#দূর_দ্বীপবাসিনী,১৪,১৫
মুশফিকা রহমান মৈথি
#১৪তম_পর্ব
দরজায় টোকা পড়লে চারুর নজর যায় সেখানে। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। অনুমতি পাবার অপেক্ষা। চারু স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“আসুন”
“তুমি রেগে আছো আমার উপর, চারুলতা?”
শ্রাবণের কন্ঠ অন্য রকম শোনালো চারুর কাছে, অনেকটা অনুশোচনায় মোড়ানো মোলায়েম স্বর। কিন্তু বাবার সাথে কথা বলার সময় কন্ঠ এমন ছিলো না। বরং চারুর মনে হয়েছিলো রোষানলে জ্বলছিলো যেনো শ্রাবণ। তাহলে এখন এতো কাতর কন্ঠ কেনো! চারু দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মাথার কাছের জানালা দিয়ে আকাশটা ভালোই দেখা যায়। সেই নিকষকৃষ্ণ আকাশে একটুকরো রুপালী অর্ধচাঁদ, চৈত্র চলে এসেছে। এখন বাতাসে শীতলতা নেই, বরং উত্তপ্ত মাটির হাফ ছাড়া নিঃশ্বাস রয়েছে। নিস্তদ্ধ ঘরে দুজন, একজন নীরবতায় আকাশে চোখ রেখে চাঁদের মাঝে কলঙ্ক খুঁজছে তো অন্য জন্য অধীর প্রতীক্ষায় প্রেয়সীর উত্তরের পানে চেয়ে আছে। চারুর নীরবতায় দম বন্ধ করা অস্বস্তির সঞ্চার করছে শ্রাবণের ভেতর। শ্রাবণ কিছুটা এগিয়ে এলো। নিজের কৃতকাজের সাফাই দেবার বাক্যগুলো নিপুনভাবে সাজালো। এতোকাল এতোটা ভয় হয় নি চারুর সাথে কথা বলতে, তবে আজ হচ্ছে। এভাবে চারুকে আপন করার ইচ্ছে তার ছিলো না। কিন্তু মনীরুল সাহেবের কথায় মস্তিষ্ক শীতল রাখা দুষ্কর হয়ে পড়েছিলো। শ্রাবণ চারু থেকে দূরত্ব রেখে বিছানায় বসলো। বিয়ে করা বউ এর কাছে যেতে তার সংকোচ হচ্ছে। সংকোচটা হচ্ছে চারুর কারণে। সে চায় না চারু তাকে লালসাপ্রেমী পুরুষ ভাবুক। কিয়ৎকাল অপেক্ষা করলো চারুর প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য। কিন্তু চারু আগের ন্যায় জানালার পানে তাকিয়ে রয়েছে। শ্রাবণ এবার ধীর কন্ঠে বললো,
“হুট করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যা হয়তো তোমার ভালো লাগে নি। কিন্তু আমি কি করতাম চারুলতা, বড় চাচার কটুক্তি আমার বিশ্রী লাগছিলো। এখানে অন্য কেউ হলে নিজেকে সামলাতেও পারতাম না। আর এই সমাজে বড় চাচার মতো অনেকেই আছে। সবার মুখ জনে জনে কিভাবে থামাতাম বলো। আমি তোমায় বলেছিলাম তাড়া নেই, আমি তোমাকে জোর করবো না। আজ ও একই কথা বলবো, তাড়া নেই। আমি তোমাকে জোর করবো না। তুমি সময় নাও। আমি অপেক্ষা করবো। শুধু তুমি আমার উপর রাগ করো না চারুলতা”
চারু এবার দৃষ্টি সরিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকায়। তার ছলছল নয়নে শ্রাবণ নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো। চারু এবার ঈষৎ কাঁপা স্বরে বলে,
“আমি রাগ করি নি, শুধু অভিমান হয়েছিলো। কিন্তু অভিমানের দেয়ালটাও গুড়িয়ে গেছে। শুধু একটা অনুরোধ, নিজের খেয়াল রাখবেন। আমার খুব ভয় হচ্ছে। জানা শত্রুদের মোকাবেলা করা যায়। অজানাদের নয়। প্রথমে আপনার দূর্ঘটনা এখন আমার অ/প/হ/র/ণ। আপনার মনে হয় না, কেউ আমাদের সাথে নিজের শত্রুতা দেখাচ্ছে”
শ্রাবণ কিছুটা এগিয়ে এসে বসলো। ডানহাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো চারুলতাকে। গভীর কন্ঠে বললো,
“তুমি ভয় পেও না চারুলতা, ইনশাআল্লাহ আমাদের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি তো এখন নিরাপদ আছো। আসলে কি বলতো, এক মাসে যা যা হয়েছে তোমার একটা ভয় তৈরি হয়েছে। আর ঘটনা গুলো এতোটা বাজে যে ভয় হওয়া স্বাভাবিক। আর আমাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে, তাও তোমার ওই প্রেমিকের নাকের নিচ থেকে। তাহলে কেনো অযথা ভয় পাচ্ছো! তারপরেও যদি তুমি কোনো চিঠি পাও, বা এমন কিছু হয় যা অপ্রীতিকর। আমাকে জানাবে, আমরা আইনের সাহায্য নিবো”
শ্রাবণের কথায় মনের ভেতরের জড়োসড়ো হয়ে জমে থাকা ভয়টা কিছুটা হলেও উবে যায় চারুর। সে ম্লান হেসে বলে,
“এই বিয়ে আপনার পরিবার মানবে?”
