দূর আলাপন,পর্ব-১৫,১৬

0
1103

দূর আলাপন,পর্ব-১৫,১৬
অদ্রিজা আশয়ারী
পর্ব-১৫

ভিড়ানো দরজার খানিকটা খুলে তিহা উঁকি দিল ভেতরে। এখান থেকে শুধু ওর পেছন টুকুই নজরে পড়ছে। মেঝেতে শুয়ে আছে মেয়েটা। জানালার গরাদ গলে সকালের নরম রোদ এসে পড়ছে তার গায়ে।
তিহা ধীর পায়ে এগোয় সেদিকে। রোদে নিজের হাত রেখে সে হাতটাকে নাড়াচাড়া করছে তিতিক্ষা। সৃষ্টি হচ্ছে অদ্ভুত সব আকৃতির ছায়া। সেসব চঞ্চল ছায়া এসে পড়ছে তার মুখে, চোখে। রোদে পড়ে জ্বলজ্বল করে ওঠা নিজের ফ্যাকাসে সাদা হাতের দিকে সে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ চোখে।
তিহা গিয়ে তার পাশে বসে। হাসি হাসি মুখ করে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি করিস?’
বোনের উপস্থিতি টের পেয়েও তিতিক্ষা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ওভাবেই রোদে হাত রেখে নাড়তে নাড়তে বলে, ‘রোদ দেখি।’
তিহা অস্ফুট হাসে,’ রোদ কি আবার দেখার জিনিস নাকি?’
-‘আমার দেখতে ভালো লাগে। রোদ থেকে আমি শক্তি নিই। গাছের মতো। ‘
তিহার দৃষ্টি গভীর হয়। ওভাবেই তাকিয়ে থেকে সে দেখতে থাকে নিজের কাছের মানুষের বদলে যাওয়া অন্য রূপটাকে। দিনের পর দিন এই বদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে মেয়েটার সাদা মুখ আরও ভয়ংকর সাদা হয়েছে উঠেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোন বিদেশিনী। তখন তার কালো চুল দেখে সেই ভ্রম ভাঙ্গে। চোখের রঙও যেন বদলে গেছে অনেকটা। তার হালকা বাদামি চোখ এখন গাঢ় ধূসর রঙে পরিনত হয়েছে। আর চোখের ওপরের বাদামি রেখা যেন পূর্ণতা দান করেছে সেই চোখের সৌন্দর্যে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নিখুঁত হাতে আঁকা গাঢ় অঞ্জন যেন।
তিহা সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকায়। তাকানো মাত্র রোদের তেজে চোখ তার বুজে আসে। সে খুব দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় তখন। তারপর নিশ্বাস ছাড়ে ধীরে ধীরে। যেন কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে সে সূর্যের থেকে।
-‘কতবার না বলেছি মেঝেতে না শুতে। তবুও? উঠে বোস এক্ষুনি!’ বলে সে টান দেয় তিতিক্ষার হাত ধরে। তিতিক্ষা ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে।
-‘আমি ফের একটু বাইরে যাব। ফিরতে খানিক দেরি হবে। এখন খাইয়ে দিয়ে যাই।’ বলে সে আকবরের মা কে ডাকে গলা উঁচিয়ে। আকবরের মা প্রায় সাথে সাথেই হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে হাজির হয়। নিনাদের ওখান থেকে ফিরে, নিজে ফ্রেশ হয়ে ছোটনকে খাইয়ে আকবরের মা কে সে বলেছিল তিতিক্ষারও খাবার দিতে। তাকে খাইয়ে তবেই আবার সে যাবে নিনাদের বাড়ি।

