দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১২,১৩,১৪

0
663

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১২,১৩,১৪
শানজানা আলম
১২

খোদেজা বেগম শেষ রাতের দিকে একটু সুস্থ হলেন, মনি আর বিলকিস জেগে রইল সারারাত।

সকালের দিকে একটু তন্দ্র্রা লেগে এসেছিল, মনি টের পায়নি, জাহেদ এসে বসেছে দাদীর পাশে। দাদী অসুস্থ বলে রাতরাতি রওনা দিয়েছিল, বাড়িতে জানায়নি। বিছানার পায়ের দিকে শুয়ে পড়েছিল মনি। বিলকিস রান্নাঘরের চৌকিতে ফজরের আজানের পরে গা এলিয়ে দিয়েছে।

ও মনি মনি, ওঠ, দেখ, আমার দাদোয় আইছে, ধরফর করে উঠে বসল মনি।

তুমি এখন কেমন আছ দাদী? -দাদীর হাত ধরে জাহেদ জানতে চায়।

তুমি আইছ, এহন আমি সুস্থ। তোমার বিয়া দিমু, মনির লগে।

জাহেদ অস্বস্তি ঢাকার জন্য কাশল। মনি উঠে নামতে গেল, খোদেজা বেগম তাকে ঝাড়ি দিয়ে বসালেন। মনির গা হাতপা কাঁপছে।

ও বউ এদিকে আসো৷ কাজী ডাকো, আইজই বিয়া হইবে।

জাহেদ বলল, দাদী, বিয়ার সময় আছে পরে, এখন আগে সুস্থ হয়ে নেন। খোদেজা বেগম টেনে মনির হাতটা জাহেদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। মনি কেঁপে উঠল।। জাহেদ হু হা করে কতক্ষণ বসে ভেতরে চলে গেল।

মনি চুপচাপ বসে রইল। কি করবে, কী ই বা করার আছে।

কিছুক্ষণ পরে চাপা আওয়াজ শুনতে পেল, আম্মা এইটা হয় না। ওদের সাথে ক্লাশ মিলে?

মনি শক্ত হয়ে গেল, জাহেদের গলা। কাদের সাথে মেলার কথা হচ্ছে।

রেনুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শোন, দাদীরে বল রাজী, তোর বিয়া করা লাগবে না। আমি তোর আব্বা কেউ রাজী না।

এইটা কেমন কথা আম্মা? সে আজ বাদে কাল মারা যাবে, তারে মিথ্যা বলব?

মিথ্যা না বললে সে ঝামেলা পাকাবে। কষ্ট নিয়া মরবে।

এইটা সম্ভব না। এইভাবে কী বিয়ে হয়, সে তো সেন্সে নাই।

বিয়া সত্যি তো না, এমনি বলবি। এইটুকই!

জাহেদ নিজের ঘরে দরজা আটকে দিলো। মনি বিলকিসকে ডেকে বাড়ি চলে গেল। এখানে আর থাকা চলে না৷

সত্যিই তো, জাহেদের ক্লাশ আলাদা, তার সাথে কোনো দিক দিয়েই মিলে না৷ তার হয়তো ঢাকায় কেউ পছন্দ আছে। কোথায় মনি আর কোথায় জাহেদ, পাশাপাশি থাকলেই কী সব সময় দূরত্ব ঘোচে! ঘোচে না। যত মিষ্টি করেই কথা বলুক, তাদের দয়া ছাড়া কিছুই করে না জাহেদরা। মনি ঠিক করল, আর ওই বাড়িতে যাবে না। দাদী অসুস্থ বলেই যাওয়া হলো, নয়তো কতদিনই তো যায় নি! জাহেদকে নিয়ে ভাবে নি! কিন্তু জাহেদ ভাই আব্বা যেদিন বিয়ে করে আসলেন, ওইদিন কি মিষ্টি করে কথা বলেছিল! মনির অর্ধেক কষ্ট কমে গিয়েছিল৷ সেটাও মন থেকে বলে নি হয়তো!

শানজানা আলম

চলবে

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১৩
মনি এসে বাড়িতে ঢুকল, সাবিনা উঠে ভাত চড়িয়েছে। আব্বা খেয়ে দোকানে যাবে। মুক্তা ওঠেনি এখনো।
সাবিনা ভাববাচ্যে জিজ্ঞেস করল, কলেজ আছে?

মনি উত্তর দিলো, যাবো না। শরীরটা টানতেছে না। ঘুমাই নাই।

-একটা ডুব দিয়া আসলে মাথা ঠান্ডা হইত!