“আমার জীবনের সিদ্ধান্তে অন্য কারোর অযাচিত দখলদারি আমার পছন্দ নয়। বিয়ে তো হবার ই ছিলো। আজ হতো বা কাল। আচ্ছা ভালো কথা, কাল ইন্সপেক্টর আসবে। ফরমালিটিস, কিছু প্রশ্ন করবে। তুমি যা জানো, নির্ভয়ে বলবে তাদের। আচ্ছা তুমি কি ওই লোকগুলোর মুখ দেখেছিলে, কারোর বর্ণনা, কন্ঠ, কথাবার্তা? কিছু কি শুনেছিলে?”
চারু মিনিট দুয়েক চুপ করে রইলো। শ্রাবণ তখন বললো,
“তুমি প্রেসার নিও না। আমি আছি তো। এখন মনে করা লাগবে না। বিশ্রাম নাও। রাত হয়েছে”
শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। চারু কিছু বলতে যেয়েও বললো না। শ্রাবণ চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে পেছনে ফিরলো। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“আমি আসছি বউ, খুব জলদি নিজের কাছে নিয়ে যাবো”
শ্রাবণের মুখে “বউ” শব্দটি কানে ঝংকার তুললো। বুকের মধ্যখানে এক অন্যরকম অনুভূতি হলো তার। গাল জোড়ে রক্তিম হয়ে উঠলো। লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সে। চারুর রক্তিম মুখখানা অপলক নজরে দেখলো শ্রাবণ। আনমনেই বললো,
“আরোও একবার প্রেমে পড়লাম, আরোও একবার এই হৃদয় হারালাম সেই চিরচেনা লাজে রাঙ্গা মুখশ্রীতে”
শ্রাবণ অপেক্ষা করলো না। বেড়িয়ে পড়লো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হবার পালা। তবে বেড়িয়ে যাবার আগে ধ্রুবকে দেখতে পেলো না সে। ধ্রুবের মাঝে একটা বৈরীভাব রয়েছে। যা প্রথমে নজরে না পড়লেও আজ বাজে ভাবে নজরে পড়েছে শ্রাবণের। তার সাথে কিছু প্রশ্ন ও উদয় হয়েছে তার। শ্রাবণের ধারণা ধ্রুব চায় না শ্রাবণের সাথে তার বিয়ে হোক। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেনো!
“স্যার, আমি কিন্তু মোস্তফা স্যারকে কিছুই বলি নি। তবে তিনি যে ব্যাপারটায় খুশি হবেন না তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি”
শ্রাবণের ধ্যান ভাঙ্গলো। নজর গেলো রাকিবের দিকে। মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ। শীতল কন্ঠে বললো,
“তোমাকে সে নিয়ে ভাবতে হবে না। যা কাজ দিয়েছি সেটা ঠিক ভাবে করো”
রাকিব কথা বাড়ালো না। বরং গাড়ির গতি বাড়ালো। পিচঢালা রাস্তা চিরে এগিয়ে গেলো শ্রাবণের গাড়ি নিজ গন্তব্যে_______
???
নীল আকাশটা হুট করেই রঙ্গ বদলালো। পশ্চিমে জমলো কৃষ্ণ মেঘমালা। ছাদে কাপড় তুলতে এসেই বিপাকে পড়লো চারু। আকাশ পাতাল কাপিয়ে ঝড় শুরু হলো। নীল আকাশ মূহুর্তেই নিকষকৃষ্ণ হয়ে উঠলো। কাপড়গুলো ঝড়ের উম্মাদনায় হয়ে উঠলো লাগামছাড়া। চোখে ধুলো উড়ে আসছে। বিকালের গোধূলী মূহুর্তেই নিভে গেলো। চারুর মনে হলো সন্ধ্যে নেমে গেছে। আশেপাশের চাচীরা ছুটে এলেন ছাদে। যে যার কাপড় তুলছেন নয়তো শুকাতে দেওয়া শুকনো কুল গুলো বোয়মে ঢুকাচ্ছেন। চারুর শুকনো কন্ঠে ডাক দিলো,
“চিত্রা, উপরে আয়। এই ঝড় আমাকে উড়িয়ে নিবে”
আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন এর পূর্বে সে দেখে নি। দাদীর কাছে কালবৈশাখীর গল্প শুনেছিলো। আজ যেনো তা স্বচক্ষে দেখছে। এই বছর পুরোটাই অন্যরকম, শীতে বর্ষা, বসন্তে কালবৈশাখী। এর মাঝেই বাবার হাতে লাগানো লেবু গাছের মোটা টব টা ধরাম করে পড়ে গেলো কর্ণিশ থেকে। সাথে সাথে এক জোড়া শক্ত হাত চারুকে সরিয়ে নিলো পেছনে। আর একটু হলেই হয়তো পা টাই থেতলে যেতো চারুর। চারু তটস্থ হতেই পেছনে চাইলো। উঁচু লম্বা মানুষটা ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। নিজেকে তার থেকে ছাড়িয়ে বললো,
“ধ্রুব ভাই”
চারুর কথাটা শুনতেই ধ্রুব তার থেকে দূরে সরে যায়। তারপর কোনো কথা বলেই দ্রুত কাপড় তুলে দেয় সে। ঝড়ের তান্ডব এখনো চলছে। ধ্রুব কাপড়গুলো চারুর হাতে ধরিয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি চল, ঝড় বাড়বে”
বলতে বলতেই বৃষ্টি থামলো। মনখারাপের মেঘ গুলোর ক্রন্দন শুরু হলো। উত্তাপিত মাটি থেকে ছড়ানো ভেজা সুভাস। চারু চোখ বুঝে বৃষ্টির শীতল ছোয়ার আলিঙ্গন করলো। শ্যাম মুখখানায় মুক্তোর ন্যায় জমা হলো জলবিন্দু। ধ্রুব গভীর নয়নে একপলক দেখলো সেই মুখশ্রী। বিষাদগুলো গলায় জড়ো হলো। অনুভূতিগুলো মাথা চারা দিলো। কাতর গলায় বললো,
“জীবন এতো নিষ্ঠুর কেনো?”
চারুর কানে ধ্রুবের কথাটা যেতেই চোখ খুললো সে। অবাক নয়নে বললো,
“কিছু বললে?”
ধ্রুবের চোখে এক অদ্ভুত বেদনা। চারু সেই বেদনাকে অনুভব করতে পারছে যেনো। ধ্রুব নজর সরিয়ে ফেললো, বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“চারু, বলতে পারবি অপূর্ণতায় এতো কষ্ট কেনো?”
“কারণ মানুষের পূর্ণতা অয়াবার আকাঙখা বেশি”
কিছুসময় থেমে কথাটা বলে চারু। ধ্রুব স্মিত হেসে বলে,
“পূর্ণতা চাওয়া কি পাপ?”
“পাপ হবে কেনো? পূর্ণতায় যে সুখের ছোঁয়া আছে। তাহলে পাপ হতে যাবে কেনো? আচ্ছা কি হয়েছে ধ্রুব ভাই? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব কষ্টে আছো! আমাকে বলতে পারো”
“বললে কি হবে?”
