#দূর_দ্বীপবাসিনী,১০,১১
মুশফিকা রহমান মৈথি
#১০ম_পর্ব
কথাটা পুরো করতে পারলো না চারু। তারপূর্বেই একজোড়া কালো হাত তার মুখ চেপে ধরলো। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠলো সে। ফলে হাতে হাতা মোবাইলটি পড়ে গেলো মাটিতে৷ নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করতে লাগলো। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মুক্ত হবার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যার্থ হলো সে। এক পর্যায়ে হাতের মাঝে থাকা রুমালের ক্লোরোফর্মের জন্য নিস্তেজ হয়ে পড়লো চারু। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসলো। মোবাইলের ওপাশের ব্যক্তির উদ্বিগ্নতা বাড়লো। অস্থির কন্ঠে চিৎকার করতে লাগলো,
“চারুলতা, চারুলতা… চারুলতা, তুমি ঠিক আছো?”
কিন্তু উত্তরটা দিতে পারলো না চারু৷ তার আগে অপরিচিত মানুষটির গায়ে তলিয়ে পড়লো। দু জন যুবক তাকে তুললো মাইক্রোতে। কাধের ব্যাগ, বটভাজির প্যাকেট আর মোবাইলটা পড়ে রইলো চরম অবহেলায়। যুবকের একজন মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো। কেটে বন্ধ করে দিলো। তারপর মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর মাইক্রোটা রওনা দিলো নিজের গন্তব্যে।
ফোন কেটে যাওয়ায় অস্থিরতা বাড়লো শ্রাবণ। খারাপ চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে নিজের স্থান করে নিলো। স্যালাইনের ক্যানোলাটা টান দিয়ে খুলে ফেললো শ্রাবণ। শ্রাবণ উঠতে গেলে তার সেক্রেটারি এবং বিশ্বস্ত লোক রাকিব তাকে বাঁধা দেয়। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
“স্যার কি হলো? উঠে পড়লেন কেনো?”
শ্রাবণ উত্তর দিলো না, বরং চারুর মোবাইলে ফোন দিতে লাগলো৷ প্রতিবার ই একটা লাইন ই কানে আসলো,
“আপনার কাঙ্গিত নম্বরে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব নয়…
শ্রাবণের কপাল কুঞ্চিত হলো। চোখ মুখে অস্থিরতা প্রকাশ পেলো। তার নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে। ক্রোধ দমনের চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যর্থ হলো। উত্তেজিত স্বরে বললো,
“বিরক্ত করো না রাকিব, চারুলতার ফোনটা হুট করেই বন্ধ হয়ে গেলো। ওর গোঙ্গানীর আওয়াজ শুনলাম। আর তুমি কি না আমাকে বিরক্ত করছো? সরো সামনে থেকে”
“স্যার উত্তেজিত হবেন না। বড় স্যারের ওর্ডার আপনাকে যেনো ফুল রেস্ট দেওয়া হয়”
রাকিবের কথাটা শুনতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো শ্রাবণের। হুট করেই কলারটা টেনে ধরলো তার। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“আমার চারুলতার সাথে যোগাযোগ হচ্ছে না আর তুমি এখানে ফাজলামি করছো? মনে রেখো তোমার বেতন ওই বড় স্যার দেয় না। আমি দেই। তাই কথা বলার পূর্বে বুঝে বলো”
“সরি স্যার”
“ফোনের লোকেশন বের করো, ফাস্ট। আধা ঘন্টা সময় দিলাম”
রাকিব চুপসে গেলো ভয়ে। এদিকে শ্রাবণ নিজের চুল টানতে লাগলো। তার অস্থিরতা বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। একবার ওই বাড়ি ফোন দিতে চাইলো কিন্তু কিছু একটা ভেবে ফোনটা দিলো না। পুনরায় চারুর নম্বরে ফোন দিলো সে৷ কিন্তু এবারো সংযোগ পেলো না। শ্রাবণের মনে একটা ক্ষীন ভয় উঁকি দিলো, কেউ চারুর কোনো ক্ষতি করলো না তো!!
