দূর আলাপন,পর্ব-৯,১০

0
921

দূর আলাপন,পর্ব-৯,১০
অদ্রিজা আহসান
পর্ব-৯

নিনাদের ঘুম হয় না। রাতটা জেগেই কাটে তার আজকাল। জেগে জেগে কত অসম্ভব কল্পনাই সে করে। কখনো কখনো অসম্ভব সেসব কল্পনার বেড়াজালে পরে, স্বপ্ন ও বাস্তবতার ফারাক সে ভুলে যায় ।
মনে প্রচন্ড অস্থিরতা নিয়ে নিনাদ উঠে বসল। আজ রাতটাও নির্ঘুম কাটবে নিশ্চয়ই। অথচ কাল বিকেলে ফ্লাইট। একটা ঘুমের ওষুধ কি খেয়ে নেবে সে? তাই হোক। দেশ ছাড়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেজন্য দরকার ফ্লাইটের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সুস্থ থাকা। তাই সে করবে।
নিনাদ অস্থির হয়ে বিছানায় বসে রইল। হাত বাড়ালেই পাশের টেবিলে ওষুধের বাক্স। কিন্তু বুকে ঝড় ওঠানো এত শত তার চিন্তা! একটা ওষুধে কি হবে কাজ তার?

নিনাদ নিজের মাথার চুল খামচে ধরে, অনুতাপে। কেন সে করল এমন কাজ! এতটাই কি অসহায় হয়ে পড়েছিল সে। যে শেষে কিনা…..
কি মস্ত ভুলটাই না সে করেছে। আবছা ভাবে দৃশ্য গুলো ভাসতে থাকে নিনাদের চোখের আঙিনায়।

খাঁ খাঁ করা দুপুরে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ বড় প্রকট শোনায়। তার ওপর দরজার ওপাশের আগন্তুক মানুষটি বোধহয় অস্থির। কড়া নাড়া তিনি থামাচ্ছেন না এক মুহুর্তের জন্য। তিতিক্ষা ওড়না মাথায় ভালো করে পেচিয়ে দৌড়ে এসে দরজা খোলে। আড়াল থেকে তাকায়। দরজার বাইরে নিনাদ। সে সত্যিই বেশ অস্থির। বাড়িতে তিতিক্ষা তখন একা। বাবা ফেরেন নি গ্রাম থেকে। ছেলেকে নিয়ে তিহা গেছে স্কুলে। ভদ্রতার সব বালাই ভুলে তিতিক্ষা মুখের ওপর দরজা লাগাতে উদ্যত হয়।
নিনাদ যেন জানত তিতিক্ষা এমনই করবে। এগিয়ে এসে সুকৌশলে একটা হাত রেখে দরজা আটকানোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেয় সে। কোনো ছল নয়। কথা বলে সে সরাসরি। হঠাৎ হড়বড় করে কিছু এলোমেলো কথা সে বলে। উদভ্রান্তের মতই তাকায়।
তিতিক্ষা অবাক হয়ে চেয়ে রয় সেদিকে। কি বলল লোকটা! এসব কি কথা সে বলে? ‘সে কোথাও যেতে চায় না। যাবে না কোথাও। শুধু তিতিক্ষা একবার না করুক। সব সে ছেড়ে দেবে। ‘
কি সব ছেড়ে দেবার কথা আবার সে বলে?
ক্যাম্পাসে এত এত মেয়ের সাথে যে তার সম্মন্ধ, তাকে না দেখলে তারা যে ক্ষনে ক্ষনে মরে যায়, তাদের ছেড়ে দেবে সে? গিটার বাজিয়ে সুরের ঝংকার তুলে গান গাওয়া। সেও কি ছেড়ে দেবে? সুন্দরী মেয়ে দেখলে সেই যে তার মিষ্টি করে হাসি, প্রতিউত্তরে সেদিক থেকে কি একটা গোপন ইঙ্গিত। এদিকে ফের তেমনি অহমিকা পূর্ণ গর্বিত হাসি। সব ছেড়ে দেবে সে? এতটা সে পারে নাকি?
নিনাদ তখন উন্মাদ। সব সে পারে। এদিকে যাই তাল দেয়া হয়, সেদিকে তখন তাই সুর বাজে।