মনি কথার উত্তর না দিয়ে ঘরে গিয়ে বসল। জাহেদ ভাই কীভাবে কথাটা বলল, ক্লাশ মিলে না। তাদের টাকা পয়সা নেই বলেই তারা ছোটো জাতের! জাত কীভাবে মাপে মানুষ? আজকে এমন যদি হয়, মনির কোনো ভাবে অনেক টাকা পয়সা হয়ে গেল, তখন কী জাহেদ বলবে, ক্লাশ মিলে না!

মনি চেষ্টা করছে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে, কিন্তু মাথা থেকে একদমই সরছে না৷

একটু তন্দ্রা লেগে আসছিল, তখনি ওই বাড়িতে হইচই শোনা গেল। মনি উঠে বসে ভাবল যাবে না। পরক্ষণেই মনে করল, কেন যাবে না, দাদী তো তাকে ভালোবাসে। আর বিয়ের কথা দাদী বলছে, তার তো হুশ জ্ঞান নেই, থাকলে হয়তো বলতো না।

মনি তাই উঠে গেল আবার। সাবিনা বলেছিল, আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে যেতে কিন্তু মনি বলল, আগে দেখে আসি কি হলো।

খোদেজা বেগম উঠতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে গেছেন!
মনি অবাক হলো, গত দুই বছরে দাদী ওঠে নি, আজ কেন উঠতে গেল!

অনেক অপরিচিত মহিলাদের দেখা যাচ্ছে, আত্মীয় স্বজনরা আসছে।

খোদেজা বেগম টেনে টেনে বললেন, ঘাটে যাইয়া ডুব দিতে চাইছিলাম।

মনি একটু পেছনে ছিল, সামনে এগিয়ে বলল, আপনে নামতে গেলেন ক্যান৷ আপনে কী একলা নামতে পারেন!

পারমু না ক্যান, রফিজ মেম্বারের বউ আইল!

রফিজ মেম্বারের বউ মারা গেছে আরো পনের বছর আগে৷ দাদীর কাছে খুব আসত। মারা যাওয়ার পরে সবাই বলাবলি করেছিল, মেম্বারে বিষ দিছে মনির মনে আছে।

ও বউ জাহেদরে ডাকো। বিয়া কখন দিবা!

আশপাশের মহিলারা গুঞ্জন তুলল, জাহেদের বিয়া? কার লগে?

খোদেজা বেগম ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন আর কথা বলে যাচ্ছেন অনবরত।

একজন বলল, শেষঅবস্থা। আজকে রাতটা টিকবে না মনে হয়।

জাহেদ কাছে এসে বসে বলল, দাদী, আপনে সুস্থ হইলে বিয়া হইবে।

না দাদো আমি আর টিকমু না। বিয়াডা দেইখা যামু।

জাহেদ কী করবে কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের দিকে তাকালো।

খোদেজা বেগমের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছ, এত ভীড়ে দম বন্ধ হয়ে যাবে মনে হয়। ঘরটা ফাঁকা করে দিলে ভালো হয়। মনি আর রুমি মিলে সবাইকে বের করে দিলো।

রেনু, বিলকিস,মনি আর রুমি চারজন বাদে বাকি সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। খোদেজা বেগম বললেন, আমার চুড়ি দুই গাছ কই? ও বউ আমার চুড়ি?

আছে আম্মা, সিন্দুকে।

এটটা মনিরে দিবা, আরেটটা রুমিরে।

ঠিক আছে দিব।

আমার লাল শাড়িটা মনিরে দিবা।

আচ্ছা দিব।

ফার্মেসীর শহিদুল একটা ইনজেকশন পুশ করে দিয়ে গেছে। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়বেন।

রেনু জাহেদের আব্বার কাছে গেল।

জাহেদের আব্বা কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মনোয়ারকে ডেকে আন, আর কাজী সাহেবকেও আন।

রুমি এসে মনিকে বলল, মনি আমার রুমে আয়।

মনি বলল, কেন?

রুমি কিছু না বলে চলে গেল।

রেনু এসে খোদেজা বেগমকে বলল, কাজী ডাকতেছে, আপনি শান্ত হোন এখন। জাহেদ পেছনের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। কিছুক্ষণ পডে মনিকে পুকুরপাড়ে ডেকে পাঠাল জাহেদ।

বিলকিস, মনিকে পুকুরপাড়ে পাঠিয়ে দে।

রুমি মনিকে একটা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে।বিয়ের জন্য লাল শাড়ি পরানো উচিত ছিল, রুমির মন টানল না। একটা সবুজ শাড়ি পরিয়ে দিলো। মনি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। যেন সব কিছু স্বপ্নের মধ্যে চলছে।

মুক্তা সাবিনা কেউ নেই। তাদের কেউ ডাকেনি।

মনি গিয়ে ঘাটে দাঁড়াল। উৎসাহী কয়েকজন মহিলা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছে, এর বাপ গতমাসে বিয়ে করে আনছে, মা সেই শোকে মারা গেল। এরকম কথা মনে হয়!