☘️☘️☘️☘️☘️
দুপুরে খেতে বসলো ধ্রুব। জাহানারা তাকে বেড়ে দিচ্ছে খাবার। কিন্তু জাহানারার নজর গেটের দিকে। তিনটে বাজতে চললো অথচ মেয়ে আসার নামটি নেই। চারুর কখনোই আসতে দুটোর অধিক বাজে না। যদি পলির বাড়িও যায় তবে তা দুটোর মধ্যে। ধ্রুব মুখে লোকমা তুলতেই নজর দিলো ছোটমামীর দিকে। তার মুখটা চুপসানো। শ্যামবর্ণের মুখখানা আরোও বেশি কালো লাগছে। ধ্রুব খেতে খেতে বললো,
“কি হয়েছে মামী? তুমি বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছো কেনো?”
জাহানারা কিছু একটা ভাবলো, তারপর চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“চারুটা এখনো বাড়ি ফিরে নি রে। এতো দেরি কখনোই হয় না। চিন্তা হচ্ছে বড়। তোমার মামা জানতে পারলে ঘর মাথায় করবে”
“যেয়ে দেখো, তোমাদের হবু জামাই এর সাথে ঘুরতে গেছে”
“না রে, ও আমাকে বলে গিয়েছিলো দুটোর মধ্যেই ফিরবে”
জাহানারার কথাটা শুনতেই হাত আটকে গেলো ধ্রুবর। খাবারটা গলা দিয়ে নামলো না। পানি খেয়ে থমথমে গলায় বললো,
“তুমি নিশ্চিত ও শ্রাবণের সাথে যায় নি?”
“একটা ফোন করে দেখবি?”
জাহানারার চিন্তিত মুখখানা এড়াতে পারলো না ধ্রুব। তাড়াতাড়ি ফোন ঘুরালো চারুর নম্বরে। কিন্তু হতাশ হলো বারবার। একটা সময় বাধ্য হয়ে ফোন করলো শ্রাবণকে। অপরিচিত নম্বর দেখে প্রথমে না ধরলেও পরে ঠিক রিসিভ করলো শ্রাবণ। হিনহিনে কন্ঠে ধ্রুব বললো,
“চারু আছে?”
“চারু এখানে থাকবে কেনো? ও বাসায় পৌছায় নি?”
“না, এদিকে মামী চিন্তা করে এক শেষ”
শ্রাবণ ফোন রেখে দিলো। তার মুখ শক্ত হয়ে এলো। রাকিবকে জানালো,
“কিছু হিল্লে হলো”
“না, স্যার”
“যতসব আকাম্মা, আমার সন্দেহ ঠিক। কেউ চারুকে কিডন্যাপ করেছে”
শ্রাবণের চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। তার কপালের শিরা ফুলে এসেছে। রাগ সংবরণে সে হাতে হাত ঘষসে। রাকিব মিনিয়ে বললো,
“স্যার, আপনার এক্সিডেন্ট যারা করিয়েছে তারাই ম্যাডামকে কিডন্যাপ করে নি তো। আপনার সাথে শত্রুতা ম্যাডামের উপর ঝাড়লো”
কথাটা বুঝতে কয়েক মূহুর্ত সময় লাগলো শ্রাবণের। সে আগের ন্যায় ই বসে রইলো হাত জড়ো করে। রাকিব আর কিছু বললো না। শ্রাবণের রাগ সম্পর্কে সে অবগত। অন্য সময় হলে সে সারা ঘর ভেঙ্গে চুরে একাকার করে ফেললো। কিন্তু আজ সে শান্ত। এটা ঝড় আসার পূর্ব মূহুর্ত ও বলা চলে। কিয়ৎকাল বাদে সে ধীর গলায় বললো,
“বাবা কোথায়?”