“কষ্ট ভাগ না করতে পারলেও, তোমার মন হালকা হবে”
চারুর সরলতায় হার মানলো ধ্রুব। এই জমায়িত কষ্টগুলো বুক চিরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বিষাদ মাখা কন্ঠে বললো,
“প্রণয়ের জ্বালারে। পরিণয়ে পরিণত হবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে রে! আমার প্রেয়সী আজ অন্যকারোর। অথচ চাইলেও তাকে কথাটা বলতে পারছি না”
ধ্রুবের কথাটা অন্যরকম শোনালো চারুর কাছে। কিছু বলতে যাবার পূর্বেই চিত্রার কন্ঠ শোনা গেলো,
“বুবু, শ্রাবণ ভাই আসছে……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১৫তম_পর্ব
ধ্রুবের কথাটা অন্যরকম শোনালো চারুর কাছে। কিছু বলতে যাবার পূর্বেই চিত্রার কন্ঠ শোনা গেলো,
“বুবু, শ্রাবণ ভাই আসছে। তাড়াতাড়ি আয়”
চিত্রার কণ্ঠ কানে আসতেই ধ্রুব দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চারুর ঝাপসা চোখে ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। বৃষ্টির কারণে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে তার মনে হলো ধ্রুব কাঁদছে। চারুর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,
“ধ্রুব ভাই, কেনো কাঁদছো?”
কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না। মানুষের সুখের কারণ জিজ্ঞেস করতে হয়, দুঃখের নয়। চারু ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলো। বৃষ্টির তেজ কমলো না, বরং আরোও বাড়লো। ধ্রুব বা হাত দিয়ে ভেজা চুল গুলো পেছনে নিয়ে নিলো। বেদনা গুলো অশ্রুরুপে গড়াচ্ছে। অপূর্ণ প্রণয়ে এতো যন্ত্রণা সেটা কি জানতো সে। জানলে হয়তো এই ফাঁদে পা ই দিতো না। ধ্রুব এর আজ ও মনে পড়ে সেদিনের কথা, যেদিন প্রথম এই বাড়ি এসেছিলো। মায়ের মৃত্যুর পর ছোট মামাই তাকে এখানে নিয়ে আসে। অসহায় ধ্রুব তখন নিজেকে এক ঘরে আটকে রাখতো। মায়ের স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেরাতো তাকে। সেই একাকীত্বে একটা ছোট মেয়ে প্রথম তার কাছে আসে। নিজের পুতুলখানা তার হাতে দিয়ে বললো,
“কেঁদো ধ্রুব ভাই! তুমি একা না, আমরা সবাই তোমার পরিবার”
মেয়েটির কথায় কি যেনো ছিলো। না চাইলেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো৷ নিঃসঙ্গতায় কৃষ্ণ প্রহরে একরাশ কুসুম প্রভা এসে হাতছানি দিলো কিশোর ধ্রুবের মনে। চারুর প্রতি অনুভূতির জন্ম সেখান থেকে। সেই অনুভূতিগুলো গাঢ় হতে হতে প্রণয়ের রুম নিলো। আজ সেই প্রণয়েই দগ্ধ হচ্ছে সে। প্রতিবারের মতো আজ ও মনের কথাগুলো মনেই আটকে রাখলো। এখন সেগুলো নিছক হাত পা ছাড়া কিছু উটকো অনুভূতি। জাহির করা বা না করায় কিছুই যায় আসে না। সব কিছুই অহেতুক_______
জামা পালটে নিচে নামলো চারু। তার খোলা চুল থেকে এখনো জলবিন্দু গড়াচ্ছে। একটা শ্বেত সালোয়ার কামিজ তার পরণে। বসার ঘরের সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে শ্রাবণ। চারু যখন সিড়ি দিয়ে নামছিলো, তখন ই শ্রাবণের নজর সেখানেই আটকে গেলো। আনমনেই মুখ থেকে বের হলো “মাশাআল্লাহ”। মূহুর্তবাদেই তার মনে পড়লো সে একা নয়। তার সাথে রয়েছে ইন্সপেক্টর সামিন। চারুর কাছে অপ/হ/র/ণ/কারীদের বিস্তারিত ঘটনা শুনতে এসেছে সে। তারা কেসটা আগাতে পারছে না৷ চারুর বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায় সেটাই এখন ভরসা। নিজের নজর সরিয়ে নিলো সে। হৃদস্পন্দনের গতি বেসামাল হয়ে উঠেছে শুধু চারুলতার এক দর্শনেই। জাহানারার দিকে চেয়ে বিব্রত কন্ঠে বললো,
“আন্টি, পানি হবে?”
