগুলো বাচ্চা?
– ছিঃ অসভ্য লোক। লজ্জা করে না, নিজেই ছেলেদের বলুন মেয়েদের বিরক্ত না করতে এখন নিজেই করছেন। আপনার আসল মুখোশ বলে দিবো সবাইকে।
– বলে দেও সমস্যা নেই। কেউ ট্রাস্ট করবে না তোমার কথা।
– অসভ্য লোক। কোন দুঃখে যে আপনার সাথে দেখা হলো আমার……
আদিবার কথা শেষ হতে না হতেই ফয়সাল এমন একটি কাজ করে বসলো যার জন্য আদিবা পুরো কথা আর বলতে পারলো না। হঠাৎ করেই ফয়সাল আদিবার সেই তিল ওয়ালা গালে কিস করে বসলো। চোখ থেকে দু এক ফোঁটা করে পানি গাল বেয়ে পড়লো আদিবার। বিয়ের আগে এমন কিছু হোক সে আশা করেনি। জড়িয়ে ধরা, হাতে টাচ্ করা, মাঝে মধ্যে দু একটা কিস এইসবের কারণে জীবনে প্রেম করেনি। ফ্রেন্ডের কাছে শুনেছিল প্রেম হলেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে এমন ঘনিষ্ট হতে হয় সেই কারণে প্রেম নামক শব্দ থেকে হাজার হাত দূরে থাকতো সে। আর এখন,,,, ভাবতেই ওর দু চোখ পানিতে ভরপুর হয়ে উঠলো……
চলবে,
দু’মুঠো প্রেম
ফারজানা আফরোজ
৭
কাল বৈশাখী ঝড়ের গতিতে দৌঁড়ে পালালো আদিবা। চোখে তার সাগর পানি। ফয়সালের প্রতি রয়েছে তার বিরাট অভিযোগ, এক আকাশ রাগ। সেদিন আর সে ভার্সিটি যেতে পারেনি। কিস করার দৃশ্যটা বারবার চোখে ভাসছে তার।
সূর্য এখন মাথার উপরে বসে আছে। আজকের গরম পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাথা থেকে ঘাম পায়ে গড়িয়ে পড়ছে আদিবার বাবার। দরকারি একটা কাজে ব্যাংকে যেতে হচ্ছে তাকে। রিক্সার হুড তোলে দিয়ে গরমে আশপাশ করছেন উনি। গত রাতের বৃষ্টির পর ভেবেছিল আজকের দিনটা ঠান্ডাময় হবে কিন্তু নাহ আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের থেকে আরো মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
– মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি ভীষণ বিরক্ত। বিরক্ত হবেন না কেন? উনি আমাদের পাঠিয়েছেন দুনিয়াতে উনার ইবাদত করার জন্য আর আমরা করছি কিনা চব্বিশ ঘণ্টায় টাকার পিছনে ছুটছি। সারাদিনে এক ঘন্টা সময়ও উনার জন্য ব্যয় করতে পারছি না। আমাদের দোষের কারণেই আজ আমাদের এই অবস্থা।
– স্যার আইয়া পড়ছি।
রিক্সা চালকের কণ্ঠস্বর শোনে চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে এসে লোকটির মুখের দিকে তাকালেন আদিবার বাবা মিষ্টার নিজাম উদ্দীন। লোকটির বয়স আনুমানিক ষাট কি তার উপরে হবে। সাদা সাদা দাড়িগুলো রোদের আলোতে কালচে রঙ ধারণ করেছে। মাথায় ভিজা গামছা বেঁধে রেখেছে। সেন্টু গেঞ্জী, ময়লা লুঙ্গি গায়ে। মিষ্টার নিজাম উদ্দীন লোকটির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এক হাজার টাকার নোট দিলো লোকটিকে। লোকটি তখন মুখটা কালো করে বলল,
– স্যার আমার কাছে ভাঙতি নাই এত টেহার। সত্তর টেহা ভাড়া আপনে হাজার টেহা দিতাছেন কেমনে ভাঙতি দিমু কইন। আইজকাল গাড়িঘোড়া যেই হাড়ে ঢাকা শহরে আইতাছি রিক্সায় তো মানুষজন যাই না এখন। সারাদিনে তো পাঁচশো টেহা কামাইতে পারি না এহন হাজার টাহার ভাঙতি কেমনে দিমু স্যার। দেহেন আপনের কাছে ভাঙতি আছে নাকি?