তিহা রুটি ছিড়তে ছিড়তে আড়চোখে তাকায় বোনের দিকে। তারপর সবজি নিয়ে তিতিক্ষার মুখে পুরে সতর্ক ভাবে বলে,’কাল যে এল আমাদের বাড়িতে একটা ছেলে। তাকে চিনতে পেরেছিলি তুই?’
বোনের দিকে তিতিক্ষার খেয়াল নেই তখন। জানালার বাইরে গাছের ডালে বসে থাকা কি একটা পাখির দিকে তার নজর। ওদিকে তাকিয়েই সে সরল গলায় বলে, ‘কিভাবে চিনব? তাছাড়া তুমি না বললে ও কেউ নয়?’
তিহা থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিতে কিছুটা সময় লাগে তার। এর মাঝে আর কোন কথা না বলে সে খাইয়ে যায় বোনকে। তারপর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলে, ‘কাল তো এত ব্যাস্ত ছিলাম। অতকিছু ভেঙে বলার সময় কই! কিন্তু তাই বলে তুই চিনতে পারিস নি! কে ও?’
তিতিক্ষা বিরক্ত স্বরে বলে, ‘না।’
তিহা আবারও বেফাঁস কিছু বলবার আগে ধাতস্থ হয়। তারপর দায়সারা ভাবে বলে, ‘নিনাদকে চিনিস না তুই? আমার বন্ধু। দু’দিন পর পরই আসত এখানে। সেদিন না আমেরিকা গেল পড়তে। এর মাঝেই ভুলে গেলি! ও তো….’ তিহা থেমে যায়। সন্দিগ্ধ চোখে দেখতে থাকে বোনের মুখ। নিনাদের নাম শুনে তিতিক্ষা কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে না তো আবার!
তিতিক্ষা কিন্তু স্বাভাবিকই থাকে। অনেকক্ষণ ধরে সে ভাবে কিছু একটা নিয়ে। তারপর হঠাৎই চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটে ওঠে তার। সে অস্থির হয়ে বলে, ‘আর খাব না বুবু, তুমি এখন যাও এখান থেকে।’ বলে বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তিহা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সেই গমন পথের দিকে। তারপর হতাশ মুখে উঠে পা বাড়ায় বাইরে।

_________________________
নিনাদের ঘুম ভাঙে প্রচন্ড গরমে। জ্বর গায়ে, ঘুমের রেশ লাগা বোজা বোজা চোখে প্রথমে সে কিছু বুঝতে পারে না। ভাবে আমেরিকাতেই আছে এখনো। তবে এত গরম কেন লাগছে? এমনিতে শীতের প্রকোপে তো টেকা দায়। রুম হিটার ছাড়া চলে না এক মুহুর্ত, তবে হঠাৎ এত গরম…। নিনাদ চোখ খুলে দেখে গায়ে তার কাঁথা জড়ানো। পড়নের টি-শার্ট টা ঘেমে ভিজে একাকার। কাঁথা সরাতে সরাতে ঘরের দিকে সহসা চোখ পড়তেই সে চমকে ওঠে। এটা তোর তার গুড স্ট্রিটের বাড়িটা নয়। তারপর অনেকটা সময় লাগে তার ধাতস্থ হতে। সে বুঝতে পারে এখন সে আছে বাংলাদেশে, তার নিজের ঘরে। আমেরিকা থেকে ফিরেছে সকালের ফ্লাইটে। সবকিছু বুঝতে পারা মাত্র মুহুর্তে নিনাদ অস্থির হয়ে ওঠে। যে কারণটা তাকে সময়ের আগে জোর করে টেনে নিয়ে এসেছে এখানে, সেটা মনে হতেই শুরু হয় এই অস্থিরতা। নিনাদ বিছানা ছেড়ে উঠতে চায়। কিন্তু শরীর বেঁকে বসে। তখন সে খেয়াল করে ঠিক মত উঠে বসবার শক্তিও তার নেই। মনের জোরের সাথে সাথে দেহের জোরও কোথায় হারিয়ে গেছে। আর কিছু ভাবার আগেই দরজার নব নড়েচড়ে ওঠে। যে এগিয়ে আসে তাকে দেখে নিনাদের বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেড়োয় শুধু। সে গন্তব্যহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনে। তিহা বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে এসে বসে। তার মুখ দেখে মনে হয় এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী ও অপরাধী মানুষটা সে।

নিনাদ একটু উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। তাকায় তিহার দিকে। তিহা চোখ তুলতেই সে হালকা হাসে। শান্ত স্বরে বলে,’কেমন আছিস?’
প্রতুত্তরে মলিন মুখে তিহা শুধু মুচকি হাসে। নিনাদও কিছু না বলে বালিশে হেলে পড়ে। তার দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ তিহার কানেও পৌঁছায়। যা ভেঙে দেয় তিহার মনে বেঁচে থাকা বাকি জোর টুকু। দুজনে নিরব থাকে অনেকক্ষণ। তিহা অস্থির ভাবে নিজের হাত কচলাতে থাকে কেবল। তার বেপরোয়া মন আর বাঁধা মানতে চায় না। সহসা সে অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে। ‘নিনাদ’
নিনাদ পাশ ফিরে তাকায়।
তিহা কিছুটা থেমে করুন স্বরে বলে, ‘মাফ করে দিস আমায় নিনাদ। আমার জন্যই সম্ভব হয়েছে সবটা। আমার লোভের জন্য, বেশি চাহিদার জন্য। ভালো ঘর পেয়ে, চেয়েছিলাম ওকে পার করে দিতে। কিন্তু….. ‘
মাঝপথে নিনাদ ওকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘থাক ওসব কথা। আমি অবুঝ নই। তোকে কখনোই দায়ী করতে পারি না এসবের জন্য। যা ঘটে গেছে, সেটা ঘটারই ছিল। আর, আমি কেই বা ওর! কেন কৈফিয়ত দিচ্ছিস আমার কাছে?’
তিহা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। যেন সে হারিয়ে ফেলেছে সব শব্দকে। কথা বলবে সে কি করে?
নিনাদ মাথা নুইয়ে কিছু ভাবে, গম্ভীর হয়। তারপর মেঘ স্বরে বলে, ‘আমাদের সম্পর্কের নীড় যেখানে, সেখানেই আমরা ফিরে যাই। আমরা দুজন ভালো বন্ধু সেই ছোটবেলা থেকে। বন্ধুত্বটা ভালো থাকুক। বন্ধুত্বে যেটুকু চলে, সেটুকুই চলুক। আর সব বাদ যাক। তোর পরিবার শুধু তোর, আর আমার পরিবার… ‘ নিনাদ থেমে যায় হঠাৎ। সত্যিই কি তার কিছু আছে পরিবার বলতে? খানিক থেমে সে বলে,’আমার ব্যাক্তিগত যা কিছু, সেসব শুধুই আমার। এখন থেকে আমরা দুজন শুধু ভালো বন্ধু। আর কিছু না।’ বলে সে মুচকি হাসে।
তিহা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে নিজের বন্ধুর দিকে। আহত গলায় কেবল উচ্চারণ করে, ‘নিনাদ।’
নিনাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে, কিছুই যেন হয়নি এমন ভঙ্গিতে অবাক হবার ভান করে বলে, ‘একি! আমি তো খেয়ালই করি নি এতক্ষণ। কি অবস্থা হয়েছে তোর! মুখ শুকিয়ে, চোখের নিচে কালি পরে গেছে। বরের হাতে মার খেলে মেয়েদের মুখ এমন হয়। রওশান ভাইকে কি আজকাল বউ পেটানোর রোগে ধরল নাকি?’
তিহা হাসে। এমন ভাবে তাকায়, যেন সে দেখছে কাছে বসে থাকা খুব দূরের কোন মানুষকে। এতটা দূরের, যে তার সাথে শুধু সুখের দিনে দু একটা খোশগল্পই বলা চলে। দুঃখের দিনের একফোঁটা অশ্রুর বিসর্জন সেখানে প্রহসনের মত শোনায়!

তবুও তিহা নিজের দায় এড়ায় না। শিউলি বেগম আর আফরিন দুজনেই অনুষ্ণ ধরনের মানুষ। তাদের কেবল মুখেই রা। কাজের বেলায় ততটা শক্ত নন। তাই তিহাকে তারা সেদিন অনেক বেলা পর্যন্ত আটকে রাখেন জোর করে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিহার সন্ধ্যে পেড়োয়। গেট পেড়িয়ে উঠোনে পা রাখতেই দেখে মারুফ সাহেব ছোটনকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন উঠোন জুড়ে। সে এগিয়ে যায়। কিছুটা রাগি স্বরেই বলে,’ বাবা, এই ভর সন্ধ্যে তে তুমি ওকে নিয়ে বাইরে কেন ঘুরছ? তাছাড়া তিতিও তো ঘরে একা রয়েছে।’
মারুফ সাহেব শান্ত গলায় বলেন,’তিতি মা’র আজ হঠাৎ যে আবার কি হল। তুমি যাওয়ার পর থেকেই খুব চিৎকার চেচাঁমেচি করছে। দরজাও বন্ধ করে রেখেছে, খেলও না কিছু সারাদিন। কেমন যেন হয়ে গেছে মেয়েটা। কথা শোনে না একদম। ছোটন ভয় পাচ্ছিল সেসব দেখে। তাই…’
তিহা চিন্তিত মুখে বলে, ‘ওহ, তাই নাকি? আচ্ছা চল ভেতরে। আমি দেখছি কি করা যায়। ‘

তিহার অনেক আর্জি-অনুরোধের পর দরজা খোলে তিতিক্ষা। তিহা ভেবেছিল নিশ্চয়ই ঘরে বসে কোন অনর্থ বাঁধিয়েছে মেয়েটা। হয়তো ভাংচুর করেছে আবারও। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তার ধারনা পাল্টে যায়। সে ভেতরে পা বাড়াতেই তিতিক্ষা এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তিহা একটু কেঁপে ওঠে। মুখের কাঁচা ক্ষত গুলোর ওপর খামচিয়ে সেগুলোর অবস্থা করুন করে ফেলেছে মেয়েটা। দু এক জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে ওখানেই। তিহা তাকিয়ে থাকে বোনের মুখের দিকে। তিতিক্ষা তাকে জড়িয়ে ধরে হিচকি তুলে কাঁদছে। সে হাত রাখে বোনের মাথায়। চাপা স্বরে বলে, ‘কি করেছিস!’
তিতিক্ষার খেয়াল নেই সেসবে। সে গুমরে কাঁদতে কাঁদতে অসহায় মুখে বলে,’ আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন বুবু? আমি শ্বাস নিতে পারছি না। শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরা জ্বলছে। নিজের গলা কেটে ফেললেও বোধহয় কারো এত যন্ত্রণা হয় না। আমি কি মারা যাব বুবু? আমি বোধহয় মারাই যাচ্ছি। এখানে আর কোন সুখ নেই। মরেই আমার শান্তি। আমাকে একটু শান্তি দাও।’
তিহা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তিতিক্ষার দিকে। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে অনবরত। সে হঠাৎ তিতিক্ষার হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। আর যে নিতে পারছে না সে। কত আর সওয়া যায়?
ঘর থেকে বেড়িয়ে তিহা আবারও থমকে দাঁড়ায়। তার বাবার মারুফ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে, পাথরের মূর্তির মত। কিন্তু মূর্তির চোখে কি কখনো জল ঝরে? মারুফ সাহেবের চোখ বেয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। তিহাকে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি এবার কথা বলেন। করুন স্বরে বলেন,’ তিহা, কারো কষ্ট যখন জীবনের সকল কিছুর থেকেও প্রবল হয়ে ওঠে তখন তার জন্য মৃত্যুই হয় শ্রেয়, মুক্তির একমাত্র উপায়। এসো, তিতিক্ষাকেও আমরা মুক্তি দিই।’
চলবে…….

অদ্রিজা আশয়ারী

দূর আলাপন
পর্ব-১৬
______________
তিহা আহত চোখে তাকায়। কাছে গিয়ে হাত ধরে মারুফ সাহেবের। নিচু স্বরে বলে, ‘ কি বলছ বাবা? এসব কি বলছ তুমি? ভালো-খারাপ সবই তো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদেরই পরীক্ষা নেন বেশি। দেখেন সেই বান্দার ধৈর্য কতটুকু। এই দুঃসময় টা একদিন ঠিক কেটে যাবে। আল্লাহ দুঃখ যেমন দিয়েছেন, তেমনি সুখও দেবেন। তবে কেন তুমি বলছ এসব কথা! সারাজীবন তুমিই না আমাদের শিখিয়েছ কিভাবে সবর করতে হয়, অনেক অল্পেই কিভাবে সন্তুষ্ট থাকা যায়?’
মারুফ সাহেব অসহায় মুখে মেয়ের দিকে তাকান। তার মেয়ে কি সুন্দর বুঝদারের মত কথা বলতে শিখেছে, ঠিক যেরকমটা একসময় তিতিক্ষা বলত। অথচ তিনি নিজে এই পরিনত বয়সে এসেও আজ কিরকম ভেঙে পড়েছেন। দিনরাত চোখের জল ফেলছেন চিন্তায়, এসব দেখে দেখে।
তিহা ফের বলে, ‘তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না বাবা। তাহলে আমি একা কিভাবে সামলাবো এতসব? ‘
মারুফ সাহেব চোখের চশমা খুলে সামনে এগিয়ে যান। গিয়ে বসেন অদূরে রাখা চেয়ারে। তিহা বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়।
কিছুক্ষণ নিরব থেকে কপালে হাত রেখে কি যেন ভাবেন তিনি। তারপর উত্তেজিত হয়ে মেয়েকে বলেন,’ তিহা, এসো যেভাবেই হোক আমরা তিতির একটা বিয়ের ব্যাবস্থা করি।’
তিহা হতাশ মুখে বলে,’ কে করবে ওকে বিয়ে বাবা? সবকিছু জানার পর, এইযুগে কেউ কি রাজি হয়? ‘
মারুফ সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেন। কিন্তু আবার নতুন উদ্যমে বলেন,’ না হোক আমার মেয়ের বড় ঘরে বিয়ে। আমরা নাহয় অসহায় কাউকে একটা খুঁজে এনে ওর সাথে বিয়ে দেব। দুজনকে রাখব এবাড়িতেই। মেয়েটার জীবনে তাহলে সত্যি একটা গতি আসবে। নাহয় এভাবে আর কতদিন? আমারও তো বয়েস হয়েছে। কদিনই বা আর বাঁচব? তারপর, কি হবে ওর?’
তিহা প্রতুত্তরে কিছু বলে না। কিছুক্ষণের জন্য ভাবুক হয়ে ওঠে সে। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে ‘হুম’ বলে সে চলে যায় নিজের ঘরে।

এই নিয়ে তিহা অনেক ভাবে এরপর। নিনাদ তাকে মিষ্টি ভাষায় যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে সেদিন, তারপর আর ওর কথা ভাবা যায় না। অথচ এই নিনাদ একসময় কত পাগল ছিল তিতিক্ষার জন্য। যেকোনো পরিস্থিতিতে সে রাজি ছিল তিতিক্ষাকে বিয়ে করতে। তিহা বোঝে নিনাদ কষ্ট পেয়েছে। সবকিছু জানার পরও যেভাবে সে নিনাদকে রেখে অন্য কারো কাছে সপে দিচ্ছিল নিজের বোনকে। সেই ব্যাপার টা কষ্ট দিয়েছে তাকে। কিন্তু তাই বলে আজ এই দুঃখের দিনে সেসব কথা ধরে বসে থেকে, নিজে থেকে সবকিছু শেষ করে দেয়া। তা-ও কি ঠিক? কিন্তু নিনাদ তো করল তা-ই। তিহা তাই শেষে যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখে মারুফ সাহেবের কথাগুলো। একবার সংসার জীবনে ঢুকে পরলে তিতিক্ষা সত্যিই হয়ত ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবতা মানুষকে চিনিয়ে দেয় অনেককিছু, জীবনটা কত জটিল, তার অলিগলি গুলো কত প্যাচানো তা মানুষ বুঝতে পারে সহজে। তিতিক্ষাও হয়ত সংসারে পড়ে বদলে যাবে। কত লোকেরই তো পরিবর্তন হয় এভাবে।

এরপরের দিনগুল ভীষণ ব্যাস্ত কাটে তিহার, তিতিক্ষা কে নিয়ে। প্রতিনিয়ত তিতিক্ষা কে সে বোঝাতে থাকে জীবন কোন ছেলেখেলা নয়। এভাবে দিনের পর দিন কাটতে পারে না একটা মানুষের। তিতিক্ষা কখনো বোঝে সবই, মাথা নেড়ে সায় জানায়, কখনো আবার অবুঝ হয়ে ওঠে ভীষণ।
এরমধ্যেই একটা ছেলে দেখা হয়। পিতামাতা হীন গরিব ছেলে। শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করে রোজগার করে যা দু’পয়সা। থাকে মেসে।
ছেলেটি সবকিছু জেনেই রাজি হয়। মারুফ সাহেব আশাবাদী হয়ে ওঠেন। এবার যদি হয় মেয়েটার একটা গতি…..।
তিতিক্ষার সাথে কথা বলার জন্য একদিন ডেকে পাঠানো হয় ছেলেটিকে। তিহা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বোনকে নিয়ে হাজির হয়। প্রথমে স্বাভাবিকই থাকে সে। কিন্তু ছেলেটির নাম শোনা মাত্রই তিতিক্ষা খেপে ওঠে হঠাৎ। সামনের টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট ছুড়ে মারে সে ছেলেটির কপালে। কপালে রুমাল চেপে রক্ত মুছতে মুছতেই বাড়ি ছাড়ে ছেলেটি। তিতিক্ষাই তাকে বাধ্য করে বাড়ি ছাড়তে। পরবর্তীতে সে জানতে পারে তার অমার্জনীয় অপরাধ হল তার নামটা। রাজন। অতএব মারুফ সাহেবকে এই সম্মন্ধের আশাও ত্যাগ করতে হয়।
এবার তিহা এবং মারুফ সাহেব উভয়েই ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান। এভাবেই যদি ছোট ছোট কারনে তিতিক্ষা পেছাতে থাকে, তাহলে আদৌও ওর বিয়ে হবে কিনা সন্দেহ। নিজে তো সে সম্পুর্না নয়। তবে কিসের অত বাছবিচার! তারাও অবশেষে বিরক্ত হয়ে ওঠেন।

সেদিন বিকেলে তিহা তখন চা করছিল রান্নাঘরে। ছোটন উঠোনে খেলছে। মারুফ সাহেব পত্রিকা পড়ছিলেন সোফায় বসে। তিতিক্ষা নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিল। সে অনেকটা সুস্থ এখন। আজকাল আর পাগলামি করে না যখন তখন। দিনরাত ব্যাস্ত থাকে এটা সেটা নিয়ে। হয় বই পড়া কিংবা কুরআন তিলাওয়াত অথবা সেলাই। তিহা আর মারুফ সাহেবের জোরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে সে এখন। কিন্তু এখনো বেঁকে বসে ওই এক জায়গাতেই। বিয়ের কথা বললেই সে অযথা ভীষণ গম্ভীর হয়ে ওঠে।
মেয়েকে নিয়ে মারুফ সাহেবের দুশ্চিন্তা তাই কমে নি এখনো।

সেই শেষ অপরাহ্নে, সবাই যখন ব্যাস্ত নিজেদের কাজে তখন বাইরেই দরজায় একটা আওয়াজ ওঠে। কেউ বেশ শব্দ করেই উঠোনের শেষ মাথার লোহার গেইট খুলে এসে ঢোকে বাড়িতে। তিহা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঁকি দেয় সেদিকে। তখন আফরিন উঠোন পেরিয়ে এসে হন্তদন্ত হয়ে দাঁড়ায় কাঠের দরজা আগলে। তিহা তাকে দেখে অবাক হয়। বলে,’ আফরিন, তুমি হঠাৎ?’
আফরিন চিন্তিত মুখে সসংকোচে উত্তর করে,’ অনুরোধ, আপনি একবার আসেন আমার সাথে। নিনাদ ভাইয়ের কি জানি হইসে। এতদিন হয়া গেল এখনো তার জ্বর কমল না। ডাক্তারও দেখায় না, ওষুধও খায় না। সারাদিন দোর দিয়া বইসা থাকে ঘরে। আর রাত হইলেই খালি আবোলতাবোল কয়।’
তিহার কপালে ভাজ পড়ে, ‘তুমি আমাকে একটা কল করলেই তো পারতে আফরিন। এতদূর কষ্ট করে একা আসতে হত না। ‘
আফরিন স্বভাবমত শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে ইতস্তত করে বলে, ‘নিনাদ ভাই তার ফোন, সিমকার্ড সব ভাইঙ্গা ফালাইসে সেইদিন। আমার আর চাচির ফোন থাইকাও ডিলিট কইরা দিল আপনেগো নাম্বার। তারপর আজকে নিজেই আমারে কইল আপনারে নিয়া যাইতে। তাই…… দয়া কইরা আপনে একবার আসেন আমার সাথে।’
আফরিনের কথা শেষ হতেই তিহা দৌড়ে যায় ঘরে। মুহূর্ত পরেই বেরিয়ে আসে গায়ে বোরকা জরিয়ে। বলে, ‘চল।’

নিনাদের বাড়ি পৌঁছাতেই শিউলি বেগম তিহাকে দেখে ছুটে আসেন। করুণ স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,’ ও মায়া, আমার নিনাইদ্দার কি হইল একটু দেহো না। কেমন জানি হয়া গেসে ছেরাডা। আমার কথা একদম শুনে না। সারাদিন বইসা থাকে ঘরের দরজা বন্ধ কইরা। কিছু কইলে খালি হাসে। আমারে কইতে চায় না কোনকিছু। তুমি কথা কউ তার লগে। হেরে বিয়ার দিবার চাইতাছি যহন থাইকা তহন থাইকাই এমন অদ্ভুত আচরন করতাসে ছেরাডা। ওরে তুমি কউ তার কাউরে পছন্দ থাকলে আমারে কউক। ও যা চায় তাই হইব। আমি ওর পছন্দের মাইয়ার লগেই ওরে বিয়া দিমু।’
তিহা হালকা হেসে বলে, ‘আপনি অত ভাববেন না ফুআম্মা। আমি দেখছি। কি ব্যাপার।’ বলে সে এগোয় নিনাদের ঘরের দিকে।

নিনাদের ঘরের সামনে এসে তিহা ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পরতেই পেছন থেকে আফরিন সাথে সাথে বলে ওঠে ,’ খারায়া রইছেন কেন? নিনাদ ভাই কিছু মনে করব না। আপনি ভেতরে যান।’
তিহা পা বাড়ায়। ভেতরে গিয়ে দেখে নিনাদ চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায়। তাকে দেখেই সে ত্বরিতে উঠে বসে। মুখে কিছু বলে না। কেবল চোখ তুলে তিহাকে ডিঙিয়ে সে তাকায় পেছনে দাঁড়ান আফরিনের দিকে। আফরিনের সামনে নিনাদ কথা বলতে সংকোচ করছে দেখে তিহা ঘাড় ঘুড়িয়ে আফরিন কে বলে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসতে। ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আফরিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। ফিরে এসে রেখে যায় এক গ্লাস পানি।

পুরো ঘরে আলো আঁধারির আবছা জাল বিছানো। নিনাদ অপরাধীর মত মাথা নুইয়ে বসে আছে বিছানায়। তিহা আড়চোখে একবার তাকায় সেদিকে। নিনাদকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ অসুস্থ। মুখও কেমন বিষাদে পূর্ণ যেন তার।
তিহা একটা চেয়ার টেনে বসে বিছানা থেকে কিছুটা দূরে। স্বাভাবিক গলায় কথা শুরু করে। কোনরকম সৌজন্যতা না দেখিয়ে সরাসরি বলে,’ কেন ডেকেছিস বল।’
নিনাদ মুখ তোলে না। কয়েক মুহূর্ত কিছু যেন ভাবে। তারপর ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে,’আমি সত্যিই দুঃখীত তিহা। তখন মাথার ঠিক ছিল না। তিতিক্ষা কে নিয়ে তুই কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস সেটা না বুঝেই আমি সেদিন কষ্ট দিয়েছি তোকে।’
তিহা ইতস্তত করে বলে, ‘না না, কিছু মনে করি নি আমি সেসবে।’
নিনাদ মলিন হেসে বলে,’আমি জানতাম। তুই কখনো আমাকে ভুল বুঝতেই পারিস না। তুই হলি আমার বোন। ভাই অপরাধ করলেই কি বোন তাকে ছেড়ে দিতে পারে? তিহা শোন, আমি খুব কষ্টে আছি। আমি খেতে, ঘুমাতে পারি না। সব আমার থমকে আছে। একা থাকলেই শুধু একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। আচ্ছা তিহা, আমার একটা অনুরোধ রাখবি? একবার নিয়ে যাবি আমাকে তোদের ওখানে? আমি সত্যিই…. ‘
তিহা হঠাৎ থামিয়ে দেয় তাকে। তারপর নিজেই বলে চাপা স্বরে, ‘হ্যাঁ, যাব তোকে নিয়ে। তার আগে বল কেন তুই এমন করছিস? শিউলি ফুআম্মার পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কেন তোর এত বিতৃষ্ণা? তোর চিন্তায় ফুআম্মার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছিস? তুই কি তাহলে এখনো তিতিক্ষাকেই বিয়ে করবি বলে ভেবে রেখেছিস?’ বলে সে কৌতুহলী চোখে তাকায় নিনাদের দিকে।
-‘চাইলেই কি রাজি হবে ও?’ নিনাদ মলিন কণ্ঠে বলে।
তিহা একটু অবাক হয়। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে থাকে নিনাদের দিকে। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তার গলায় আটকে থাকা কাঁটাটা যেন সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু নিজেকে সে সামলে নেয়। সহসাই গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে, ‘এখন তুই জ্ঞানে আছিস তো? ভেবে বলছিস সবকিছু? তিতিক্ষার সাথে যা ঘটে গেছে সেটা জানার পর ফুআম্মা কোনদিন ওকে মেনে নেবে বলে তোর মনে হয়? তাছাড়া আমার বোন জীবনে অনেক সয়েছে। এখন যদি আবার সবকিছু ঠিক হওয়ার পর ঝড় আসে, ও সামলাতে পারবে না।’

নিনাদ তীব্র স্বরে বলে, ‘তিতিক্ষার সাথে কি ঘটেছে সেসবে কিছু যায় আসে না আমার। আমি শুধু ওর পাশে থাকতে চাই। অহর্নিশ আমার শুধু মনে হয়, আমি এখানে থাকলে কখনো ঘটত না এমন কিছু। যদিও এই ভাবনাটা অযৌক্তিক। আল্লাহ যখন যা ঘটার লিখে রেখেছেন তা ঘটবেই।
তবুও আমি একটু শান্তি চাই। বাবা-মা কে হারানোর পর জীবনে আর কখনো আমাকে এত কষ্ট পেতে হয়নি। তুই তিতিক্ষা কে বল ও যা চাইবে তাই হবে। আমি শুধু ওর ছায়া হয়ে থাকব। এর বেশি আর কিছু চাইব না। শুধু সেটুকু নিশ্চিত হতে চাই, যেন জীবনে আর কখনো ঝড় না আসে।’ বলে নিনাদ থামে।
-‘আর ফুআম্মার ব্যাপার টা? ‘
-‘ফুআম্মা আমার জন্য সব মেনে নেবেন। নিশ্চয়ই রাজি হবেন।’
তিহা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। আঁধার রাত্রির নিগূঢ়তা পেরিয়ে আবার নতুন করে সেদিন সে আশার আলো দেখতে পায়।
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here