হঠাৎ তিতিক্ষা বুঝতে পারে, নিনাদ এসব কথা বলছে ঘোরের মাঝে। ঘোর কেটে গেলেই পূর্বাবস্থায় ফিরবে সে। তিতিক্ষা এবার চরম কাজটা করে। সেদিন তিতিক্ষা এত অপমান নিনাদকে করে যে ঘোর তার কেটে যায় সহজেই! তিতিক্ষার সেসব খেয়াল তখন আর নেই। সামনের মানুষটি যে পূর্ণ মনোযোগে তার বাক্যবাণ গলধঃকরন করছে সেসব খেয়াল না করেই অনবরত সে বলে যায় তার কথা।
নিনাদের সামনে সেদিন নিজের সরূপের যে আয়না উন্মোচিত হয়, সেখানে নিনাদকে বড় কুৎসিত দেখায়। সে নাকি চরিত্রহীন, লম্পট, বড় নাকি মুখরা তার স্বভাব!

ছলনা করেই হোক কাউকে খুশি করবে, এমন মেয়ে তিতিক্ষা নয়। নিনাদ ইঙ্গিতে যে প্রশ্ন তাকে করে, তার উত্তর সে দেয় সরাসরি। বলে, সারাজীবন নাহয় অনূঢ়া থাকবে সে। তবুও নিনাদকে বিয়ে কখনোই সে করবে না। তারও নাকি আবার উচ্চাশা আছে! নিনাদ ভাবল উচ্চাশা আছে! তবে অন্য মেয়ে আর তিতিক্ষার মাঝে তফাত রইল কি? পরমুহূর্তেই তিতিক্ষা বলল, বিয়ে সে রিকশাওয়ালা কেও করতে ডরায় না। চোখ বুজে রাজি। তবে ওপারে তার স্থানী ঠিকানা থাকা চাই। অর্থাৎ তাকে হতে হবে পূর্ণ দ্বীনদার। যেন জীবনের সব কষ্ট তারা এপারেই সাঙ্গ করে ওপারে পাড়ি জমাতে পারে বেশ নিশ্চিন্তে। তাদের সুখের স্থানী ঠিকানায়।’
উত্তর শুনে নিনাদের মনে হল এতদিনে এই মেয়েটিকে সে কিছুমাত্র চিনতে পারে নি। তার এতদিনের সমস্ত স্বপ্ন, আশাও বৃথাই আঁকা হয়েছিল। এই মেয়ের চিন্তাধারা বয় অন্য এক স্রোতে, যার ধারে কাছে নিনাদের অস্তিত্বের চিহ্ন কোন নেই!

সেদিন নিনাদ ভীষণ তপ্ত দুপুরে তার বুক পূর্ণ করেই ফিরেছিল নিজ বাড়ি। নিজের সরূপের প্রকৃত পরিচয়, তার বহুদিনের জমানো সমস্ত আশার একমুহূর্তে ধূলিসাৎ, আর ওপাশের দরজাটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবার দারুণ ভয়ানক শব্দ। সব সে পেয়েছিল শ্রাবণের অসাধারণ সুন্দর, সাদা নীল আকাশের নিচে, কড়া রোদের সেই বিষন্ন দুপুরে।

_____________________

সবাই এসেছে নিনাদকে বিদায় দিতে। বিশাল বন্ধুর দল, শিউলি ফুআম্মা আর আফরিন। তবুও যেন কি বাকি রয়ে গেল। কি এক অজানা সুখের আকাঙ্ক্ষা যেন নিনাদ করছে। আফরিন উৎসুক হয়ে তাকাচ্ছে এদিক-সেদিক। নিনাদও তাই। তিহার পরিবারের সবাই আসবে আজ। সেজন্যই এই প্রছন্ন তীব্র অপেক্ষা তার। আজ শেষ বারের মত সে নাহয় একটু দোষ করবে। তাকে চোখ ভরে দেখে নেবে। আর কখনো না। সব কথা সে ভুলে যাবে। তিতিক্ষার করা অপমান আর তার দেয়া অপ্রয়োজনীয় একপাক্ষিক ভালোবাসা। সব। শুধু মনে রাখবে আজকের দিনটা। এটুকুও কি সে পারে না? তবুও কি তিতিক্ষা তাকে আটকাবে গুনাহের জালে? বলবে কঠিন গুনাহ আছে এই কাজের মাঝে। বলুক! সাধু সন্ন্যাসী তো সে নয়! হয়তো হত একদিন। তিতিক্ষা পাশে থাকলে। সে পথ যখন বন্ধ হয়ে গেছে তাহলে এসব ক্ষুদ্র অপরাধ সে করতে পারে বৈকি!

রওশান ছেলে কোলে নিয়ে আগে আগে এল। বাকিরা পেছনে। নিনাদ ছোটনকে দেখে হেসে আবার সেই আগমনী পথের দিকে তাকাল। তিহা এল, তারপর মারুফ সাহেবও তো এল। কিন্তু সে কোথায়? কই আর তো কেউ আসে না। সে কি বেশি পেছনে পরে গেল? একা আসতে কি ভয় পাচ্ছে? নিনাদ কি যাবে তাকে এগিয়ে নিয়ে আসতে? নিনাদ অস্থির হয়ে উঠল। আর তো সে পারছে না। অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা এখন আর কাজ করছে না।
অস্থির সুস্থির অবস্থার এক ঘোরের মাঝেই নিনাদ সবার সাথে কথা বলে চলল। সবাই তাকে শুভকামনা জানিয়ে নানান উপহারও দিল। বন্ধুরা সব আলাপে মশগুল হলে এক ফাঁকে তিহাকে সে জিগ্যেস করল। অনেক চেষ্টার পর অস্ফুট স্বরে কথা বের হল তার মুখ দিয়ে, ‘কিরে, ছোট গিন্নি এল না? নাকি এখনো জ্যামে আটকা পড়ে আছে? ‘
তিহার হঠাৎ যেন কি মনে পরে গেল। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করল। মুখে বলল, ‘ না রে। ও এল না। এত করে বললাম আমি আর বাবা। কথা শুনলে তো। আমি আসার সময় এটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল তোকে দিতে। ‘ প্যাকেট টা সে দিল নিনাদকে। নিনাদ যন্ত্রের মতই নিল সেটা। তার আর বলার কিছু নেই। আজ শুরু থেকেই সে বড় চুপচাপ ছিল। বন্ধুদের পেয়েও সে মুখ খোলে নি। তার সমস্ত হাসি, ঠাট্টা, মশকরা যেন বাকি সবের মতই তার সুটকেসে বন্দি হয়েছে। হাসবে সে কি করে!

নিনাদ আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। ফ্লাইটের আর বেশিক্ষণ বাকি নেই, সব বুঝে গুছিয়ে নিয়ে উঠতে হবে। এইসব বলে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে, আরেক দফা ফুআম্মার চোখ মুছিয়ে দিয়ে সে যেতে লাগল। তিনটি মেয়েমানুষ এয়ারপোর্টে ভরা জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল হাউ মাউ করে। নিনাদ একবারও পেছন ফিরল না। এই কান্নার আওয়াজ কি তার কানে পৌঁছায় নি? নিনাদ কি এত নিষ্ঠুর? নাকি সে পেছন ফেরেনি এই ভয়ে যে, আর কেউ তার একান্ত কষ্টের গোপন কান্না দেখে ফেলে অনধিকার ভাগ বসাবে তাতে!

______________________

ওহিও’র বাহারি রঙের মেঘ পূর্ণ শীতল আকাশে তখন রাত্রি নেমেছে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে আকাশে মেঘ সরে গিয়ে সেখানে উঠেছে মস্ত এক থালার মত বড় রূপালী চাঁদ। ভীষণ তীব্র স্বচ্ছ প্রস্ফুটিত সেই পূর্ণ চাঁদের আলো। কত বড় চাঁদ! নিনাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। বাংলাদেশে থাকতে চাঁদকে এত বড় তো কখনো লাগে নি তার! কিজানি চাঁদটা কিভাবে হঠাৎ এত বড় হয়ে গেল।