“স্যার তো বৈঠক ঘরে”
“ঠিক আছে, তুমি ট্রাক করার ট্রাই করো আমি আসছি”
বলেই উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। এক মিনিট সময় নষ্ট না করেই হাটা দিলো সে। গন্তব্য বৈঠক ঘর।
খাবার অর্ধখাওয়া রেখেই উঠে গেলো ধ্রুব। হাতটা ধুয়ে বললো,
“তুমি থাকো মামী, আমি দেখে আসছি গলিতে”
বলেই বেড়িয়ে পড়লো সে। বাইক এ উঠে হন্তদন্ত হয়ে রওনা দিলো চারুর কলেজের দিকে। অন্য সময় সেই চারুকে কলেজ থেকে আনে। কিন্তু আজ তা হলো না। নানা কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে চারুকে আনতে যাওয়া হলো না তার। সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো। আজ তার ভুলের কারণেই চারু নিখোঁজ। গ্লানিতে ভরে আসলো হৃদয়। সাথে চারুর জন্য দুশ্চিন্তা গুলো দলা পাকালো মস্তিষ্কে। প্রেয়সীর ক্ষতি যে ইহজীবনেও চায় না সে। চিন্তায় দৃষ্টি ঘোলা হয়ে এলো। কখন যে অশ্রু জমা হলো টের টি পেলো না ধ্রুব। বাইকের স্পিড বাড়ালো। হঠাৎ দু গলি পর চোখে পড়লো, পাড়ার টোকাই গুলো মাটি থেকে কি যেনো কুড়িয়ে খাচ্ছে। দুটো বাচ্চা একটা কালো ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। সেই সময় ই বাইক থামালো ধ্রুব। তাদের কাছে যেতেই তারা ব্যাগ ছেড়ে দৌড় লাগালো। ব্যাগটি দেখেই চিনতে বাকি রইলো না এটা চারুর ব্যাগ। বুক কেঁপে উঠলো ধ্রুব এর। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। তার চারু কি কোনো বিপদে পড়লো?
☘️☘️☘️
হন্তদন্ত হয়ে মোস্তফা কামালের রুমে প্রবেশ করলো শ্রাবণ। তার চোখ মুখ অপ্রকৃতস্থ দেখালো। চুল এলোমেলো। দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। সর্বদা অনুমতি নেওয়া ছেলে আজ বিনা অনুমতিতেই ঢুকে পড়লো দেখে বিরক্ত হলেন মোস্তফা কামাল। তবে কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। তার পূর্বেই টেবিলে ডান হাত ভর করে ঝুকে পড়লো শ্রাবণ। শ্রাবনের আচারণে তিনি চমকে উঠলেন। রাশভারী স্বরে বললেন,
“এসব কি শ্রাবণ?”
“আমার চারুলতা, বিপদে আছে। কেউ ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। আপনার তো অনেক ক্ষমতা, আমার চারুলতাকে খুঁজে দিন”
শ্রাবণ গরগর করে কথাগুলো বললো, মোস্তফা কামাল ছেলের এরুপ আচারণে রীতিমতো অবাক। তিনি চশমাটা খুলতে খুলতে বললেন,
“তোমার এখন রেস্টের প্রয়োজন শ্রাবণ। ঘরে যাও। শুয়ে থাকো”
“আপনি শুনেন নি আমি কি বললাম?”
“শুনেছি। কিন্তু এতে এতো অস্থিরতার প্রয়োজন নেই। পুলিশ তার কাজ করবে”
এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না শ্রাবণ। চিৎকার করে বললো,
“চার ঘন্টা, চার ঘন্টা সময় দিচ্ছি আপনাকে। দরকার হলে নিজের সম্পূর্ণ ক্ষমতা লাগিয়ে দিন। আমার চারুলতাকে যদি চারঘন্টায় খুজে না বের করতে পারেন, তবে আমি আমার রুপ ধারণ করবো। তখন কিন্তু আর বললেও আমি শান্ত থাকবো না বাবা।”
“আমাকে ওর্ডার করছো তুমি?”