মিষ্টার নিজাম উদ্দীন মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে লোকটির কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– চাচা আমাকে ভাঙতি দিতে হবে না। এই এক হাজার টাকা রেখে দিন। আজ যে গরম পড়ছে এই বয়সে আপনার শরীর সইতে পারবে না তারচে বরং আজকের দিনটা বিশ্রাম করুন।
– বাবা। আমাগো গরিবদের বিশ্রাম কইতে কোনো শব্দ নাই। তাছাড়া গরিবদের অসুখ হয় না। অসুখ নিজেই ডরায় কারণ অসুখ জানে, গরিবদের অসুখ হইলে ডাক্টার দেখানোর টেহা নাই। এই অসুখ বিসুক নিয়াই গরিবরা কাজ করবে নয়তো মরবে তবুও ডাক্টার দেখাইতে যাইবার সাহস করবে না। অসুখ হইলো বড়লোকের আমাগো মতো গরিবদের কের অসুখ আবার।
মিষ্টার নিজাম উদ্দীন লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার কানে বার বার একটা কথা ভেসে আসছে, অসুখ হইলো বড়লোকের আমাগো মতো গরিবদের কের অসুখ আবার। শ্বাস ছেড়ে দিয়ে মিষ্টার নিজাম উদ্দীন বললেন,
– চাচা টাকাটা নেন। মনে করবেন আপনার কোনো সন্তান আজ দিয়েছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে চাচা আসি।
মিষ্টার নিজাম উদ্দীন চলে গেলেন। বয়স্ক লোকটি টাকাটা হাতে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। আজ বাবা হারা নাতনীর জন্য কিছু ফল, ভালো খাবার, নতুন পোশাক কিনে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেছেন।
আদিবা বাসায় এসে মন খারাপ করে বসে আছে। আজকের ঘটনা কিছুতেই সে ভুলতে পারছে না। পড়ন্ত বিকেলের রোদ মুখের কাছে আসতেই বাহিরের দিকে তাকালো সে। বকুল গাছে কয়েকটি পাখি বসেছে যার অনেকেরই নাম তার অজানা। হঠাৎ করেই পিচ্চি একটি হাত তাকে স্পর্শ করতেই পিছন ফিরে আদুরীকে দেখে ভীষণ অবাক হলো। কারণ, আদুরী মুখে ফেস ওয়াশ লাগিয়ে ঘষছে। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল আদিবা,
– এই অসময়ে মুখে ফেস ওয়াশ লাগাচ্ছিস? ব্যাপার কি?
– আর বলো না আপু। চিপসের প্যাকেট কিনতে হান্নান আংকেলের দোকানে গিয়েছিলাম পাজি আংকেল পান খেয়ে ঠোঁট মুখ লাল করে ফেলেছে। আমাকে দেখেই বলতে শুরু করলো, আরেহ আমার আদুরী মামুনি এসেছে, বলেই পাপ্পি দিতে লাগলো গালে। উনাকে তো কিছু বলতে পারি না তাই চিপস এনেই মুখ ক্লিন করতে লাগলাম। আমাকে কেউ পাপ্পি দিলেই আমি এই কাজ করি।
আদুরীর কথাটা আদিবার মাথায় ঢুকে গেলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলল,
– এতে কাজ হয়? পাপ্পির স্পর্শ কি চলে যায়?
– অবশ্যই আপু। তখন মুখটা আরো সুন্দর হয়।
আদিবা দৌঁড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল অনেকটা ফেস ওয়াশ হাতে মেখে গাল ঘষতে লাগলো। প্রায় পনেরো মিনিট পর আদিবা আদুরীর দিকে তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বলল,
– ওই আমার গাল জ্বলছে। তোর কথা শোনে মুখটা নষ্ট করে ফেলছি আমি।
আদুরী দুই হাত কপালে রেখে বলল,
– তোমাকে কি বলছি জোরে জোরে ঘষতে। আস্তে আস্তে ঘষলে কি গাল লাল হতো? কিছু তো বুঝ না। আমি তোমার হেল্প করলাম আর তুমি উল্টো ধন্যবাদ না জানিয়ে বকছো। যাও আজকের পর থেকে আর কোনো হেল্প করবো না।
আদুরী দৌঁড়ে চলে গেলো। আদিবা আয়নার কাছে আসতেই দেখলো তার ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। মনে মনে ফয়সালের গুষ্টি উদ্ধার করে ভেসলিন লাগিয়ে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করতে লাগলো।
সিগারেট ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে আরিফের মুখে ধোঁয়া উড়াচ্ছে ফয়সাল। চোখ দিয়ে যেন আগুন জ্বলছে তার। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বলল আরিফ,
– দোস্ত কি হয়েছে তোর? এমন রেগে আছিস কেন?
– আজ তোর কথা মত রোমান্টিক হতে গিয়ে আদিবার চোখে ঘৃনার পাত্র হয়ে গেছি আমি।
– কেন কি করলি তুই আবার?