জাহানারা সাথে সাথেই বললো,
“হ্যা বাবা, আমি চিত্রাকে বলছি”
চিত্রা পানি এনে দিতেই এক নিঃশ্বাসে তা শেষ করলো শ্রাবণ। বিয়ের পর নাকি নারীদের সৌন্দর্য বর্ধিত হয়। চারুলতার সৌন্দর্য বর্ধিত হয়েছে কি না শ্রাবণের জানা নেই। তবে তার স্ত্রী যে আরোও মায়াবতী হয়েছে সেই সন্দেহ নেই তার। চারু নিচে আসতেই আহসান সাহেব বলেন,
“চারু মা, তুমি এখানে বস। আসলে ইন্সপেক্টর সাহেব তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে এসেছেন। সেদিনের ঘটনার নীল নকশাকারীদের তো ধরা জরুরি। এবার কোনো ক্ষতি না হলেও পরে যে হবে না তার কি নিশ্চয়তা? তাই তুমি যা জানো নির্ভয়ে বলো। জোর করার প্রয়োজন নেই। যতটুকু মনে পড়ে”
চারু বাবার পাশেই বসে। আঙ্গুলের মাঝে ওড়নার কোনা শক্ত করে ধরে রয়েছে সে। ঈষৎ ভীতু সৃষ্টিতে শ্রাবণের দিকে তাকায় সে। শ্রাবণ চোখের ইশারায় আশ্বাস দেয়, “সে আছে, ভয় নেই”। চারু চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর ধীর গলায় বলে,
“সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে আমি দুই গলি সামনের হালিমের দোকানে থামি। চিত্রা বটভাজি খেতে চেয়েছিলো। সেটা কিনে বাড়ি ফিরার জন্য রিক্সা খুজি। কিন্তু ভরদুপুরে রিক্সা না পাওয়ায়, হেটেই রওনা দেই। দু গলি পথ, তাই আমার মাথায় কোনো চিন্তা ছিলো না। এর মাঝেই শ্রাবণের ফোন আসে। আমি তার সাথে কথা বলছিলাম। হুট করেই একজোড়া হাত আমার মুখ চেপে ধরল। ওদের হাতে রুমাল ছিলো। আমি কিছুক্ষণ বাদেই বেহুশ হয়ে যাই। ফলে তাদের চেহারা দেখতে পারি নি। যখন হুশ আসে তখন আমার চোখ, হাত, মুখ বাধা ছিলো। শুধু কিছু শব্দ ই কানে আসছিলো। আমি বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টা করি কিন্তু পারি নি। একটা সময় হাল ছেড়ে দি। ওদের একজন আমার কাছে এসেছিলো। তার নামটা, নামটা! হ্যা মনে পড়েছে। নাজমুল, নাজমুল ছিলো। কারণ আরেকটা তীক্ষ্ণ গলা তাকে নাজমুল বলে ডাকছিলো। তাদের একজন বস ও ছিলো। যে তাদের ফোনে নির্দেশনা দিচ্ছিলো। তারপর ওই লোকটার বস ফোন করায় নাজমুল চলে গেলো। তারপর কেউ রুমে আসে নি। এর পরে আপনারা আমাকে উদ্ধার করেন৷ আমি এটুকুই জানি। চোখ বাঁধা থাকায় একজনের মুখ দেখি নি। তবে শুধু দুজন ছিলো না। অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনেছি”
সামিন কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে,
“আচ্ছা, ভয়েসটা ঠিক কেমন? মানে যুবকের কন্ঠ নাকি রাশভারী কন্ঠ?”
“শ্লেষ্মাজনিত কন্ঠ, মনে হলো বয়স্ক লোকটা। চল্লিশের ঘরে। শিওর না, অনুমানমাত্র”
“বুঝলাম, আচ্ছা মোবাইলটা কোথায়?”
“আমার কাছে নেই, মোবাইলটা ওদের কাছেই”
“মোবাইলের রিসিট টা কি আছে?”
“জ্বী, কেনো?”
“আসলে মোবাইলটা ওরা হয় তাদের কাছে রাখবে নয়তো চোরাবাজারে বেঁচে দিবে। আমি সেকারণেই চাচ্ছি। মোবাইলের সেটের EMI নম্বরটা পেলে কে বিক্রি করছে না করতে ধরতে পারবো। আর যদি নাও বিক্রি করে তবে সিম ট্রাক করে তাদের ধরার ট্রাই করবো। আচ্ছা আহসান সাহেব! আপনার কি কোনো শত্রু রয়েছে? মানে, ব্যাবসা বা কোনো কারণে, রেষারেষি না দ্বন্দ?”
আহসান সাহেব বিনয়ী কন্ঠে বললেন,
“দেখুন, আমি চালের ব্যাবসা করি। ঢাকার এই এলাকায় চালের সাপ্লাই আমি ই দেই। এখন মানুষের সাথে না চাইতেও একটু দ্বন্দ তো হয় ই। কিন্তু এমন নয় যে আমার মেয়েকে তুলে নিবে”
“বুঝতে পেরেছে। দেখুন এখানে শ্রাবণ সাহেব ও আসেন, আপনিও আছেন। আমি না খুব ভাবলাম। ক্ষতি করার জন্য মিস চারুকে কি/ড/ন্যা/প করা হয় নি। কারণ তারা টাকা পয়সা বা অন্য কারণে ফোন করে নি। সাধারণত যা নরমাল ক্ষেত্রে দেখা যায়। আর যদি সেটা মিস চারুকে ক্ষতি করার জন্যই হতো, তবে চার ঘন্টায় অনেক কিছু করা যায়। খু/ন করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিলেও আমরা কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু সেটাও হয় নি। ঠিক অল্প সময়ের জন্য তারা চারুর ফোন অন করে। কেনো করে! নিশ্চয়ই আমাদের ক্লউ দেবার জন্যই করেছিলো। এই অ/প/হ/র/ণ খুব বড় প্লানিং ছোট একটা ট্রেইলার। যে এই সবের পেছনে তার মাথায় বড় কিছু ঘুরছে। তাই শুধু সাবধানে থাকেন। আর আমাদের সাহায্য করুন। কিছু লুকাবেন না। কারণ এতে ক্ষতি আপনাদের হবে”
আহসান সাহেবের মুখের বর্ণ বদলে গেলো। চিন্তায় উজ্জ্বল মুখখানায় মেঘ জমলো। সামিন উঠে দাঁড়ালো। শ্রাবণ তাকে গেট অবধি ছাড়তে গেলো। যাবার উপর সামিন স্মিত হেসে বললো,
“চিন্তা করবেন না। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো। আপনি ওই মোবাইলের বিলটা পাঠিয়ে দিয়েন”
“জ্বী”
আহসান সাহেবের চিন্তাটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো শ্রাবণ। সে তার কাছে গেলো। হাটু গেড়ে বসলো তার সামনে। আনুগত্যের সাথে বললো,
“আপনি চিন্তা করবেন না, সেদিনের মতো ঘটনা আর কখনোই হবে না। আমি কথা দিচ্ছি, চারুলতার গায়ে একটা আঁচড় ও পড়তে দিবো না”
“কিন্তু…”
“ভরসা রাখুন আমার উপর”
আহসান সাহেব শ্রাবণের উপর ভরসা করতে চাচ্ছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। একটা ভয় ভেতরে থেকেই যাচ্ছে। অজানা শত্রুটি কি পরিকল্পনা করছে কে জানে। শ্রাবণ কথা পাল্টাতে বললো,
“আজ বাবা আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিছু ঝামেলার জন্য আসতে পারছেন না। আসলে বুঝেন ই তো। একটা অনুরোধ, আমাদের বিয়েতে কোনো দহরমমহরমের প্রয়োজনীয়তা নেই। বিয়ের জিনিসপত্রগুলো আগামীকাল রাকিব দিয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ বিয়ের দিন তিনি উপস্থিত থাকবেন। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। যখন যা প্রয়োজন, আমাকে জানাবেন। সংকোচ করবেন না আংকেল। আমি ও একজন ছেলে”
“তবুও তোমার বাবা এতো সম্মানীয় ব্যাক্তি, তার ছেলের বিয়ে। আড়ম্বরতা ছাড়া তো মানাবেও না”
“সেটা আপনার ব্যাপার। তবে চাপ নেবার প্রয়োজন নেই। আসলে এতো তাড়াহুড়ো করতাম না যদি ঘটনা গুলো অস্বাভাবিক না হতো”
শ্রাবণের কথা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু হাতে সময় কম। এতো দ্রুত, সব কিছু করাটা খুব কঠিন কাজ। বিয়ে বলে কথা, কতো কাজ, কতো মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে, কতো আয়োজনের ব্যাপার। যতই হোক, নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ে। আহসান সাহেব ধীর গলায় বললেন,
“আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু একটা আবদার। অন্তত দিন পনেরো সময় পেলে ভালো হতো। আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে। দেখো শ্রাবণ, সেই রাতের আবদার মেনেছি। আজ আমার আবদার তুমি মেনে নাও। আর মোস্তফা সাহেবের সাথে কথা বলার যে বড্ড ইচ্ছে আমার। নিজের বেয়াইকে বিয়ের দিন ই শুধু দেখা, ব্যাপারটা হাস্যকর নয় কি?”
“জ্বী, বুঝতে পেরেছি। তাহলে বাবা ফ্রি হলেই নাহয় দিন ঠিক হবে”
শ্রাবণ জোর করলো না। তার চারুলতা তো এখন কেবল ই তার। অহেতুক জোর করে কি হবে! তবে শ্রাবণের হাসিমুখটা ঈষৎ কালো হয়ে গেলো। পনেরো দিন সময়টা পনেরো বছরের ন্যায় লাগছে তার কাছে। আবার চারুর মুখের দিকে তাকাতেই আফসোস গুলো উবে গেলো। মাত্র পনেরোদিন ই তো, এর পর চারুলতা চিরজীবনের জন্য তার ঘরের আলো হয় রবে, শুধু তার চারুলতা হয়েই রবে_______
পনেরো দিন পর,
বধু বেশে বসে রয়েছে চারু। লাল বেনারসি পরণে, মাথায় ঘোমটা। হাত ভর্তি লাল চুড়ি, চোখে কাজলের অলংকারে সাজানো। ও বাড়ি থেকে গহণা দিয়েছে অনেক। কিন্তু চারুর এতো সাজসজ্জা ভালো লাগে না। শ্রাবণের ফুপু যখন গহণা পড়াতে এলেন, চারু অনুরোধ করলো,
“এতোকিছু না পড়লে হবে না?”
“এই প্রথম বউ দেখলাম, যে কি না সাজতে চায় না। অবশ্য আমার শ্রাবণের বউ এমনেই সুন্দর, মাশাআল্লাহ”
শান্তার কথায় মাথা নত করে ফেলে চারু। লজ্জায় তার গাল জোড়া রক্তিম রুপ নেয়।
আহসান সাহেব এবং মনীরুল সাহেব আত্নীয়দের আপ্পায়নে ব্যাস্ত। মোস্তফা সাহেব বরযাত্রী নিয়ে চলে এসেছেন৷ তার খাতিরের কোনো ত্রুটি রাখতে চান না তারা। ধ্রুব ও এই কার্যে নিয়োজিত। চিত্রা তাকে দেখছে। লোকটাকে যত দেখে ততই অবাক হয় সে। ভেবেছিলো সে যে আগুণে জ্বলছে ধ্রুবকে সেই আগুনে জ্বলতে দেখলে ভালোই লাগবে। কিন্তু ভুল ছিলো চিত্রা, ধ্রুব এর কষ্ট গুলো মোটেই ভালো লাগছে না তার। কিন্তু পরমূহুর্তে বুবুর মুখের হাসিটাও এড়িয়ে যেতে পারছে না। চারু সত্যি খুব খুশি। অজান্তেই শ্রাবণের নায়ায় জড়িয়েছে সে। এই মায়ার বাধন যে ধ্রুবের অব্যক্ত অনুভূতি থেকেও প্রবল। এর মাঝেই আফিয়ার আগমণ হলো চারুর রুমে। শান্তার কানে কানে কিছু বললো। এর পর ই শান্তার মুখোভাব পালটে গেলো। থমথমে গলায় বললো,
“শ্রাবণের গাড়ি এখনো পৌছায় নি, ওর কোনো বিপদ হলো না তো……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি