দূর আলাপন,পর্ব-৬,৭
অদ্রিজা আহসান
পর্ব-৬
অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল মাথা নুইয়ে। তিতিক্ষা একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘তোমাকে তুমি করে বলে ফেললাম। মনে করনি তো কিছু?’ আফরিন হেসে ডানে বামে মাথা নাড়ল। প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় মনে মনে বোধহয় খানিক স্বস্তিও পেল।
মাঝে হঠাৎ যে নিরবতা নেমে এসেছিল, দুজনের কেউই তাতে কিছু মনে করল না। হয়ত দুজনের একজনও ব্যাপার টা ঠিক ধরনেই পারেনি। কিছু মুহুর্তের জন্য দুজনই যেন ভাবুক হয়ে উঠেছিল সেসময়।
আবার সেই নিস্তব্ধতা ফিরে আসছে দেখে তিতিক্ষা নিজেই কথা শুরু করল এবার। পুরো আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘের রাজত্ব। মেঘেদের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে ভীষণ। তিতিক্ষা আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে ওড়না টা আরেকটু ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,’তোমার বয়স কত আফরিন?’ খানিক থেমে বলল, ‘কিছু মনে কর না। এভাবে নাম ধরে ডাকছি তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভুল হয়ে থাকলে যেন শুধরে নিতে পারি।’
-‘কিছু মনে করি নাই আমি। আমার বয়স আসলে কত তা আমি নিজেই জানি না ঠিকমতো। তবে চাচি কইছে এই পৌষে আমার বয়স ঊনিশে পরব।’
-‘তাহলে ঠিক আছে। তুমি বয়সে আমার কিছুদিনের ছোটই হবে। শুধু আফরিন বলেই ডাকা যায় তোমায়। ‘বলে তিতিক্ষা ম্লান হাসল।
হাসল আফরিনও। বলল,’আপনি খুব ভালা মানুষ। আর নিনাদ ভাই কি না কিই কইছিল আমারে আপনের কথা……’
তিতিক্ষা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,’কি বলেছিল তোমার নিনাদ ভাই? ‘
আফরিন ফের শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে বলে,’কইতো, আমি যেইখানে থাকি ওইখানে একটা নাগিনী আছে বুঝলি। আমারে দেখলেই খালি হিস্ হিস্ কইরা ফণা তুইলা ছোবল দিতে আসে। একেবারে কালনাগিনী সাপ। উউহ….কি ভয়ংকর! দেখলেই ডর লাগে আমার।’ কথার মাঝখানেই হঠাৎ থেমে মেয়েটি দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। ‘ছিঃ! ছিঃ! কিসব কইতাছি আমি! কিছু মনে কইরেন না আপনে। আমার মুখের লাগাম নাই। বড় বেহায়া মুখ আমার।’
দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে তিতিক্ষা বহু কষ্টে একটু হাসল। বলল,’শুধু এসবই? ভালো কথা কি কিছু বলে না আমার নামে?’
আফরিন অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’হু, কয়তো। ভালো কথাও কয়। বাড়িতে গেলে হে সারা দিন-মান আপনাগো কথাই খালি কইতে থাকে ঘুইরা-ফিরা।’
-‘তোমার সাথে বুঝি নিনাদ ভাইয়ের খুব ভাব?’
আফরিন লাজুক হেসে উত্তর দেয়,’হু, বাড়িতে গেলে তো নিনাদ ভাই সারাদিন আমার সাথেই গপ করে। আর কত কিছু নিয়া যায় আমার লাইগা…. ‘
তিতিক্ষা হঠাৎ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যার জানার সব জানা হয়ে গেছে তার। সকলকে দেখিয়ে বেরানো নিনাদের ভালোমানুষির পেছনে আসল রূপ তবে এই!
আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে তিতিক্ষা হঠাৎ ব্যাস্ত কণ্ঠে বলে,’ভেতরে যাই চল। বৃষ্টি নামবে এখনই।’ তারা ঘরে ফিরে আসে। তিহা কিংবা শিউলি ফুআম্মা কেউ তখন আর নেই সেখানে। রান্নাঘর থেকে কথা ভেসে আসছে। আফরিন সেদিকে পা বাড়ায়। তিতিক্ষাকে আসতে বললে সে বলে, ‘আসরের আযান দিয়েছে। নামায পড়ে তারপর যাই। তুমি নামায পড়বে না?’
আফরিন সহসা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইতস্তত হেসে বলে,’মাঝে মাঝে তো পড়ি। আচ্ছা, খারান ওযু কইরা আসি।’
বাড়িতে প্রতিটা বিকেল তিতিক্ষার কাটে ছোটনের সাথে। হোক ঘুম, খেলা কিংবা ঘুরাঘুরি। বিকেল হলেই তিতিক্ষাকে ছোটনের চাই। তিতিক্ষা নামায শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছোটনের খোঁজে এদিক সেদিক তাকায়। এবাড়ি আসার পর থেকে ছোটনের দেখা আর পায় নি সে। একঝলক না দেখলে মন এখন শান্ত হবে না আর। তিতিক্ষা সামনের ঘরে উঁকি দেয়। নাহ, আর কেউ নেই। ছোটন একা ঘুমিয়ে আছে বড় সোফাটায়। তিতিক্ষা তার পাশে এসে বসতেই দরজার নব নড়েচড়ে ওঠে। খুলে যায় দরজা। নিনাদ মাথা থেকে টুপি নামিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে ভেতরে আসে। তিতিক্ষা কে যেন সে দেখেই নি, এমনি ভাবে সে আফরিনকে ডাকতে থাকে। অদূরে বসে তিতিক্ষা সহসা ঘোমটার আড়াল থেকেই আড়চোখে সেদিকে চায়। এই দুজনের ব্যাপার টা কি, আজ সে দেখে তবে ছাড়বে। আফরিন এগিয়ে আসতেই হাতে থাকা ঠোঙা টা সে আফরিনের হাতে দিয়ে ঘুরে দরজা লাগাতে উদ্যত হয়। আফরিন সেখানে দাঁড়িয়েই ঠোঙা খোলে। ভেতরে জিলাপি দেখে ভ্রু কুচকে বলে,’ওমা, এত জিলাপি কেন্ আনছেন?
জিলাপি না আপনের দুই চোক্ষের বিষ। সাপের মত নাকি দেহা যায়? তাইলে আজকে আবার কি হইল?’
নিনাদ এসব কোনো কথার উত্তর না দিয়ে আফরিনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে চলে গেল সেখান থেকে। আফরিন দৌড়ে ফুআম্মার কাছে চলে যায়। সেখানে গিয়েও বলে একই কথা ।
জিলাপি দেখে যদিও তিতিক্ষার চোখ চকচক করে উঠেছিল ক্ষনিকের জন্য, তবু সে নিজেকে সামলে নিল। হতাশ হয়ে মুখ ফেরাল সেদিক থেকে। ছোটনের মাথায় এলোমেলো আঙুল চালাতে লাগল। নাহ! তার চাওয়া মতো কিছুই হল না। ভেবেছিল নিনাদ, আফরিনের কথায় অস্বাভাবিক কিছু অবশ্যই থাকবে। আর সে খপ করে হাতেনাতে ধরে ফেলবে তাদেরকে। অথচ নিনাদ তো কথাই বলল না। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল গটাগট হেঁটে। তিতিক্ষা হঠাৎ ভাবে, ব্যাপার টা এমন নয় তো, যে তাকে দেখেই নিনাদ এই মাত্রাতিরিক্ত নির্লিপ্ততা দেখাল! সে-ই তো ওর স্বভাব। নইলে কি আর ভার্সিটিতে শ’খানেক ললনা সামলাতে পারে একাই?