– আদিবাকে কিস করেছি।
আরিফ কপাল চাপড়িয়ে কটমট চোখে তাকালো ফয়সালের দিলে। শক্ত গলায় বলে উঠলো,
– শালা, রোমান্টিক মানে কি কিস দেওয়া নাকি? রোমান্টিক মানে হলো, একটু লাজুক লাজুক হাসি, বিয়ের পর ঘুরতে যাবার কথা বলা, কি কি খেতে ভালোবাসে, মেয়েটির সাথে ফ্রেন্ডলী হবার চেষ্টা করা, বাইকে উঠিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করা, হাত ভর্তি শপিং কিনে দেওয়া, বাদাম,চটপটি, ফুচকা, আইস্ক্রিম একত্রে বসে খাওয়া। ধীরে ধীরে পরে সামনে তো এগুতে পারতি তুই। যেখানে যতবার মেয়েটির সাথে কথা হয়েছে ততবারই তো ফয়সাল ভাই হয়ে সামনে গেছিস আর এইবার লুচু ফয়সাল হয়ে। রাজনীতি করতে করতে কি তোর মাথার বুদ্ধি শুদ্ধি জলে ভাসিয়ে দিয়েছিস নাকি?
ফয়সাল নিজের মাথা চুলকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
– আসলে ওর গালের তিলটা দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। বল না দোস্ত এখন কি করব আমি?
– কি করবি মানে? এখন ভাবীর রাগ ভাঙাবি। কিভাবে রাগ কমানো যায় তার প্ল্যান দিচ্ছি শোন তুই।
আরিফ ফয়সালকে রাগ কমানোর প্ল্যান দিচ্ছে। ফয়সাল নিজেই এখন অভাব। সারাদিন রাজনীতি নিয়ে থাকতে থাকতে তার মন কঠিন পাথরের ন্যায় ধারণ করেছিল। এখন সেই পাথরের মন কিভাবে একটা মেয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ল। মনে মনে এতদিন যাদের প্রেম করার জন্য শাস্তি দিয়েছিল তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া শুরু করেছে।
রাত আটটা কি নয়টা। অরিনের আম্মু ওষুধ খেতে এসে দেখলো বক্সে কোনো ওষুধ নেই। প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে অরিনের উদ্দেশ্য চিৎকার করে বলে উঠলো,
– অরি, তুই আজ ওষুধ কিনে আনিস নাই?
জিভে কামড় দিয়ে বলে উঠলো অরিন,
– সরি মাম্মী একদম মনে ছিল না। দেও আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
– এত রাতে তোর যেতে হবে না। আমি নিজেই কিনে আনছি। ডক্টর বলেছিল এই ওষুধটা প্রতিদিন খাওয়ার জন্য, ছেড়ে ছেড়ে খেলে সমস্যা হবে নয়তো আগামীকালই নিয়ে আসতাম।
অরিন তার মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– তোমার শরীর একটুও ভালো নেই। বাসার নিচেই তো দোকান দেও নিয়ে আসছি। বিশ মিনিটে যাবো আর আসবো।
মায়ের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাঁটা দিল ফার্মেসির উদ্দেশ্য। সকালে আদিবাকে নিয়ে যেয়ে ফয়সাল কি করলো তারপর আদিবা দৌঁড়ে বাসায় চলে গেলো এইসব চিন্তা করতে করতে সেও ভুলে গিয়েছিল মায়ের ওষুধের কথা। বাসার নিচে এসে দেখলো দুইটা দোকানই বন্ধ। সামনে আরেকটি দোকান আছে সেইজন্য হেঁটেই যেতে লাগলো সে। দশ মিনিট হাঁটার পর দোকানের সামনে এসে ওষুধ কিনে যেই বাসায় ফিরতে যাবে একটি ছেলে এসে দাঁড়ালো তার সামনে। শিস বাজিয়ে বলল,
– সিঙ্গেল নাকি? বয়ফ্রেন্ড আছে?
বিরক্ত প্রকাশ করে বলল অরিন,
– যেহেতু আমি সুন্দরী, বয়সও কম নয় তাহলে ভাবলেন কিভাবে আমি সিঙ্গেল থাকবো? অবশ্যই রিলেশনশিপে আছি জানা উচিৎ ছিল আপনার।
– ওয়াও। ইউ আর সো হট অ্যান্ড বিউটিফুল। তাছাড়া বুদ্ধি আছে ভালো। তোমার মতই তো কাউকে চাই আমার। আচ্ছা বলো কোথায় ঘুরতে যাবে বিয়ের পর সাজেক নাকি ঠিকানাতে?
– আশর্য! আপনার মত নির্লজ্জ প্রাণী দুনিয়াতে আমি আর একটাও দেখিনি। মাম্মীর ওষুধ নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে নইলে এক্ষুনি মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলতাম। উগান্ডার অকেজো বাসিন্দা একটা।
রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো অরিন। ছেলেটি অরিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
– তোমার মত কত মেয়েকে যে আমার পিছনে ঘুরিয়েছি তোমাকে ঘুরাতে আমার বাম হাতের খেল। খুব শীগ্রই দেখা হবে আমাদের ঝাঁসির রাণী।
চলবে,