“যদি আপনার মনে হয় তাই। তাহলে তাই। আপনার কাছে তিন ঘন্টা উনষাট মিনিট আছে। আমি এই সময়টাই শান্ত থাকবো। তারপর কিন্তু আর হাতে হাতে রেখে বসবো না আমি”
মোস্তফা কামাল রক্তিম চোখে নিজের ছেলেকে দেখছেন। কিন্তু তিনি অসহায়, ছেলেকে শান্ত করার একটাই উপায় চারুকে খুঁজে বের করা। শ্রাবণ বাবার সামনের চেয়ারে বসলো। তার পা কাঁপছে। চারুর কথা ভাবতেই বুক কাঁপছে। না জানি কি অবস্থায় আছে মেয়েটা_____
☘️☘️☘️
জ্ঞান ফিরলো চারুর। কিন্তু চোখ খুলতেই টের পেলো তার চোখ মুখ এবং হাত বাঁধা। এতো সময় অজ্ঞান ছিলো সে। কতটা সময় কেঁটে গেছে নিজেও জানে না। নিজের অবস্থান তটস্থ হতেই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো কিন্তু মুখ বেঁধে থাকার জন্য পারলো না। ভয়ে এটেসেটে বসলো সে। কোথায় আছে, কে নিয়ে এসেছে কিছু জানে না। বুকে জমে থাকা ত্রাশ ভয়ংকর রুপ নিলো যখন একজোড়া পায়ের আওয়াজ কানে এলো………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১১তম_পর্ব
জ্ঞান ফিরলো চারুর। কিন্তু চোখ খুলতেই টের পেলো তার চোখ মুখ এবং হাত বাঁধা। এতো সময় অজ্ঞান ছিলো সে। কতটা সময় কেঁটে গেছে নিজেও জানে না। নিজের অবস্থান তটস্থ হতেই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো কিন্তু মুখ বেঁধে থাকার জন্য পারলো না। ভয়ে এটেসেটে বসলো সে। কোথায় আছে, কে নিয়ে এসেছে কিছু জানে না। বুকে জমে থাকা ত্রাশ ভয়ংকর রুপ নিলো যখন একজোড়া পায়ের আওয়াজ কানে এলো। কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে। শব্দটা ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। চারুর নিজের পা ঘষে দূরে সরবার চেষ্টা করলো। কিন্তু দেয়ালের কাছে এসেই থেমে যেতে হলো। বুক কাঁপছে তার। ঘাড় বেয়ে শীতল ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়লো। গোঙ্গাচ্ছে সে, কিন্তু তাতে হয়তো সম্মুখের মানুষের কিছুই যায় আছে না। মানুষটি একেবারে তার কাছে আসতেই, পেছন থেকে এক যুবকের কন্ঠ কানে এলো,
“নাজমুল ভাই, বস ফোন দিছে”
নাজমুল নামক ব্যাক্তিটি বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“তুই যা, আমি আসতেছি”
কিয়ৎকাল পর পায়ের শব্দটি ক্ষীন হয়ে গেলো। রুদ্ধশ্বাস ফেললো চারু। তাকে যারা কিডন্যাপ করেছে তাদের একজনের নাম নাজমুল। কিন্তু এই নাজমুল কেনো তাকে অপহরণ করলো হিসেব মিলাতে পারছে না চারু। তার সাথে এই ব্যাক্তির কি কোনো শত্রুতা রয়েছে! নাকি তাকে আটকে রেখে এই নাজমুলের খুব বড় কোনো লাভ হবে! গণিতটা খুব কঠিন ঠেকছে চারুর কাছে। আতংক, ত্রাশের দরুন মস্তিষ্ক ও স্লোথ হয়ে গিয়েছে। খুব কান্না পাচ্ছে চারুর। না জানি বাবা-মার কি অবস্থা! তারা কি তার খোঁজ পাবে! নাকি এই অন্ধকারের মাঝেই ঘুটে ঘুটে ম/র/তে হবে চারুকে।
????
সময় যেতে থাকলো, মেঘকুঞ্জে উত্তেজনা ভর করলো। আহসান সাহেব আর শান্ত থাকতে পারছেন না। দু ঘন্টা কেটে গেছে। মেয়ের কোনো খবর পাচ্ছে না, এদিকে মোবাইলটাও বন্ধ। দূর্বল হৃদয়টা বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় আরোও বেশি দূর্বল হয়ে উঠছে। মেয়েটির যদি কোনো ক্ষতি হয়! কি করবে তখন! মেয়েটির সামনে বিয়ে, অঘটন ঘটলে এই বিয়েটাও ভেঙে যাবে। বুকের মধ্যখানে চিনচিন ব্যাথা করছে। জাহানারাকে ডেকে বললেন,
“চারুর মা, আমার ঔষধ টা দাও তো”
জাহানারা আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। মারুফা তাকে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়ে নিখোঁজ, এই সময় ঠিক কোনো স্বান্তনা কি কাজ করে! ধ্রুব বাড়ি ফিরলো থমথমে মুখ নিয়ে, মনীরুল সাহেব উঠে গিয়ে বললেন,
“কিছু খবর পেলে?”