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। তিতিক্ষা, তিহা দুজনেই চিন্তান্বিত। এই বৃষ্টি না থামলে তারা আজ ফিরবে কি করে! এদিকে সন্ধ্যে হয়ে এল। বাবা বাড়িতে একা আছেন। তিহা, তিতিক্ষা, ছোটন এই তিনটি প্রাণীর চিন্তান্বিত মুখের দিকে চেয়ে খানিক করুণা করেও বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখাল না। তিতিক্ষা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠল। একে তো বাবার চিন্তা তার ওপর বিকেলের সেই ব্যাপার টার পর থেকেই তার মন কেমন বিষিয়ে উঠেছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরার কথাও ভাবল দুএকবার! সন্ধ্যার প্রায় এক প্রহর কেটে যাবার পর অর্থাৎ রাতের প্রথম প্রহরে বৃষ্টি তার গতিতে কিছুটা লাগাম টানল। একে তো বৃষ্টি, তার ওপর আবার ছুটির দিন। সেজন্যই বোধহয় রাস্তাঘাট অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা ছিল। নিনাদ তাদের একা ছাড়তে পারল না এই অবস্থা দেখে। একটা ক্যাব ডেকে এনে সে নিজেও উঠে গেল তাদের সাথে।
বাড়ির সামনে ক্যাব থামতেই সবার আগে তিতিক্ষা বেরিয়ে বৃষ্টির মাঝেই গটাগট হেঁটে ভেতরে চলে গেল। পেছন ফিরল না একবারও। ঘরে এসেই দ্বোর বন্ধ করল সে।
তিহা একপ্রকার জোর করেই নিনাদ কে নিয়ে এল ভেতরে। সেই ভিজেছে সবচেয়ে বেশি। ক্যাবের খোঁজে তখন রাস্তায় নামতে হয়েছিল তাকে।
তিতিক্ষার ঘরের সামনে এসে বিরক্তি মেশানো স্বরে ব্যাস্ত হয়ে তিহা বলল,’এখন দরজা বন্ধ করলি কেন আবার? ছেলেটা ভেজা গায়ে বাইরের ঘরে বসে আছে। গামছা-টামছা কিছু একটা দে। এদিকে ছোটনের মাথাও ভিজে গেছে। আজই না আবার জ্বরে পড়ে। ওর বাবা আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে জানলে….।আমি যাই ওর মাথা মুছি গিয়ে। ‘
তিতিক্ষা বাধ্য হয়ে পানসে মুখে দরজা খুলল। দেয়ালের এপাশ থেকেই তোয়ালেটা ছুড়ে মারল নিনাদের সামনের সোফায়। সাথে সাথে ঘুরে হাটা ধরল রান্নাঘরের দিকে। চুলা ধরিয়ে কেতলিতে পানি বসাল চায়ের জন্য।
নিনাদ বসার ঘরে একাই বসে ছিল। তার চুল, দাড়ি বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পড়নের সাদা পাঞ্জাবি টাও ভিজতে বাকি নেই। এই ভিজে জবজবে শরীরে অন্যের বাড়িতে, অন্যের সোফায় বসতে খারাপ লাগে। কিন্তু না বসে উপায়ও নেই। নাহয় এ নিয়েও তিহা ঠিক ঝগড়া বাঁধাবে তার সাথে। নিনাদ যখন ভিজে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে এসব ভাবছিল তখনই আচমকা তোয়ালেটা তার সামনের সোফায় এসে পড়ে। নিনাদ একমুহূর্তের জন্য ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। তারপর বুঝল এটা ছোট গিন্নির কাজ।
মাথা মুছতে মুছতেই নিনাদের নাকে এসে লাগল দার্জিলিং থেকে আনানো প্রকট সুঘ্রাণ বিশিষ্ট চা পাতার গন্ধ। বৃষ্টির ভেজা গন্ধ যেন সেই ঘ্রাণকে আরও প্রবল করে তুলছে। এই চা-পাতার ঘ্রাণ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা চামচ নাড়ানোর ক্ষীণ আওয়াজ, ঘরের থমকে থাকা আবহাওয়া নিনাদকে বারবার এখানে আসতে বাধ্য করে। তার ওই নির্জন কুটিরে তো এমন সুখ নেই! কিন্তু কিসেরই বা তার অভাব? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর ক্ষনে ক্ষনে নিনাদের কানে এসে ঠেকে। সে হল ‘মানুষের অভাব’। তার ঘরে মানুষ নেই। এমন কেউ নেই যে দিনভর হেঁটে বেড়াবে চারিদিক জুরে, রাগ করে রান্নাঘরে ধুপ ধাপ আওয়াজ তুলে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করবে সময়ে অসময়ে, এমন বৃষ্টির দিনে এভাবেই দার্জিলিং টি বানাবে, চামচের টুংটাং শব্দ তুলে বাড়িঘর মুখরিত করবে। নিনাদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে।
তিতিক্ষাদের ওবাড়ি থেকে আসার দুদিন পর একরাতে মারুফ সাহেব মেয়েকে ডেকে পাঠালেন কথা বলার জন্য। ঘরের মানুষের গোপন বৈঠকও বলা যায়। যতই হোক তিহা এখন বিবাহিত। এবাড়িতে সে মেহমান। তাই সব বিষয়ে তাকে জরানো ঠিক নয়।
রওশানের মতো মারুফ সাহেবও নিনাদে মুগ্ধ ছিলেন। বাবা মা হারা ছেলে বলে খানিক করুণাও এসে মিশেছিল সেই মুগ্ধতার সাথে। তিনি আরামকেদারায় শুয়ে এক হাতের ওপর অন্য হার রেখে গুনগুন করে কিসব ভাবতে ভাবতে মেয়েকে হঠাৎ একটা প্রস্তাব করলেন। ‘তিতি, নিনাদের ফুফু শুনলাম তোমাদের খুব যত্ন করে খাইয়েছেন সেদিন। তিহার সাথে নাকি খুব ভাব। এযুগে আজকাল এতটা কে করে বল?’
তিতিক্ষা বাবার পাশে বিছানায় বসে গম্ভীর মুখে বলল, ‘হু’
মারুফ সাহেব গুনগুন করে হাত নাড়াতে নাড়াতে ফের বললেন, ‘ নিনাদও চলে যাচ্ছে। ছেলেটাকেও তো একদিন এনে ভালো মন্দ খাওয়ানো দরকার। ওদের বরং দাওয়াত করে দিই আসার জন্য। কি বল?’
তিতিক্ষা সহসা মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। মুখ শক্ত করে মনে মনে বেজায় চটে গিয়ে বলল,’আবার সেই দাওয়াত! আমি মরে যাই, মরে যাই আমি!’
মারুফ সাহেব মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে বললেন,’কি হল তিতি! করে দেই দাওয়াত। কি বল?’
-‘হু, করো দাওয়াত। ‘
-‘নিনাদের ফুফু। ভদ্রমহিলা প্রথমবার আসবেন আমাদের বাড়িতে। দেখো যত্ন আত্তির ত্রুটি যেন না হয়। নিনাদও তো চলে যাবে বাইরে। সেখানে কি খায় না খায়। ওর যা যা পছন্দ সব জেনে নিয়ে তারপর রান্না করো। কেমন?’
-‘হু’
-‘আসতে বলি কবে বলত? পরশু? ‘
-‘তোমার যেদিন ইচ্ছে। ‘ হঠাৎ সাদা হয়ে ওঠা মুখ নাড়িয়ে মিনমিনে স্বরে তিতিক্ষা বলে। তারপর আচমকা উঠে পা বাড়ায় রান্নাঘরের দিকে। চাপা স্বরে বলে, ‘তুমি বসো বাবা। আমি চা নিয়ে আসছি।’
চলবে….
দূর আলাপন
পর্ব-৭
______________
সেদিন অপরাহ্নে আকাশে ভীষণ মেঘ করে হঠাৎ শুরু হওয়া শ্রাবণের সেই ধারা বর্ষন চলল অবিরত দু’দিন। এই ঘোর বর্ষার মাঝেই মারুফ সাহেব নিনাদকে বললেন শিউলি ফুআম্মা ও আফরিনকে নিয়ে আসতে। নিনাদ দুঃখ প্রকাশ করে জানাল এ সপ্তাহের শেষে তার ভিসা ইন্টারভিউ। কিছুটা পড়াশোনা আর প্রস্তুতির ব্যাপারও আছে। তাই চাইলেও আসতে পারছে না সে। শিউলি ফুআম্মা আর আফরিন শহরে নতুন। নিনাদ না এলে তাদের আসার প্রশ্নই ওঠে না।
মারুফ সাহেব দাওয়াতের দিন পেছালেন অবশেষে। আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার অর্থাৎ নিনাদ আমেরিকা যাওয়ার ঠিক পনেরো দিন আগে তিনি আসতে বললেন তাদেরকে। তিহা আর ছোটন ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। রওশানও আসবে সেদিন। তাদের মা-ছেলেতে খুশি যেন আর ধরে না।
কিন্তু দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল সবার আগ্রহ ফুরিয়ে আসতে লাগল তত। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর চলে যাবে নিনাদ। এরপর দীর্ঘ এক বছরের জন্য বিচ্ছেদ ও অপেক্ষা। এই এক বছর সময়টা যেন সামান্য ক’টা দিন হয়েও বড় দীর্ঘ মনে হতে লাগল সকলের কাছে। বহু আগে থেকেই সেসময়ের সমস্ত রসদ জোগারজন্তের ব্যাপার তিহা নিয়মিত তাড়া দিতে লাগল নিনাদ কে। রওশানও খানিক পর পর কল করে এই-সেই উপদেশ দিচ্ছে। কিভাবে চলতে হবে, কোনটা করা যাবে, কোনটা করা যাবে না সেসব নিয়ে জ্ঞান দিয়ে চলেছে দিনরাত।
রাতদিন নিনাদকে নিয়ে তিহা, রওশানের এই ক্রমাগত আদিখ্যেতা দেখে বিরক্তিতে তিতিক্ষার গা জ্বলতে থাকে।
-‘বিদেশ তো যাচ্ছে না, যেন রকেটে চড়ে মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে এলিয়েন খুঁজতে। ন্যাকামি দেখে মাথা ধরে গেল আমার। অসহ্য!’ সেসব দেখে মুখ ভেঙচিয়ে একথাই বলে তিতিক্ষা।
________________
-‘তিতিক্ষা, একবার এদিকে আয় জলদি।’
ড্রয়িংরুমের ফুলদানিতে জারভেরা ফুলগুলো রেখে তিতিক্ষা দ্রুত পায়ে বুবুর কাছে এল।
‘উঠোনের কোণের লেবু গাছটা থেকে লেবু পাতা ছিড়ে নিয়ে আয় দুটো। ‘
বোনের কথা শেষ হওয়া মাত্রই আজ্ঞা পালনে আবার সে ছুটল বাইরেই পানে। পেছন থেকে তিহা চেচিয়ে বলল, ‘দেখিস, সাবধানে যাস। পা পিছলে পরিস না যেন। বৃষ্টি পড়ে উঠোনের মাটি স্যাতঁস্যাঁতে হয়ে আছে ভীষণ। ‘ সেকথা তিতিক্ষার কান পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা বোঝা গেল না। সে উড়ে চলে গেল ।
কথা শেষ করে তিহা রান্নায় মন দিল। সকালে সে এসে ঢুকেছিল রান্নাঘরে। তারপর আর একবারও এখান থেকে বেরোনোর সুযোগ হয়নি। নিনাদ আসবে, তৃপ্তি করে একটু খাবে, তাতেই তার প্রাণ জুরাবে। কেউ না জানুক, সে জানে। নিনাদকে সে কতটা ভালোভাসে। কোনদিন নিজের আপন ছোট ভাই ছাড়া আর কিছু ভাবেনি নিনাদকে। নিনাদের খুশি তাই সবার আগে। সেটুকু হলে তার আর কি চাই !
হঠাৎ অস্ফুট একটা চিৎকারে তিহার ভাবনা ছুটে গেল। বাইরে থেকেই আসছে আওয়াজ টা। খানিকক্ষণ আগে তিতিক্ষাই না গেল সেদিকে!
তিহা বাইরে এসে দেখল তিতিক্ষা মাঝ উঠোনে বসে আছে একহাত বা-পায়ে চেপে ধরে। ব্যাথায় তার মুখ ফ্যাকাসে সাদা বর্ণ দেখাচ্ছে। তিহা কাছে এসে ভীত স্বরে বলল, ‘কি হল তোর? এভাবে বসে আছিস কেন?’
তিতিক্ষা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘পা মচকে গেছে।’
-‘হায় আল্লাহ! কিভাবে? এত করে বললাম বাইরে কাঁদা মাটি। সাবধানে হাঁটতে…। এখন আমি কি করি! আব্বাও তো বাড়ি নেই। ‘
তিহা বোনের কাছে বসে পড়ল,’বেশি মচকে গেছে?’
-‘জানি না, কিন্তু…. ‘
-‘খুব ব্যাথা করছে?’
তিতিক্ষা ফোপাঁতে ফোপাঁতে ওপর নিচ মাথা নাড়লো।
-‘আমার সাথে উঠে ঘরে যেতে পারবি না? একটু চেষ্টা করে দেখ।’
অনেকক্ষণের চেষ্টায় বোনের সাহায্য নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে তিতিক্ষা ঘরে এল। পায়ে বরফ লাগিয়ে, তিহা অস্থির হয়ে বারবার কল করতে লাগল মারুফ সাহেব কে। রান্না করতে এসে কিছু জিনিস নেই দেখে সে নিজেই বাজারে পাঠিয়েছিল বাবাকে। এখনো ফেরার নাম নেই। ফোনকলও রিসিভ করলেন না তিনি। তিহা ভীষণ অস্থির হয়ে এবার তার স্বভাবমত একটা কাজ করে বসল। বিপদে পড়লেই যা সে সবসময় করে। বাবাকে ফোনে না পেয়ে সে কল করল নিনাদকে।
নিনাদ ধানমন্ডিতে এসেছিল ছাত্র পড়াতে। তাকে পরিস্থিতি জানিয়ে দ্রুত ডাক্তার নিয়ে আসতে বলল তিহা। আধঘন্টা পর একটি ছেলেকে সাথে নিয়ে চিন্তিত মুখে নিনাদ এসে হাজির হল। তিহা দরজা খুলতেই শুষ্ক কণ্ঠে তাকে জিগ্যেস করল, ‘পা কি বেশি মচকে গেছে নাকি?’
পাশের ছেলেটিকে দেখে তিহার ততক্ষণে মেজাজ বিগড়ে গেছে। ভীষণ ফর্সা, লম্বা মত, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া ছেলেটি নিতান্তই বাচ্চা। এই বাচ্চা ছেলে কি চিকিৎসা করবে তার বোনের!
নিনাদকে ভেতরে টেনে এনে তিহা বিরক্তি মেশানো স্বরে ফিসফিস করে বলল,’কোথ থেকে এই বাচ্চা ছেলেকে ধরে এনেছিস তুই? এ করবে চিকিৎসা? ‘
নিনাদ রাগী স্বরে উত্তর করল,’তোর ‘কোলের আবু’ বোনের চিকিৎসার জন্য তো শহরের সব ডাক্তার লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে না? আমি যাব আর ধরে ধরে নিয়ে চলে আসব!
এ আমার পরিচিত ছোট ভাই। এদিকেই থাকে, ইন্টার্ন ডাক্তার। এঁকে নিয়ে গিয়ে দেখালে দেখা, নইলে বিদাই করে দেই।’
তিহার গলায় স্বর কোমল হল একটু । ‘আচ্ছা ঠিক আছে, রাগ দেখাচ্ছিস কেন! ওকে নিয়ে আয় ভেতরে। কিন্তু তিতিক্ষা কে তো জানিস, সব বিষয়ে কেমন গোঁড়ামি ওর। ডাক্তার দেখে এখন আবার কি বলে কে জানে!’
ডাক্তার আসছে শুনে তিতিক্ষা হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। ছেলে বেলা থেকেই ডাক্তারে তার ভীষণ ভয়। কান্নার শব্দ শুনে তিহা দৌড়ে এল ঘরে। নিনাদও আসছিল পেছনে। তিতিক্ষা রাগে, যন্ত্রণায় ফোসফাস করতে করতে বলল, ‘ডাক্তার ছাড়া আর কেউ যেন না আসে ঘরে। ‘
সেই ছেলেটিকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে নিনাদ তাই বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
চিকিৎসা করতে এসে সেই তরুণ ডাক্তার ছেলেটি দেখল রোগীর গোঁড়ামি সত্যিই আকাশচুম্বী!
অযথাই সে ফ্যাচফ্যাচ করছে ভীষণ। অবস্থা দেখে সে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে দিয়ে, আগামী তিনদিন বেড রেস্টে থাকতে বলে সে নিজের পথ দেখল তাড়াতাড়ি।
ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে এসে নিনাদ ফ্যাকাসে মুখে বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। তিহার হঠাৎ সেদিক খেয়াল হতেই ছুটে গেল নিনাদের কাছে। ইতস্তত করে বলল,’ তুই কি রাগ করেছিস তিতিক্ষার কথায়? জানিসই তো ও এমন। ঘাড় তেড়া। তুইও এখন এসব কথা ধরলে কি চলে! ‘
নিনাদ সেকথার জবাব দিল না। গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি এখন যাই।’
তিহা ব্যাস্ত হয়ে বলল-‘আচ্ছা যা, দুপুর তো হয়েই এল। দেরি করিস না আর। ফুআম্মা আর আফরিনকে নিয়ে চলে আয় তাড়াতাড়ি।’
-‘আজ থাক। এমনিতেই তিতিক্ষার পা মচকে গেছে। একটা বিপদ হল এর মাঝে আবার…… ‘
তিহা একটু অবাক হয়ে চাইল বন্ধুর দিকে। নিনাদকে এই প্রথম সে শুনল তিতিক্ষার নাম ধরে ডাকতে। নাহয় সবসময় সে ছোট গিন্নি বা আর কিছু বলে ডাকে তাকে। সে ব্যাস্ত কণ্ঠে বলল, ‘মাথা খারাপ হয়েছে তোর? তিতিক্ষার পা মচকেছে তো কি হয়েছে? পা মচকানোর সাথে এর কি সম্পর্ক? বেশি কথা না বলে ওদের নিয়ে আয় জলদি। বাবা কত আয়েস করে ফুআম্মাকে দাওয়াত দিয়েছেন…’
নিনাদ চলে গেল। দুপুরে শিউলি ফুআম্মা আর আফরিন কে নিয়ে এল। তিতিক্ষার অবস্থা দেখে শিউলি ফুআম্মা বারবার আফসোস করতে লাগলেন। আফরিন তো তিতিক্ষার পাশেই বসে রইল তখন থেকে। সেখানে বসে কত কথাই না বলতে লাগল সে। সব কথাই ঘুরে ফিরে নিনাদে এসে থামে। তিতিক্ষা নিরব হয়ে সব শোনে শুধু। কিছুই সে বলে না।
খাবার-দাবার শেষে বিকেলের দিকে বাড়িটা যেন একটু ঝিমিয়ে পড়ল। আফরিন ছোটনকে নিয়ে ছাদে উঠে গেল। মারুফ সাহেব নিজের ঘরে ভাতঘুম দিতে গেলেন। নিনাদও বাইরে গেল। তিহাকে বলে গেল ফিরে আসবে খানিক পরই। শিউলি ফুআম্মা এসে তিতিক্ষার পাশে বসলেন তখন। তিতিক্ষা অসুস্থ, সব কাজ তাই তিহার একার ঘাড়ে। তাছাড়া সন্ধ্যায় রওশান আসবে। তার জন্য গুছিয়ে রাখতে হবে সব খাবার-দাবার। তিহা তাই ছিল রান্নাঘরে। শিউলি ফুআম্মা তিতিক্ষা কে বললেন, ‘তোমার আপায় গেল কই, একটা কথা ছিল তুমাগো দুই বইনের লগে। ‘
তিতিক্ষা নম্র ভাবে হেসে বলল,’ আপু তো রান্নাঘরে। আসবে বোধহয় এক্ষুনি। ‘
শিউলি ফুআম্মা কিছু অস্থির হয়ে বললেন,’ এহন কেউ নাই। কথাটা কওয়ার সুযোগ আছিল। তোমার আপায় তো দেরি করতাসে। আপ্পিনি না আবার নাইমা আসে ছাদ থাইকা।’
তারপর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন তিনি। তিহা তখনো আসল না দেখে এবার বললেন, ‘আইচ্ছা, থাউক। এহন তুমারেই কই। পরে যদি আর সুযোগ না পাই। তখন তুমিই কইয়ো তুমার আপারে বুঝায়া। কেমন? ‘
তিতিক্ষা মাথা নেড়ে ইতস্তত হাসল। শিউলি ফুআম্মা নিচু স্বরে বলতে শুরু করলেন, ‘তুমরার দুই বইনেরে তো নিনাদ খুব মানে। তাই তুমরার কাছেই দুঃখের কথা কই বুঝলা।
পোলাডা বিদেশ যাইতাসে। বিদেশের বাতাস গায়ে লাগলে পুলাপানের স্বভাব বিগড়ায়া যায়। তাই পোলাডারে না করছিলাম দূর দেশে যাইতে। কিন্তু কথা শুনল না। তাই ভাবছি বিদেশ যাওনের আগে ওরে বিয়া দিয়া দিমু। একবার শিকল দিয়া শক্ত কইরা বানতে পারলে আর সহজে ছুটত না। বুঝলা না?
তাই আপ্পিনিরেও আনলাম সাথে। আমি ছাড়া তো আর কোনো কাছের আত্মীয়স্বজন কেউ নাই তারার। তাই ভাবছিলাম এইহানেই ওগো বিয়াডা দিয়া দিমু।
আজকালকার পুলাপানের কি যে স্বভাব। পোলার মনে যে কি চলে, বুঝা মুশকিল। খালি গাইগুই করে। বিয়ার কথা কিছু কইলেই খালি হাসে।
এহন তুমরাই আমার ভরসা। তুমরার সব কথাই হে শুনে। তুমরা ওরে বুঝায়া রাজি করাও।’
তিনি ফের অনুরোধের সুরে বললেন, ‘আমার এই উফকার টা তুমরা করো।’
তিতিক্ষা কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে বসে রইল। শিউলি ফুআম্মার গুরুত্বপূর্ণ কথা তাকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে।
সে কিছু বলছে না দেখে তিনি আবার বললেন, ‘কি কউ মায়া, করবা তো তুমরা আমার এই উফকার টা?’
তিতিক্ষা হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল যেন। মলিন হেসে মৃদু স্বরে সে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি আপুকে বলব নিনাদ ভাইকে বোঝাতে। আপুর কথা উনি ফেলতে পারবেন না। দেখবেন বিদেশ যাওয়ার আগেই উনি বিয়েতে মত দেবেন।’
শিউলি ফুআম্মা প্রসন্ন মুখে হাসলেন। তিতিক্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি বড় ভালা মাইয়া গো।’
চলবে…….।
অদ্রিজা আহসান