দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-৮,০৯,১০,১১
শানজানা আলম
০৮
রেবেকা বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছে, মনি হাত থেকে প্লেট ফেলে দিয়ে দৌড়ে গিয়েও ধরতে পারল না তাকে।
মনির হাতের উপরই চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে গেল রেবেকা৷ মনি বুঝতে পারল না।
জোরে চিৎকার করতে লাগল, আম্মা অজ্ঞান হইয়া গেছে।
দ্রুত ডাক্তার ডাকা সম্ভব না এই এলাকায়। তবু ভ্যান ডাকতে গেল দিন মজুরে কাজে থাকা মফিজ। রেনু এলেন দ্রুত হেঁটে৷ হাতের নাড়ি ধরে তিনি বললেন, মনি তোর মায়েরে শোয়াইয়া দে। আর একটা ওড়না দিয়া মুখটা ঢাইকা দে।
মুক্তা এসে দাঁড়িয়েছে বিছানার পাশে। নতুন বউ জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে বসে আছে।
ও চাচী, মুখ ঢাকা লাগবে ক্যান, দম আটকাইয়া যাবে তো!
-মনি বুঝেও বিশ্বাস করতে চায় না।
রেনু ভাঙা গলায় বললেন, দম নাইরে পাগলি। আব্বারে খবর দে।
সব কিছু ঘটে গেল অস্বাভাবিক দ্রুততায়। রেবেকার জায়গা হলো বাড়ির পেছনে পুকুরের ওই পাড়ে। মনি কাঁদল না৷ কাঁদল মুক্তা, গগনবিদারী চিৎকার করে সাবিনাকে ডাইনি বলে কাঁদল। আর কাদল পাশের বাড়ি থেকে আসা মেয়ে বউরা। তারা কেন কাঁদল মনি বুঝতে পারল না। হয়তো মরা বাড়ি কাঁদতে হয়, তাই কেঁদেছে।
মনির বাবাকে দেখা গেল মুখ নিচু করে বসে আছে। কষ্ট পেয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
ও মনি একটু কানতো মা, শক্ত হইয়া থাকলে কইলজা ফাইট্টা যাইবে।
মনি কাঁদল না৷ কেঁদে আর কি হবে, ভালোই হয়েছে, মরে গেছে৷ বেঁচে থাকতে চিকিৎসা হয় নি, একটু খেতেও পায়নি ঠিক মতো। রেনু চাচীর দেওয়া হাবিজাবিও সোনামুখ করে খেয়ে নিতো।
বিয়ে হয়েছিল সেই দুই যুগ আগে। নানা নানী মরে গেছে তাও এক যুগ
নানাবাড়িতে মামা, মামী আছে দুই জোড়া। নিজেদের সংসাার নিয়েই ব্যস্ত। একবেলা বেড়াতে গেলে পরের বেলা আরেক ঘরে পাঠাতে ভণিতা শুরু করে। তারাও এলো, আনুষ্ঠানিক একটা দায়িত্ব তো আছে।
মরা বাড়িতে লাশও দেখল সবাই, আবার গা টেপাটেপি করে নতুন বউ সাবিনাকেও দেখল। দেখল মনি মুক্তাকেও।
রেনু মনি মুক্তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন কিন্তু মনি রাজী হলো না। কি আর হবে, নতুন আর কিছু হওয়ার নেই। সব ক্ষতি হয়ে গেছে, মান সম্মান চলে গেছে, মান সম্মানের সাথে মা ও চলে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই।
মনি ঠায় বসে থাকে রান্নাঘরের দরজায়, রেবেকা আগে যেখানে বসত।
চলবে
শানজানা আলম
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-৯
রেবেকা মারা যাওয়ার পরে কোনো কিছুই খুব একটা পাল্টায়নি। মনির বাপ আগের চাইতে একটু ঘরমুখো হয়েছে, সেটা হতে পারে মানুষের কথার জন্য বা নতুন কমবয়েসী বউয়ের জন্য। মনি কলেজে যায়, মুক্তাও স্কুলে যায়। মনি ফিরে এসে রান্না করা ভাত তরকারি পায়, খেয়ে নিজের মত করে থাকে। এক স্যারের দুটো বাচ্চাকে পড়ানোর কাজ নিয়েছে। তুলনামূলক ভালো ছাত্রী, হাতের লেখা সুন্দর বলে নির্মল স্যার নিজেই বললেন বাচ্চা দুটোকে হাতের লেখা শেখাতে। বিকেলে সেখানে যায়, বারোশ টাকা পাবে, একেবারে কম নয়। আগে বাপের কাছ থেকে টাকা নিতো, কিন্তু এখন চাইতে ইচ্ছে করে না। খেতে হয়, তাই খায়। কেমন একটা নিস্তরঙ্গ চুপচাপ জীবন পার করে দিচ্ছে প্রতিদিন।
মনির একটা বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল পাশের বাড়ির এক ভাবী। ছেলে খুলনায় ফ্যাক্টরীতে কিছু একটা কাজ করে। মনি রাজী হয় নি। বিয়ে মানেই আবার কথাকথি হবে, বাবার বিয়ে, মায়ের মৃত্যু, কোনো কিছুই মনির আবার শুনতে ভালো লাগে না। সাবিনার সাথে মনির কথা বার্তা খুব একটা হয় না। মুক্তা ডাইনী, পেত্নী বলে গালাগাল করে, মনি কিছু বলে না। রেবেকার খাটে সাবিনা থাকে। মনি পেছনের বারান্দায়। মুক্তা সামনে থাকে। সাবিনাকে খুব একটা খারাপ লাগে না মনির। বেচারি নিজেও আরেক হতভাগা।
এই বাড়ি, ঘর কিছুই মনির নিজের মনে হয় না। আগে মনের গোপনে একটা ঘর সংসার ছিল মনির, সেখানে দেখা যেত, কোনো কোনো দিন জাহেদ ভাইয়ের আসা যাওয়া। হয়তো কোনো এক বৃষ্টিতে দুজনের একসাথে ছাতা নিয়ে একটা কাঁদা মাখা পথে হাঁটার একটা দৃশ্য ছিল, কোনো এক সন্ধ্যায় একসাথে চা খাওয়ার মতো একটা দৃশ্য ছিল। আজ সেসব দৃশ্যগুলো ধূসর হয়ে গেছে। এই আপন দৃশ্য গুলোর সাথে বেশি ছাড়াছাড়ি হয়েছে মনির। এগুলো আর কখনো নিস্তব্ধ দুপুরে মনির কাছে আসবে না।
দুপুরবেলায় মনি ফিরে আসে কলেজ থেকে। মনোয়ারের ভাত নিয়ে যায় দোকানের কাজ করে যে বাচ্চা ছেলেটা, নাম দুলাল। সাবিনা কোন ফাঁকে খায় মনি জানে না। একদিন ফিরে এসে দেখল, বেশ অনেকটা ভাত রয়েছে। খেতে বসার আগে মনি ভাব বাচ্যে জিজ্ঞেস করল, এত ভাত কেন?
আমি খাই নাই, একলা খাইতে ইচ্ছা করে না।
ওহ, ডাকবে কিনা দ্বিধা লাগে মনির।
সাবিনা নিজেই প্লেট নিয়ে এসে বসে।
আপনে অনেক ভালো, আপনের মায়ে মরার জন্য আমারে দোষী ভাবেন নাই।
মনি বলল, হায়াত তার ওইটুক ছিল।
আপনের অনেক ভালা হইবে, দ্যাখবেন! মুক্তা পোলাপান মানুষ, আমার নামে আজেবাজে কথা কইয়া বেড়ায়।
সাবিনা কী নালিশ করতেছে মনির কাছে! মনি বুঝল না। তাই উত্তরও দিলো না।
আপনে যদি একটু বুঝাইয়া বলতেন!
মনি বলল, আচ্ছা বলব।
ইলিশ মাছ ভাজা হয়েছে আজ। কড়াইয়ে থাকা তিনপিসের মধ্যে বড়টা মনিকে তুলে দেয় সাবিনা। এবারে ইলিশের মৌসুম ভরপুর৷ ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়তেছে। দুয়েকদিন পর পর সবার প্লেটে ইলিশের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। মা গতবছর খুব ইলিশ ইলিশ করছিল। রেনু চাচীর দেওয়া মাথা লেজই সোনামুখ করে খেয়েছে, বাড়িতে মাছ ঢোকেনি।
মনি নিঃশ্বাস ফেলে, সবই কপাল হয়তো!
চলবে
শানজানা আলম
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১০
মুক্তা পড়ে বিবি বালিকা বিদ্যালয়ে। বিবি- এ হয় বাণীবালা বালিকা বিদ্যালয়। বাণীবালা দেবীর বাবার অনেক টাকা পয়সা ছিল, একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তিনি এসব কিছু পেয়েছেন। বিয়ে করেননি, একটা স্কুল করেছেন। বিনা বেতনে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা এখানে পড়তে পারে। তবে কাছাকাছি একটা সরকারি স্কুল থাকায়, এখানে ভর্তি হয় ওই স্কুল থেকে ফেল করা ছাত্রীরা। বেতন দিতে হয় না, স্কুলে আসে আর যায়। তিন চারজন শিক্ষিকা থাকলেও তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। স্কুলে আসেন, গল্প টল্প করেন, ক্লাশে গিয়ে কতক্ষণ চেঁচামেচি করে আবার কমনরুমে চলে আসেন।
মুক্তার বাবা আরেকটা কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছে, হুট করে মাও মরে গেল। এই শোকেই বলা যায়।
এটা ছোট্ট এলাকায় বেশ আলোচনা তৈরি করেছে। মুক্তাকে রোজ একেক ম্যাডাম ডাকেন। পুরো ঘটনা শোনেন। এখন বাড়িতে কে রান্না করে, নতুন মা কেমন, খেতে দেয় কিনা, এসব মিলিয়ে বেশ রমরমা গল্প। মুক্তার খারাপ লাগে না। শুধু স্কুলে না, আশপাশের বাড়িতেও সে জমপেশ গল্প করে বেড়ায়।
পাশের বাড়ির দাদী একদিন মনিকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন, কিরে মনি, তোদের খাইতে দেয়? রান্নাঘরডা ছাড়িস না৷
মনি বুঝল, এদের সাথে মুক্তা আলোচনা করেছে। মুক্তাকে ডাকল বাড়ি ফিরে।
মুক্তা এদিক আয়।
জি আপা… মুক্তা এসে দাঁড়াল।
সামনে আয়
মুক্তা সামনে গেল।
উপরে তাকা
কেন আপা
তাকাতে বলছি তাকা
মুক্তা ঘাড় উঁচু করল।
এখন ছ্যাপ দে।
কি বলো আপা
হ, ছ্যাপ ফেল।
না, গায়ে আসব তো!
আসলে আসব, দুনিয়ার মানসের বাড়ি যাইয়া কুটকাচালি কইরা আসোস, সেগুলা গায়ে লাগে না!
আপা, ওই পেত্নি তোমারে চিনিপড়া খাওয়াইছে।
একটা থাপ্পড় দিব। ফেল করে আসছ বিবি স্কুলে, সেইখানে পড়াশোনার নামও নাই। মায়ে মরছে, বাপে আরেকটা বিয়া করছে, তোরে নিব কেডা পড়াশোনা না করলে?
মুক্তা চুপ করে রইল, কথাটা সত্য, কেই তারে নিতে আসবে না। মা মরলে বাপ তালই হয়, আপা এমনিতে ভালো, একটু মেজাজ করে ইদানিংকালে। ভালো হয় আপার কাছে মাফ চাইলে।
আপা ভুল করছি, আর করব না।
মনি নিশ্বাস ফেলল। মা কিছুই ছিল না, তবু মায়ের কোলটা ছিল। কেমন সব শূন্য শূন্য লাগে। চারপাশে এত মানুষ তবু চুপচাপ থাকা, অসুখে ভোগা একটা মেয়ে লোক সব ফাঁকা করে দিয়ে চলে গেছে।
★★★
রাতে মনি শোয়ার আয়োজন করছিল। বিলকিস এসে ডাকল, খোদেজা বেগমের শ্বাস উঠছে, দম ফেরাতে পারছে না। রেনু চাচী মনিকে ডাকছে।
চলবে
শানজানা আলম
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -১১
খোদেজা বেগম ঘামছেন। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনি এসে বসেছে মাথার কাছেই। বার বার ঠোঁটে পানি ঢেলে দিচ্ছে। শুভাশিস ডাক্তার আজ এলাকায় নেই, ট্রেনিং নিতে বরিশালে গেছে তিন দিনের জন্য। এত রাতে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও লাভ নেই, ফার্মেসীর শহিদুলকে ডাকতে গেছে স্যালাইন দেওয়ার জন্য৷
দুপুর থেকে তিন চারবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পরে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন। স্যালাইন খাওয়ানো হয়েছে তখন। রাত্রে আবার শুরু হয়েছে বমি। দুটো ফ্যান চললেও তার ঘাম কমছে না। খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
ও বউ, জাহেদরে খবর দেও। আমার লাশ উঠাইতে ওরে লাগবে তো!
রেনুকে বললেন তিনি।
আম্মা, চোপেন তো, দুপুর হইতে চাইরবার গু মুত সরাইছি, আপনে আছেন ঢংগের কথায়।
চাচী, থাউক না, আপনে একটু শান্ত থাকেন!-মনি বলল।
আয় হায়, মনোর বউটা ধইরা ঘরে উঠাইছি, ওয়ে এহন বাঁশতলা শুইয়া রইছে, আমি কী আর বাচমু, জাহেদরে খবর দাও! অর বিয়াডা দেহি।
কি সব কথা আম্মা, সুস্থ হইয়া লন, বিয়া পরে দিয়েন।
রুমির জামাইরে খবর দিয়া আনো, ওর হাতে রুমিরে তুইলা দিয়া যাই। আমার বিয়ার শাড়িডা মনিরে দিও, জাহেদের বউর জন্য রাখছি।
মনি কেঁপে উঠল, দাদী কী বলল! জাহেদ ভাইয়ের বউয়ের জন্য রাখা শাড়ি, তাকে কেন দিবে!
দিব আম্মা, যারে যা দিতে চান দিব। এখন শান্ত হন এটটু।
শহিদুলকে নিয়ে জাহেদের আব্বা আসছেন। স্যালাইন লাগিয়ে দিতে হবে।
ও জাহেদের বাপ, মনোর বড় মাইয়াডা লক্ষী আছে, অর লগে জাহেদের বিয়া দিস৷
আচ্ছা আম্মা, আপনে সুস্থ হোন আগে।
রেনু শুনেও শুনলেন না, আবোল তাবোল বকতেছে। মনিও কথাটা খেয়াল করল না।
জাহেদকে খবর দেওয়া হইছে? অরে ডাইকা আনাও, অর বউ দেখমু!
খবর দিছি আম্মা, আসবে, সকালে রওনা দেবে।
খোদেজা বেগম আবোল তাবোল বকেই চলছেন। মনি মাথায় হাত দিতে দিতে একটু ঘুমালেন।
জাহেদের আব্বা রেনুকে বললেন, শুভাশিস ডাক্তাররে।খবর দিছি, কালকে বিকালে আসবে। আম্মারে নিয়া দূরে যাওয়ার উপায় নাই। দেখি আল্লাহ কি চায়!
রেনু আস্তে বললেন, হুশ যায় নাই, মনিরে জাহেদের বউ করতে চায়।
আমারেও বলছে।
রাজী হইয়েন না পোলারে না জিগায়া।
না না, আমি রাজী না। তারে শান্ত করতে বলছি। মাইয়া খারাপ না, বাপটায় অকাম না করলেও চলত!
বাদ দেন। চুপচাপ থাকেন।
জাহেদের আব্বা বাদ দিতে পারলেন না। বাম চোখটা কেৃন খচখচ করছে। আল্লাহ জানেন, কী না কী হয়! যতই বয়স হোক, মা তো! দুর্বলও লাগছে মনে মনে।
চলবে
শানজানা আলম