দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -২১,২২ শেষ

0
1264

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -২১,২২ শেষ
শানজানা আলম
২১

যত অনাড়ম্বর ভাবে মনির বিয়ে হয়েছিল, ডিভোর্সটা হল তার চাইতে অনেক বেশি আয়োজনে। ছয় মাস পরে ছেলে বাড়িতে এসেছে, এই খুশিতে আসার কারণ ভুলে জাহেদের বাড়িতে সবাই উৎসবে মেতে উঠল। ছাড়াছাড়ি তো হওয়ারই ছিল। মনির সহজেই সইটা করে দিলো এবার। একজন মানুষ তীব্র অপ্রেম নিয়ে তার সাথে সংসার করলে বিষয়টা কী ভালো হতো! তবু একটা অপমান বোধ ভেতরে। একটা দিন, একটা ঘণ্টা কী মনিকে দেওয়া যেত না! এত অস্পৃশ্যা মনি!

মনি বের হয়ে যাচ্ছিল। গত মাসখানেক সে নিজেদের বাড়িতেই থাকছে। মুক্তাকে পড়ানোর চেষ্টা করেছে, নিজেও পড়েছে৷ রেনু চাচী ডাকলে এসে দেখা করে গেছে। সাবিনা আর মনির বাবা বেশি ঘাটায় নি মনিকে। আজ থেকে হয়তো কথা শোনাবে। স্বামী খোঁজ না রাখলেও বড়লোক বাড়ির বউ! একটু সমীহ করেই চলেছে মনিকে।

মনিকে ডাকে থামালেন রেনু।

একটু বস, দরকার আছে।

মনি বসল।

একটু পরে জাহেদ এসে ঢুকল। মনির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না যেন, কোনো অজানা অপরাধ বোধে যেন নিজের কাছে ছোটো হয়ে আছে, কিন্তু আসলে কী কোনো অপরাধ ছিল?

মনি উঠে দাঁড়াল।

বসো মনি। তোমার সাথে দরকার আছে।

এতদিনেও কোনো দরকার হয়নি, আজ কি দরকার হতে পারে, মনি ভেবে পায় না৷ তবে উত্তরও দিলো না।

জাহেদ একটা খাম দিলো মনিকে।

এটা রাখো।

এখানে কী আছে?

এখানে একটা ভালো এমাউন্টের টাকার চেক আছে। তোমার কাজে লাগবে।

ও আচ্ছা। কিন্তু আমার কোনো টাকা লাগবে না।

তুমি যেভাবে চাইবে, সেভাবেই তোমার দেখাশোনার দায়িত্ব আমাদের বাড়ি থেকে নেওয়া হবে। তোমার বিয়ের ব্যবস্থাও আম্মা করে দিবে।

আমাকে কারো দেখতে হবে না৷

মনি শীতল গলায় বলল।

তুমি বোধহয় রেগে আছ বা কষ্ট পাচ্ছ! কিন্তু দেখো, আমি কখনো তোমাকে এমন কোনো চোখে দেখিই নি।

মনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সেটা তো জানি। আজ তো দুইদিক থেকেই সব শেষ হয়ে গেল।

জাহেদ আর কথা বলল না। রেনু এসে বললেন, টাকাটা নে মনি। এতদিন তোরে কেউ কিছু না বললেও, কালকে থেকে বলবে। তখন পায়ের নিচে জোর পাবি না।

না চাচী, টাকা লাগবে না।

মনি টাকা না নিয়েই চলে গেল। রেনু আর জোর করলেন না। তবে মনির টাকা মনিই পাবে, ওর বাপ পাবে না। এই ব্যবস্থা তিনি করবেন বলে ঠিক করলেন।

মনি পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকছিল, ওর আব্বা জিজ্ঞেস করল, টাকা ক্যাশ দিছে?

মনি উত্তর দিলো না।

কি হইল? একটা কথা জিজ্ঞেস করছি!

মনি বলল, টাকা যেভাবেই দিক, আপনার কি?

আমার ব্যবসা ভালো চলতেছে না। দোকানটা বড় করতে চাইছি!

করেন, সমস্যা কি!

কিছু টাকা যদি দিতি!

মনি বলল, মুক্তা আর আমার খাওয়ার খরচ আমি দিব।আমরা দুই বোনরে আপনার খাওয়ান লাগবে না।

মনির আব্বা আর কিছু বলল না। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও মুক্তা বাড়ি ফিরল না। রাত দশটার দিকে একজন এসে খবর দিলো, মুক্তা ওপারের রজ্জাক কামারের ছেলে রকেটের সাথে ভাগছে।

ভাগছে মানে কি?

মানে বিয়া করছে নাকি। এখন রজ্জাক কামারের ঘরে আছে। তার দুই সংসার এক ঘরে থাকে, রকেট বড় বউয়ের ছোটো ছেলে।

বিয়া হয় কীভাবে, মুক্তার তো আঠারো বচ্ছর হয় নাই।

সে কাগজে কলমে না হইলেও কলমা পড়ে হয়।

মনির বাপ শাপশাপান্ত করতে করতে নামল। মনিও উঠল সাথে। যদি ফেরানো যায়! কি অদ্ভুত বিষয়, আজই মনি তালাকনামায় সই করল, আর আজই মুক্তা বিয়ে করে নিলো!

চলবে

শানজানা আলম

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -২২

মুক্তা বিয়ে করেছে এবং সে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরবে না। মনি আর মনির বাবা বোঝানোর চেষ্টা করল অনেকভাবেই। এরকম একটা বস্তি এলাকায় মুক্তা কীভাবে থাকবে। আর ছেলেটা তো কিছু করে না।

মুক্তা নিজের জায়গায় অনড়, সে বাড়িতেও খুব ভালো থাকে না। জোর খাটিয়ে প্রতিবেলায় ভাত খেতে হয়। সেটা না হয় এখানেও করবে। একদম শেষে রকেট নিজেই কথা বলল, বিয়া যখন কইরা ফেলাইছি, মুক্তার দায় দায়িত্ব সবই আমার। আমি ভ্যান চালামু, বাপের দোকানে কামারের কাজ করমু, আমার বউরে ভাত দেওয়ার, কাপড় দেওয়ার দায়িত্ব আমার। এখন মুক্তা কোনো জায়গায়ই যাইবে না।

রজ্জাক কামার বাউন্ডুলে ছেলের মুখে এরকম কথা শুনে মনে মনে খুশি হয়ে গেল। একটা লোক রাখলে সাত হাজার টাকার কমে হয় না। সেখানে ছেলে গিয়ে বসলে কাজ দুইটা বেশি আসবে। দা বটি সবারই লাগে, কাজ থাকেই।

সেও আগ্রহ করে বলল, মিয়া ভাই, ছোটো পুলাপান, বিয়া কইরালাইছে যহন, থাউক। আমার দুই সংসার চালাই, এক ঘরে পুলাপান নাই। আমার আর দুইটা গ্যাদা থাকলেও তো খাওয়াইতাম। থাকুক মা জননী।

কোনো আয়োজন নেই, আড়ম্বর নেই৷ ঘর ভর্তি মানুষ, কে কোথায় থাকবে, তারও ঠিক নেই! রজ্জাকের গায়ের জামাটাও নেই। তবু ছেলের বউকে মা জননী বলল!

আর রকেট, যে কিনা বখাটে, বাউন্ডুলে, সেও বউকে খাওয়াবে বলল! মনির মনে হলো, ওই শিক্ষিত, বড়লোক বাড়ির চাইতে এই অশিক্ষিত, বস্তির মত বাড়িতে থাকা মানুষগুলো অনেক বেশি ভালো। এখানে মুক্তাকে সবাই মাথায় তুলে রাখবে।
মনি ভাবলো, সে নিজে মুক্তাকে জামা কাপড়, জিনিসপত্র কিনে দিয়ে যাবে। অন্তত একটা বোন সুখে থাক, যদি ওর কপালে সয়!

বাড়িতে মুক্তাকে ছাড়াই ফিরে এলো মনি। ঘরটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মধ্য ঘরের বিছানা ছেড়ে মনি পেছনের বারান্দায় চলে এলো। ঘরে মা নেই, মুক্তাও নেই, মনির দম বন্ধ লাগে। তবু মনি একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে৷ প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা ওর জোগাড় করতেই হবে। ওই বাড়ির টাকাটা হয়তো ওর থাকবে, কিন্তু এই টাকা মনির কাছে অপমান লাগে। মনি কি চেয়েছিল আসলে? সারাজীবন কষ্ট করে একটা স্বচ্ছল, সুন্দর পরিবার।
কিন্তু ওর ভাগ্যে হয়তো সেটা ছিল না।

★★★

সময় দ্রুত কেটে যায়। বার বার যার লক্ষ্য সরে যায়, একবার না একবার তার ভাগ্য ঠিকই সহায় হয়ে যায়।
মনি স্কুলের সরকারি চাকরিটা পেয়ে যায়।

একটা চাকরি জীবনটাই বদলে দিলো। নতুন নতুন মানুষ, ছোটো ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে ক্লাশ মনির ভালোই লাগল। য বেতনটা পাওয়া যায়, তার উপর বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে আরো কিছু বাড়তি টাকা আসে। মনি উপজেলায় টিচার্স প্রোমোটে থাকা শুরু করল।

বাড়ি হয়তো পনের দিনে একবার আসে, নাও আসতে পারে। কোনো পিছুটান নেই।

রেনু চাচী ঘাট থেকে পড়ে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছেন। এটা শুনে মনি একদিন দেখতে এলো। রেনু চাচী তাকে আর তার মা কে কম ভালোবাসেন নি কখনো।

এমনিতে এ বাড়িতে আসতে অস্বস্তি হয় না। কিন্তু জাহেদ আছে মনে হয়। মনি শুনেছে বিয়ে করছে, ঢাকায় গিয়ে চাচী,চাচা আংটিবদল করে এসেছে। বড় অনুষ্ঠান করা হবে এবারে হয়তো।

মনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার সাথে বড় গেটের সামনে জাহেদ দাঁড়িয়েছিল। মনিকে দেখে ডাকল,
মনি, কেমন আছ?

জি ভালো।

উত্তরে মনি জিজ্ঞেস করল না জাহেদ কেমন আছে।

মা তোমার কথা খুব বলে।

মনি উত্তর দিলো না।

জাহেদ গতরাতে এসেছে। কিছু একটা জিনিসপত্র খুজতে গিয়ে মনির একটা পুরনো বই পেয়েছে৷ যে রুমে মনি থাকত, সেই রুমে। পাতা উল্টাতেই হাতে চলে এসেছে জাহেদের একটা ছবি, অনেক বছর আগে, মনি সেটা কুড়িয়ে নিয়েছিল, বাড়ির পাশে ফেলে দেওয়া কাগজপত্র থেকে। ছবিটা হাতে নিয়ে জাহেদের কেমন একটা অনুভূতি হলো৷ তাহলে কী কোনো ভুল করে ফেলেছে! মনি কি তাকে পছন্দ করত অনেক আগ থেকেই! কখনো জানতে চায়নি জাহেদ। নিজের আজন্ম লালিত বড়ত্ব বা শ্রেনী বৈষম্য জাহেদের মনকে কখনো মনির জন্য দ্রবীভূত হতে দেয় নি৷ মনি ওদের চাইতে নিচু পরিবারের। সারা জীবন যাদের দয়া করে এসেছে, তাকে ভালোবাসা এতটাই সহজ!
জীবন তো ছায়াচিত্র নয়!!

মনি ম্যাডাম, প্রোমটে যাবেন নাকি!

ভ্যান থামিয়ে শিমুল স্যার ডাকছে। মনির কলিগ, দুই ব্যাচ আগে জয়েন করেছে মনির স্কুলেই।

হ্যা, যাব।

মনি জাহেদকে বলল, আসি।

মনি ভ্যানে গিয়ে বসল, ভ্যান চলতে চলতে মোড় ঘুরে আড়ালে চলে গেল। জাহেদ দাঁড়িয়ে রইল দূরের দিকে ঝাপসা দৃষ্টিতে।

শেষ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here