দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১৫,১৬,১৭
শানজানা আলম
১৫
খোদেজা বেগমের মৃত্যু পরবর্তী কর্মযজ্ঞে মনির বিয়ে নিয়ে কোনো কিছু করা হলো না। কাছের সম্পর্কীয় আত্মীয়রা নিজেরা বলাবলি করলেন, মানুষটা মইরা গেলেও মাইয়াটার একটা গতি কইররা গ্যাছে!
দাফন শেষে শোকের তাপ একটু কমতেই মনির দিকে সবার খেয়াল গেল। বিয়ে হয়েছে, এখন স্বামীর সাথে থাকবে না? সেটা কেমন কথা! হোক মরা বাড়ি, বিয়েও তো হয়েছে। অল্প করেই আয়োজন হোক।
জাহেদ সরাসরি প্রতিবাদ করল, দাদীর মন রাখতে সে রাজী হয়েছিল। এখন দাদীই তো নেই, সে চায় না সম্পর্কটা থাকুক।
মনি হতভম্ব হয়ে গেল, এসব কী বলছে জাহেদ! এখন কী বিয়েটা ভেঙে যাবে?
জাহেদের আব্বা মনির আব্বাকে কী বুঝালেন, কিছু বোঝা গেল না। সে বলল, আপনারা যা ভালো মনে করেন।
কাজী সাহেবকে আরেকবার ডাকা হবে, বিয়ে বিষয়ে ফয়সালা করতে৷
আশপাশে ছিছি পড়ে গেল। এটা কেমন কথা, দাদী বাঁচবে না আগেই জানত, তাহলে বিয়েটা করল কেন, মনির কী আর বিয়ে হবে এই বিয়ে ভাঙলে!
মনি কিছু বলল না৷ চুপচাপই থাকল।
কাজী সাহেব রাজী হলেন না বিয়ে ভাঙতে। বিয়ে পবিত্র বন্ধন, কোনো ছেলেখেলা না যে এক রাতে বিয়ে পড়িয়ে আবার সে বিয়ে পরের রাতে ভেঙে দেবে। আগেই ভাবা উচিত ছিল। এত জ্ঞানী, শিক্ষিত মানুষজন সব, তারা আগে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি?
দেখুন কাজী সাহেব, ছেলে মেয়ে নিজেরাই সংসার করতে চায় না। – কথাটা বললেন জাহেদের আব্বা।
ঠিক আছে, ডাকুন তাদের, আমার সামনে বলুক।
মনি আর জাহেদকে ডাকা হলো।
মনি একটা আটপৌরে সালোয়ার কামিজ পরা, খুবই হতছিন্ন লাগছে তাকে। কিছুটা বিপর্যস্তও। নিজের বাবার বিষয়ে তেমন কিছু জানে না সে। যদিও তার বাবা বলে গেছে, বিয়ে ভাঙতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু মনি তো প্রাপ্তবয়স্ক।
প্রথমে জাহেদকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি বিয়েটা রাখতে চান না।
জাহেদ স্পষ্ট করে বলল, না৷।
কেন? সমস্যা কী? বাবা মা চাপ দিচ্ছে?
জী না। তখন দাদীআপু অসুস্থ ছিলেন, তার মনের শান্তির জন্য কেউ আগে পিছে ভাবেনি। এখন ভাবছি, মনির সাথে আমার এডজাস্ট হবে না৷
আপনি তো ওর সাথে থাকেনই নাই। কীভাবে বুঝলেন যে আপনাদের মিলমিশ হবে না!
জাহেদ উত্তর দেওয়ার আগেই তার আব্বা বললেন, আমার ছেলেকে এত জেরা কেন করা হবে! এখানে সবাই উপস্থিত, কোনো কিছু লুকোছাপা নেই।
কাজী সাহেব মনিকে জিজ্ঞেস করলেন, আম্মা আপনার কী মত? আপনিও বিয়ে টা টিকাতে চান না।
মনি চুপ করে থেকে মাথা নিচুু করে বলল, আমি বিয়ে ভাঙতে চাই না। এই সম্পর্ক রাখতে চাই।
চলবে
শানজানা আলম
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১৬
মনির কথায় উপস্থিত সবার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো।
কাজী সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন, এখন তো কাহিনী ঘুইরা গেল। আর তো কথা থাকে না।
জাহেদ বলল, আমি এই সম্পর্কে থাকতে চাই না। এটা জানার পরেও এই সম্পর্ক রাখতে চাওয়া বোকামি। জোর করে আমার স্ত্রী পরিচয়টাই শুধু রাখা যাবে, ভরণপোষণও পাওয়া যাবে কিন্তু অধিকার পাওয়া কী যাবে?
কথাটা মনির উদ্দেশ্যে বলা। মনি বলল, একটা বিয়ে হইছে, সেইটা দুই দিনের মাথায় না ভেঙ্গে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে চাই। এমনও তো হইতে পারে, আপনার মন ঘুরল। আমার জীবনটা নিয়ে আপনারা এমন করতে পারেন না। আমার টাকা পয়সা নাই, বা আপনাদের মত মান সম্মান নাই কিন্তু তাও এইটা করতে পারেন না আমার সাথে।
জাহেদ অবাক হয়ে গেল। মনি মুক্তা সস্তা ফ্রক পরে ওদের বাড়িতে আসত, মা রান্নাঘরের চেয়ারে বসিয়ে ফিরনি মিষ্টি দিলে সেটা চুপচাপ খেয়ে চলে যেত। সেই মনি, দাদী বু, জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে তাকে বিয়ে দিয়ে গেলেন। কিন্তু বললেই তো তাকে বউ হিসেবে মানা সম্ভব না।
মনির আব্বা বললেন, মনি, মুরব্বিদের মাঝখানে এইরকম কথা বলার অভ্যাস কই থিকা পাইছ, বড় মানসে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেইটাই হবে।
মনি বুঝল, আব্বাকে রাজী করিয়ে ফেলেছে জাহেদ ভাইয়ের আব্বা। হয়তো টাকা নয়তো জমি কিছু একটা তো দিয়েছে। নাহলে এভাবে কথা বলবে কেন! মা মরলে বাপ তো এমনেই তালই হয়ে যায়, সে তার স্বার্থ দেখতেছে। কিন্তু মনি চায় এই সম্পর্ক থাকুক। এমন তো হইতে পারে, জাহেদ ভাইয়ের মন ঘুরল। তাদের সংসার হইলো সুন্দর করে। জোছনা রাতে……
মনির চিন্তায় ছেদ পরে। কাজী সাহেব মেয়ের অমতে তালাকের ব্যবস্থা করবেন না। তিনি ছয়মাস সময় দিলেন। এই ছয় মাসে যদি স্বামী স্ত্রীর ভাব ভালোবাসা না হয়, তাহলে তিনি ব্যবস্থা করবেন।
মনি ভাবল, ছয় মাস, মাত্র!
আলোচনা সভা শেষ হলো। জাহেদ নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বের হয়ে এলো। মনি তখন পেছনে, দাদীর খাটে বসা। ভেতরের কথাগুলো শোনা যাচ্ছে।
রেনু চাচী স্পষ্ট করে বলছেন, আব্বো, তুমি এই রাইতে যাইও না। ছয়টা মাস তো, দেখতে দেখতে শেষ হইবে, কেউ তোমারে ঘর সংসার করতে বলবে না। তুমি তোমার মতো থাইকো।
জাহেদ বলল, আম্মা আমি ছয় মাস পরে আসব, যেদিন ছাড়াছাড়ির জন্য বসবে আবার, সেইদিন।
জাহেদের আব্বা কিছু বললেন না। কানাঘুষো, নানা কথা কাণ্ডের মাঝে জাহেদ বের হয়ে গেল।
সবাই বলাবলি করতে লাগল, কেমন মাইয়া, স্বামীরে ঘরছাড়া করল,অলক্ষী, অপয়া।
মনি যেন এসব শুনেও শুনলো না। সে পাথরের মত শক্ত হয়ে বসে রইলো।
চলবে
শানজানা আলম
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১৭
দিন কেটে যায়। মনি জাহেদের বাড়িতে থাকতে শুরু করল। প্রথমে দাদী আপুর বিছানায় জায়গা নিলেও জাহেদের আব্বা বললেন, ওরে দোতলায় থাকতে বলো জাহেদের আম্মা। মানুষ জন আইসা ওরে এখানে দেখতেছে। পর্দা পুশিদাও তো আছে নাকি!
রেনু কিন্তু মনিকে কিছু বলেননি। যত যাই হোক, বিয়েটা তারাই দিয়েছিলেন। এখন রাখতে না চাইলেও সমাজ বলে তো একটা বিষয় আছে। সমাধান হবেই, ছেলে যদি সংসার না করতে চায়, জোর করে কতদিন বিয়ে টিকবে।
রুমির ঘরের পাশে একটা ঘরে পুরনো ব্যাগ, বস্তা ছিল। সেগুলো রেনু একদিন বিলকিসকে নামিয়ে ফেলতে বললেন। মনির সাথে এ বাড়ির কারোরই কথা হয় না। নিজের বাড়িতে গিয়েছিল মনি, জাহেদ চলে যাওয়ার পরের দিন সকালে। মনির আব্বা স্পষ্ট বলে দিলেন, ওর রাস্তা ওরে দেখতে বল মুক্তা! করছে সংসার? জামাই তো গেছে হাইট্টা! ও বিয়াডা ভাঙলে, ফাওয়ের উপরে এক কুড়া জমি পাওয়া যাইত৷ কমপক্ষে তিন লাখ দাম।
মনির মুখে চলে এলো, টাকা নিয়ে নিজের মেয়ের সংসার ভাঙার চিন্তা করা বাপ মনে হয় তুমি একলা।
সাবিনা একবার বলল, এইসব কি বলেন আপনে!
মনোয়ার চুপ করিয়ে দিলো, তুমি চুপ করো। বয়স কম, এইসব তুমি বুঝবা না৷ তাও বুঝতাম বউয়ের মর্যাদা দিলে, কামের ছেমরির মত পইরা থাকবে ওই বাড়িতে!
মনি কিছুই বলল না৷ অকারণে কথা বলতে তার ভালো লাগল না। বললেই কি বাপের চরিত্র ভালো হয়ে যাবে! কখনোই না।
মুক্তা জিজ্ঞেস করল, আপা তুমি এখন রেনু চাচীগো ঘরে থাকবা?
মনি নিজের জামাকাপড় গুলো নিয়ে চলে এসেছে। মনি চলে আসায় মুক্তা মনির জায়গা পেয়ে গেল। ওর বাপের চাল কম খরচ হবে, এটাও বা কম কিসে।
বিলকিসকে দিয়ে ঘর পরিস্কার করিয়ে রেনু বলল, মনিরে বল, উপরে জিনিসপত্র নিয়া উঠতে।
বিলকিস জিজ্ঞেস করল, ভাইজানে আসবে না?
রেনু উত্তর দিলো না। মাত্র কয়েকটা দিনে বাড়িঘর কেমন অন্ধকার হয়ে গেছে। সব চুপচাপ, নিরিবিলি, নিস্তব্ধ।
রেনুর মনিকে গালমন্দ করতে ইচ্ছে করে না। ও বেচারির দোষ কি, বাপটা একটা হারামি। মনে মনে বাপের থেকে মুক্তি চাইছে, কিন্তু জাহেদ তো ওকে পছন্দ করতেছে না। বোকা মেয়ে সেটা বুঝতে পারতেছে না৷ ছোটোবেলা থেকে ওদের জাত শ্রেণী আলাদা চিন্তা করেছে জাহেদ। আজকে হুট করেই সেখান থেকে নিজের বউ ভাবা সম্ভব না। আম্মার মরণের সময় চিন্তা ভাবনা লোপ পাইছিল।
আছে থাকুক। ছয়মাস পরে জাহেদ আসলে একটা সমাধান হবেই। রেনু চিন্তা করেছে, মনির জন্য একটা ঘর তুলে দিবে, ওদের বাড়ির মধ্যেই, একটা রুম, বাথরুম রান্নাঘর তুলে দিলে ও আলাদা থাকতে পারবে। জাহেদের সাথে বিয়া ভাঙলে ওর তো আবার বিয়া হবে। তখন ওর একটা ঘর বাড়ি থাকলে সুবিধা হবে।
মনি একদিন আস্তে গিয়ে রুমিকে বলল, রুমি আপা, আমার পরীক্ষা সামনে। কলেজে যাওয়া শুরু করব।
কলেজে যাওয়ার দরকার নাই, মানুষ নানা কথা বলবে।
রুমি খুব কর্কশভাবে উত্তর দিলো।
রেনু শুনলেন। দুপুরে খাওয়ার সময় বললেন, তুই কলেজে যা, বোরকা পরে যা আর কারো সাথে ঘরের কথা আলাপ করিস না৷ বাড়ির সম্মান কিন্তু তোরও সম্মান।
মনির নিজেকে খুব ছোটো মনে হয় আজকাল। সে কী জোর করে উঠে এসে বসেছে? না তো, সবাই তার বিয়ে দিয়েছে। সে স্বার্থপর? না তো, সে শুধু কিছুদিন চেষ্টা করতে চেয়েছে।
তার জীবনটা সহজ হতে পারত না? মা বেঁচে থাকত,বাবা বিয়ে না করত, আগের মত সব থাকত!
সেরকম কিছুই হয় নি। তার জীবনটা সাপলুডুর বড় সাপটা গিলে নিয়েছে।
শানজানা আলম