“না মামা, আমি কোনো খোঁজ পাই নি। পলিদের বাড়িতেও নেই। কলেজ ও খুঁজে এসেছি। কোথাও নেই। শুধু ওর ব্যাগটা রাস্তায় পড়া পেলাম। আমার মনে হয় এবার আমাদের থানায় যাওয়া উচিত”
“কি বলিস, থানা পুলিশ করলে মেয়ের বদনামি হবে উলটো। আরেকটু দেখি”
মনীরুল সাহেবের কথায় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো ধ্রুব। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আজ যদি চিত্রা নিখোঁজ হতো তখনো কি এভাবেই বসে থাকতেন আপনি? কিসের বদনামির কথা ভাবছেন? একটা বার ভেবেছেন যদি সত্যি ওর কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তখন কিভাবে সামাল দিবেন? ফুলের মতো মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে? আপনার হাতে হাত রেখে বসে থাকার ইচ্ছে থাকুন। আমি আর ছোট মামা যাচ্ছি”
মনীরুল সাহেবের চ্যাটাংচ্যাটাং কথা ধ্রুব এর সামনে চুপসে গেলো। আর ধ্রুব সেই পরগাছা ভাগ্নেটা নেই, যাকে পাঁচ ছয়টা গাল মন্দ করে থামিয়ে রাখা যায়। তার চোখের দিকে তাকাতেই বুকের পানি শুকিয়ে গেলো মনীরুল সাহেবের। আহসান সাহেব বললেন,
“চল, এখন ই বের হই”
চকবাজার থানার অসি সাহেবের সম্মুখে বসে আছে ধ্রুব এবং আহসান সাহেব। অসি মেহেদী হাসান আয়েশ করে বসে রয়েছেন, আরামে পান চিবুচ্ছেন তিনি। ধ্রুব অস্থির কন্ঠে বলল,
“স্যার, চারু এখনো বাড়ি ফিরে নি। ওর ফোনও বন্ধ। তাই আমরা থানায় ডাইরি লিখাতে এসেছি”
মেহেদী হাসান তার পান চিবানো অব্যাহত রাখলেন। সরু দৃষ্টিতে বললেন,
“নাম কি মেয়ের?”
“ফাতেমা তুজ জোহরা চারু”
“বয়স কত?”
“তেইশ”
এবার বাঁকা হাসি হাসলেন মেহেদী, বিদ্রুপের স্বরে বললেন,
“প্রেম টেম করে?”
“এসব কি বলছেন?”
“ঠিক ই বলছি, আজকালকার মাইয়া পোলারা আমার প্রেম ছাড়া বুঝে না, যায়ে দেখেন নাগরের সাথে পালালো কি না। হয়তো ফোন এজন্য বন্ধ। যায়ে দেখেন নতুন সিম নিছে। আরে এমন ই হয়, মাইয়ারা ঘর থেকে পালায়। বাপ মায়ে ভাবে নিখোঁজ, পরে দেখা যায় প্রেমিকের লগে ভাইগে গেছে”
“আপনাকে এখানের ইনচার্জ বানালো কে?”
তীক্ষ্ণ কন্ঠে কথাটা বলে ধ্রুব। মেহেদীর উল্টো পালটা কথা মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। চাইতেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না ধ্রুব। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, দৃষ্টি স্থির। ক্রোধাগ্নি ঝরছে দৃষ্টিতে। তার কথা শুনে নড়েচড়ে উঠে মেহেদী। পানের পিকটা একটা বাটিতে ফেলে বলে,
“ঐ পোলা, তুমি কি বলতেছো?”