নিনাদ সেদিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। যে বাড়িটায় সে থাকে সেখানে ছাদ নেই। আশেপাশের কোন বাড়িতেই ছাদ নেই এখানে। কিন্তু বাড়ির সামনে বিশাল খোলা জায়গা আছে। এই মধ্যরাত্রিতে নিনাদ সেখানে খাপছাড়া ভাবে হাঁটে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে দেখে ওই একফালি রূপোর থালাটাকে। নিনাদের তখন হঠাৎ কেমন শূন্য লাগে চারপাশ। ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে বুকের ভেতর টা। এখানে কত সুন্দর আনন্দময় বিচিত্র জীবন তার। মাসে একবার তারা ফিশিংয়ে যায়, লেক ইরিতে যাওয়া হয় সময়ে অসময়ে। তার রুমমেটরা খুব স্নেহ করে তাকে। এখানে সে সবার চেয়ে বয়সে ছোট ও নতুন কিনা তাই।
যা সে চায় সব সে করতে পারে এখানে। কেউ বাঁধা দেবে না তাকে। তবুও যেন কোন কিছুই ভালো লাগে না নিনাদের। দিনগুলো কেটে যায় ভীষণ ব্যাস্ততার মাঝে। কিন্তু রাতগুলো যেন ফুরাতে চায় না আর।

নিনাদের মনে পড়ে বহু বছর আগের সেই বিভীষিকাময় রাত্রি গুলোর কথা। যখন অভাবের সংসারে মাঝপথে তাদের ফেলে বাবা চলে গেলেন। বাবার মৃত্যুতে ভীষণ শোকে তার পাগলপ্রায় মাও ওপারে পাড়ি জমালেন বাবার প্রয়াণের মাত্র তিনদিন পর। নিনাদ তখন ছ’মাসের কোলের ভাইটাকে নিয়ে একা এই মাঝদরিয়ায়। ভাইটাকে সে নিজের প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাইল। অনাহারে নিজে শুকিয়ে মরে ভাইকে খাওয়াল। কিন্তু সেও রইল না। এক শরতের বিকেলে প্রচন্ড জ্বরে ধুঁকে ধুঁকে, অপুষ্টিতে ভুগে সেও মারা গেল। নিনাদ রইল একা। পুরো পৃথিবীতে সে তখন ভয়ানক একা যেন। আর কেউ নেই। না খেয়ে অনাহারে, তীব্র মনকষ্টে সেও যখন মৃত প্রায় তখন হঠাৎ মেঘদূতের মত শিউলি বেগম এসে হাজির হলেন। তাকে নিয়ে চলে গেলেন গ্রামের বাড়ি। নিনাদকে সুস্থ স্বাভাবিক করে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিলেন ক্লাস ফাইভে ।

স্কুলের শিক্ষকরা কিছুদিন পরই শিউলি বেগমকে ডেকে নিয়ে জানাল নিনাদ পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী। তার মেধা বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। এক ক্লাস ওপরের পড়া সে ধরে ফেলে অনায়াসেই। ফাইভ পাসের পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বইচ্ছায় তাকে শহরে পড়ার জন্য পাঠাতে চাইলেন। শিউলি বেগম গ্রামের মেয়ে হলেও ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। আবেগী মন তার ছিল না। তিনি রাজি হলেন ছেলেকে শহরে পড়াতে। ঢাকার পাশে মানিকগঞ্জের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে নিনাদ আবার এল শহরে। হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে গেল সে।

নিনাদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। কি দিন ছিল, কি দিন এল, জীবনে কত সে পেল, কত সে হারাল। শুরুতে সে যেমন একা ছিল আজও তেমনই একা সে রয়ে গেল। মাঝে যে এসেছিল মাঝেই সে চলে গেছে। না, সে আদৌও আসেই নি কখনো। নিনাদ জোর করে টেনে এনেছিল তাকে। এবার স্বইচ্ছায় ছেড়ে দিল। আর কেউ কি আসবে এই পোড়া জীবনে? না আসুক। নিনাদ একাই ভালো থাকতে জানে। সে একাই বেশ কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন টা।
চলবে…..

অদ্রিজা আহসান

দূর আলাপন
পর্ব-১০
_______________
রাত্রির পর দিনের আগমনের যে স্বাভাবিকতা, নিনাদের জীবন এখন সেই নিয়মে বাঁধা। নিগূঢ় আঁধারের রাত্রি গুলো কেটে যায়, ফের দিন আসে। নিনাদ খায়, দায়, ভার্সিটি যায়। সবকিছু চলছে আগের মত। তবে পরিবর্তনও কিছু এসেছে নিনাদের। নিসঙ্গতায় বোঝা যায় লোকসমাগমের মাহাত্ম্য। নিনাদও ঠিক তেমনি এখানে একা পড়ে, ভালোবাসাহীন হয়ে বুঝেছে অনুরাগের মূল্য কত। নিনাদ এখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, সময় পেলেই বসে কুরআন নিয়ে। যে মরিচীকার পেছনে সে ছুটেছে চিরকাল, তার নাগাল সে পায়নি কোনদিন। অথচ কোরআন শান্তির বাণী নিয়ে কত কাছে ছিল সবসময়, সেদিকে তাকানোর সময় বা ইচ্ছা কোনদিন তার হয়নি। যদিও জানত সবাই ছেড়ে গেলেও এই আনকোরা ভাঙা ভাঙা সুরে, ভুলে ভরা উচ্চারণে করা তার তিলাওয়াত কখনো বৃথা যাবে না।

আজকাল কাজ ছাড়া নিনাদ ঘরের বাইরে পা বাড়াতে চায় না একটুও। নিজের ঘরে একা বসে থাকে চুপচাপ। কি করবে যেন সে ভেবেই পায় না। তার এই অদ্ভুত আচরন দেখে বাকিরা অবাক হয়। প্রথম প্রথম এখানে আসার পর, কি রেখে কি করবে, কোন জায়গা ছেড়ে কোন জায়গায় যাবে সেসব ভেবেই অস্থির থাকে সবাই। অথচ নিনাদের যেন শুরু থেকেই কোন কিছুতেই কোন আগ্রহ নেই। সে যেন আমেরিকা নামক বন্দী জেলখানায় বছরের পর বছর অবরুদ্ধ থেকে ভীষণ ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছে। একটুখানি বাইরের আলো বাতাসের জন্য তার ভেতর যেন হাঁসফাঁস করছে সবসময়।
আজও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সবাই যখন সাজগোজ জুড়ে দিল বাইরে যাওয়ার জন্য, তখনো নিনাদ বসে রইল চুপচাপ। জিগ্যেস করলে জানাল শরীর ভালো লাগছে না তার। অবশেষে তাকে রেখেই বিকেলে বেরিয়ে যায় সবাই। নিনাদ একটু একা হতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন।
জানালার পর্দা সরিয়ে নিনাদ বাইরে তাকায়। রাস্তা দিয়ে সা সা করে একের পর এক গাড়ি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছে। গুড স্ট্রিটের ইতস্তত ছড়ানো বাড়ি গুলোয় সন্ধ্যেতেই যেন মাঝরাত্রির নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কোনো আওয়াজ নেই, কারো বাড়ির আঙ্গিনায় কোন মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নিনাদ সেদিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। সঙ্গোপনে ফেলে দীর্ঘ নিশ্বাস। এত একা কেন সে?

আজ চার মাস হতে চলল তিহা বা তার পরিবারের কারো সাথেই যোগাযোগ নেই তার। প্রথম ছ’মাস সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কথা হত নিয়মিত তিহা, ছোটন আর রওশানের সাথে। তারপর হঠাৎ একদিন তিহার কল এল। ছোট বাচ্চাদের বড়রা যেভাবে ভোলাতে চায়, ছলনা করে বোঝাতে চায় যে “তাদের চাহিদার বস্তুটি দূর আকাশের চাঁদ। নাগাল পাওয়া যার অসম্ভব। অতএব তা পাওয়ার বাসনা তাকে ছাড়তে হবে।” ঠিক সেভাবেই সেদিন তিহাও তাকে কিছু একটা বোঝাল।

জানালার কাছ থেকে সরে নিনাদ আলমিরার সামনে এসে দাঁড়ায়। আলমিরা খুলে খুব সন্তর্পণে বের করে কিছু একটা। একটা রেপারে মোড়ানো প্যাকেট। প্যাকেট হাতে নিয়ে সে বিছানায় এসে বসে। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে থাকে প্যাকেট টার দিকে। এই নিয়ে বোধহয় একশবারের বেশি খুলেছে সে এই প্যাকেট টা। পুরোনো হয়ে গিয়ে কেমন ছোপ ছোপ দাগ বসে গেছে তাতে। ছিড়ে গেছে নানা অংশ । তবুও যেন প্রতিবার একই রকম উত্তেজনা অনুভব করে সে প্যাকেট টা খোলার সময়।
একটা গাঢ় সবুজ জায়নামাজ, খুব সুন্দর কাঠের একটা তসবিহ্ আর অনুবাদ সহ একটা কুরআন শরীফ।
একে একে সবগুল বের করে নিনাদ। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে দেখে। মুহুর্তেই ওহিও’র গুড স্ট্রিটের একটি বাড়ির এক নিভৃত অন্ধকার ঘরে বসে থেকেও সে যেন ফিরে যায় বাংলাদেশে, তার ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোতে। তখন যা ছিল অতি তুচ্ছ, হয়তো যা কিছুই ছিল না। এখন যেন তা-ই নিনাদের কাছে এক সমুদ্র দুঃখের মাঝে হয়ে ওঠে এক পশলা সুখের মতন। অতীতের একই কিছু স্মৃতি আজ কেবলই অনুরণনের মত বারবার বেজে যায় তার কানে।

এটুকুই তিতিক্ষার শেষ স্মৃতি চিহ্ন হিশেবে রয়ে গেছে তার কাছে। আর কিছুই নেই। নতুন করে কোন স্মৃতি জমানোর সুযোগও নেই। তিতিক্ষাকে আর কোনোদিন ছোট গিন্নি বলে ডাকতে সে পারবে না। তিতিক্ষার বিয়ে হয়ে গেছে!
এই কথাটা জানাতেই তিহা তাকে কল করেছিল সেদিন। বিয়ের তখনো তিনদিন বাকি। তারপর আর কথা হয়নি তাদের কারো সাথে। নিজে থেকেই তারপর সে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। নিনাদকে তিহা বুঝিয়েছিল সেদিন, তিতিক্ষা কোনদিন তাকে চায়নি। সে ভীষণ স্বাধীনচেতা মেয়ে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ সে করবে না কখনো। নিনাদকে সে শুরু থেকেই অপছন্দ করে। বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসে না।
কথাগুলো শুনে নিনাদ সেদিন খুব শান্ত হয়ে গিয়েছিল। এতটা শান্ত যে আর কোনো কথা বলারই শক্তি রইল না তার। তবুও শুনতে হয়। সে শুনল তিতিক্ষার যে বর, সে নাকি মস্ত বিজ্ঞ ব্যাক্তি। দশ এলাকার ছেলেদের আদর্শ। কলেজের প্রফেসর। নিনাদ হাসল। ভালোই হয়েছে। তিতিক্ষা এমন বর ই তো চেয়েছিল। সে তবে সুখে থাকুক।

____________________

শ্রাবণ পেরিয়েছে সেই কবে। এখন বৈশাখ। চারিদিকে শুধু কাঠফাটা রোদ্দুরের উষ্ণ রেশ। খাঁ খাঁ দুপুরে, শেষ বসন্তের কোকিলের ডাক এখনো শোনা যায়। ডাকতে ডাকতে কোকিল গুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে। থেমে যায় তাদের সুর। তৃষ্ণায় শুষ্ক হয়ে ওঠে ওদের ঠোঁট। এই কাঠফাটা রোদে কোকিলের ডাকে, আকাশের বুক চিরে মাঝে মাঝে ধূসর মেঘও উঁকি দেয়। ব্যাস্ত জনজীবনে কারো সেসব খেয়ালের সময় নেই। একমাত্র যারা এসব খেয়াল করে নিসন্দেহে তারা নিতান্ত অকর্মা নাহয় বিরহে কাতর নিষ্প্রভ প্রাণ। সেজন্যই প্রকৃতির খেয়ালে আজ হঠাৎ বড় নজর পড়েছে তাদের।

ঘরের ঝকঝকে সাদা মেঝেতে একটা নিস্পন্দ বস্তু পড়ে আছে। জানালার পাতলা সফেদ পর্দাগুলো স্থির থাকছে না এক মুহূর্ত। সমুদ্র তরঙ্গের ন্যায় তারা ওঠা নামা করছে অবিরত। বারান্দার দরজাটা হাট করে খোলা। সেদিক দিয়ে শ্রান্ত বৈশাখ দুপুরের শুষ্ক রূপ ভীষণ ভাবে চোখে পড়ে। বাইরে থেকে কেউ খুব ক্ষীণ স্বরে ডাকছে। খানিকটা ভয়, স্নেহ আর কত দরদ মেশানো সে ডাক। মেঝেতে পড়ে থাকা বস্তুটি হঠাৎ একটু নড়েচড়ে ওঠে। তখন বোঝা যায় সেটা কোনো বস্তু নয়, একটা মানুষ। মরে গিয়েও বেঁচে থাকা জীবন্ত একটি প্রাণ!

তিহা আবার ডাকে। ধীরে ধীরে ভীষণ যত্নে সে উচ্চারণ করে, ‘তিতি, দরজা খোল তিতি!’
এদিকে কোন সারা নেই। বস্তু রুপী সেই প্রাণটি ওভাবেই পড়ে থাকে। তার কোন তাড়া নেই, কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, নেই কোন কৌতূহল। সে তখনো একদৃষ্টে চেয়ে আছে উজ্জ্বল সাদা নীল ওই আকাশের পানে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ বুজে আসতে চায়, চারপাশ সব আঁধার ঠেকে। তবুও সে চেয়ে থাকে উদ্দেশ্যহীন ওই গন্তব্যে।

দরজার বাইরে গলার আওয়াজ একসময় জোড়ালো হয়, তারপর আবার নিভে যায়। হতাশ হয়ে থেমে যায় সেই কণ্ঠস্বর। চলে যায় দরজা ছেড়ে।

তিতিক্ষা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নেয়। সময় হয়েছে তার একান্ত এবং একমাত্র প্রিয়জনের সাথে কথা বলার। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নামাজে। আধঘন্টা, একঘন্টা, দেড়ঘন্টা….. সময় পেরিয়ে যায়। তিতিক্ষা নামাজ পড়তে থাকে। সিজদায় গিয়ে উঠতে আর তার মন চায় না। সে চুপচাপ পড়ে থাকে সিজদায়। মুখে কোন রা নেই, চোখ বেয়ে শুধু পানি পড়তে থাকে ফোঁটায় ফোঁটায়। যিনি মনের সব কথা জানেন, তার কাছে কয়েকটা এলোমেলো শব্দ উচ্চারণের কিইবা প্রয়োজন?

সে ঘরের সামনে থেকে মলিন মুখে ফিরে আসে তিহা। মারুফ সাহেব তাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ান। মেয়ের ফিরে আসার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। অসহায় মুখে নিচু স্বরে কথা বলেন মারুফ সাহেব, ‘তিতি দরজা খুলেছে? খেয়েছে কিছু? কি কথা বলল?’
তিহা মলিন হাসে।’আজকের দিন কি অন্য দিন থেকে আলাদা বাবা? যে ও কথা বলবে? আর কথা বলবে কিভাবে? দরজাই তো খোলে নি।’
মারুফ সাহেবের মলিন মুখ আরও ম্লান হয়ে আসে। ‘আচ্ছা, আমি যাই, ছোটদাদুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। ও এলে যদি সে কথা বলে… ‘
তিহা উত্তরে নিশ্চুপ থাকে। রোজ রোজই তো ছোটনকে ওঘরে পাঠাচ্ছে সে। লাভ একদিনও হয়নি এপর্যন্ত।

ছোটন ফিরে এলে তার পোশাক বদলে, তাকে খাইয়ে আজও তিহা ফের ওঘরে পাঠায়। নানান কথা শিখিয়ে পড়িয়ে বুঝিয়ে দেয় তাকে কি করতে হবে। ওইঘরে যাওয়ার নাম শুনলেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে আসে ছোটনের। তিতিক্ষা কে সে আজকাল বাঘের মত ভয় পায়। তবুও সে যায়। সেই যে একটা সময় ছিল, যখন মিমি তাকে খুব ভালোবাসতো, রাতদিন তারা দুজন একসাথে কাটাত, কত হাসি, কত দুষ্টুমি..। সেসব দিনের কথা মনে করেই সে ওই ঘরে, মিমির কাছে একা যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে।

একমাত্র ছোটন ডাকলেই ওই ঘরের অবরুদ্ধ দরজা আর রুদ্ধ থাকতে পারে না। তিতিক্ষা দরজা খুলে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। তা দেখে ছোটন দমে যায়। মায়ের শেখানো কথাগুলো একে একে ভুলে যেতে থাকে। তারপর কাছে গিয়ে বসে নিজের মনেই নানান এলোমেলো কথা সে তিতিক্ষাকে বলে।
-‘জানো মিমি, স্কুলে রাকা নামে আমার যে বান্ধুবিটা আছে? আজ ও পরে গেছিল মাঠে, সবার সামনে, হো হো করে সবার সে কি হাসি… রাকা খুব কাঁদছিল তখন।’
তিতিক্ষা তখন হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে ওঠে। চোখ বড় বড় করে ছোটনের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ স্বরে বলে,’ তুমি কি করলে তখন? তুমিও হাসছিলে সবার সাথে, না? ‘
ছোটনের চোখ দুটো ভীত হয়ে ওঠে। সে নিচু স্বরে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ ও তো আমার বন্ধু। আমারও কান্না পাচ্ছিল তখন। তাই আমি…..আমি ওকে টেনে তুলেছি।’
তিতিক্ষার বাঁকানো ভ্রু জোড়া আস্তে আস্তে আবার সরল হয়ে আসে। হঠাৎ সে ছোটনকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। ‘
বিরবির করে কিসব বলতে বলতে, নাক টেনে টেনে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। কি করুণ শোনায় তখন তার কান্না। ছোটন কিছুই বুঝতে পারে না। তার ভয় কেবল বাড়তে থাকে। মনে হয় দম আটকে মারা যাবে সে। কিন্তু তিতিক্ষা তাকে ছাড়ে না। তার সে খেয়ালই নেই। সে ছোটন কে ওভাবেই জাপটে ধরে বসে থাকে। বারবার বলতে থাকে, ‘তুমি কক্ষনো ওদের মত হয়ো না। ওরা খুব বাজে। কেউ কাঁদলে তুমি তা দেখে কক্ষনো হেসো না। খুব কষ্ট হয়। কাঁদলে যখন কেউ হাসে। তখন আমার খুব কষ্ট হয়। শ্বাস আটকে আসে, নিশ্বাস নিতে পারি না আমি। আমি কাঁদলে আর তুমি হেসো না।’

তিহা দরজার বাইরে আড়াল থেকে ভীত চোখে ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু বইতে থাকে। কেন এমন হল! এত বড় কলঙ্ক কেন ঘটল তার নিষ্পাপ বোনের জীবনে? আজ এভাবে ধুঁকে ধুঁকে তাকে মরতে দেখেও সে কেন এত নিরুপায়? আর কখনো কি তিতিক্ষা হাসবে না? তার খিলখিল হাসির কলরবে কখনো কি আর মুখর হবে না এই ঘর? সে কি তবে এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে সমাপ্তির দিকে?

একসময় কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত তিতিক্ষার হাত আলগা হয়ে আসে। প্রথম সুযোগেই ছোটন দৌড়ে পালায়। তিতিক্ষা ওভাবেই বসে রয়। আর অনবরত বিরবির করে বলতে থাকে, ‘আমি যখন কাঁদি, তুমি তখন হেসো না। আমার খুব কষ্ট হয়।’

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here