জাহেদ ভাই, মনি ডাকল।

জাহেদ মনিকে দেখল তাকিয়ে। মনিকে এত সুন্দর আগে কখনো লাগেনি। সব সময় একটা হীনমন্যতা নিয়ে চলে মেয়েটা। ওর প্রতি মায়া হয়, করুণা হয়, কিন্তু ভালোবাসা হয়নি কখনো।

মনি, এখন কথা বাড়ানোর সময় নেই। দাদীর মন রাখতে হয়তো বিয়ে পড়ানো হবে, কিন্তু এই বিয়েতে আমার মত নেই।

মনি চুপ করে থেকে বলল, আমারও না।

তাহলে বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি ভাবার দরকার নেই, মনে করে নাও, একজন অসুস্থ মানুষের মন রাখতেছ।

কিন্তু বিয়ের মতো এত বড় বিষয়ে আপনি সায় দিচ্ছেন কেন?

উপায় নাই, তাই। আব্বার মনটা নরম। তার দিকে তাকিয়ে….

কথা শেষ হলো না। ভেতর থেকে শোরগোল শোনা গেল।

মনি দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।

চলবে

শানজানা আলম

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -১৪

মনি একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। নিজেই বুঝতে পারছে, মনটা লোভী হয়ে উঠেছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই ঝামেলার মধ্যে যদি বিয়েটা হয়ে যায়!

মনের মধ্যে দুটো সত্তা আলাদা হয়ে গেছে। একজন স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করছে, কী দরকার যারা এত দূরছাই করে সরাসরি, তাদের বিয়ে করার!

আরেক জন বলছে, একবার বিয়ে হলেই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি। কেউ কোনো কথা বলার সাহস পাবে না এই বাড়ির বউকে।

পুকুর পাড়ে কেউ নেই, খোদেজা বেগমের শ্বাস উঠেছে। সবাই বুঝতে পারছে, আর হয়তো টিকবে না। দুয়েকবার জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে বলছে, জাহেদের বিয়া দাও।

সব মানুষের মধ্যেও চাপা একটা গুঞ্জন, জাহেদের বিয়া, কার সাথে, পাশের বাড়ির ওই মেয়েটার সাথে! কেন? কোনো সম্পর্ক চলে? এরা তো সব চেপে রাখে, বুড়া মানু, সে তো চাপতে পারতেছে না।

বিলকিস মনিকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল। মনি খোদেজা বেগমের পাশে বসল।

কই জাহেদ কই, কাজী আসছে? বিয়া কখন?

জাহেদের আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন, বিয়ে হবে। মনির আব্বা সামনে বসে আছে। দুজনের পাশে বসার মতো কোনো সামাজিক অবস্থান কখনো হয় নি। তার মনে কী চলছে, বোঝা যাচ্ছে না।

খোদেজা বেগমকে মানসিক শান্তি দিতে রাতে কোনো আড়ম্বর ছাড়াই জাহেদের সাথে মনির কলেমা পড়ানো হলো।

রেনু কিছু বললেন না, জাহেদ কয়েকবার বলেছিল, বিয়ে পড়ানো হলেও আমি কখনো মনিকে বউ ভাবতে পারব না।
এটা হয় না মা। কোনো ভাবেই মানতে পারব না।

রেনু চুপ করে রইলেন। মনি কলের পুতুলের মত কবুল বলল, সইটাও করল। আত্মসম্মানবোধটার চাইতে স্বার্থপর একটা আনন্দ মনে নাড়া দিচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে, জাহেদ ভাই সরাসরি না বলেছে, বিয়ে হলেও সেটা গুরুত্বপূর্ণ না ভাবতে। আবার মনে হচ্ছে, বিয়ে হলে প্রথমে রাজী না হলেও একসময় তো সংসার করবেই৷

আর জাহেদের চরম বিরক্ত লাগছে মনিকে। যদিও ওর কোনো দোষ নেই, কিন্তু মনে হচ্ছে সব কিছুর জন্য মনি দোষী। জাহেদের একবারো মনে হচ্ছে না, তার বাবা মা চাইলে বিয়েটা এড়িয়ে যেতে পারতেন। জাহেদ বলেছিল, বিয়ের আয়োজন করতে, কিন্তু সেটা সত্যি হবে, সেটা কেন যেন ভাবতে পারে নি।

কলেমা হয়েছে শুনে খোদেজা বেগম শান্ত হলেন। শান্ত হয়ে একটু চোখ বন্ধ করলেন। তবে সেই চোখ আর তিনি খুললেন না৷ সম্ভবত ঘুমের মধ্যেই তিনি এই পৃথিবীর যাত্রা শেষ করে অন্যভুবনের অনন্ত পথযাত্রা শুরু করেছেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here