“ভুল কিছু বললাম কি? আমাদের মেয়েদের তিনঘন্টা ধরে খুঁজে পাচ্ছি না আর আপনি মশকরা করছেন? এটা কি সময় এমন কথা বলার? আর আমাদের মেয়েকে আমরা আপনার থেকে ভালো করে চিনি। দু গলি ছাড়িয়ে ওর ব্যাগ পেয়েছি। কোথায় মিসিং রিপোর্ট লেখাবেন তা না, আজাইরা বকে যাচ্ছেন”
ধ্রুবের তীক্ষ্ণ কথা আতে লাগলো মেহেদীর, চেতে উঠে বললো,
“ওই শু/য়ো/র, তুই আমারে কাজ শেখাস? থানায় এসে আমার সাথে হিরোগিরি করিস? আব্দুল, ওরে ভরো তো সেলে। যতসব”
“স্যার, ছেলেমানুষ। রাগ বেশি। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”
আহসান সাহেব নরম গলায় হাত জোর করে কথাটা বলে। মেহেদী হাসানের হুমড়ি তুমড়ি আরও বৃদ্ধি পায়। সে আজ ধ্রুবকে জেলে ভরেই ছাড়বে। ঠিক তখন ই একটা ফোন আসে থানায়। ফোন রিসিভ করতেই মেহেদীর মুখখানা শুকিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
“জ্বী স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা এখনই এখানের সব থানায় ইনফর্ম করে দিচ্ছি। জ্বী জ্বী স্যার। একঘন্টায় এই লোকেশন খুঁজে বের করছি স্যার”
বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো ওপাশের ব্যাক্তিটি। মেহেদীর মুখ পাংশুটে হয়ে রয়েছে। রুমাল দিয়ে কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা মুছে নিলো সে। থমথমে কন্ঠে বললো,
“আগে বলবেন না, আপনি মোস্তফা স্যারের আত্নীয়। মাত্র আইজি স্যার ফোন করলেন। আপনারা নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আমরা চারু কে খুঁজে বের করবোই।“
আহসান সাহেব এবং ধ্রুব নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। কিয়ৎকাল পূর্বের ঘটনাটা তাদের বধোগম্য হলো না। যে ইন্সপেক্টর নিজের ক্ষমতা জন্য হুংকার ছাড়ছিলো সেই কি না ভেজা বেলাই এর মতো মিউ মিউ করছে। এখন বসে থাকা ব্যতীত আর কোনো কাজ ই অবশিষ্ট নেই। ধ্রুব ধীর গলায় বললো,
“চলেন মামা, আপনাকে বাসায় পৌছে দেই”
“আর তুমি?”
“আমি একটু আশেপাশে খোঁজ করবো। যদি কিছু খোঁজ পাওয়া যায়। হাতে হাত ধরে বসে থাকাটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে”
আহসান সাহেব হু হু করে উঠলেন, পুরুষদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু যে বাবার মেয়ে তিনঘন্টা যাবৎ নিখোঁজ তার মনোস্থিতি কেমন হতে পারে তা কল্পনাতীত। হৃদয়ে ক্রমাগত ছুরি চলছে, কিন্তু রক্তক্ষরনটা অদৃশ্য। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে রয়েছে হৃদয়। মেয়েটা ঠিক আছে তো!____
?????
অন্ধকার ঘরের কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে চারু। তার চোখ মুখের বাধন এখনো অক্ষত। হাজারো প্রচেষ্টার পর ও সে তা খুলতে পারে নি। সকালের পর থেকে না খাওয়া শরীরটি এখন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। পানি তৃষ্ণা পেয়েছে প্রচন্ড কিন্তু নিস্তব্ধ এই রুমে তার গোঙ্গানি শোনার মতো কেউ নেই। অন্ধকার জীবন যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা আজ বুঝতে পারছে চারু। সব কিছু নিগূঢ় আধার, মাঝে মাঝে পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু তা অনেক দূরে। মাঝে মাঝে হাসির তীক্ষ্ণ শব্দও কানে আছে। হাতটা এতোসময় বেঁধে থাকার কারণে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেলো চারু। বেশ কয়েকজোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নিবৃত্ত হৃদয় পুনরায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। শিরদাঁড়া বেয়ে রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। বুক কাঁপছে। শরীরটাও ত্রাশে জমে গেছে। এক জোড়া পা তার দিয়ে এগিয়ে আসছে। চারু ভয়ে শিটিয়ে গেলো। চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো সে দেয়াল গেসে। তখন ই এক জোড়া হাত তার চোখের বাঁধন খুলে দিলো। তীক্ষ্ণ হলুদ রশ্নি চোখে এসে লাগলেই নেত্র বুজে নিলো চারু। এতোসময় আধারে থাকার দরুন চোখ সইতে পারছে না আলো। খুব কষ্টে চোখটি খুলতেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠলো। এতো সময়ের নিকষকৃষ্ণ ভয়ের মেঘগুলো সরে কুসুম প্রভাত উদয় হয় মনের ব্যালকনিতে। সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে অশ্রু ছেড়ে দিলো সে। মানুষটিও পরম যত্নে খুলে দিলো সব বাঁধন, মোহনীয় কন্ঠে বললো,
“আমি এসে গেছি চারুলতা……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি